ইহজগৎকে অস্বীকার করে বাস্তব জীবনকে পরকালে স্থানান্তরিত করার সর্বজনগ্রাহ্য যে-একটি বিশ্বাস ছিল তাকে অতিক্রম করার মতো যথেষ্ট যৌবনময় প্রাণশক্তির অধিকারী ছিল গ্রিক জাতি। তাই অর্ফিক মতবাদ সীমাবদ্ধ ছিল অজিমে দীক্ষিত একটি সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, রাষ্ট্রধর্মের ওপর তার প্রভাব ছিল না বললেই চলে। এমনকি এথেন্সের মতো স্থানের জনগোষ্ঠী, যারা তাদের রাষ্ট্রীয় ধর্মাচারে গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলো উদ্যাপনের রীতি গ্রহণ করেছিল এবং তাকে আইনগত সুরক্ষা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অর্ফিক মতবাদের প্রভাব ততটা ছিল না। অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের এক ধর্মতাত্ত্বিক পোশাকে তা গ্রিক জগতে বিজয় অর্জন করেছিল, কিন্তু তার জন্য পুরো এক হাজার বছর সময় লেগেছিল।
এই বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত মনে হয়, বিশেষ করে এলিউসীয় গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে, যেগুলো অর্ফিক মতবাদ দ্বারা পরিপূর্ণ। ব্যাপক অর্থে বললে, যাদের মেজাজ ও মনোভঙ্গি ছিল ধর্মীয় তারাই অফিঁজমের দিকে ঝুঁকেছে আর যুক্তিবাদীরা অৰ্কিজমকে ঘৃণা করেছে। ১৮ শতকের শেষ ও ১৯ শতকের শুরুর দিকের ইংল্যান্ডের মেথডিজম। বা পদ্ধতিবাদের সঙ্গে অজিমের মর্যাদার তুলনা করা যেতে পারে।
একজন গ্রিক তার পিতার কাছে কী শিক্ষা লাভ করত তা আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু একেবারে শৈশবের দিনগুলোতে একজন গ্রিক তার মায়ের কাছ থেকে কী ধরনের শিক্ষা লাভ করত তা সম্পর্কে আমরা জানি খুব অল্পই। পুরুষরা যে সভ্যতা থেকে আনন্দ লুটত, নারীরা তার আলো থেকে বেশ বঞ্চিত ছিল। এমন হতে পারে যে, শিক্ষিত এথেন্সবাসিরা, এমনকি তাদের সর্বোত্তম যুগেও, আচরণগত দিকে সচেতন মানসিক প্রক্রিয়ায় যত যুক্তিবাদীই হোক না কেন, ঐতিহ্যগতভাবে একেবারে শৈশব থেকেই চিন্তাপদ্ধতি ও অনুভবের এমন একটি আদিম ধরন তাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল যা সংকটময় মুহূর্তগুলোতে সর্বদাই জয়ী হয়েছে। এই কারণে গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কোনো সরল বিশ্লেষণ যথার্থ হবে বলে মনে হয় না।
সাম্প্রতিককালের আগে পর্যন্ত গ্রিক চিন্তায় ধর্মের, বিশেষ করে অন-অলিম্পীয় ধর্মের প্রভাব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। জন হ্যারিসনের প্রলেগোমেনা টু দি স্টাডি অব গ্রিক রিলিজিয়ন গ্রন্থে সাধারণ গ্রিকদের ধর্মে আদি ও ডায়োনিসাসীয় উপাদান, দুটোর কথাই জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এফএম কর্নফোর্ড-এর ফ্রম রিলিজিয়ন টু ফিলোসফি গ্রন্থে দার্শনিকদের ওপর ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে গ্রিক দর্শনের শিক্ষার্থীদের অবগত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অথবা তার নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলো সম্পূর্ণ আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করা যায় না। আমার জানা মতে, সবচেয়ে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে জন বার্নেটের আরলি গ্রিক স্টাডিজ গ্রন্থটিতে, বিশেষ করে বইটির বিজ্ঞান ও ধর্ম শীর্ষক অধ্যায়টিতে। বার্নেট বলেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে হেলাসজুড়ে যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সৃষ্টি হয় তা থেকে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে একটি বিরোধ দাঁড়িয়ে যায়; আয়োনিয়া থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে হতে পশ্চিমে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা ঘটতে থাকে। তিনি বলেন, উপমহাদেশীয় হেলাসের ধর্ম বিকশিত হয়েছে আর্জেনিয়ার ধর্মবিকাশের ধরন-প্রক্রিয়ার চেয়ে খুবই আলাদাভাবে। নির্দিষ্ট করে প্রেস থেকে আগত ডায়োনিসাস-পূজা, যার কথা হোমারে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তাতে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির বীজ ছিল। থ্রেসীয়রা নিজেরা কোনো উচ্চমানের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিল এ কথা বলা নিশ্চিতই ভুল হবে। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, গ্রিকদের আধ্যাত্মিক পরমানন্দের বিষয়টির অর্থ ছিল এই যে, আত্মা কেবল সত্তার একটি ক্ষীণ প্রতিরূপ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু এবং আত্মা যখন দেহের বাইরে যায়, কেবল তখনই তার প্রকৃত স্বরূপ দেখা যায়…।
মনে হয় গ্রিক ধর্ম যেন সেই পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল, প্রাচ্যের ধর্মগুলো ইতমধ্যে যে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের উত্থান ছাড়া আর কিসের দ্বারা সেই প্রবণতা প্রতিহত হয়েছিল তা দেখতে পাওয়া কঠিন। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রাচ্য ধরনের ধর্ম থেকে গ্রিকরা রক্ষা পেয়েছিল এই জন্য যে তাদের কোনো পুরোহিততন্ত্র ছিল না। কিন্তু এ রকম বলার অর্থ দাঁড়ায় কারণকে কার্য হিসেবে ধরে নেওয়া, অর্থাৎ এতে ভুল করা হয়। পুরোহিততন্ত্র অন্ধবিশ্বাস তৈরি করে না, যদিও ইতমধ্যে সৃষ্ট বা বিদ্যমান অন্ধবিশ্বাসকে তা জিইয়ে রাখে। কিন্তু বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যে কোনো পুরোহিততন্ত্র সে অর্থে ছিল না। গ্রিসকে রক্ষা করেছে তার বৈজ্ঞানিক ধারাগুলো যতটা, পুরোহিততন্ত্রের অনুপস্থিতি ততটা নয়।
নতুন ধর্ম-যা এক বিবেচনায় নতুন, অন্য বিবেচনায় মানবজাতির মতোই পুরাতন-তার বিকাশের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে অফিক সম্প্রদায়গুলোর গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে। যত দূর দেখতে পাই, সে সম্প্রদায়গুলোর আদি নিবাস ছিল অ্যাটিকা, কিন্তু তারা অসাধারণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলিতে। তারা প্রথমত ছিল ডায়োনিসাসের উপাসক গোষ্ঠী, কিন্তু তারা আলাদা ছিল দুটি দিক থেকে, যা গ্রিক নাগরিকদের মধ্যে ছিল নতুন বিষয়। তাদের কাছে ধর্মীয় কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তারা সংগঠিত হয়েছিল কৃত্রিম সম্প্রদায় রূপে। যেসব কাব্যে তাদের ধর্মতত্ত্ব রয়েছে সেগুলোর উৎস অর্ফিয়ুস, এই অর্ফিয়ুস নিজে থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন হাডেস-এ এবং পরজগতে দেহ থেকে মুক্ত আত্মাকে ঘিরে যেসব ভয়ানক বিপদ-আপদ রয়েছে সেসব অতিক্রম করে যাবার পথে তিনি এক নিরাপদ দিগনির্দেশক।