বার্নেট আরো বলছেন, অর্ফিক ধর্মবিশ্বাসগুলোর সঙ্গে প্রায় একই সময়কার ভারতে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলোর একটি চমৎকার সাদৃশ্য আছে; যদিও তিনি মনে করেন যে, তখন এ দুই দেশের মধ্যে কোনো যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। এরপর তিনি orgy বা উদ্দাম পানভোজনোৎসব শব্দটির মূল অর্থের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। অর্ফিকরা এই শব্দটিকে ধর্মদীক্ষার অনুষ্ঠান বোঝাতে ব্যবহার করত। এই উপায়ে তারা বিশ্বাসীর আত্মাকে শুদ্ধ করত এবং জন্মের চক্র থেকে তাকে মুক্ত করতে চাইত। আমরা যাকে গির্জা বা church বলি, তার প্রতিষ্ঠা করে অর্ফিকরা, অলিম্পীয় ধর্মের পুরোহিতরা তা করেনি। গির্জা মানে ধর্মীয় সম্প্রদায়, লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সে সম্প্রদায়ের সদস্য হতে পারত। তাদেরই প্রভাব থেকে জীবনযাপনের একটি বিধান বা পথ হিসেবে দর্শনের সৃষ্টি।
০২. মিলেসীয় ধারা
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে লেখা দর্শনের প্রত্যেকটি বইতে প্রথমেই যে কথাটি উল্লেখ করা হয় তা হলো : দর্শনের শুরু থেলিস থেকে, যিনি বলেছিলেন সবকিছুই পানি থেকে সৃষ্ট। যে নবিস ছেলে বা মেয়েটি দর্শনের প্রতি তার পাঠ্যসূচির প্রত্যাশিত অনুরাগ নিজের মধ্যে সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করছে-প্রাণপণে না হলেও, চেষ্টা করছে-তার কাছে এটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিন্তু তবুও থেলিসের জন্য শ্রদ্ধাবোধ করার প্রচুর কারণ রয়েছে, যদিও তা আধুনিক অর্থে দার্শনিক হিসেবে নয়, বরং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে।
এশিয়া মাইনরের মিলেটাস নামক এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক নগরীর অধিবাসী ছিলেন থেলিস। সেখানে ছিল এক বিশাল দাস জনগোষ্ঠী, আর স্বাধীন জনগণের মধ্যে ছিল ধনী আর গরিবে এক তিক্ত শ্রেণিসংগ্রাম। মিলেটাস প্রথমে সাধারণ মানুষ জয়ী হয়। এবং তাদের প্রতিপক্ষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, এমনভাবেই পুড়িয়ে মারে যে জ্বলন্ত মানবদেহের আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়। থেলিসের যুগে এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ নগরীতেই এ ধরনের সংঘাতময় অবস্থা ছিল।
আয়োনিয়ার অন্যান্য বাণিজ্যিক নগরীগুলোর মতো মিলেটাসেও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে। প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল ভূস্বামী অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে, তবে তা ক্রমশ চলে যায় ধনী বণিকগোষ্ঠীর হাতে। পরে এই ক্ষমতা চলে যায় এক স্বৈরশাসকের হাতে, যে কি না তা লাভ করে সাধারণ জনতার সহযোগিতায় (যেমনটি সেকালে সচরাচর ঘটত)। লিডিয়া রাজ্যের অবস্থান ছিল গ্রিক উপকূলীয় নগরীগুলোর পুব দিকে, কিন্তু নিনেভাহ্ (খ্রি.পূ. ৬০৬)-এর পতনের আগ পর্যন্ত গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে লিডিয়ার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। এর ফলে লিডিয়া তার পশ্চিম দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করার ফুরসত পায়। কিন্তু মিলেটাস বরাবর লিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়, বিশেষ করে শেষ লিডীয় রাজা ক্রোয়েসাসের সঙ্গে, যাকে খ্রি.পূ. ৫৪৬ সালে সাইরুস পরাজিত করেন। মিলেটাসের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল মিসরের সঙ্গেও, সেখানকার রাজা গ্রিক বণিকদের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতিপয় নগরী উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মিসরে প্রথম গ্রিক বসতি ছিল একটি দুর্গ, সেটি দখল করে নিয়েছিল এক মিলেসীয় বাহিনী। তবে ৬১০-৫৬০ খ্রি.পূ. সময়কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডাফনি। সেখানে জেরোমিয়াহ্ ও অন্যান্য ইহুদি ফেরারীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু মিসর যেহেতু সন্দেহাতীতভাবে গ্রিকদের প্রভাবিত করেছিল, সেহেতু আমরা মনে করতে পারি না যে সন্দেহপরায়ণ আয়োনীয়দের প্রতি গ্রিকদের বা জেরোমিয়াহর ভয় ছাড়া অন্য কোনো ভালো অনুভূতি ছিল।
থেলিসের জীবনকাল সম্পর্কে সর্বোত্তম সাক্ষ্য হচ্ছে, যেমনটি আমরা জানি, তিনি এক চন্দ্র/সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জ্যোতির্বিদদের মতে সেই গ্রহণ ঘটেছিল খ্রি.পূ. ৫৮৫ সালে। এ রকম আরেকটি সাক্ষ্য থেকেও তাকে এর কাছাকাছি সময়কালের মানুষ রূপেই পাওয়া যায়। থেলিসের পক্ষে একটি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া কোনো অসাধারণ প্রতিভার বিষয় ছিল না। মিলেটাসের মৈত্রী ছিল লিডিয়ার সঙ্গে, আর লিডিয়ার ছিল ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আর ব্যাবিলনিয়ার জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেছিল যে প্রায় ১৯ বছরের এক চক্রে চন্দ্রগ্রহণ ঘুরে ঘুরে আসে। চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস তারা দিতে পারত বেশ সাফল্যের সঙ্গেই, তবে সূর্যগ্রহণের ব্যাপারে তাদের সমস্যা ছিল এই যে, সূর্যগ্রহণ কোনো একটি জায়গা থেকে দৃশ্যমান হতে পারে আবার অন্য আরেক জায়গা থেকে না-ও হতে পারে। ফলে তারা শুধু জানতে পারত যে সম্ভাব্য অমুক অমুক তারিখে সূর্যগ্রহণের প্রত্যাশায় আকাশে তাকানো যেতে পারে। থেলিস সম্ভবত এ সবকিছুই জানতেন। থেলিস নিজে বা তারা কেউই জানতেন না সঠিক কী মেয়াদে সূর্যগ্রহণের চক্রটা ঘুরে ঘুরে আসে।
বলা হয়ে থাকে, থেলিস মিসর ভ্রমণ করেছিলেন আর সেখান থেকেই গ্রিকদের কাছে এনেছিলেন জ্যামিতির বিজ্ঞান। মিসরীয়রা জ্যামিতিশাস্ত্রের যা জানত তা ছিল অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন দ্বারা স্থিরীকৃত কিছু পরিমাপ-পদ্ধতি (rules of thumb)। তাই এ কথাও মনে করার কোনো কারণ নেই যে থেলিসের জ্যামিতিক জ্ঞান অবরোহমূলক প্রমাণ অবধি পৌঁছেছিল। সেটা ছিল পরবর্তী কালের গ্রিকদের আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, তিনি সমুদ্রতীরে দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রবক্ষের কোনো জাহাজের দূরত্ব কীভাবে পরিমাপ করতে হয় এবং একটি পিরামিডের ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে ওই পিরামিডের উচ্চতা কীভাবে মাপতে হয় তা আবিষ্কার করেন। আরো অনেক জ্যামিতিক উপপাদ্য থেলিসের আবিষ্কার বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সম্ভবত তা ঠিক নয়।