গ্রিকদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, তারা প্রশংসনীয় রকমের সৌম্য-শান্ত, তারা আবেগের বশবর্তী না হয়ে আবেগ সম্পর্কে চিন্তা করতে পারত এবং আবেগের মধ্যকার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারত, কিন্তু নিজেরা ছিল শান্ত ও অলিম্পীয় মেজাজের। এটি খুবই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। সম্ভবত হোমার, সফোক্লিস এবং অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে, কিন্তু এটা সেইসব গ্রিকের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সত্য নয় যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাক্কাসীয় বা অর্ফিক উপাদানগুলো দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এলিউসিসে, যেখানে এথেনীয় রাষ্ট্রধর্মের সবচেয়ে ঐশ্বরিক অংশ গঠিত হয়েছিল এলিউসীয় গুহ্যাচার থেকে, সেখানে একটি স্তোত্র গাওয়া হতো, যার বাণীগুলো এ রকম–
উচ্চে দুলিয়ে সুরাপাত্র তোমার,
উন্মত্ত উল্লাসে
এলিউসিসের পুষ্পময় উপত্যকায়
এসো হে-বাক্কাস, পিয়ান, স্বাগতম।
ইউরিপাইডিসের বাককেতে মায়েনাদের কোরাসে কাব্য ও বর্বরতার সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়, যা কিনা শান্ত স্বভাবের একেবারেই বিপরীত। তারা একটি বন্য পশুকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে সেখানেই, তখনই, একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলে–
যখন পবিত্র ছাগশিশুর চামড়া লেগে থাকে
আর সবকিছুই ভেসে যায় উড়ে যায়
তখন ছোটার ক্লান্তিতে বেহুশ হয়ে পড়া
কী আনন্দ কী আনন্দ তখন পাহাড়ে
স্রোতস্বিনী রক্তপ্রবাহের আনন্দে
ছিঁড়ে ফেলা পাহাড়ি ছাগলের রক্তে
বন্য পশুর ভয়ঙ্কর ক্ষুধার গৌরবে
যেখানে পাহাড়ের চূড়া ধরে ফেলে দিনকে
সেই ফ্রিজিয়ান আর লিডিয়ান পাহাড়ে পাহাড়ে
হে ব্রোমিওস, পথ দেখাও।
পর্বতচূড়ায় মায়েডদের নৃত্য কেবল উন্মত্তই ছিল না, তা ছিল সভ্যতার বোঝা আর দায়িত্ব-কর্তব্য-যত্ন-সতর্কতা থেকে অমানবিক সৌন্দর্যের জগতে, হাওয়া আর তারকাদের মুক্ত জগতে পলায়নস্বরূপ। অপেক্ষাকৃত কম উত্তেজনার মেজাজে তারা একটি গান গাইত–
তারা কি আবার আসবে আমার কাছে, আবার কখনো
সেই সব দীর্ঘ, দীর্ঘ নৃত্য?
যে-সব নৃত্য চলত সারা রাত ধরে, অনুজ্জ্বল তারাগুলো মিলিয়ে না যাওয়া অবধি?
কণ্ঠে কি আমি শিশিরের স্পর্শ পাব? চুলে লাগবে হাওয়ার পরশ?
নিষ্প্রভ প্রান্তরে আমাদের শুভ্র পদরাজি কি দ্যুতিময় দেখাবে?
হরিণশাবকের পাগুলো হারিয়ে গেছে হায়! সবুজ বনে,
একাকী, ঘাসে আর সৌন্দর্যে
শিকারির শিকার হয়ে লাফাবে না আর, কোনো ভয় আর নেই তার।
আর তার ফাঁদে পড়ার ভয় নেই, নেই কোনো মারাত্মক চাপ।
একটি কণ্ঠস্বর তবুও ভেসে আসে,
একটি কণ্ঠস্বর, একটি ভয়, ডালকুত্তাদের ছুট,
ওহ্ জান্তব শ্রম, দুর্ধর্ষ ক্ষিপ্রতা,
নদী আর উপত্যকা বেয়ে ধেয়ে চলা
হে ঝাক্ষিপ্র পদযুগল, এ কি হর্ষ, না আতঙ্ক?
মানুষের উৎপাতহীন, নির্জন, প্রিয় এই দেশে,
যেখানে ধ্বনিত হয় না কোনো কণ্ঠ, ছায়াচ্ছন্ন সবুজের মাঝে
বনভূমির ছোট ছোট জীব বাস করে অলক্ষ্যে।
গ্রিকরা সৌম্য-শান্ত ছিল এই কথাটির পুনরাবৃত্তি করার আগে ইউজিন ওনিলের একটি নাটকে ফিলাডেলফিয়ার ম্যাট্রনদের এ রকম আচরণের কথা ভেবে দেখার চেষ্টা করুন। ডায়োনিসাসের আদি উপাসকদের চেয়ে অর্ফিকরা কোনোভাবেই বেশি শান্তশিষ্ট নয়। একজন অর্ষিকের কাছে এ জগতে জীবন হচ্ছে যন্ত্রণা, ক্লান্তি আর একঘেয়েমি। তাদের মতে, আমরা এমন এক চক্রে বাঁধা যা জন্ম আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীনভাবে ঘুরে চলেছে। আমাদের সত্যিকারের জীবন স্বর্গে, কিন্তু আমরা বাঁধা পড়ে আছি পৃথিবীর মাটির সঙ্গে। শুদ্ধি, ত্যাগ আর কৃচ্ছসাধনাপূর্ণ জীবনযাপনের দ্বারাই কেবল আমরা সেই চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং পরিশেষে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের পরমানন্দ লাভ করতে পারি। যেসব মানুষের কাছে জীবন সহজ ও আনন্দদায়ক এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এটা অনেকটাই সেই নিগ্রো ধর্মসঙ্গীতের মতো, যেখানে বলা হয়–
যখন আমি ঘরে পৌঁছুব
তখন আমার সব সমস্যার কথা ঈশ্বরকে বলব।
গ্রিকদের সবাই নয়, কিন্তু তাদের এক বিরাট অংশ ছিল তীব্র আবেগপ্রবণ, অসুখী। তাদের মধ্যে ছিল যুক্তিবুদ্ধি আর আবেগের লড়াই। তাদের মধ্যে স্বর্গের কল্পনা আর নরক সম্পর্কে সচেতন আত্মপ্রত্যয়ের দ্বন্ধ ছিল। তাদের একটি নীতিবাক্য ছিল, কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি কোরো না। কিন্তু বাস্তবে তাদের সব কিছুতেই ছিল বাড়াবাড়ি-বিশুদ্ধ চিন্তায়, কাব্যকলায়, ধর্মে এবং পাপকর্মে। যখন তাদের মধ্যে আবেগ আর যুক্তিবুদ্ধির মিলন ঘটেছে তখন তারা মহৎ সব কর্ম করাতে পেরেছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে তারা যেভাবে বদলে দিয়েছে, শুধু আবেগ বা শুধু যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তা করা কখনোই সম্ভব ছিল না। পুরাণে তাদের প্রত্নপ্রতিমা অলিম্পীয় জিউস নয়, বরং প্রেমিথিউস, যে স্বর্গ থেকে আগুন এনেছিল এবং তার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল চিরন্ত ন যন্ত্রণা।
সামগ্রিকভাবে গ্রিকদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের ব্যাপারে উপরে যা বলা হলো, অর্থাৎ, গ্রিকদের যে শান্তশিষ্ট বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, তা একটি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তুত গ্রিসে প্রবণতা ছিল দুটি। একটি আবেগ-প্রবণতা : ধর্মীয়, মরমি, পরজাগতিক প্রবণতা। আর অন্যটা হাসি-খুশি, অভিজ্ঞতাবাদী, যুক্তি ও বুদ্ধিবাদী এবং বিচিত্র রকমের ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী প্রবণতা। দ্বিতীয় প্রবণতাটি লক্ষ করা যায় হেরোডটাসের মধ্যে। একেবারে গোড়ার দিকের আয়োনীয় দার্শনিকদের মধ্যেও তা ছিল। একটি পর্যায় পর্যন্ত অ্যারিস্টটলও তাই। অফিজম বর্ণনা করার পর বেলক বলেছেন