Site icon BnBoi.Com

সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

সুখের সন্ধানে - বার্ট্রান্ড রাসেল

সুখের সন্ধানে

 ০১. মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?

প্রাণীরা যতক্ষণ সুস্থ থাকে, প্রচুর খেতে পায়, ততক্ষণই সুখে থাকে। মনে হয় মানুষেরও সেরকম থাকা উচিত, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে মানুষ সুখী নয়। অন্ততপক্ষে অধিকাংশ মানুষই সুখী নয়। আপনি নিজে যদি অসুখী হন, তাহলে মনে করতে পারেন আপনিও এ ব্যাপারে কোনও ব্যতিক্রম নন। আর আপনি যদি সুখী হয়ে থাকেন তাহলে নিজের কাছেই জানতে চান আপনার ক’জন বন্ধু আপনার মতো সুখী। তারপর আপনি বন্ধুদের জীবন পর্যালোচনা করে মুখ দেখে তাদের রূপ চেনার বিদ্যাটা আয়ত্ত করে নিন। আপনি যাদের প্রতিদিন দেখেন তাদের মনোভাবের সাথে যাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন তার জন্যে মনকে তৈরী করুন। কবি ব্লেক বলেছেন :

‘আমি যাকে দেখি তার মুখে দেখি একই চিহ্ন
দুর্বলতার চিহ্ন, বিষাদের চিহ্ন। (১)

এর নানা প্রকার হলেও আপনি সব জায়গায় সেই অসুখীভাবকে দেখতে পাবেন। মনে করুন আপনি নিউইয়র্কে আছেন, যা একটি আধুনিকতম নগর। কর্মব্যস্ত কোনও সময়ে এই নগরের এক জনাকীর্ণ রাজপথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, অথবা সপ্তাহশেষে কোনও বড় রাস্তায় অথবা কোনও সান্ধ্য নাচের আসরে। এবার মন থেকে অহংভাবটা দূর করে মনটাকে শূন্য করুন, তারপর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করুন একের পর এক অজানা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ঠিক তখন আপনি বুঝতে পারবেন ওদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধরনের আলাদা আলাদা সমস্যা রয়েছে। আপনি তাদের মধ্যে খুঁজে পাবেন উদ্বেগ, অতিরিক্ত মনঃসংযোগ, অজীর্ণতা, জীবন সংগ্রামে ব্যাকুলতা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে অনীহা, খেলাধুলায় অক্ষমতা, অন্যদের ব্যাপারে সহমর্মিতার অভাব। সপ্তাহ শেষে রাজপথে দেখবেন স্বচ্ছল নারী-পুরুষের ভিড়, যাদের অনেকেই খুব ধনী। যারা চলেছে আনন্দের সন্ধানে। সবারই গতি যেন সমতালে, যে গতি ধীরতম মোটরযানের সাথেই শুধু তুলনীয়। গাড়ির ভিড়ে পথ ঢেকে গেছে। কোনও কিছু দেখার উপায় নেই, চোখ অন্যদিকে ঘোরালেই দুর্ঘটনা।

সব গাড়ির সব যাত্রীরা কী করে অন্য গাড়িকে টপকে যাবে সেই চিন্তাতেই মেতে আছে। কিন্তু ভিড় সামলে তা করার উপায় নেই। এই চিন্তা থেকে যদি তারা মন অন্য দিকে সরিয়ে নেয় কখনও, বিশেষ করে যারা গাড়ির চালক নয় তারা, তা হলে তখন তারা এক অনুচ্চারিত বিরক্তিতে কাতর হয়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে ক্লান্তির ছাপ।

একবার হয়তো গাড়িভর্তি এক দল অশ্বেতাঙ্গ লোক প্রচুর হৈ চৈ করে মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আনন্দে। কিন্তু তাদের ব্যবহারে অন্যরা কষ্ট পাবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের হাতে পড়বে, কারণ ছুটির দিনে রাজপথে আমোদ-প্রমোদ বেআইনি।

অথবা, আপনি কোনও উৎসবমুখর সন্ধ্যার জনতাকে লক্ষ্য করুন, তারা আমোদ-প্রমোদে ভেসে সুখী হওয়ার জন্যে এসেছে- যেমন ভয়শূন্য মন নিয়ে লোকে দন্তচিকিৎসকের কাছে যায়। তারা মদ্যপান ও প্রমোদে ভেসে যাওয়াকে আনন্দের দরজা মনে করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাতাল হয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গীদের মনে কতটুকু বিতৃষ্ণা জেগে উঠছে সেদিকে আর তাকিয়ে দেখে না। তারপর আরো কিছু মদ্যপান করে তারা কাঁদতে আরম্ভ করে। তারা যে কত অপদার্থ এবং নৈতিকভাবে মায়ের স্নেহের অনুপযুক্ত তা নিয়ে অনুতাপ করতে আরম্ভ করে। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তাদের বিচারবুদ্ধি যে পাপবোধকে চেপে রাখে, মদ এসে তাকে তা থেকে মুক্ত করে দেয়।

সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের মধ্যে এই নানা প্রকার অতৃপ্তির কারণ খুঁজে দেখতে হবে। এই ব্যক্তি-মনস্তত্ত্ব আবার অনেকাংশে সমাজ ব্যবস্থার পরিপূরকের ওপর নির্ভরশীল। কোন কোন পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা সুখ ও তৃপ্তির পরিপোষক, তা নিয়ে আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। যেমন যুদ্ধ-বন্ধ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নিষ্ঠুরতা ও ভয়ের শিক্ষা- এইসব বিষয়ে এই লেখায় কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। যুদ্ধকে এড়ানো কী ভাবে সম্ভব, তা আবিষ্কার করা আমাদের সভ্যতার পক্ষে জরুরী। কিন্তু সেই পথ আবিষ্কৃত হলেও তা কোনও কাজে লাগবে না, কারণ মানুষ যতদিন অসুখী থাকবে, ততদিন সে অবিরাম দিনের আলো সহ্য করার চেয়ে পরস্পরকে উচ্ছেদ করা কম ভীতিকর মনে করবে। যন্ত্রনির্মিত দ্রব্য যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের তা মেটাবার যদি কিছুমাত্র সদিচ্ছা থাকে, তবে দারিদ্রকে ধরে রাখা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ধনবানরা নিজেরাই যদি এমন দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তাহলে সকলকে ধনবান তৈরী করে কী লাভ? নিষ্ঠুরতা এবং ভয়ের শিক্ষা খারাপ, কিন্তু যারা নিজেরাই এইসব কুপ্রবৃত্তির দাস তারা আর কী শিক্ষা দিতে পারে? এইসব বিবেচনা থেকে ব্যক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে। পুরুষ হোক অথবা নারী, আমাদের এই পিছন ফিরে তাকানো সমাজের মধ্যে বর্তমানে বাস করে, আত্মতৃপ্তির জন্যে এখন, এই মুহূর্তে সে কী করতে পারে? এই প্রশ্ন আলোচনা করতে আমি শুধু তাদের কথা উল্লেখ করব যাদের ব্যবহারিক অর্থে দুঃখ ভোগ করার কোনও চরম হেতু নেই। আমি ধরেই নেব তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্যে যথেষ্ট উপার্জন রয়েছে। সাধারণ কায়িক পরিশ্রমের জন্যে উপযুক্ত স্বাস্থ্য রয়েছে, আমি বড় ধরনের কোনও বিপদের প্রসঙ্গ তুলছি না, যেমন সকল সন্তানের মৃত্যু অথবা প্রকাশ্য কোনও গ্লানি। এসব হিসাবের মধ্যে নয়, কিন্তু আমি যা নিয়ে আলোচনা করব তা ভিন্ন ধরনের। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সভ্য বিশ্বের অনেক দেশের প্রচুর মানুষ দিনের পর দিন যেসব ছোট ছোট অতৃপ্তি ভোগ করে, তার কোনও বাইরের কারণ না থাকাতে, তা থেকে তারা মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না, আর সেজন্যে তা আরও বেশি অসহনীয় মনে হয়। আমার মনে হয়, এই অতৃপ্তির মোটামুটি কারণ হচ্ছে পৃথিবী সম্বন্ধে ভুল ধারণা, ভুল নৈতিকতাবোধ এবং জীবনের ভুল উদ্দেশ্য, যার ওপর শেষ পর্যন্ত তাদের তৃপ্তিলাভ নির্ভর করে, যা সেইসব আয়ত্তের পরিধির মধ্যেই থাকে। আমি এমন কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছি যা ঘটাতে পারলে কোনও ব্যক্তি যদি মোটামুটি অভাবী না হয়, তা হলে সে সুখী হতে পারবে।

যে দর্শনবিদ্যার কথা বলতে যাচ্ছি, সম্ভবত আমার নিজের জীবনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে তার সাথে প্রকৃত পরিচয় ঘটবে। আমি সুখী হয়ে জন্মাইনি, শৈশবে আমার প্রিয় স্তবগান ছিল ‘পার্থিব বিষয়ে শ্রান্ত এবং আপন পাপে ভারাক্রান্ত। পাঁচ বছর বয়সে আমার অন্তরে প্রতিফলিত হয়েছিল, যদি আমি সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচি, যা আমার বর্তমান বয়সের মাত্র চৌদ্দ ভাগের এক ভাগ, তা হলে আমার সামনে যে সুবিস্তৃত একঘেয়ে জীবন রয়েছে তা সহ্য করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কৈশোরে আমি জীবনকে ঘৃণা করেছি এবং ক্রমাগত আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। কিন্তু গণিতশাস্ত্রকে বেশি করে জানতে আগ্রহী হওয়ায় আমি সেই ইচ্ছা থেকে দূরে থেকেছি। তার জন্যেই আমি এখন জীবনকে উপভোগ করছি। এখন আমি বরং বলতে পারি, একটি বছর শেষ হচ্ছে আর আমিও জীবনকে আরো বেশি উপভোগ করছি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কী আমার চাওয়া, তা জানতে পারার জন্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে অনেকগুলি উপভোগ্য বস্তুর দখল প্রতিষ্ঠা করেছি। আর এর জন্যে অংশত দায়ী হচ্ছে কিছু কামনার বস্তুকে সফলভাবে ত্যাগ করতে পারা, যেমন কিছু বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যে, সব কিছু অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মুলত যা অসম্ভব বলে মনে করেছি তা-ই ত্যাগ করেছি। আমার এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ এই যে, আমি নিজের সম্বন্ধে ভাবনা কমিয়ে দিতে পেরেছিলাম। যেমন যারা পিউরিটানদের শিক্ষা পেয়েছে আমিও তাদের মতো আমার পাপ, বোকামি এবং নানা ভুল-ত্রুটি বিষয়ে ধ্যান করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। নিজেকে মনে হত, এবং যথার্থই মনে হত, আমি একটা হতভাগ্য উদাহরণ। ধীরে ধীরে আমার নিজের বিষয়ে, আমার ভুল-ত্রুটির বিষয়ে উদাসীন থাকতে শিখলাম। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাইরের বস্তুতে ঘনীভূত করতে আরম্ভ করলাম। যা হচ্ছে চলমান দুনিয়ার অবস্থা, জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা আর স্নেহভাজন সহমর্মী ব্যক্তিরা। বাইরের জিনিসে মন দিলে অবশ্য সেসব আবার তাদের নিজস্ব ধরনের সম্ভাব্য মনোবেদনা বয়ে আনে। যেমন বিশ্ব যুদ্ধে মত্ত হয়ে উঠতে পারে, কোনও বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানার্জন সাধ্যের বাইরে হতে পারে, প্রিয় বন্ধুরা মারা যেতে পারে। কিন্তু এই রকম মনোযন্ত্রণা জীবনের উৎকর্ষকে নষ্ট করতে পারে না, যেমন পারে নিজের প্রতি ঘৃণাজাত বেদনা। বাইরের প্রত্যেকটি কাজে অনুসন্ধিৎসা যে কোনও কাজে উৎসাহ দেয় এবং সেই অনুসন্ধিৎসা যতদিন সজীব থাকে ততদিন তা সম্পূর্ণভাবে অবসাদকে প্রতিরোধ করার কাজে লাগে। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কৌতূহল অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও প্রেরণার সঞ্চার করে না। নিজের ব্যাপারে উৎসাহ, দিনলিপি লেখার প্রেরণা দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানে আগ্রহ জাগতে পারে অথবা সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হতে সাহায্য করতে পারে। তাও আবার আশ্রমের দৈনন্দিন কাজে ডুবে গিয়ে নিজের অহং ভুলে যেতে না পারলে সুখী হওয়া যাবে না। যে তৃপ্তি তিনি ধর্মের করুণায় পেয়েছেন বলে ভাবছেন, তা তিনি একজন ঝাড়ুদার হয়েও পেতে পারতেন, যদি তিনি সেই পদে থাকতে বাধ্য হতেন। যেসব হতভাগ্যের আত্মনিমগ্নতা এমন-ই গভীর যে, অন্য কোনও উপায়ে তা থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে না। তাদের তৃপ্তিলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে বাইরের শৃঙ্খলার ওপর ভরসা।

আত্ম-নিমগ্নতা নানা ধরণের। সাধারণভাবে তিনটি ধরণের ওপর আলোচনা করা যেতে পারে : পাপী, আত্মপ্রেমিক এবং আত্মঅহংকারী।

আমি পাপী, অর্থে যে পাপকাজ করে তাকে বোঝাচ্ছি না। কেন না পাপকাজ সকলেই করে না হলে কেউ করে না। সবকিছু নির্ভর করে পাপ বলতে কী বোঝায় তার ওপর। পাপী বলতে যে ব্যক্তি পাপের চিন্তায় নিমগ্ন তাকে বোঝাতে চাই। এই ব্যক্তি সবসময় নিজের কাজের বিরোধী। যদি তিনি ধার্মিক হন, তবে এই আত্মবিরোধিতাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে ব্যাখ্যা করেন। তার নিজের বিষয়ে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা আছে। তার নিজের সম্বন্ধে যে জ্ঞান, তার সাথে সেই ধারণার অবিরাম বিরোধ চলছে। শৈশবে তার জননীর হাঁটুর পাশে বসে যেসব নীতিবাক্য তিনি শুনেছেন যদি তা দীর্ঘদিন যাবৎ তার চেতনা থেকে হারিয়ে যায়, তবে তার জন্যে পাপবোধ হয়তো তার চেতনার গভীরে ডুবে আছে এবং শুধুমাত্র মত্ত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে, তবুও সবকিছুর স্বাদ নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মনের গভীরে কিন্তু তিনি এখনও শৈশবে শেখা নিষিদ্ধ জিনিসকে সেভাবেই মেনে নেন। শপথ করা অন্যায়, মদ্যপান অন্যায়, সাধারণ ব্যবসায়িক চতুরতা অন্যায় এবং সবার ওপরে যৌনতা অন্যায়। তিনি অবশ্য এইসব উপভোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন না। কিন্তু এর জন্যে তার অধঃপতন হচ্ছে এই ধারণা থেকে সবকিছু তার বিষময় হয়ে ওঠে। একটিমাত্র সুখ যা তিনি অন্তর দিয়ে পেতে চান তা হচ্ছে তার জননীর স্নেহাদর। যা তিনি পেয়েছেন শৈশবে, যা তাকে এখনও উদ্বেলিত করে। কিন্তু সেই আনন্দ তার জন্যে আর উন্মুক্ত নয়। তাই আর কিছুকে তিনি পরোয়া করেন না। যেহেতু পাপ তাকে করতেই হবে, তাই গভীরভাবেই তিনি তাতে ডুবে যেতে চান। যখন তিনি প্রেমে পড়েন তখন তিনি দয়িতার কাছে মাতৃসুলভ কোমল স্পর্শ খোঁজেন, কিন্তু তা পেলেও গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ মাতৃমূর্তির আভাসের জন্যে কোনও নারীকে তিনি সম্মান করতে পারেন না, তারা তার যৌনসঙ্গী হয়েছেন বলে। তারপর ব্যর্থতার জন্যে তার মধ্যে জেগে ওঠে এক নিষ্ঠুরতা। তা থেকে জেগে ওঠে অনুশোচনা, আর সেই সাথে নতুনভাবে তিনি আবার কল্পিত পাপবোধ আর প্রকৃত অনুশোচনার স্বাদহীন পথে যাত্রা করেন। এটাই অধিকাংশ দুশ্চরিত্র লম্পটদের মনস্তত্ত্ব। তারা যে পথভ্রষ্ট হন তার কারণ হল তারা একটি অপ্রাপ্যনীয় জিনিসের ওপর নিষ্ঠা রেখে চলেন (তা হচ্ছে মা কিংবা মায়ের প্রতিকল্প)। এ সাথে যুক্ত হয়েছে সেই হাস্যকর নৈতিকতা, যা তার মনে শৈশবে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম জীবনের বিশ্বাস ও ভালবাসার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়াই এইসব মাতৃসুলভ গুণাবলীর শিকারদের সুখ পাওয়ার প্রথম স্তর।

আত্মপ্রেম, একদিক থেকে, অভ্যাসজাত পাপবোধের বিপরীত-আশ্রয়ী। আত্মপ্রেমের উপাদান হচ্ছে নিজেকে ভালবাসার অভ্যাস এবং অপরের ভালবাসা পাওয়ার কামনা। কিছুদূর পর্যন্ত এটা স্বাভাবিক এবং এর জন্যে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মাত্রাধিক্য ঘটলে এটা খুবই ক্ষতিকর। অনেক নারীর মধ্যে, বিশেষ করে ধনী-সমাজের মহিলাদের মধ্যে ভালবাসা অনুভবের ক্ষমতা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। তখন তাদের মনে জেগে ওঠে অন্য পুরুষদের ভালবাসা পাওয়ার এক তীব্র কামনা। এই ধরণের নারী যখন সন্দেহমুক্ত হন যে কোনও পুরুষ তাকে ভালবেসেছেন, তখনই সেই পুরুষের প্রয়োজন তার জীবনে শেষ হয়ে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়, কিন্তু এত বেশি নয়। এ প্রসঙ্গে ‘লিয়ে দাঁগেরোসে’ নামক কাহিনীর নায়ক, এ সুবিখ্যাত ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। মিথ্যা অহংকার এত উচ্চতায় ওঠে যে, তখন অন্য কোনও মানুষ সম্বন্ধে তার প্রকৃত কোনও কৌতূহল থাকে না। তাই এরা প্রেম থেকে প্রকৃত কোনও সুখ লাভ করতে পারেন। না। উদাহণস্বরূপ বলা যায়, একজন আত্মপ্রেমিক চিত্রশিল্পীদের প্রচুর শ্রদ্ধা পেতে দেখে নিজে চিত্রশিল্পের ছাত্র হতে পারেন, কিন্তু যেহেতু এই শিক্ষালাভ তার কাছে বিশেষ একটি উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষ্য, তাই শিল্পের আঙ্গিকে তার কোনও স্বাদ থাকবে না এবং নিজেকে বাদ দিয়ে তিনি অন্য কোনও কিছুর কথা ভাবতেই পারবেন না। এর ফল হবে ব্যর্থতা এবং নৈরাশ্য, অর্থাৎ ঈপ্সিত প্রশংসার পরিবর্তে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ লাভ। যে সব ঔপন্যাসিক তাদের উপন্যাসে আদর্শ নায়িকারূপে নিজেদের তুলে ধরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও একথা বলা যায়। যে বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক বাইরের তার প্রতি প্রকৃত আকর্ষণ কতটুকু তার ওপর যথার্থ সাফল্য নির্ভর করে। সফল রাজনীতিবিদদের বেলায় দেখা যায় সেই বিয়োগান্ত নাটক। কারণ তাদের নিজের সমাজের প্রতি যে আকর্ষণ এবং যে অব্যবস্থা দূর করবেন বলে তিনি দাঁড়ান, তার পরিবর্তে তার মধ্যে আত্মপ্রেম জেগে ওঠে এবং তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন শুধু নিজের জন্যে। তাই তিনি আর শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য থাকেন না, কেউ তাকে শ্রদ্ধাও করে না। যে ব্যক্তির একমাত্র ভাবনা যে পৃথিবীর সব লোক তার প্রশংসা করুক, তার পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভবও হয় তবুও তিনি পুরোপুরি সুখী হতে পারবেন না, কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কখনো সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক নয়। একজন আত্মপ্রেমিক নিজেকে কৃত্রিমভাবে একটি সীমার মধ্যে ততটুকু আবদ্ধ করেন যেটুকু করেন একজন পাপবোধে তাড়িত ব্যক্তি। আদিম মানুষ ভাল শিকারী বলে হয়তো গর্বিত ছিল, কিন্তু শিকারকে অনুসরণ করার মধ্যে যে উদ্দীপনা তা সে উপভোগ করত। আত্মতৃপ্তি বিশেষ একটা সীমা লঙ্ঘন করলে তার নিজের দোষে সব কাজেই আনন্দকে নষ্ট করে দেয়, যা তখন পৌঁছে যায় উদাসীনতা আর একঘেয়েমিতে। প্রায় ক্ষেত্রে এর মূলে রয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব যার প্রতিকার রয়েছে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির মধ্যে। কিন্তু এই আত্মমর্যাদা লাভ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সফল কাজের মধ্যে নিজেকে যুক্ত রাখা যার প্রেরণা পাওয়া যাবে বস্তুগত ব্যাপার থেকে।

আত্ম-অহংকারীর সঙ্গে আত্মপ্রেমিকের পার্থক্য হচ্ছে, তিনি আকর্ষণীয় হওয়ার চেয়ে বেশি চান ক্ষমতাবান হতে। তারা চান লোকে তাদের ভালবাসার চেয়ে ভয় করুক বেশি। বহু উন্মাদ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ অধিকাংশ মহৎ ব্যক্তি এই শ্রেণীতে পড়েন। মিথ্যা অহংকারের মতো ক্ষমতার প্রতি ভালবাসা সাধারণ মনুষ্য-চরিত্রের একটি প্রবল উপাদান এবং তাকে সেইভাবেই গ্রহণ করতে হবে। যখন এর মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পায় অথবা অসম্পূর্ণ বাস্তববোধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, তখন-ই তা মারাত্মক হয়ে ওঠে। আর তা ঘটলে মানুষ অসুখী বা নির্বোধ হয়। যদি দুটো–ও হয়, যে উন্মাদ নিজেকে মুকুটধারী রাজা মনে করছে, একদিক থেকে তিনি অবশ্য সুখী। কিন্তু তা এমন নয় যা কোনও প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি ঈর্ষা করবে। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’(২) উন্মাদের সমগোত্রীয়, যদিও তিনি উন্মাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু নিজের স্বপ্ন সফল করতে তিনি পারতেন না, কারণ তা তাঁর সাফল্যের সাথে সাথে অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। যখন এ বিষয়ে আর দ্বিধা ছিল না যে ইতিহাসের পরিচিত কালে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী, তখন তিনি ভাবলেন যে তিনিও একজন ঈশ্বর। তিনি কী একজন সুখী মানুষ ছিলেন? তাঁর মাদকাসক্তি, উগ্র ক্রোধ, নারীর প্রতি ঔদাসীন্য এবং তাঁর দেবত্বের দাবি, এসব থেকে বোঝা যায় তিনি তা হতে পারেননি। মানব প্রকৃতির অন্যসব উপাদান বাদ দিয়ে কোনও একটি বিশেষ উপাদানের অনুশীলন করলে শেষ পর্যন্ত সুখী হওয়া যায় না। সাধারণত আত্মগর্বী ব্যক্তি হলে, তা সে উন্মাদ হোক বা নামমাত্র প্রকৃতিস্থ হোক, অতিরিক্ত অবমাননা থেকে জাত হীনতাবোধের ফল। স্কুলে নেপোলিয়ন(৩) সহপাঠীদের তুলনায় হীনমন্যতাবোধে ভুগছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন দরিদ্র বৃত্তিধারী ছাত্র, আর সহপাঠীরা ছিলেন অভিজাত বংশের। তারপর তিনি যখন দেশত্যাগী রাজানুগতদের ফিরে আসার অনুমতি দিলেন তখন তাঁর প্রাক্তন স্কুল সহপাঠীদের তার সামনে মাথা নত করে অভিবাদন করতে দেখে তৃপ্তি লাভ করেছিলেন। কী স্বর্গীয় আনন্দ! তবুও তিনি জার (রাশিয়ার সম্রাট)-কে পরাজিত করে তা থেকেও একই ধরণের আনন্দ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই অভিযান শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনে নিয়ে যায়। কোনও মানুষই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় না। সেজন্যে যে জীবন ক্ষমাপ্রিয়তার প্রভাবে পড়ে কোনও না কোনও দিন তাকে দুরতিক্রম্য বাধার সামনে পড়তেই হয়। এমনটি যা ঘটতে পারে সে জ্ঞান পাছে চেতনাকে গ্রাস করে, তাই তাকে আটকাতে হয় এক ধরণের পাগলামির সাহায্যে। যদি কোনও ব্যক্তি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হন, তা হলে যদি কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেন তখন তিনি তাঁকে কারাগারে প্রেরণ অথবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। রাজনৈতিক দমন এবং মনোবিকলন অর্থে দমন হাত ধরে চলে। যখনই কোথাও মনোবিকলিক দমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখনও প্রকৃত সুখের অভাব দেখা যায়। ক্ষমতাকে নিজের সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখলে সুখ বৃদ্ধিতে অনেকভাবে সাহায্য করে। কিন্তু তাকে জীবনের চরম লক্ষ্য করলে তার ফল বিপদ ডেকে আনতে পারে, বাইরের দিক থেকে না হলেও অন্তরের দিক থেকে।

এটা স্পষ্ট যে, অতৃপ্তির মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনেক এবং নানা ধরণের । কিন্তু তাদের মধ্যেও একটা মিল আছে। জন্ম-অসুখী তাকেই বলা হয় যে প্রথম জীবনে কোনও স্বাভাবিক কামনার সহজ পরিতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরে সেই একটিমাত্র কামনার পরিতৃপ্তিকেই অন্য আর সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সে তার জীবনকে একটিমাত্র দিকেই চালিত করেছে। কামনার সাথে প্রস্তুতির ওপরেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে, তার সাথে যুক্ত আনুষাঙ্গিক উপকরণসমূহকে অগ্রাহ্য করে। বর্তমানে আর এক নতুন ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, কোনও ব্যক্তি নিজেকে কোনও বিষয়ে অতি পরাজিত মনে করার ফলে কোনও পথেই তৃপ্তিকে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেছে চিত্তবিক্ষেপ আর বিস্মৃতিকে। এরপর সে সহজ আনন্দের অনুসারী হয়ে উঠবেই। এর অর্থ হল সে নিজেকে অর্ধমৃত করে জীবনকে সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ মাতলামির কথা বলা যায়, যা হল সামাজিক আত্মহত্যা। মাতলামি থেকে যে সুখ পাওয়া যায় তা শুধুই নেতিবাচক, অতৃপ্তিকে সাময়িকভাবে ভুলে থাকা। আত্মপ্রেমী এবং আত্মগর্বী লোক অন্তত বিশ্বাস করে সুখ লাভ করা সম্ভব, যদিও তা পাওয়ার জন্যে তারা ভুল পথ অবলম্বন করে। কিন্তু যে লোক নেশার পথে এগিয়ে যায়, যে নেশাই তা হোক সে সবছির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র বিস্মৃতি ছাড়া। তার ক্ষেত্রে প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, সুখ অবশ্যই প্রত্যেকের কাম্য। নিদ্রাহীন ব্যক্তি যেমন নিদ্রাহীনতার জন্যে গর্বিত, অসুখী ব্যক্তি তেমনি অসুখী হওয়ার জন্যে সবসময় গর্বিত থাকে। দারিদ্রের অহংকার, অতৃপ্তির অহংকার এসব কিছুই মনে হয় সেই লেজকাটা খেকশিয়ালের মতোই অহংকারের। যদি তা সত্যি হয় তাহলে তার প্রতিবিধান হল নতুন লেজ গজানোর শিক্ষা দান করা। যদি তারা সুখের পথ দেখতে পায়, তাহলে আমার বিশ্বাস, খুব কম মানুষই স্বেচ্ছায় অসুখী হওয়ার পথ বেছে নেবে। এমন লোক যে রয়েছে তা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি তাই ধরে নেব যে, পাঠকেরা অসুখী হওয়ার চেয়ে সুখী হতেই চাইবেন। আমি জানি না এ বিষয়ে বুঝতে তাদের কোনও সাহায্য করতে পারব কিনা, কিন্তু এই ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টা তাদের কোনও ক্ষতি করবে না।

——–
১. কবি ব্লেক- William Blake (১৭৫৭-১৮২৭) অষ্টাদশ শতকের কবি। যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে অতীন্দ্রিয়বাদকে অবলম্বন করে কাব্যসাধনা করেছেন। রাসেলের উদ্ধৃতি “Auguries of Innocence” কবিতা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।

২. আলেকজান্ডার : Alexander the Great (খ্রিঃ পূঃ ৩৫৬-৩২৩)। সম্রাট ফিলিপের পুত্র, বিশ্ববিখ্যাত দিগ্বিজয়ী, দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন।

৩.নেপোলিয়ন, Napolean Bonaparte (১৭৬৯-১৮২১)। ফরাসী জেনারেল, পরে কনসাল এবং সম্রাট। ইউরোপের ইতিহাসে সুবিখ্যাত এক নাম। শেষ জীবন কাটে বন্দীদশায়-সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেখানেই মৃত্যু।

০২. বায়রনীয় অ-সুখ

বিশ্বের ইতিহাসে পূর্বেও যেমন ছিল, বর্তমানেও সবার ধারণা এই যে, আমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তারা প্রাচীন যুগের সব উৎসাহ-উদ্যমের পরিচয় পেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে বেঁচে থাকার জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যারা এই মতো ধারণ করেন, তারা যথার্থই অসুখী, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা গর্বিত। কারণ তারা বিশ্বের এই প্রকৃতিকে অতৃপ্তির হেতুরূপে প্রচার করেন এবং মনে। করেন যে, আলোকিত মানুষের পক্ষে অতৃপ্তিই হচ্ছে একমাত্র যৌক্তিক মনোভাব। তারা তাদের অতৃপ্তির জন্যে অহংকার বোধ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দুর্দশাকে উপভোগ করেন, তিনি নিজে দুর্দশাগ্রস্ত নন। এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সরল। এ বিষয়ে দ্বিধা নেই যে উচ্চমন্যতাবোধ এবং অন্তদৃষ্টি দুঃখভোগ জনিত কিছু ক্ষতি পূরণ করে। কিন্তু সহজ আনন্দ উপভোগের অভাব তা পূরণ করতে পারে না। আমি মনে করি না যে অসুখী হওয়ার মধ্যে কোনও উচ্চমার্গের বিচারবোধ আছে। জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অবস্থায় যতটা সম্ভব ততটাই সুখী হবেন এবং যদি তিনি অনুভব করেন যে পৃথিবীর ব্যাপারে ভাবনা একটা বিশেষ সীমার পর বেদনাদায়ক, তখন তিনি তার পরিবর্তে অন্য কিছু ভাববেন। এই অধ্যায়ে এই কথাটাই আমি প্রমান করতে চাই। পাঠককে বোঝাতে চাই যে নানারকম বিতর্ক থাকলেও যুক্তি কখনো সুখের ওপরে নিষেধবিধি আরোপ করেনি। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি যারা তাদের দুঃখের কারণকে আন্তরিকভাবে তাদের পৃথিবী সম্পর্কিত ভাবনার জন্য দায়ী করেন, তারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেন। মূল কথা হচ্ছে, তারা কেন অসুখী তা-ই তারা জানেন না। আর এই অতৃপ্তি তাদের অভ্যস্ত পারিপার্শ্বিক বিশ্বের কম পছন্দের বৈশিষ্ট্যসমূহের দিকেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখে।

আধুনিক আমেরিকানদের জন্যে আমি যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীটি তুলে ধরতে চাই তা মিস্টার জোসেফ উড ক্রাচ’ তার ‘দ্য মডার্ন টেম্পার’ নামে যে পুস্তক তাতে তুলে ধরেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্যে এটি করেছেন কবি বায়রন।(১) সর্বকালের জন্যে করেছেন ‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক। মিস্টার ক্রাচ বলেছেন: আমরা পরাহত এবং জগতে আমাদের স্থান নেই, কিন্তু তাই আমরা আমাদের মানবজন্মের জন্যে দুঃখিত নই।

আমরা বরং মানবরূপে ধ্বংস হব। তবুও পশুরূপে বেঁচে থাকতে চাইব না । কবি বায়রন বলেন :

‘যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে।
যৌবনের ভারের গরিমা ডুবে যায় কাল সিন্ধু নীরে।‘(২)

‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক বলেন :

‘এই কারণে, যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের চেয়ে মৃত, অর্থাৎ যারা আগেই মরে গেছেন, তাদের আমি বেশি সাধুবাদ দিয়েছি।

সত্যিই এই দুই প্রকারের মানুষের চেয়ে সেই বেশি ভাল যিনি এখনও জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি এখনো সূর্যের নিচে ঘটে যাওয়া পাপাচার দেখেননি।

এই তিনজন নৈরাশ্যবাদী জীবনের সকল উপভোগের বিষয়কে দেখেই এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন যার মধ্যে কোনও আনন্দের কণা নেই। মিস্টার ক্রাচ নিউইয়র্কের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের সমাজে বাস করেছেন। বায়রন পৌরাণিক যুগের নায়কদের মতো হেলেসপন্টে সাঁতার কেটেছেন এবং চুটিয়ে প্রেম করেছেন। একলিজিয়াস্টেসের লেখক প্রমোদের বৈচিত্রে বায়রনকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি মদে ডুবেছেন, সঙ্গীতে আত্মহারা হয়েছেন এবং আনুষঙ্গিক সব কিছুতেই নিজেকে জড়িত করেছেন। তিনি জলাশয় তৈরী করেছিলেন। তাঁর অনেক সেবাদাস ও সেবাদাসী, অনেকে তাঁর বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিল। এমন অবস্থাতেও তিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি। কিন্তু তবুও তিনি দেখেছেন সব কিছু অর্থহীন। এমনকি জ্ঞানও তার কাছে অর্থহীন।

“আমি অন্তর দিয়ে জানতে চেয়েছি জ্ঞানকে, জানতে চেয়েছি উন্মাদনা ও মুখতাকে। আমি দেখেছি আত্মা এতেও পীড়িত হয়, কারণ যত জ্ঞান তত অনুতাপ। যে মানুষ জ্ঞানকে বাড়াবেন তিনি দুঃখকেই বাড়াবেন।”

তাঁর জ্ঞান তাঁকে বেদনাহত করেছিল, মনে হয়। তিনি এ থেকে মুক্তির ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

“অন্তর থেকে আমি বলেছিলাম এবার এসো, আনন্দ দিয়ে যাচাই করি তোমাকে।

অতএব প্রমোদে ভেসে যাও। কিন্তু দেখলাম তাও অর্থহীন।”

কিন্তু তার জ্ঞান তার সঙ্গ ছাড়েনি,

“আমি তখন নীরবে বললাম, যেমন বুদ্ধিহীনের বেলায় ঘটে, তেমনি আমার বেলাতেও ঘটে। তা হলে আমি বেশি জ্ঞানী হলাম কেন? তখন আবার আমি মনে মনে বললাম, এও অর্থহীন।

সুতরাং আমি জীবনকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। কারণ যা কিছু এই বিশ্বে হয়ে যাচ্ছে তা আমার কাছে বেদনাদায়ক। কারণ সবকিছুই অর্থহীন এবং মানস সত্তার পক্ষে বিরক্তিকর।”

এটা লেখকদের পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে, লোকে অনেক আগেকার দিনের লেখা আর পড়েন না। কিন্তু যদি পড়তেন; তাহলে তারা এই সিদ্ধান্তে আসতেন যে জলাধার সম্পর্কে যাই বলা হোক, নতুন বই লেখা নিশ্চিতভাবেই অর্থহীন। আমরা যদি দেখাতে পারি জ্ঞানী লোকের পক্ষে একমাত্র একলিজিয়াস্টেসের মতবাদই উন্মুক্ত, সেকথা ঠিক নয়। তা হলে ঐ একই মেজাজের পরবর্তী অন্যসব লেখা নিয়ে আমাদের আর ভাববার কিছু নেই। এই ধরণের আলোচনায় আমাদের উচিত, লেখার মনন এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ– এই দুইয়ের পার্থক্যটা মনে রাখা। লেখার মননের সাথে কোনও তর্ক নেই, কোনও অনুকূল ঘটনায় তার পরিবর্তন হতে পারে অথবা আমাদের শারীরিক কোনও পরিবর্তনে তার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তর্ক দ্বারা কখনো নয়। আমি নিজে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যখন মনে হয়েছে সব কিছু অর্থহীন, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি কোনও দার্শনিক চিন্তা দিয়ে নয়। পেয়েছি কোনও অবশ্য করণীয় কাজের চাপে পড়ে। আপনার শিশুসন্তান অসুস্থ হলে আপনি অসুখী হতে পারেন। কিন্তু কখনো আপনার মনে হবে না যে এসব অর্থহীন। আপনার মনে হবে যে সন্তানকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। এ প্রশ্ন আপনার মনে উঠবেই না যে জীবনের কোনও চরম মূল্য রয়েছে কিনা। ধনী লোক মনে করতে পারেন এবং সচরাচর মনে করেও থাকেন সবকিছু অর্থহীন। কিন্তু যদি কোনও কারণে তার অর্থনাশ হয়, তবু তার মনে হবে না যে পরবর্তী আহারের ব্যাপারটাও অর্থহীন। প্রকৃতিলব্ধ অভাবের সহজ পূরণ থেকেই এই অনুভূতি জাগ্রত হয়। মানবজাতি অন্যসব প্রাণীর মতো এক বিশেষ ধরণের জীবনযুদ্ধের উপযোগী হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর অর্থের সাহায্যে মানুষ বিনা শ্রমে তার সব খেয়াল চরিতার্থ করতে পারে। অবস্থা যদি এমনি হয় পরিশ্রমের অভাবই সুখের একটি প্রধান উপকরণ তার জীবন থেকে চলে যাবে। যেসব জিনিসের প্রতি মানুষের কামনা প্রবল নয়, সেসব যদি সে সহজে লাভ করে, তা হলে সে মনে করবে কামনা পূরণে সুখলাভ হয় না। তার অন্তর যদি কিছু দার্শনিক ভাবনায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তা হলে তার মনে হবে মূলত মানবজীবন দুঃখময়। তা হলে যে মানুষ যা চায়, তাই যদি পেয়ে যায়, সে আরও অসুখী। সে ভুলে যায় যে কিছু অভাব থাকা সুখের একটি অপরিহার্য উপাদান।

এই হল মেজাজ বা মননের কথা, যা এখানে শেষ করতে হয়। অবশ্য একলিজিয়াস্টেসে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনাও রয়েছে।

“নদী সাগরে গিয়ে পড়ছে, তবু সাগর অপূর্ণ।
সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই।
পূর্ব-স্মৃতি বলে কিছুই নেই।
এই পৃথিবীতে সুর্যের নিচে যে শ্রম আমি করেছি,
আমি ঘৃণা করেছি তাকে, কারণ আমার পরে যে জন্মাবে
তাকে দিয়ে যেতে হবে অর্জিত সম্পদ।”

এই আলোচনা আধুনিক দার্শনিকের ভাষায় সাজিয়ে নিলে তা অনেকটা এইরকম দাঁড়াবে : মানুষ নিরন্তর পরিশ্রম করছে, বস্তু অবিরাম গতিশীল, তবু কিছুই অবিনশ্বর নয়। যদিও পরিবর্তনের নিয়মে যা করে আসছে তার সাথে পূর্বের কোন পার্থক্য নেই। কোনও মানুষ মারা গেলে তার উত্তরপুরুষ তার শ্রমের ফল ভোগ করে। নদী পড়ছে সাগরে গিয়ে। কিন্তু তার জলরাশি সেখানে থাকছে না। বারবার সীমাহীন, উদ্দেশ্যহীন চক্রে মানুষ এবং সব জাগতিক বস্তুর উদ্ভব এবং বিনাশ হচ্ছে। কোনও উন্নতি নেই, স্থায়ী কোনও ফল নেই। এমনি চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নদীদের যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে তারা চলত না, স্তব্ধ হয়ে থাকত। সলোমন(৩) যদি বুদ্ধিমান হতেন, তাহলে তিনি উত্তরপুরুষের ভোগের জন্যে ফলের গাছ পুঁততেন না।

কিন্তু অন্য মেজাজে দেখলে সব কিছুর চেহারা বদলে যাবে। সূর্যের নিচে নতুন কিছুই আর নেই। কেন, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, আকাশ-যান, আর রাজনীতিবিদদের বেতার ভাষণের কথা ভাবুন? সলোমন(৪) এসবের কিছু জানতেন কি? যদি রাজ্যের অভ্যন্তর থেকে ফিরে এসে তিনি শেবার রাণির প্রজাদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত বেতার ভাষণ শুনতে পেতেন, তাহলে তাতে কী তিনি তাঁর তুচ্ছ গাছপালা আর জলাশয়ের মাঝখানে সান্ত্বনা পেতেন না? যদি তার অধীনে কোনও তথ্য দপ্তর থাকত এবং সংবাদপত্রে তার হারেমের আরাম সম্বন্ধে কী বলছে, এবং তার সাথে তর্করত বিরোধী জ্ঞানীদের কী দুর্দশা ঘটছে, তা যদি সেই দপ্তর সংবাদপত্রের কাটিং পাঠিয়ে তাঁকে জানাতে পারত, তাহলেও কী তিনি বলতেন সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই? হয়তো এসব তাঁর নৈরাশ্যকে সম্পূর্ণ দূর করতে পারত না। কিন্তু এসব কিছুকে তিনি নতুনভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন। বস্তুত আমাদের সময় সম্পর্কে মিস্টার ক্রাচের একটি অভিযোগ এই যে, সুর্যের নিচে নতুন জিনিস একটু বেশিই আছে। নতুনত্বের অভাব অথবা উপস্থিত–দুই-ই যদি সমান বিরক্তিকর হয় তাহলে তার কোনটি নৈরাশ্যের সত্যি কারণ হতে পারে তা মনে হয় না। তার ওপর এই কথাটি বিবেচনা করে দেখুন : “সব নদী সাগরে গিয়ে লীন হচ্ছে, তবু সাগর পূর্ণ হচ্ছে না। যেখান থেকে নদীসমূহ আসছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।” নৈরাশ্যের কারণরূপে বিবেচনা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভ্রমণ নিরানন্দময়। লোকে গ্রীষ্মকালে স্বাস্থ্যকর স্থানে যায়, আবার ফিরে আসে। এতে প্রমাণ হয় না যে গরমের দিনে স্বাস্থ্যনিবাসে যাওয়া অর্থহীন। জলের যদি অনুভূতি থাকত, তা হলে তা হয়তো শেলির(৫) ‘ক্লাউড’ (মেঘ)-এ বর্নিত রীতিতে নিজের সাহসে ভরা ভ্রমণচক্রটা উপভোগ করত। উত্তরাধিকারীর জন্যে সব রেখে যাওয়ার বেদনাবোধ থেকে বলা যায় যে বিষয়টি দুদিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। উত্তরাধিকারীর দিক থেকে দেখতে গেলে এটি স্পষ্টতই কম দুর্দশামূলক। সব কিছুই পরিণতিতে দূরে চলে যায়। শুধু সেই কারণে তার জন্যে হতাশ হওয়া উচিত নয়। যদি তাদের পরিবর্তে খারাপ জিনিস আসে তাহলে তাকে আশাব্যঞ্জক হওয়ার একটি কারণ মনে করা যেতে পারে। সলোমন যেমন মনে করেন, যদি তেমন কিছু ফিরে আসে? তা হলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই তো নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্যই যায় না, যদি না আবর্তনের প্রতিটি স্তর আলাদাভাবে বেদনাদায়ক না হয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তা কী বয়ে আনবে, তার মধ্যে বর্তমানের সমস্ত অর্থ নিহিত, এইভাবে দেখার ধারণাটাই অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমানের নিজেরই একটি মূল্য আছে। তার অংশবিশেষের কোনও মূল্য না থাকলে সমগ্রেরও কোনও মূল্য থাকে না। জীবন আর যাই হোক মিলনান্তক নাটক নয়। অবিশ্বাস্য রকমের বহু দুর্ভোগের ভিতর দিয়ে গিয়ে নায়ক-নায়িকার আনন্দঘন মিলন ঘটে যে নাটকে, বাস্তব জীবনকে তার অনুরূপ ভাবা উচিত নয়। আমি আমার সময়ে বেঁচে আছি এবং সেই সময়কে যথারীতি উপভোগ করছি, আমার পুত্র পরে আসবে এবং সেও তার সময়ের সম্পদ ভোগ করবে। তারপর তার পুত্র আসবে। এরইমধ্যে বিয়োগান্তক কী রয়েছে? বরং আমি যদি চিরজীবী হতাম, তা হলে শেষ জীবনে সব আনন্দ বিস্বাদে পরিণত হত। জীবন দুর্বিসহ বোঝা হয়ে উঠত। যেভাবে জীবন চলছে তাতে তা চিরসজীব রয়েছে,

“জীবনের আঁচে তপ্ত করেছি দুহাতে ভাই
আগুন নিভেছে, এবার আমিও বিদায় চাই।”(৬)

মৃত্যুতে যন্ত্রণা পাওয়া যতটা যুক্তিসঙ্গত, এই মনোভাবও ততটাই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং যুক্তি দিয়েই যদি মেজাজ গড়তে হয়, তা হলে হতাশ হওয়ার পক্ষে যতটুকু যুক্তি আছে, খুশী হওয়ার পক্ষেও ততটুকু যুক্তি রয়েছে।

‘একলিজিয়াস্টেস’ বিষাদময়। মিস্টার ক্রাচের মডার্ন টেম্পার’ হৃদয়বিদারক । মিস্টার ক্রাচ অন্তরের অন্তস্থলে বিষণ্ণ, কারণ মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ছে। পরবর্তী অসুখী যুগের অনেক মূল্যবোধ আর শাশ্বত মনে হয় না। তিনি বলেছেন, “আধুনিক নিরানন্দ কালটা হচ্ছে মৃত দুনিয়ার প্রেত-অধ্যুষিত কাল, এবং এখনও সেকাল স্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি। যে কিশোর পৌরণিক ধর্মীয় ভাবধারায় বড় হয়েছে, সে যেমন স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে দিগভ্রান্ত, এর সঙ্কট অনেকটা সেই রকম।” একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সম্পর্কে এটা সম্পূর্ণ সত্য। এঁরা সাহিত্যের শিক্ষালাভ করেছেন, তাই আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না। এঁরা প্রথম জীবনের বিশ্বাসকে আবেগের ভিত্তির ওপর স্থাপন করার শিক্ষা পেয়েছেন। তাই যা আধুনিক জগতের জ্ঞান দ্বারা পূরণ করা যায় তাতে তাদের আস্থা নেই। অন্যান্য আরো সাহিত্য-কর্মীর মতো। মিস্টার ক্রাচ এই ধারণায় নির্ভর করে বলছেন যে, বিজ্ঞান তার প্রতিজ্ঞা পালন করেনি। এই প্রতিজ্ঞা কিসের তা অবশ্য তিনি বলেননি। কিন্তু তিনি মনে হয় ভাবেন ষাট বছর আগে ডারউইন। ও হাক্সলি বিজ্ঞান থেকে এমন কিছু আশা করেছিলেন, যা বিজ্ঞান দিতে পারে নি। আমার মনে হয় এর সবটুকুই ভুল এবং এই ভুল পোষণ করে এসেছেন সেই সব।

লেখক এবং যাজক, যারা চান না তাদের বিশেষ জ্ঞানকে কেউ তুচ্ছ মনে। করুক। এ কথা সত্যি যে বর্তমানের জগতে অনেক নৈরাশ্যবাদী রয়েছে। যখনই অনেক লোকের আয় কমে যায় তখনি নৈরাশ্যবাদের প্রকোপ দেখা যায়। একথা ঠিক যে মিস্টার ক্রাচ একজন আমেরিকান এবং মোট কথা আমেরিকানদের আয় যুদ্ধের কারণেই অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে বুদ্ধিজীবীরা খুবই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধ প্রত্যেকের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তার ভাব জাগিয়ে তুলেছে। একটা যুগের মানসিক গঠনে বিশ্বের গতি প্রকৃতি বিষয়ক মতবাদের তুলনায় এইসব সামাজিক কারণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ত্রয়োদশ শতক সবচেয়ে নৈরাশ্রময় যুগ। যে বিশ্বাসের অভাব নিয়ে মিঃ ক্রাচ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তা এয়োদশ শতকের নৈরাশ্যভরা সময়ে তৎকালীন সম্রাট এবং কয়েকজন ইতালিয়ান অভিজাত ব্যক্তি ছাড়া অন্য সবার মনে গেঁথে ছিল। মিঃ ক্রাচ বলেছেন কিছু মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যেই আধুনিক কালের মানুষের এই দুর্দশা, তা কিন্তু সঠিক নয়। রজার বেকন(৭) বলেছেন, “যে কোনও অতীত যুগের তুলনায় বর্তমান পাপ বেশি মাত্রায় রাজত্ব করছে এবং পাপ ও জ্ঞান বিপরীতধর্মী। যদি বিশ্বের সমগ্র অবস্থা দেখি এবং সব জায়গায় তার রূপ কী দাঁড়িয়েছে তা বিবেচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব দুর্নীতি সর্বকালের সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং তা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে শীর্ষমহলে। … লাম্পট্য রাজ দরবারকে কলুষিত করেছে এবং ঔদারিকতা সবার মনিব সেজে বসেছে…। সমাজের শীর্ষস্তরে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে নিচের দিকের অবস্থা কী? গীর্জার প্রভুদের দেখুন, কীভাবে তারা আত্মাকে উদ্ধার করার চেয়ে অর্থের পিছনে ছুটছেন। …তারপর ধর্মীয় গোষ্ঠীদের দেখা যাক, যা বলতে যাচ্ছি তা থেকে কেউ বাদ যাবে না। দেখুন তাদের কী পরিমাণ অধঃপতন হয়েছে কেউ এ থেকে বাদ নেই, নতুন গোষ্ঠী (ফ্রায়ারগণ) নিজেদের উচ্চ মর্যাদাবোধ থেকে ভয়ানকভাবে নিচে নেমে গেছে। যাজকশ্রেণী এখন অহংকার, লাম্পট্য এবং লালসাগ্রস্ত। এবং যেখানেই যাজক-সহকারীরা একসাথে ছুটেছে, প্যারিসে হোক বা অক্সফোর্ডে, সেখানেই তারা কলহ, মারামারি এবং আরো সব কুকর্ম দ্বারা জনগণকে কলংকিত করেছে। …প্রত্যেকে যদি লালসা চরিতার্থ করতে পারে, তবে কী হচ্ছে, কেমন করে হচ্ছে, কোন্ কৌশলে হচ্ছে, কিছুই আসে যায় না। প্রাচীন যুগের পৌত্তলিক পণ্ডিতদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, তাঁদের জীবন আমাদের চেয়ে এত বেশি ভাল ছিল যে, দুয়ের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না। যেমন ভাল ছিল শালীনতায় এবং বিশ্বকে নিন্দা করার ব্যাপারে, তার সব আনন্দ, ঐশ্বৰ্য্য এবং মর্যাদা নিয়ে। এসব জানা যাবে অ্যারিস্টটল,সেনেকা, টুলি, অভিসেনা, আলফারারিয়াস, প্লেটো, সক্রেটিস এবং অন্যান্যদের লেখা থেকে। এইভাবে তারা জ্ঞানের রহস্যে পৌঁছেছিলেন এবং তার রহস্য ভেদ করেছিলেন।”(৮) রাজার বেকনের অভিমত হচ্ছে, তাঁর সমকালীন সাহিত্যসেবীদের কেউ তাঁর মতো নিজের যুগকে পছন্দ করেননি। এসবের মুলে কোনও দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে আমি তা মূহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করি না। বাস্তব অর্থে এর মূলে আছে যুদ্ধ, দারিদ্র এবং সন্ত্রাস।

মিঃ ক্রাচের রচনার করুণতম অধ্যায় হচ্ছে প্রেম বিষয়ে আলোচনা। ভিকটোরিয়ান যুগের লোকদের প্রেম বিষয়ে ধারণা খুব উচ্চস্তরের ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের আধুনিক বাস্তববোধ দিয়েই প্রেমকে দেখি। “ভিকটোরিয়ানদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত সন্দেহবাদী, তাদের কাছে প্রেম ঈশ্বরের কিছু উদ্দেশ্যসাধন করত যা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের কাছে প্রেম ছিল ঈশ্বরের প্রতিরূপ। এই সঙ্কটের মুখে অনেক শক্তলোকও সাময়িকভাবে অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে পড়তো। তারা নিজেদের দেখেছেন এমন এক রহস্যময় শক্তির মুখোমুখি, যা তাদের মনে একপ্রকার ভক্তির ভাব জাগিয়ে তোলে, যা অন্য কিছুতে জাগায় না। তা এমন কিছু, যার প্রতি তাদের প্রশ্নহীন আনুগত্য সমর্পন করা উচিত। এ কথা তারা মর্মমূল থেকে অনুভব করেন। তাদের কাছে, প্রেম ঈশ্বরের মতোই সবরকম আনুগত্য দাবি করে। ঈশ্বরের মতোই জীবনের এক অর্থময় রূপবৈচিত্র্যে বিশ্বাসীদের ভূষিত করে। যাকে এখন পর্যন্ত যে কোনও ভাবে বিশ্লেষণ করে বাতিল করা যায়নি। তাদের চেয়ে আমরা ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে বেশি অভ্যস্ত, কিন্তু এখনও এমন পৃথিবীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, যেখানে প্রেম নেই। প্রেমহীন, ঈশ্বরহীন পৃথিবী যখন হবে, তখনি নিরীশ্বরতার সঠিক অর্থ কী তা বুঝতে পারব।” এটি খুবই কৌতুকের ব্যাপার যে আমাদের কালের তরুণদের চোখে ভিকটোরিয়ান যুগ যত প্রেমময় মনে হচ্ছে, সে যুগের লোকদের কাছে তা ততটা প্রেমময় ছিল না। আমার দুজন মহিলার কথা মনে পড়ে, দুজনেই সে যুগের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করতেন। আমার প্রথম জীবনে দুজনেই খুব পরিচিত ছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন নীতবাদী এবং অন্যজন ছিলেন ভলটেয়ারপন্থী, অর্থাৎ ধর্ম মানতেন না। প্রথম মহিলা এই বলে দুঃখ করতেন যে, সব কবিতা যেন শুধু প্রেম নিয়ে লেখা এবং তার মতে বিষয়টা স্বাদহীন। পরের মহিলা বলতেন–“আমার বিরুদ্ধে কারো কিছু বলবার নেই। কিন্তু আমার মতে বাইবেলের দশ-আদেশের ষষ্ঠটি অগ্রাহ্য করা যত খারাপ, সপ্তমটি তত নয়। কেন না আর যাই হোক এতে অন্যপক্ষের সম্মতি চাই।” এই দুটি মতের কোনওটাই, যাকে মিঃ ক্রাচ বিশেষভাবে ভিকটোরিয়ানরূপে চিহ্নিত করেছেন তা নয়। কারণ এই দু’জন মহিলা প্রেমে শ্রদ্ধাশীল নন তা খুব ভাল করে বোঝা যায়। মিঃ ক্রাচ লেখকজীবনে এমন কয়েকজন লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যারা আপন পরিবেশেই মানিয়ে নিতে পারেননি নিজেদের। এর একটা বড় উদাহরণ আমার মনে হয় রবার্ট ব্রাউনিং(৯)। কিন্তু প্রেম নিয়ে কবি রবার্ট ব্রাউনিং-এর ধারণা আমার কাছে কিছুটা শ্বাসরোধী মনে হয়। তার প্রেমের দর্শন হচ্ছে :

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তাঁর সৃষ্ট হীনতম জীবও
গর্বিত হয় দ্বৈত আত্মায়, তাঁদের একটি পৃথিবীর দিকে
তাকাবার জন্যে।
অন্যটি দয়িতার দিকে ফেরাবার জন্যে।”

এর থেকে বুঝতে পারা যায়, সার্বিকভাবে এই জগতে প্রতিযোগিতার ভাবই একমাত্র সম্ভাব্য পথ। কেন? কারণ ব্রাউনিং বলবেন পৃথিবী নিষ্ঠুর। তা হলে আমাদের বলতে হয়, পৃথিবী আপনাকে আপনার মূল্যে মেনে নেবে না। ব্রাউনিং দম্পতির অনুকরণে দুজনে পরস্পর প্রশংসাকারী সমিতি গঠন করতে পারেন। ভাল-মন্দ বিচার না করে কাজের সর্বদা প্রশংসা পাওয়া নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। ব্রাউনিং এমন অবিমিশ্র প্রশংসাই চেয়েছিলেন সাথীর কাছে, ব্রাউনিং অরোরা লি’ কে প্রশংসা না করার সাহসিকতার জন্য ফিটজেরাল্ড(১০)-কে মাত্রাহীন নিন্দা করেছিলেন। এভাবে তিনি নিজেকে উঁচু স্তরের বীরপুরুষ ভেবেছিলেন। সুতরাং এদের দুপক্ষেরই সমালোচনাশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়াকে আমি সত্যি প্রশংসামূলক। বলতে পারি না। এর মূলে রয়েছে ভীতি এবং নিরপেক্ষ সমালোচনার ঠাণ্ডা ঝাপ্টা থেকে নিরাপদে থাকার কামনা। অনেক বয়স্ক চিরকুমার নিজেদের ঘরে আরামের আগুনের পাশে বসে একই তৃপ্তি লাভ করেন। আমি নিজে ভিকটোরিয়ান যুগে অনেক দিন কাটিয়েছি। মিঃ ক্রাচের আদর্শে আমি আধুনিক নই। কোনও ভাবেই আমি প্রেমে বিশ্বাস হারাইনি। কিন্তু ভিকটোরিয়ানরা যে প্রেমের প্রশংসা করেন আমি তাতে বিশ্বাসী নই। এ প্রেমে দুঃসাহসিকতা আছে। জাগ্রত এর দৃষ্টি, এ যেমন শুভবোধের জন্ম দেয় তেমনি অশুভ দিককে ভুলিয়ে দেয় না। আমার প্রেম যে পাপমুক্ত অথবা পবিত্র এরকম ভনিতা করে না। প্রেমে এইসব গুণাবলী আরোপ করা, যে প্রশংসার যোগ্য, যৌন নিষেধাজ্ঞার পাপপূণ্য বোধ থেকে এসেছে। ভিকটোরিয়ানদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে অধিকাংশ যৌনতাই অশুভ এবং যে যৌনতার অনুমোদন দেওয়া হত তার সাথে জুড়ে দেওয়া হত নানাধরণের পবিত্রতার বিশেষ সব বিশেষণ। বর্তমান যুগের তুলনায় অতীত যুগে যৌন-ক্ষুধা অনেক বেশি ছিল। এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে ঠিক এই কারণে অতীতের লোকেরা যৌনতার গুরত্ব খুব বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন সাধুরা সবসময় করে থাকেন। বর্তমান কালে আমরা এক সংশয়-পূর্ণ যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি। এই সময় আমরা অনেকেই পুরানো আদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি কিন্তু নতুন কিছুই পাইনি। এতে তাদের অসুবিধা বেড়েছে যারা এখনও পুরানো আদর্শে বিশ্বাস করেন। এতে তাদের মনোজগতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা, নৈরাশ্য, অনুশোচনা এবং বিশ্বনিন্দুকতা। আমার বিশ্বাস এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু এ যুগে তাদেরই প্রাধান্য বেশি। আমার বিশ্বাস কেউ যদি এই যুগের সাধারণ অবস্থাপন্ন যুবকদের সাথে ভিকটোরিয়ান যুগের যুবকদের তুলনা করেন, তা হলে দেখবেন প্রেম সম্পর্কে বর্তমান সময়েই তৃপ্তিলাভ বেড়েছে এবং ষাট বছর আগের চেয়ে প্রেমের মূল্য নিয়ে আন্তরিকতা এখন অনেক বেড়ে গেছে। তবুও যে কিছু বিশ্বনিন্দুক সবকিছুই খারাপ দেখে, তার কারণ খুঁজতে হবে তাদের অবচেতন মনের ওপর অতীত আদর্শের অত্যাচারের মধ্যে, আর খুঁজতে হবে আধুনিক সময়ের লোকের আচরণ-নিয়ন্ত্রক যৌক্তিক নৈতিক আদর্শের মধ্যে। অনুতাপের মধ্যে এর প্রতিকার নেই। অতীতের প্রতি মমত্ববোধের মধ্যেও নেই, রয়েছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীকে সাহসের সাথে স্বীকার করার মধ্যে। আর রয়েছে কিছুমাত্রায় বাতিল কুসংস্কারকে তাদের সব রহস্যময় গুপ্তস্থান থেকে নির্মূল করার মধ্যে।

প্রেমের মূল্য দেওয়া কেন তা সংক্ষেপে বলা খুব কঠিন। তবু আমি চেষ্টা করব। প্রেমের মূল্য দেওয়া উচিত কারণ প্রেম নিজেই আনন্দের উৎস। এটি প্রেমের উচ্চতম মূল্য না হলেও, এর প্রত্যেকটি স্তরে এই আনন্দই অনিবার্যভাবে অবস্থান করছে।

“হে প্রেম! তারা তোমাকে খুব ভুল করে
বলে তোমার মধুরতা তিক্ত
কিন্তু তোমার রসাল ফল এমন যে
তার চেয়ে মধুরতর আর কিছু নেই।”

এই কয়েকটি পংক্তির অজ্ঞাতনামা লেখক নিরীশ্বরবাদের কোনও মীমাংসা খুঁজছেন না, বিশ্বরহস্যের চাবিও নয়। তিনি নিজের মধ্যেই আনন্দকে উপভোগ করছেন। প্রেম যে শুধু আনন্দের উৎস তাই নয়, এর অভাবও বেদনার উৎস। দ্বিতীয়ত প্রেমকে এজন্যে মূল্যবান মনে করতে হবে, কারণ তা জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। যেমন সঙ্গীত, পর্বতে সূর্যোদয় এবং পূর্ণিমার সুষমায় প্লাবিত সমুদ্র। যে মানুষ তার প্রেমিকার সাথে মিলে সুন্দর জিনিস উপভোগ করেনি সে প্রেমের যে যাদু-ক্ষমতা আছে তার সন্ধান পায়নি। প্রেম অহংবোধের আবরণটা ভেঙে ফেলতে পারে। কারণ এটি জৈব-সহযোগিতারই একটি রূপ, যাতে একের প্রকৃতিজাত উদ্দেশ্য মেটাতে অপরের আবেগের প্রয়োজন হয়। বিশ্বে নানা যুগে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের কোনওটা মহৎ কোনওটা নয়। স্টোইক এবং প্রথমযুগের খ্ৰীষ্টানরা বিশ্বাস করতেন মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ মঙ্গল পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা, অন্ততপক্ষে অন্য মানুষের সাহায্য ছাড়া। অন্যেরা ক্ষমতাকেই মনে করেছেন জীবনের চরম লক্ষ্য। কেউ কেউ মনে করেছেন ব্যক্তিগত আমোদ-প্রমোদকে। এসবই বিশেষ নির্জন দর্শনের পর্যায়ে পড়ে। কেন না এতে অনুমান করা হয়েছে। যে, মঙ্গল এমন একটা বস্তু যা শুধু ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সমাজে নয়, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে আলাদাভাবে রূপায়িত হওয়া সম্ভব। আমার বিবেচনায় এ সকল মতবাদ মিথ্যা এবং তা শুধু নৈতিক মতবাদ হিসাবে নয়, আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির উৎকৃষ্ট অংশের প্রকাশরূপেও। মানুষ সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এবং কিছু ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রকৃতি তার ভিতর এমন সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে যাতে সহযোগিতার জন্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ অন্তর প্রয়োজন তা সেই সহযোগিতা প্রেরণা যোগায়, যাদের কিছুমাত্র প্রেমের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা তাদের প্রিয়জনের চরম মঙ্গলের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোনও দর্শনে তৃপ্ত হবে না। সন্তানম্নেহের অনুভূতি আরও বেশি ক্ষমতাশালী। কিন্তু তার শ্রেণী প্রকাশ ঘটে পিতা-মাতার পরস্পরের প্রেমের ফলে। আমি এমন দাবি করি না যে মহৎ প্রেম খুব একটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এ কথা বলি যে মহৎ প্রেম এমন কিছু মূল্যবোধ তুলে ধরে, যা অন্যভাবে অজানা থেকে যেত। প্রেমের নিজেরই ভিতর এমন একটা ঐশ্বর্য আছে, যাকে অবিশ্বাস দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। মহৎ প্রেম সব সংশয়বাদীর নাগালের বাইরে। যারা তাদের অক্ষমতার জন্যে যদিও সংশয়বাদকেই দায়ী করে।

“সত্য প্রেম দীর্ঘজীবী অনল
যা মনে জ্বলছে অনন্তকাল
কখনো রুগ্ন হয় না, মরে না, শীতল হয় না,
কখনো স্থানচ্যুত হয় না।”

এর পর মিঃ ক্রাচ ট্র্যাজেডি নিয়ে কী বলেছেন তা দেখব। তিনি এ প্রসঙ্গে যা বলেন, আমি তার সাথে সহমত পোষণ করি। ইবসেনের(১১) ‘গোস্টস’, শেক্সপীয়ারের(১২) ‘কিং লিয়র’ থেকে নিম্নমানের। প্রকাশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত শব্দরাজি উপহার, কোনও কিছুই ইবসেনকে শেক্সপীয়ারে রূপান্তরিত করতে পারত না। যে উপাদান থেকে শেক্সপীয়ার তার নাটক সৃষ্টি করেছেন, মানবিক মর্যাদাবোধ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির ওপর গুরুত্ববোধ এবং জীবনের বিস্তার-সম্পর্কিত কল্পনার আশ্রয়, ইবসেনের কল্পনায় এসবের কোনও গুরুত্ব নেই, এবং তার সমসাময়িকদের কাছেও তার কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে না, ছিলও না। মধ্যবর্তী শতক সমূহের মধ্যে ঈশ্বর, মানুষ এবং প্রকৃতি সব কিছু কেন জানি মূল্য হারিয়ে ফেলেছে যার অর্থ এই নয় যে, আধুনিক শিল্পের বাস্তবতা আমাদের মানুষের হীনতার সন্ধানে লিপ্ত করেছে। এইভাবে মানুষের জীবনের হীনতা বাস্তববাদী চিত্রকলা পদ্ধতি যেন কোনওভাবে আমাদের ওপর চাপানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সেই ব্যাপার যে, প্রাচীন ধাচের ট্র্যাজেডি যেখানে রাজকুমারদের দুঃখের কথা থাকত তা বর্তমান কালের উপযোগী নয়। আমরা যখন অখ্যাত কোনও ব্যক্তির দুঃখের কথা একই রীতিতে আলোচনা করি, তখন তার প্রতিক্রিয়া এক হয় না। এর কারণ অবশ্য এটা নয় যে জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অবনতি হয়েছে। বরঞ্চ এর বিপরীতটাই সত্যি। কারণ, এখন আমরা বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তিকে আর বিশ্বের মহৎ মানুষ বলে মনে করতে পারি না। একমাত্র তাদেরই বিয়োগান্ত নাটকে আবেগের অধিকার থাকবে, আর অন্যেরা কিছু লোকের মহিমা বাড়াবার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে, এমন কথা আমরা মেনে নিতে পারি না। শেক্সপীয়ার বলেছেন :

“ভিক্ষুকরা মারা গেলে আকাশে ধূমকেতুর উদয় হয় না।
কিন্তু রাজকুমাররা মারা গেলে তাদের মৃত্যুতে
আকাশ ঝলসে ওঠে।”

শেক্সপীয়ারের কালে এই আবেগ সামগ্রিকভাবে কেউ বিশ্বাস না করলেও এতে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ রয়েছে যা বাস্তবতা বিশ্বজনীন এবং শেক্সপীয়ার নিজে তা মেনে নিয়েছিলেন। শেক্সপীয়ার তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারেন নি। এরই ফলে নাটকের চরিত্র কবি সিনার মৃত্যু কৌতুকময়। কিন্তু সিজার, ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের মৃত্যু শোকাবহ। কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে যে পার্থিব গুরুত্ব, পূর্ণতা পেয়েছে সেই মূল্যবোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি কেন না আমরা এখন গণতন্ত্রী, শুধু বাইরের রূপেই নয় অন্তরের উপলব্ধিতেও। তাই অতি বিয়োগান্ত নাটককে এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিকের চেয়ে সমাজকেন্দ্রিক হতে হয় বেশি। আমি যা বলতে চাই তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি; এর্নস্ট টোলার রচিত গ্রন্থ ‘মাসেমেনশ’(১৩)-এর সাহায্যে। আমার মনে হয় না, এই গ্রন্থ অতীতে শ্রেষ্ঠ সব যুগে যে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে তার কোনওটার সমতুল্য। কিন্তু সেসব গ্রন্থের সাথে এর যে যথার্থ তুলনা চলে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থ উন্নত করে অন্তরকে, এখানে গভীরতা এবং বাস্তবতাবোধ থেকে বীরোচিত কর্মকাণ্ড চিত্রিত হয়েছে। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন তেমনি এই গ্রন্থে ‘করুণা ও ভীতি জাগিয়ে পাঠকমনকে কলুষমুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই রকম আধুনিক বিয়োগান্ত নাটক কমই রচিত হয়েছে। কারণ এখন শিল্পিত সাধারণ বিষয় দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে না, অথচ প্রাচীন আঙ্গিক এবং ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে হবে। এই কাজ কঠিন। ট্র্যাজেডি রচনা করলে নাট্যকারকে ট্র্যাজেডি অনুভব করতে হবে। সেই অনুভবের জন্যে যে বিশ্বে তিনি বাস করেন তার জন্যে সচেতন থাকতে হবে। শুধু অন্তরে নয়, প্রতি রক্তকণায় এবং স্নায়ুতে। মিঃ ক্রাচ তার বইয়ে প্রথম থেকে শেষাবধি মাঝে মাঝে নৈরাশ্যের কথা বলে গেছেন। তিনি যে বীরোচিতভাবে আনন্দহীন বিশ্বকে স্বীকার করে গেছেন তা হৃদয়কে স্পর্শ করে। কিন্তু এই আনন্দহীনতার কারণ হচ্ছে তিনি এবং অধিকাংশ সাহিত্যসেবী এখন পর্যন্ত পুরানো আবেগসমূহকে নতুন যুগের প্রেরণায় সজীবিত করতে শেখেন নি। প্রেরণার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সাহিত্যিকদের নিজস্ব গোষ্ঠীতে তা নেই। যে সব সাহিত্যিক গোষ্ঠী রয়েছেন, সমাজের জীবনের সাথে তাদের প্রাণের কোনও সংযোগ নেই। এই সংযোগ খুব জরুরী, যদি মানুষের অনুভূতির আন্তরিকতা এবং গভীরতা দিয়ে আসল দুঃখ এবং বেদনাকে পরিমাপ করতে হয়। যেসব প্রতিভাদীপ্ত যুবক জগতে তাদের কিছুই করার নেই মনে করে, ঘুরে বেড়ায়, তাদের আমি বলি : লেখার চেষ্টা ত্যাগ কর, তার পরিবর্তে না লেখার চেষ্টা কর। বিশাল বিশ্বে বেরিয়ে পড়, জলদস্যু হও। বোর্নিওতে গিয়ে রাজা হও, সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে শ্রমিক হও, এমন জীবনকে গ্রহণ কর, যাতে তোমার প্রাথমিক জাগতিক চাহিদা মেটাতে তোমার প্রায় সকল ক্ষমতা দখল করে রাখবে। আমি প্রত্যেকের জন্যে এই পরামর্শ দান করছি না। শুধু তাদের জন্যে করছি যারা মিঃ ক্রাচ আবিস্কৃত ‘অসুখ’ নামের রোগে সংক্রামিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস এরকম জীবন-যাপন করার কয়েক বছর পরে সাবেক-বুদ্ধিজীবী দেখতে পাবেন, চেষ্টা করেও তিনি আর না লিখে পারছেন না, এবং এমন অবস্থা আসবে তখন নিজের কাছে আর তার লেখা তুচ্ছ মনে হচ্ছে না। লেখার আকৃতি থেকে লিখেই তিনি অপার আনন্দ লাভ করবেন।

——-

১. বায়রন, Lord Byron (১৭৮৮-১৮২৪)। Lord Gordon নামেও মায়ের পদবীতে পরিচিত। রোমান্টিক যুগের কবি।

২. অনুবাদ মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬)। তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের “Conquest of Happiness”-এর ভাব অবলম্বনে “সুখ” গ্রন্থটি রচনা করেন।

৩. সলোমন, solomon, খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের হিব্রু রাজা। খ্রিস্ট সমাজে তার চিন্তাধারাপুত ‘Legos Theology’ গৃহীত।

৪. Eccleiasten সলোমনের রচনা নয়। কিন্তু তাঁর নামের সাথেই এই গ্রন্থ সংযুক্ত।–রাসেল

৫. শেলি, P.B Shelley (১৭৯২-১৮২২), রোমান্টিক যুগের কবি। স্বল্পায়ু। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘Ode to the West Wind’, ‘The Cloud’, ‘the Skylark’ এবং ‘Song of Prosperive’

৬. মোতাহার হোসেন চৌধুরীর অনুবাদ।

৭. বেকন, Roger Bacon (১২১৪-১২৯২), ইউরোপের মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক।

৮. Coulton(কূলটন)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ “From St. Francis to Dante” হ’তে গৃহীত।–রাসেল।

৯. ব্রাউনিং, Robert Browning (১৮১২-১৮৮৯), বিখ্যাত ইংরেজ কবি। তাঁর কবিতায় নিস্পৃহতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তোলেন অনেক সমালোচক।

১০. ফিটজেরাল্ড (১৮০৯-৮৩), ইংরেজ কবি, পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইত’-এর ইংরেজি অনুবাদক রূপে বিখ্যাত।

১১. ইবসেন, Henrik (Johan) Ibsen (১৮২৪-১৯০৬)। নরওয়ের কবি ও নাট্যকার। আধুনিক নাট্যকলার প্রবাদপুরুষ।

১২. শেক্সপীয়ার, William Shakespeare (১৫৬৪-১৬১৬)। ইংরেজী সাহিত্যের মহাকবি, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার।

১৩. Vera Meynell ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ‘Masses and Man’ নামে।-–রাসেল

 ০৩. প্রতিযোগিতা

আপনি আমেরিকার যে কোনও লোক অথবা ইংল্যান্ডের যে কোনও ব্যবসায়ে লিপ্ত লোকের কাছে যদি জানতে চান, জীবনকে উপভোগ করার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক কী, তা হলে তিনি বলবেন : ‘জীবন সংগ্রাম’। তিনি অবশ্য আন্তরিকভাবেই সে কথা বলবেন। কারণ তিনি তা বিশ্বাস করেন। কথাটা একদিক দিয়ে যেমন সত্য, তেমনি অন্য অর্থে এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থেই তা মিথ্যা। জীবনসংগ্রাম এমন একটি জিনিস, যা ঘটবেই। আমরা যদি সৌভাগ্যবান না হই, তা হলে আমাদের সকলকেই জীবনসংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। কনরাডের(১) কাহিনীর নায়ক ফকের কথা উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যায়। ফক ছিল এক পরিত্যক্ত জাহাজে। নাবিকদের মধ্যে যে দুজনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তাদের মধ্যে সে একজন। অন্য কয়েকজন নাবিকের শরীর ছাড়া তাদের জন্যে কোনও খাদ্যবস্তু ছিল না। দুজনে সেইসব শবদেহকে খাদ্যরূপে গ্রহণ করে যখন সব শেষ হয়ে গেল তখন শুরু হল প্রকৃত জীবনসংগ্রাম। দুই জনের মধ্যে জয়ী হয়েছিল ফক। কিন্তু তারপর থেকে সে নিরামিশাষী হয়ে গেল। কোনও ব্যবসায়ী যখন জীবনসংগ্রামের কথা বলেন তখন তিনি এই ধরণের জীবনসংগ্রামের কথ ভাবেন না। তার কাছে জীবনযুদ্ধ কথাটি ভুল অর্থে ব্যবহৃত। অত্যন্ত সাধারণ একটা ব্যাপারকে মহিমা দান করার জন্যে এটিকে তিনি নির্বাচিত করেছেন। তার স্বশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কজন না খেয়ে মারা গেছেন, সে কথা জানতে চান তার কাছে। আরো জানতে চান তার বন্ধুরা, যারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। পরে তাদের কী ঘটেছে, সকলেই জানে কোনও ব্যবসায়ী সর্বহারা হলেও তিনি আহারে-বসনে, যে লোকটি যথেষ্ট ধনী হয়ে সর্বহারা হওয়ার সুযোগ পাননি, তার চেয়ে অনেক সুখে থাকেন। এই শ্রেণীর লোকেরা জীবনসগ্রামের অর্থ বলে বোঝে জীবনে সাফল্য পাওয়ার সংগ্রামকে। যারা সগ্রামে রত, তাদের মনে এই যে ভয় নেই যে পরদিন সকালে তাদের প্রাতঃরাশ জুটবে না। তাদের ভয় হল প্রতিবেশীদের চেয়ে যদি কয়েক ধাপ ওপরে উঠতে না পারেন।

অবাক হতে হয় একথা ভেবে যে, তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না যে এমন কোনও যন্ত্রে তারা ধরা পড়েননি যা থেকে তাদের অব্যাহতি নেই। মূল কথাটা হল, যে দৈনন্দিন একঘেয়ে, বাঁধাধরা ও ক্লান্তিকর কাজ তারা করছেন। সেটা ওপরে ওঠার সোপান নয়। আমি অবশ্য উচ্চ-স্তরের ব্যবসায়ীদের কথা ভাবছি। তারা এর মধ্যেই প্রচুর উপার্জন করেছেন এবং তারা যদি চান তা দিয়েই সারা জীবন কাটাতে পারেন।

এইরকম জীবন কাটানো তাদের কাছে গ্লানিকর মনে হয়। যেন তারা শত্রুর ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যদি তাদের কাছে জানতে চান তাদের কাজ দিয়ে জনসাধারণের কোন্ উপকারটা করছেন, তা হলে তারা কর্মব্যস্ত জীবনের প্রচারমূলক অসার কিছু কথা তুলে ধরবেন। ঐ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কিছু তাদের কাছে নেই।

এই রকম একজন মানুষের জীবন বিবেচনা করুন, মনে করুন তার সুন্দর বাড়ি, সুন্দরী পত্নী এবং সুন্দর সব সন্তান রয়েছে। তিনি অন্য সবার ঘুম ভাঙার আগেই ওঠেন এবং তাড়াতাড়ি অফিসে বেরিয়ে পড়েন। সেখানে গিয়ে তাকে কুশলী কর্মকর্তার স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়। তাকে চোয়াল দৃঢ় নিবদ্ধ করার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়। অভ্যাস করতে হয় বাচনভঙ্গিতে দৃঢ়তা প্রকাশ এবং বাক সংযমের, যাতে অফিসভৃত্য ছাড়া আর, সবার কাছে তা প্রভাব বাড়াতে পারে। তিনি অফিসের চিঠির বিষয়ে নির্দেশ দেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেন, বাজারের অবস্থা যাচাই করেন। তারপর এমন কোনও ব্যক্তির সাথে দুপুরের আহার সারেন, যার সাথে তিনি কোনও লাভজনক লেনদেন করছেন অথবা করবেন বলে আশা করেন। সারা অপরাহ্ন একই ধরণের কাজ চলে। তারপর তিনি বাড়ি ফেরেন। তখন তিনি ক্লান্ত, নৈশাহারের পূর্বে যথাযথ পোষাক পরে তিনি নৈশাহারে বসেন তারই মতো ক্লান্ত অন্য লোকদের সাথে। খাওয়ার সময়, যেসব মহিলা তখনো ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ পাননি, তাদের সঙ্গ উপভোগ করছেন, এমন ভান করে যেতে হয়। এই হতভাগ্য লোকটি ঠিক কত ঘণ্টা পরে মুক্তি পান তা আগে বলা সম্ভব নয়। অবশেষে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং কয়েক ঘণ্টার জন্যে তার উত্তেজিত স্নায়ু বিশ্রাম পায়।

এই ব্যক্তির কর্মজীবনে রয়েছে একশত গজ দৌড়ের মনস্তত্ত্ব। কিন্তু যেহেতু এই দৌড়ের শেষ লক্ষ্য হচ্ছে কবরস্থান, সেহেতু একশত গজের পক্ষে যে নিবিষ্টতা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তিনি তার সন্তানদের সম্পর্কে কী জানেন? সপ্তাহের কাজের দিনগুলিতে তাকে থাকতে হয় অফিসে। আর রবিবারে তিনি থাকেন গলফ লিংকে। তিনি তার স্ত্রীর সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখেন? সকালে যখন স্ত্রীকে ফেলে বেরিয়ে যান, তখনো স্ত্রীর ঘুম ভাঙে না। সারা সন্ধ্যা স্বামী-স্ত্রী দুজনে সামাজিকতা রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, যা দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার সম্ভবত কোনও পুরুষবন্ধু নেই যিনি তার কাছে মূল্যবান। কিন্তু তার এমন অনেক বন্ধু আছে যাদের সাথে আনন্দলাভের অভিনয় করতে হয়। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় এই আনন্দ যদি তিনি সত্যিই অনুভব করতে পারতেন। তিনি বসন্তকালকে বা ফসল তোলার কালকে ততটুকুই জানেন, যতটা বাজারে লাভক্ষতির সাথে যুক্ত। মনে হয় তিনি অনেক বিদেশও ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু চরম ক্লান্তির চোখে। বই তার কাছে তুচ্ছ, সঙ্গীত মূল্যহীন। এভাবে বছরের পর বছর কাটিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তার মনোযোগ আরো একাগ্র হয়, ব্যবসার বাইরে জীবন হয় শুষ্ক এবং নিরানন্দময়। আমি এই জাতীয় প্রৌঢ় আমেরিকানদের স্ত্রীকন্যাদের সাথে ইউরোপে দেখেছি। স্পষ্টই বোঝা গেল এরা বেচারাকে বুঝিয়েছেন কিছু ছুটি উপভোগ করা উচিত এবং মেয়েদের পুরানো মহাদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মাতা-কন্যা আনন্দে তাকে ঘিরে দাঁড়ায় এবং যা কিছু তাদের কাছে দেখার মতো মনে হয় তাদের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গৃহস্বামী চরম ক্লান্ত, বিরক্ত। শুধু ভাবতে থাকেন অফিসের লোকেরা এখন কী করছে অথবা বেসবল ক্রীড়াজগতে কী হচ্ছে। তার নারী-সঙ্গীরা অবশেষে তার সম্পর্কে হতাশ হন এবং মনে করে পুরুষরা এক একজন বস্তুবাদী বর্বর। একথা তাদের কখনো কী মনে হয় না যে লোভের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এ কথা অবশ্য সম্পূর্ণ সত্যি নয়, যেমন সতীদাহ প্রথা একজন ইউরোপীয়ানের দৃষ্টিতে যেমন, আসলে ঠিক তা নয়। হতে পারে দশটির ক্ষেত্রে নটি বিধবা স্বেচ্ছায় আত্মদান করেছে। কারণ তাকে তৈরী করা হয়েছে পুড়ে মরার গৌরব লাভের জন্যে। কারণ তাই ছিল ধর্মের বিধান। ব্যবসায়ীর গৌরব এবং ধর্ম দাবি করে আরো অধিক অর্থ উপার্জন। সুতরাং তিনি হিন্দু বিধবার মতো এই অত্যাচার আনন্দের সঙ্গে মেনে নেন। অমেরিকান ব্যবসায়ীকে আরো সুখী করতে হলে তার ধর্মকে পরিবর্তন করে নিতে হবে। যতদিন তিনি শুধু সফলতা নয়, অন্তর থেকে বিশ্বাস করবেন সাফল্যের পিছনে ধাবমান হওয়াই মানুষের কর্তব্য। যিনি তা করেন না তিনি হতভাগ্য। ততদিন তার জীবন এমন কেন্দ্রীভূত এবং চিন্তাময় থাকবে যাতে তিনি কোনওভাবেই সুখী হতে পারবেন না। অর্থ বিনিয়োগের একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রায় প্রত্যেক আমেরিকান তার অর্থের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে শতকরা ৮ ভাগ লভ্যাংশ চাইবেন, তবুও নিরাপদ বিনিয়োগ ৪ শতাংশ চাইবেন না। এর ফলে তাদের প্রায়ই অর্থনাশ হচ্ছে, সাথে সাথে অবিরাম মানসিক উদ্বেগ আর অশান্তি বেড়ে চলেছে। আমার নিজের কথা হচ্ছে আমি অর্থ থেকে যা চাই তা হচ্ছে নিরাপত্তার সাথে অবসর। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ যা চান তা হচ্ছে আরো বেশি অর্থ যা দিয়ে চমকপ্রদ সমারোহ প্রকাশ করা যায়। যাতে তিনি দীপ্তির আভায় সমশ্রেণীর ব্যক্তিকে অতিক্রম করতে পারেন। আমেরিকার সামাজিক মান অনির্দিষ্ট এবং সবসময় ওটা ওঠা-নামা করে। তার ফলে সব ধরনের উন্নাসিক প্রবৃত্তি সেখানে সামাজিক অবস্থান ভেদে একরকম স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ফলে তা বড় অস্থির। যদিও একমাত্র অর্থ দিয়েই শুধু মানুষ বড় হয়ে ওঠে না, তবু অর্থকে বাদ দিয়েও বড় হওয়া কঠিন। তার ওপর অর্থ সৃষ্টি করাই হল মস্তিষ্কের স্বীকৃত মাপ। যে ব্যক্তি অনেক অর্থ উপার্জন করেন তিনি চালাক, যিনি করতে পারেননি তিনি চালাক নন। কে আর নির্বোধ বলে পরিচিত হতে চান! সুতরাং বাজারের অবস্থা অনিশ্চিত হলে তার অবস্থা পরীক্ষার সময় তরুণদের অবস্থার মতো অস্থির হয়ে পড়ে।

ব্যবসায় বিনষ্ট হলে পরিণতি কী হতে পারে, ব্যবসায়ীর এই দুশ্চিন্তার ভিতর যথার্থ অথচ অযৌক্তিক ভয়ের একটা অংশ প্রায়ই অনুপ্রবেশ করে। একথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত, আরনল্ড বেনেটের(১) ‘ক্লে-হ্যাংগার’ যতই ধনবান হন, তার মন সবসময় শংঙ্কিত ছিল যে, তিনি কারখানার ভিতর মারা যাবেন। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যারা শৈশবে দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়েছেন, তারা সবসময় ভয়ে। কাতর থাকেন যে, তাদের সন্তানরাও সেই দারিদ্র ভোগ করবেন। তারা ভাবতে থাকেন সেই দারিদ্র্য রুখে দিতে যত অর্থের সঞ্চয় গড়ে তোলা প্রয়োজন তা প্রায় অসম্ভব এই ভয় প্রথম প্রজন্মে অনিবার্য, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম, যারা কঠিন দারিদ্র্যের মুখোমুখি হননি তাদের কাছে এই ভয় সামান্য, বাস্তব সমস্যার শুধু একটা অংশবিশেষ।

সন্তোষের মূল উৎস প্রতিযোগিতামূলক সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। এর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়াই হল বাস্তব সংকট। একথা আমি অস্বীকার করি না যে, সাফল্যের অনুভূতি জীবন উপভোগ সহজ করে দেয়। একজন চিত্রশিল্পীর কথা ধরা যাক, তিনি যদি প্রথম যৌবনে অখ্যাত থাকেন এবং পরে তার প্রতিভা যথার্থ স্বীকৃতি পায়, তিনি আরো সুখী হবেন। একথাও আমি অস্বীকার করি না যে অর্থ। কিছুদূর পর্যন্ত সুখকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব অতিক্রম করলে, সুখ আরো বেড়ে যাবে আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি সাফল্য সুখের একটা উপাদান মাত্র। অন্যান্য আর সব উপাদানকে ত্যাগ করে যদি সাফল্য পেতে হয়, তা হলে তাকে অনেক বেশি মূল্যে কেনা হয়।

ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জীবনে যে দর্শন প্রচলিত, তাই হল তাদের সকল দুঃখের আকর। ইউরোপে এখনো অন্যান্য কিছু গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মর্যাদা নষ্ট হয়নি। কিছু কিছু দেশে একটি অভিজাত গোষ্ঠী আছে। বুদ্ধিবৃত্তি সব দেশেই রয়েছে। দু একটি ছোট দেশ বাদ দিলে অন্যসব দেশে সেনা এবং নৌবহর খুব সম্মান পায়। এখন একথা সত্যি যে একজন ব্যক্তির বৃত্তি যাই হোক, তার সাফল্যের মধ্যেই প্রতিযোগিতার একটি উপাদান আছে। তথাপি একথাটা সত্যি যে, যে ধরনের বস্তু মর্যাদা পায়, তা শুধু সাফল্য নয়, তা হল তার উৎকর্ষতা। যাই হোক তা, তার ওপরই নির্ভর করে সাফল্য। একজন বিজ্ঞানীর অর্থ থাকতে পারে, নাও পারে, অর্থ রয়েছে বলে তিনি বেশি শ্রদ্ধেয়, না হলে ততটা শ্রদ্ধেয় নন। একথা কখনো সত্যি নয়। একজন নৌবহরের খ্যাত এডমিরাল বা জেনারেলকে দরিদ্র দেখলে কেউ অবাক হন না। প্রকৃতপক্ষে এসব ক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিজেই এক প্রকার সম্মান বহন করে যেন। এইসব কারণে ইউরোপে শুধুমাত্র অর্থ-প্রতিযোগিতা কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমিত এবং মনে হয়, সে কারণে তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারকারী বা সম্মানিত নন। কিন্তু আমেরিকায় বিষয়টি অন্যরকম, সেখানে পরিসেবাসমূহ জাতীয় জীবনে খুব ছোট ভূমিকা পালন করে বলে তাদের কোনও প্রভাব দেখা যায় না। জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃত্তি সম্পর্কে বলা যায় যে, বাইরের কোনও ব্যক্তি বলতে পারেন না, একজন ডাক্তার কিংবা একজন আইনজীবী তাদের নিজ নিজ পেশায় কতটা যোগ্য। তাদের যোগ্যতা বিচার হবে শুধু তাদের উপার্জন থেকে, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান থেকে। অধ্যাপকেরা তো ব্যবসায়ীদের ভাড়া করা ভৃত্য। সেজন্যে তারা প্রাচীন দেশগুলিতে যে শ্রদ্ধা পান, আমেরিকাতে পান তার চেয়ে অনেক কম। এই কারণেই সেখানকার পেশাজীবীরা ব্যবসায়ীদের অনুকরণ করেন এবং ইউরোপের মতো তাদের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই। সুতরাং ধনিক গোষ্ঠীদের মধ্যে আর্থিক সাফল্যের জন্যে যে অশালীন এবং নির্ভেজাল সংগ্রাম চলছে তা বন্ধ করতে পারার মতো কিছুই নেই।

প্রথম বয়স থেকেই আমেরিকান বালকেরা উপলব্ধি করে যে অর্থ-ই হল একমাত্র বস্তু যাকে গণ্য করা যায়। শিক্ষালাভে যথেষ্ট অর্থ উপার্জনের সুযোগ নেই তাই শিক্ষা নিয়ে তারা ভাবে না। শিক্ষার যে উদ্দেশ্য পরিকল্পিত হয়েছিল, তা হচ্ছে উপভোগের ক্ষমতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে দেওয়া। উপভোগ বলতে আমি বোঝাতে চাই সেইসব সূক্ষ্ম বিষয়ের উপভোগ, যা অপরিশীলিত মানুষের অধিকারের সীমার বাইরে। অষ্টাদশ শতকে একজন ভদ্রলোকের একটি বিশেষ পরিচয় ছিল, তিনি সাহিত্য, চিত্রকলা এবং সঙ্গীতে বিশেষ আনন্দ পেয়ে থাকেন। আজকের দিনে আমরা তার রসবোধের সাথে একমত নাও হতে পারি। কিন্তু এর মধ্যে অন্ততপক্ষে কোনও অসাধুতা ছিল না। আজকের দিনে ধনীলোকের রসবোধ সম্পূর্ণ আলাদা হতে চলেছে। তিনি কখনো বই পড়েন না। যদি তিনি নিজের সুনাম বৃদ্ধির জন্যে চিত্রশালা স্থাপনের ব্যবস্থা করতে থাকেন, তবে তার জন্যে ছবি পছন্দ করার ভার ছেড়ে দেবেন চিত্রবিশেষজ্ঞদের ওপর। এ থেকে যে আনন্দ তিনি পাবেন, তা ছবির সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে নয়, অন্য ধনী ব্যক্তিদের এইসব ছবি সগ্রহ করতে দেননি সেই আনন্দে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও, যদি ইহুদী হন, তবে মমগ্রাহী হতে পারেন। ইহুদী না হলে তিনি যেমন অন্যান্য শিল্পে, তেমনি এখানেও বেরসিক হতে পারেন। এসবের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, অবসর নিয়ে কী করবেন, তিনি তা জানেন না। তিনি যতই ধনবান হতে থাকেন ততই তার পক্ষে আরো বেশি অর্থ উপার্জন করা সহজতর হয়। এবং অবশেষে দিনে পাঁচ মিনিটের অবসর পেলেও তা কীভাবে কাটাবেন তা তিনি জানেন না। বেচারা শেষ পর্যন্ত সাফল্যের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন। সাফল্যই যতদিন জীবনের লক্ষ্য বলে স্বীকৃতি পাবে, ততদিন এরকমই হবে। সাফল্য অর্জনের পর তা নিয়ে কী করা যায় তা যতদিন লোকে না শিখবে, ততদিন তার জন্যে তাকে বিরক্তি আর ক্লান্তির বোঝা বহন করে যেতেই হবে।

মনের প্রতিযোগিতামূলক অভ্যাস ধীরে ধীরে নিজের সীমা ছাড়িয়ে অন্যদিকে প্রসারিত হয়। একটা বই পড়ার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। এক বইটার পাঠ উপভোগ, আর সেই পড়ার কথা অন্যদের বলা। আমেরিকায় মেয়েদের অভ্যাস হচ্ছে প্রত্যেক মাসে কোনও কোনও বই পড়া অথবা পড়ার ছলনা করা। কেউ কেউ সম্পূর্ণ বইটা শেষ করে, কেউ মাত্র প্রথম অধ্যায়টি পড়ে, কেউ শুধু বইটির সমালোচনা পড়ে। কিন্তু সবার টেবিলেই এসব দেখা যায়। তারা কিন্তু প্রথম শ্ৰেণীর সাহিত্যপুস্তক পড়ে না। পাঠাগারগুলি কখনো পড়বার জন্যে ‘হ্যামলেট’ অথবা ‘কিং লিয়র’ বেছে নিয়েছে এমন একটি মাসের নাম পাওয়া যাবে না। এমন কোনও মাসের কথা বলা যাবে না, যে মাসে দান্তে(৩) সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন মনে হয়েছে। ফলে যা পড়া হয় তা সবই সাধারণ মানের আধুনিক বই, কোনও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গ্রন্থ নয়, এটাও প্রতিযোগিতার ফলাফল। সম্ভবত এর সব কিছুই খারাপ। নয়। কেননা যেসব মেয়ের কথা বলা হচ্ছে তারা নিজেরা পছন্দ করে বই পড়লে, তাদের সাহিত্য-পুরোহিত এবং সাহিত্য-প্রভুরা তাদের জন্যে যা পছন্দ করতেন, তার চেয়েও খারাপ হত।

আধুনিক জীবনে প্রতিযোগিতার ওপর যে প্রাধান্য আরোপ করা হয়েছে তার সাথে সভ্য সমাজের আদর্শাবলীর ক্ষয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান। অগাস্টার যুগ শেষে রোমে যা যা ঘটেছিল তা অবশ্যই এই ধরনের। নারী ও পুরুষ, বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাধারণ আলাপচারিতায় শৈল্পিক দক্ষতা, অষ্টাদশ শতকের ফরাসী সালোঁ-তে যার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল, চল্লিশ বছর পূর্বেও তার ঐতিহ্য সজীব ছিল। এটা এক উচ্চস্তরের শিল্প, যা প্রদর্শন করতে হত এমন কিছুর জন্যে যা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এ যুগে তার কোনও মূল্য নেই যেন। চীনে দশ বছর পূর্বেও এর চর্চা ছিল। কিন্তু আমার ধারণা জাতীয়তাবাদীদের দেশসেবার নতুন উদ্যম এর চর্চাকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছে। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের জ্ঞান যা পঞ্চাশ বা একশত বছর আগেও শিক্ষিতসমাজে বিশ্বজনীন নির্মল আনন্দ পরিত্যক্ত হয়েছে। বসন্তকালে কয়েকজন আমেরিকান ছাত্র তাদের ক্যাম্পাস-সীমান্তের বনানীর ভিতর দিয়ে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। চমৎকার সব বনফুলে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে। কিন্তু পথপ্রদর্শকদের একজনও ঐ কাননের একটি ফুলের নামও জানে না। এই জ্ঞান তো তাদের কোনও কাজে লাগবে না। এই জ্ঞান তাদের উপার্জনও বাড়াবে না।

এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। কোনও ব্যক্তি বিশেষ তার সমস্যা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধও করতে পারবে না। এই সমস্যার প্রকাশ ঘটেছে সাধারণভাবে যে জীবনদর্শন গৃহীত হয়েছে তা থেকে। যে দর্শন অনুযায়ী জীবনটাই একটা সগ্রাম, একটা প্রতিযোগিতা, যাতে শুধু সম্মান অর্জন করবে বিজয়ী। এর জন্যেই বুদ্ধি এবং মেধাকে কাজে না লাগিয়ে প্রবৃত্তির অতিরিক্ত চর্চা করা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত একথা বলবার সময় আমরা ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দিচ্ছি। পিউরিটান (রক্ষণশীল) নীতিবাগিশরা আধুনিক সময়ে সর্বদা ইচ্ছাশক্তির ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও মূলে তারা বিশ্বাসকেই প্রধান্য দিতেন। হতে পারে ইউরিটানবাদ তার দীর্ঘজীবনে এমন একটা প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে ইচ্ছাশক্তির অতিবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সেই সাথে ইন্দ্রিয়বোধ এবং মেধাকে অনাহারে শুকিয়ে মারা হয়েছে, এবং এরকম একটি প্রতিযোগিতার দর্শনকে তাদের প্রকৃতির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে গ্রহণ করেছে। সে যাই হোক, প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় ডাইনোসরদের বুদ্ধির চেয়ে দৈহিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আধুনিক ডাইনোসরদের দৈহিক ক্ষমতার বিশাল সাফল্য সর্বাঙ্গীনভাবে তাদের অনুকরণ করতে প্ররোচিত করেছে। প্রত্যেক দেশের শ্বেতাঙ্গদের জন্যে এরাই হচ্ছে আদর্শ এবং আগামী একশত বছর পর্যন্ত এটা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে হয়। যারা এই ফ্যাশনের অনুসরণ করেনি, তারা অবশ্য একথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারে যে, ডাইনোসররা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেনি। তারা পরস্পরকে হত্যা করেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বুদ্ধিমান যারা দূরে দাঁড়িয়ে তাদের হত্যালীলা দেখেছিল, তারাই পেয়ে গেছে তাদের রাজত্বের উত্তরাধিকার। আমাদের আধুনিক ডাইনোসররাও এমনিভাবে নিজেদের হত্যা করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, গড়ে প্রত্যেক বিবাহ থেকে দম্পতিরা দুটি সন্তানও পেতে চান না। সন্তান আসুক এমন কামনা থেকে তারা জীবনকে উপভোগ করেন না। এখানে এই অহেতুক উদ্দীপনাহীনতার দর্শন যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে তাদের পিউরিটান পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, তা বর্তমান পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য বলে দেখা গেছে। তারা তাদের জীবনদর্শনে এমনি অসুখী যে, সন্তানলাভের কামনা তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাই জৈবিক বিচারে তাদের বিলুপ্তি অনিবার্য। সেদিন খুব দূরে নয়, যখন তাদের স্থান দখল করবে এমন কিছু মানুষ যারা আরো আমোদপ্রিয় এবং প্রাণচঞ্চল।

যে প্রতিযোগিতা জীবনের মূল লক্ষ্যরূপে বিবেচিত, তা অত্যন্ত ভয়ানক, তেমনি একাগ্র, তেমনি দৃঢ়পেশিবদ্ধ এবং অনড় বাসনার ব্যাপার যে তা খুব বেশি হলে এক বা দুই প্রজন্ম পর্যন্ত জীবনের সমরূপ ভিত্তি বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই কালসীমা শেষ হলে তা থেকে অবশ্যই স্নায়বিক ক্লান্তি জন্ম নেবে, নানারকম পলায়নী মনোবৃত্তির উদয় হবে এবং কাজের মতো-ই কঠিন এবং কঠোরভাবে আমোদপ্রমোদের পিছনে ছুটবে (কাজে অবসর উপভোগ সম্ভব নয় বলে)। এবং সবার শেষে বন্ধ্যাত্বের কারণে বংশলুপ্তি ঘটবে। প্রতিযোগিতার দর্শনে শুধু যে কাজের স্পৃহা বিষময় হয়ে ওঠে তা নয়, অবকাশও একই পরিমাণ বিষময় হয়ে ওঠে। যে অবকাশ শান্তিদান করে এবং ক্লান্ত স্নায়ুকে সজীব করে তোলে তাকেই বিরক্তিকর মনে হয়। প্রতিযোগিতর বেগ অবধারিতভাবে বেড়ে যাবেই এবং তার স্বাভাবিক পরিণতি হবে মাদকদ্রব্য সেবনে আশ্রয় লাভ এবং ভেঙে পড়া। এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে জীবনের সুষম আদর্শে সুস্থ এবং প্রশান্তির জায়গাটা নির্বাচন করে তাকে স্বীকৃতিদান।

——–
১. কনরাড, Joseph Conrad (১৮৫৭-১৯২৫)। বৃটিশ ঔপন্যাসিক, তিনি জাতিতে পোলিশ। Lord Jim তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

২. আরনল্ড বেনেট, Amold Bennet (১৮৬৭-১৯৩১) ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, The Old Wives Tale তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

৩. দান্তে, Durante Alighieri (১২৬৫-১৩২১) ইতালীর কবি। বিশ্বনন্দিত মহাকবিদের একজন। তাঁকে বলা হয় ইউরোপীয় বেঁনেসার প্রথম সূর্যরশ্মি Divine Comedy তার কালজয়ী রচনা।

০৪. বিরক্তি এবং উত্তেজনা

বিরক্তি, মানবিক আচরণের একটি উপাদানরূপে তার প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি। এটা আমার বিশ্বাস। আমার আরো বিশ্বাস সমস্ত ঐতিহাসিক যুগকে ধরলে এই বিরক্তি এক বিরাট সহায়ক চালিকাশক্তিরূপে দেখা দিয়েছে। আজকের দিনে একথা আরো বেশি সত্যি। বিরক্তিকে বিশেষভাবে একটি মানবিক আবেগ বলে মনে হতে পারে। বন্দী প্রাণী, এটা সত্যি, মাঝে মাঝে উদাস হয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করে, হাই তোলে, কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব পরিবেশে ওরা বিরক্তির সমধর্মী কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করে বলে আমার মনে হয় না। অধিকাংশ সময় তারা শত্রুর সন্ধানে নিয়ত থাকে অথবা খাদ্যের অথবা দুয়েরই। কখনো তারা সঙ্গমে ব্যস্ত, কখনো দেহকে উষ্ণ রাখতে ব্যস্ত। কিন্তু কখনো যদি অসুখী থাকে তখনো বিরক্তি অনুভব করে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ের মতো, এ বিষয়েও বনমানুষদের সাথে আমাদের মিল রয়েছে, কিন্তু তাদের সাথে কোনও দিন বাস করা হয়নি বলে পরীক্ষার সুযোগ পাইনি। বিরক্তির একটি প্রধান উপাদান বর্তমান অবস্থার সাথে অধিকতর আরামপ্রদ কোনও কাল্পনিক অবস্থার সাথে তুলনা। বিরক্তির আরো একটি উপাদান কারো কর্মদক্ষতাকে সম্পূর্ণ কাজে না লাগানো। যে শত্রু কাউকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার মতে অপ্রীতিকর তবে কোনভাবেই বিরক্তিকর নয়। যে মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, সে বিরক্তি অনুভব করবে না, যদি না তার অতিমানবিক সাহসিকতা থাকে। হাউস অব লর্ডস-এ প্রথম বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেউ কখনো হাই তোলেননি। এ বিষয়ে প্রয়াত ডেভনশিয়ারের ডিউক একটি ব্যতিক্রম। তার জন্যে তিনি লর্ডদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। বিরক্তি হল ব্যর্থ কামনা প্রকাশের ঘটনা, যা প্রীতিকর নয় কোনওভাবেই। কিন্তু সে ঘটনা এমন যা অবসাদ-জর্জরিত মনে একদিনকে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা করে তুলবে। বিরক্তির বিপরীত হল, এক শব্দে বলতে গেলে, আনন্দ নয়, শুধু উত্তেজনা।

মানুষের অন্তরে, বিশেষ করে পুরুষদের উত্তেজনার স্পৃহা অত্যন্ত গভীর বাসা বেঁধেছে। আমার অনুমান, এই কামনা আগে যা ছিল তার চেয়ে সহজভাবে পূর্ণ হয়েছে শিকারের মাধ্যমে। শিকারকে অনুসরণ করার মধ্যে উত্তেজনা আছে, যুদ্ধে উত্তেজনা আছে আর প্রেম নিবেদনে। বর্বর মানুষ ঘুমন্ত স্বামীর পার্শ্ববর্তী নারীর সাথে অবৈধ প্রেমলীলায় রত হবে। এটা জেনেও স্বামী জেগে উঠলে তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু এরকম এক অবস্থা, আমার মনে হয় বিরক্তিকর নয়। কিন্তু কৃষিসভ্যতা আগমনের পর জীবন বিস্বাদ হয়ে পড়েছে। হয়নি শুধু অভিজাতদের জীবন, কারণ তারা এখন পর্যন্ত শিকারের যুগে রয়ে গেছেন। যন্ত্রযুগের মানুষদের ক্লান্তির কথা অনেক শোনা যায়। কিন্তু আমার মতে প্রাচীন পদ্ধতির কৃষিকাজ একই রকম ক্লান্তিকর। অধিকাংশ সমাজসেবক যা মনে করেন, আমি তার বিপরীত-টা মনে করি। আমার বলা উচিত যন্ত্রযুগ বিশ্বের মোট বিরক্তির অনেকটুকুই কমিয়ে দিয়েছে। চাকুরীজীবীদের কাজের সময়টার ওপর তাদের দখল নেই, কিন্তু সান্ধ্যকালীন অবসর তারা বিভিন্ন ধরনের আমোদ-প্রামাদে কাটাতে পারে। এই উপভোগ প্রাচীনপন্থী পল্লীগ্রামে অসম্ভব ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে সেটাও ভেবে দেখুন। আগের দিনে রাতের আহারের পর স্ত্রীকন্যারা বাসনপত্র ধুয়ে ঘর পরিষ্কার করার পর সকলে মিলে পারিবারিক গল্প-গুজব করত। সেটাই ছিল তাদের জন্যে আনন্দ উপভোগ। এর অর্থ হল বাড়ির বড়কর্তা ঘুমিয়ে পড়তেন, স্ত্রী উল বুনতেন, মেয়েরা ভাবত তাদের মরণের কথা অথবা মরুভূমির টিমবকটুতে গিয়ে বাস করার কথা। তাদের পড়াশুনা করতে দেওয়া হত না, বাড়ি থেকে বাইরে যেতে দেওয়া হত না। কারণ তত্ত্বটা ছিল এই যে সে সময় তাদের বাবা আলাপ করবেন তাদের সাথে যা সকলের জন্যেই আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে। ভাগ্য প্রসন্ন হলে অবশেষে তারা বিয়ে করত এবং তাদের সন্তান জন্মাবার পর আবার তারা নিজেদের প্রথম জীবনের মতো নিরানন্দ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যেত। আর যদি বিয়ের সৌভাগ্য না হত তাহলে সারাজীবন কুমারী থেকে শেষে মনে হয় দেহেমনে এক ক্ষয় হয়ে যাওয়া নারীতে পরিণত হত। এমন ভয়ংকর ভাগ্য যা বর্বররা প্রদান করত তাদের বলিপ্রদত্তাকে। শত বছর আগের পৃথিবীর বিষয় বিবেচনা করতে হলে সেসব বিরক্তির পরিমাণটা মনে রাখতে হবে। এবং আরও অতীতে ফিরে গেলে বিরক্তির অবস্থা আরো খারাপ মনে হবে। মধ্যযুগের একটি পল্লীর একঘেয়ে শীতকালের কথা ভেবে দেখুন। লোকে লিখতে পড়তে জানত না, অন্ধকারে তাদের আলো দিতে সম্বল ছিল শুধু মোমবাতি, তাদের একটিমাত্র ঘর, অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়ায় ভরে যেত, আর পুরো বাড়িতে সেই একটিমাত্র ঘরই শুধু হিমঠাণ্ডা নয়। পথ চলা তখন প্রায় অসম্ভব ছিল, তাই ভিন্ন পল্লীর মানুষের দর্শন খুব কম মিলত। শীতের সন্ধ্যায় একমাত্র আনন্দজনক খেলা ছিল ডাইনিবুড়িকে খুঁজে বেড়ান এবং এই খেলার উদ্ভব হয়েছে যেসব কারণে তাদের মধ্যে বিরক্তি অন্যতম।

পূর্বপুরুষদের তুলনায় আমাদের বিরক্তি অনেক কম, কিন্তু আমরা বিরক্তিকে বেশি ভয় পাই। আমরা জানি, বা বিশ্বাস করতে শিখেছি যে বিরক্তি মানুষের জীবনের স্বাভাবিক অংশ নয়, এবং বিরক্তিকে এড়ানো যারা চরম উত্তেজনাময় কাজের সাহায্যে। আজকাল মেয়েরা নিজেরা উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। এই স্বনির্ভরতা তাদের সন্ধ্যাবেলা নিজেদের মতো করে আনন্দে কাটাতে সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তারা এখন তাদের ঠাকুমাদের সময়ের দুর্ভোগ এবং ‘সুখী পারিবারিক সময়’ কাটাবার অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। আমেরিকায়, যারা শহরে বাস করছে, কিংবা করতে পারছে না, প্রত্যেকের একটি মোটরগাড়ি আছে, অন্ততপক্ষে একটি মোটর সাইকেল। এই যন্ত্রযানের সাহায্যে তারা সিনেমায় যেতে পারে। প্রত্যেক বাড়িতে অবশ্য একটি রেডিও আছে। আগের চেয়ে অনেক সহজে এখন তরুণ-তরুণীরা মিলতে পারে। প্রত্যেক পরিচারিকা অন্তত সপ্তাহে একদিন এমন প্রমোদ আশা করে যা স্থায়ী হয়েছিল জেন অস্টেনের(১) নায়িকার ক্ষেত্রে সারা উপন্যাস জুড়ে। সামাজিক স্তরে যতই আমরা ওপরের দিকে উঠেছি ততই আমাদের উত্তেজনা উপভোগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্যে কুলাচ্ছে তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সাথে নিয়ে চলেছে আমোদ, নৃত্য আর মদ্যপান। আর যে কারণেই হোক তারা নতুন স্থানে এসব উত্তেজনা বেশি করে উপভোগের আশা করছে। যাদের কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়, কাজের সময় তাদের জন্যে কিছু বিরক্তি যেন অপেক্ষা করে থাকেই। কিন্তু যাদের প্রচুর অর্থ থাকার ফলে কাজ করে জীবন চালাতে হয় না তাদের চোখের সামনে যে আদর্শ, তা হচ্ছে বিরক্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত জীবন। এই আদর্শ মহৎ, আমি তার অমর্যাদা করা থেকে দূরে থাকতে চাই। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, আদর্শবাদীরা এটা লাভ করা যত সহজ বলে ভাবেন তা তত সহজ নয়, বেশ কঠিন-ই বলা যায়। যাই হোক সকালগুলি বিরক্তিকর, গতদিনের সন্ধ্যাগুলির আনন্দময়তার অনুপাতে। মধ্য বয়স আসবে, সম্ভবত বার্ধক্যও আসবে। বিশ বছর বয়সে লোকে ভাবে ত্রিশ বছরেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমি, আটান্ন বছর বয়সেও এই মত পোষণ করি না। আমার বিশ্বাস আর্থিক মূলধন ব্যয় করা যতটা অবিজ্ঞজনিত কাজ, জীবনের মূলধন নষ্ট করাও তাই। সম্ভবত কিছু বিরক্তি জীবনের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। বিরক্তি থেকে পলায়নের ইচ্ছা খুব স্বাভাবিক। সুযোগ পেলে মানুষের সকল জাতি তা প্রকাশ করেছে। শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে যখন অসভ্যেরা প্রথম সুরার স্বাদ পেল, তারা এর সাহায্যে এতদিনের বার্ধক্যজনিত অবসাদ থেকে পালাবার একটা পথ পেয়ে গেল, এবং যে যে সময়ে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে সেই সেই সময় ছাড়া তারা অবিরাম মদ্যপান এবং হুল্লোড় করতে করতে মৃত্যুকে বরণ করেছে। যুদ্ধ, গণহত্যা এবং উৎপীড়ন– এসবই বিরক্তি থেকে পালাবার এক একটি পথ। এমন কী চুপচাপ থাকার চেয়ে প্রতিবেশিদের সাথে কলহ-বিবাদ করাও অনেক ভাল বলে মনে হয়। নীতিবাগীশদের কাছে বিরক্তি তাই একটি প্রধান সমস্যা এবং মানবসমাজে অন্তত অর্ধেক পাপ বিরক্তির ভয়েই ঘটে থাকে।

বিরক্তি সম্পূর্ণ অশুভ, এটা মনে করা অনুচিত। বিরক্তি দু’রকমের হতে পারে। এক ধরনের বিরক্তি ফলপ্রসু, অন্যটা একেবারে ফলহীন। প্রথমটা জন্মে মাদক আর নেশার অভাবে, দ্বিতীয়টার উদ্ভব হয় প্রয়োজনীয় কাজের অভাবে। সব ধরনের উত্তেজনা সীমিতভাবে হলেও মাদকবস্তুর একটা ভূমিকা থাকে। যে জীবন অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ তা পরিশ্রান্ত এক জীবন যেখানে শিহরণ পাওয়ার জন্যে, যা আনন্দের একটা প্রয়োজনীয় অংশ বলে মনে করা হয়, দরকার হয় অবিরাম অতি উদ্দীপক কিছুর যোগান। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত উত্তেজনায় অভ্যস্ত সে একজন অসুস্থ ব্যক্তি যার লোভ রয়েছে গোলমরিচের প্রতি, সে পরে মরিচের পরিমাণমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও আর স্বাদ পাবে না, অথচ সেই পরিমাণ গোলমরিচে অন্য যে কেউ দম আটকে মারা যাবে। অতিরিক্ত উত্তেজনা এড়ানোর মধ্যে কিছু বিরক্তি থাকেই, আর অতিরিক্ত উত্তেজনা শুধু যে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর তা নয়, তা সবরকম উপভোগের স্বাদ নষ্ট করে দেয় আর গভীর ইন্দ্রিয়তৃপ্তির পরিবর্তে বিকৃতিতে আসক্তি জন্মায়। জ্ঞানের বদলে চাতুর্য্য এবং রূপের বদলে অমসৃণতা জাগিয়ে তোলে। উত্তেজনার বিরুদ্ধে আমি চরম কিছু বলছি না। কিছু পরিমাণে উত্তেজনা স্বাস্থ্যপ্রদ কিন্তু অন্য সব জিনিসের মতো এর মাত্রাও পরিমাণের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। উত্তেজনা খুব কম হলে রুগ্ন আসক্তি জাগিয়ে তুলবে আর খুব বেশি হয়ে গেলে তা ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে। সুতরাং সুখী জীবনে কিছু পরিমাণে বিরক্তি সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকা জরুরী এবং এটা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় যা তরুণদের অবশ্যই শেখানো উচিত।

সমস্ত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের কিছু বিরক্তিকর অংশ থাকে এবং সমস্ত মহৎ জীবনেই কিছু কিছু অনাকর্ষণীয় বিস্তার থাকে। ধরা যাক কোনও আমেরিকান প্রকাশকের বিবেচনার জন্যে সেই প্রথম ওল্ড টেস্টামেন্টের পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়েছে। তার মন্তব্য কী হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়। বিশেষ করে এই গ্রন্থের বংশলতিকা অধ্যায় নিয়ে তিনি বলতে পারেন না যে আপনার পাঠকরা কতগুলি মানুষের নাম জানতে আগ্রহী হবে, যাদের সম্বন্ধে আপনি তেমন কিছুই বলেননি। আমি স্বীকার করছি, আপনি শুরুটা খুব সুন্দরভাবে করেছেন। আমি প্রথমে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, কিন্তু সবকিছু এত বিস্তারিতভাবে বলা অতিশয়োক্তি হয়ে গেছে। এর ভিতরকার উজ্জ্বল অংশগুলি রেখে অবান্তর অংশ সব বাদ দিয়ে যুক্তিসঙ্গত আকারে কলেবর কমিয়ে পাণ্ডুলিপিটি আবার আমার কাছে নিয়ে আসুন। আধুনিক প্রকাশকের বক্তব্য অনেকটা এই ধরনের। কারণ তিনি আধুনিক পাঠকের বিরক্তির ভয় সম্পর্কে জানেন। তিনি কনফুসিয়াসের(২) শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, কোরান, মার্ক্সের ক্যাপিটাল এবং অন্যান্য সব পবিত্র গ্রন্থ যেগুলি ‘বেস্ট সেলার’ রূপে প্রমাণিত হয়েছে, সম্পর্কেও একই কথা বলবেন। শুধু পবিত্র গ্রন্থ সম্বন্ধে নয়, বিরক্তিকর অংশ সম্বলিত সব শ্রেষ্ঠ উপন্যাস নিয়ে তাঁর এই মত। যে উপন্যাসের প্রথম পাতা থেকে শেষ অবধি নানা চিত্তহারী বিষয়ে ঝলমল করে তা অবশ্যই মহৎ কোনও গ্রন্থ নয়। মহৎ লোকের জীবনও, কয়েকটি মহৎ মুহূর্ত ছাড়া সবসময়। চিত্তহরণকারী হয় না। সক্রেটিস(৩) নিশ্চয় মাঝে মাঝে ভোজসভায় যোগ দিয়েছেন এবং নিশ্চয় হেমলক পানের পর যখন বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে তখনও তিনি আলাপচারিতায় প্রচুর তৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু জীবনের অধিকাংশ কাল তিনি পত্নী জানৰ্থিপের সাথে শান্তিতে কাটিয়েছেন। বিকেলে ভ্রমণের সাহায্যে স্বাস্থ্যচর্চা করেছেন এবং কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলিতও হয়েছেন। শোনা যায় কান্ট(৪) সারা জীবনে কোয়েনিসবার্গ থেকে দশ মাইলের বেশি দূরত্বে যাননি। ডারউইন(৫) বিশ্ব পরিভ্রমণ শেষ করে অবশিষ্ট জীবন নিজের ঘরেই কাটিয়েছেন। মার্ক্স(৬) কয়েকটি বিদ্রোহের সৃষ্টি করে অবশিষ্ট জীবন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মোট কথা, দেখা যাচ্ছে শান্তিপুর্ণভাবে জীবন কাটানোই মহৎ ব্যক্তিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের আনন্দ উপভোগ এমন নয়; যা বাইরের দৃষ্টিতে উত্তেজনাপূর্ণ মনে হতে পারে। বিরামহীন কাজ ছাড়া কোনও বড় সাফল্য সম্ভব নয়। সুতরাং এই কাজে এমনভাবে আবিষ্ট হতে হবে যে এবং তা এত কঠিন যে, তা শেষ হলে তীব্র কোনও আমোদ উপভোগ করার শক্তি থাকে না। অবশ্য ছুটির দিনে শারীরিক শক্তি বাড়ানোর জন্যে কঠিন কিছু করা চলে, যার মধ্যে আল্পস পর্বতে আরোহণ করা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে।

কম-বেশি একঘেয়ে জীবনযাপনের ক্ষমতা শৈশবকাল থেকেই অর্জন করা উচিত। এ বিষয়ে আধুনিক পিতা-মাতাদের দোষ দেওয়া যেতে পারে। তারা সন্তানদের উপভোগের জন্যে অতিরিক্ত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করেন, যেমন চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং ভাল ভাল খাদ্যের আয়োজন। বিশেষ কোনও উপলক্ষ্য ছাড়া সন্তানদের কাছে তাদের একটা দিন যে অন্য দিনের চেয়ে আলাদা হওয়া কতটা প্রয়োজনীয় তা তারা বুঝতে পারেন না। শৈশবের সব আনন্দ এমন হওয়া উচিত যা শিশুরা চেষ্টা করে মাথা খাঁটিয়ে নিজেদের পরিবেশ থেকে নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিতে পারে। উত্তেজক আনন্দ, যাতে কোনও দৈহিক পরিশ্রম নেই, যেমন নাটক উপভোগ করা, এমন প্রমোদের ব্যবস্থা তাদের জন্যে খুব কম করা উচিত। এই ধরনের উত্তেজনা নেশার মতো, ধীরে ধীরে তার মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। উত্তেজনাময় উপভোগের সময় শারীরিক যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়, তা স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিপরীত। জমিতে একটি চারাগাছ বাধা না পেলে স্বাভাবিকভাবে সবচেয়ে বেশি বাড়ে। শিশুর ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়। ছোটদের পক্ষে অতিরিক্ত দেশভ্রমণ, বিচিত্র বিষয়ের ওপর তাদের মনে ছাপ ফেলা ভাল নয়। কারণ তা হলে তারা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় একঘেয়েমিও আর সহ্য করতে পারবে না। আমি বলি না যে একঘেয়েমির নিজস্ব একটা মূল্য আছে। আমি বলি যে কিছু মাত্রায় একঘেয়েমি না থাকলে কোনও কোনও ভাল কাজ সম্ভব হয় না। ওয়ার্ডওয়ার্থের(৭) ‘প্রেলিউড’-এর কথাই ধরা যাক, প্রত্যেক পাঠকই জানেন তার ভাবনা বা অনুভূতির মূল্য যাই হোক, তার পক্ষেই তা সম্ভব হয়েছে, কোনও কৃত্রিম শহরবাসী যুবকের পক্ষে তা সম্ভব হত না। কোনও বালক বা যুবকের যদি গঠনমূলক কিছু করার ইচ্ছা থাকে তবে তাদের কাজের জন্যে প্রয়োজন হলে তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই অনেক বিরক্তি সহ্য করবে। কিন্তু যে বালক বিক্ষেপ এবং অপচয়ের মধ্যে জীবন কাটিয়েছে তার মনে গঠনমূলক কিছু করবার কামনা জাগ্রত হবে না। এই কারণেই তার মন সব সময় ছুটতে পারে একের পর অন্য আনন্দের দিকে, কিছু সৃষ্টি করার দিকে নয়। এই অবস্থায় কোনও একটা যুগ যদি বিরক্তিকে সহ্য করতে না পারে, তা হলে সেই যুগ হবে ক্ষুদ্র মানুষের যুগ, যে মানুষ অন্যায়ভাবে প্রকৃতির শান্ত পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যে মানুষের ভিতরকার সব জীবনধর্ম ধীরে ধীরে শুষ্ক হয়ে যায়, সেই মানুষ যেন ফুলদানিতে সাজানো কর্তিত কুসুম।

আমি রহস্যমূলক ভাষা পছন্দ করি না। তবু আমি জানি না, যা বলতে চাই তা কবিতার বিশেষ কাব্যময় ভাষা ব্যবহার না করে বিজ্ঞানের ভাষায় কী করে বলব। আমরা যা কিছু নিয়ে ভাবতে চাই, আমরা যে এই বসুন্ধরার সন্তান সে কথা ভুললে চলবে না। আমাদের জীবন পৃথিবীর জীবনেরই অংশ এবং আমরা সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর মতো পৃথিবী থেকেই জীবনের পুষ্টি সংগ্রহ করে থাকি। বসুন্ধরার জীবনছন্দ ধীরগামী, হেমন্ত এবং শীত বসুন্ধরার পক্ষে ততটুকু প্রয়োজন ঠিক যতটুকু প্রয়োজন বসন্ত ও গ্রীষ্ম। স্থিতি তেমনি অপরিহার্য যেমনি গতি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়েও শিশুর পক্ষে পার্থিব জীবনের জোয়ার-ভাটার প্রবাহের সাথে সংযোগ রাখা বেশি প্রয়োজন। মানুষের দেহ যুগ যুগ ধরে এই ছন্দের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে এবং ধর্ম তার থেকে কিছু অংশ নিয়ে ইস্টার উৎসবের সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। যেমন ইস্টার উৎসবে আমি দু’বছর বয়সের একটি বালককে দেখেছি, যে সবসময় লন্ডনে বাস করেছে সে প্রথম সবুজ গ্রামাঞ্চলে এসে হেঁটে বেড়াবার সুযোগ পেয়েছে। তখন ছিল শীতকাল। প্রত্যেকটি জিনিস ভিজে এবং কর্দমাক্ত, প্রাপ্তবয়সী লোকের চোখে আনন্দজাগানিয়া কিছুই ছিল না। কিন্তু সেই বালকের মধ্যে বিচিত্র এক উল্লাস জেগে উঠল। সে ভিজে মাটির ওপর নতজানু হয়ে বসল আর মুখখানা ডুবিয়ে দিল সবুজ ঘাসের মধ্যে এবং অর্ধস্ফুট উল্লাসধ্বনি করতে লাগল। যে আনন্দ সেই বালক উপভোগ করছিল তা আদিম, সরল এবং অনন্য। এতে তার যে দৈহিক ও মানসিক চাহিদার তৃপ্তিসাধন হচ্ছিল, তা এমন গভীর যে, যাদের এই প্রয়োজন থেকে দূরে রাখা হয়, তারা কমই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। অনেক আনন্দের মধ্যে, যেমন জুয়াখেলা তার একটি ভাল উদাহরণ হতে পারে, মাটির সাথে তাদের কোনও সংযোগ নেই। এরকম আনন্দ যখন শেষ হয়, তা মানুষের মনে ঘৃণার বোধ জাগিয়ে তোলে, তাকে অতৃপ্ত রেখে যায়। কিন্তু তার কারণ কী, তা সে বুঝতে পারে না। এই আনন্দ এমন কিছুই দেয় না। যাকে আমোদ বলা যেতে পারে, বরং যেসব আমোদ-প্রমোদ আমাদের বসুন্ধরার প্রাণের সাথে সংযোগ ঘটায় তার মধ্যে এমন কিছু থাকে যা আমাদের গভীরভাবে তৃপ্তি দেয়। যখন তার অবসান হয়; তখন যে আনন্দ সে বহন করে আনে তার রেশ থেকে যায়, যদিও যখন তারা থাকে তাদের তীব্রতা অন্যান্য উদ্দীপক এবং চিত্তচাঞ্চল্যকর আমোদের চেয়ে কম হতে পারে। এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে আমার মনে যা আছে, তা স্বরলহরীর সব স্তরের কাজের মধ্যেই আছে, সরলতম কাজ থেকে সূক্ষ্মতম সব কাজের মধ্যে। যে দু বছরের বালকটির কথা কিছুক্ষণ আগে বলেছি, সে পৃথিবীর জীবনের সাথে মিলনের যতদূর সম্ভব আদিমতম রূপটি তুলে ধরেছে। কিন্তু উচ্চতর স্তরে এই জিনিসটি পাওয়া যাবে কবিতার মধ্যে। শেক্সপীয়ারের গীতিকবিতা এত সুন্দর হতে পেরেছে এই জন্যে যে, তা এই একই আনন্দে পূর্ণ, যে আনন্দ দুই বছরের বালককে ঘাসকে আলিঙ্গন করার প্রেরণা দিয়েছিল, ‘ঐ শোনো লার্ক পাখির গান এবং ঐ হলুদ বালু কণিকারা কাছে এসো’– এই দুটি কবিতার কথা মনে করুন, দেখবেন এই কবিতা দুটির মধ্যে সেই দুই বছরের বালকের আধো আধো উচ্চারণে প্রকাশিত সেই একই আবেগ যে সুসংস্কৃত ভাষায় ফুটে উঠেছে। অথবা প্রেম এবং শুধু যৌন আকর্ষণের তফাতের কথা ভাবুন, প্রেম এমন এক উপলব্ধি যার মধ্যে দীর্ঘ খরার পর সৃষ্টি স্পর্শ পেলে উদ্ভিদের যেমন হয়, তেমনি আমাদের সকল সত্তা নতুন জীবন পায় এবং সতেজ হয়। প্রেম-বিহীন যৌনমিলনে এই উপলব্ধির কোনও সন্ধান পাওয়া যাবে না, যখন ক্ষণিকের আনন্দ শেষ হয়ে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু ক্লান্তি, ঘৃণা এবং জীবনের শূন্যতাবোধ। প্রেম পার্থিব জীবনের অঙ্গ, প্রেমবিহীন যৌনমিলন তা নয়।

যে বিশেষ ধরনের বিরক্তিতে আধুনিক নাগরিকরা ভুগছে তা পার্থিব জীবনের সাথে তাদের যে বিচ্ছেদ ঘটেছে তার সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মরুভূমিতে তীর্থযাত্রার মতোই এ জিনিস জীবনকে তাপিত, ধূলিময় এবং তৃষিত করে তোলে। যাদের নিজেদের পছন্দানুযায়ী জীবনধারা বেছে নেওয়ার মতো সঙ্গতি রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা বিশেষ ধরনের অসহনীয় বিরক্তিতে ভোগে, তাদের সেই বিরক্তির কারণ শুনতে আত্মবিরোধী মনে হলেও তা হচ্ছে বিরক্তির ভীতি। কল্যাণকর বিরক্তি থেকে পালিয়ে গিয়ে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর কবলে গিয়ে পড়েন এবং তা অনেক বেশি খারাপ। সুখী জীবন অনেক পরিমাণে শান্ত জীবন হওয়া উচিত। কেননা এইটাই একমাত্র পথ। শান্তিময় পরিবেশেই আনন্দ বেঁচে থাকে।

——-
১. জেন অস্টেন, Jane Austen (১৭৭৫-১৮১৭)। ব্রিটিশ মহিলা ঔপন্যাসিক। সৌজন্য, শিষ্টাচার, সামাজিক নীতিবোধের আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর রচনা নিখুঁত শিল্পলাবণ্যে উজ্জ্বল।

২. কনফিউসিয়াস, Confucias (খ্রীঃ পূঃ ৫৫০-৪৭৯)। চৈনিক দার্শনিক। একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক রূপে পৃথিবীতে আজও স্বীকৃত এবং সম্পূজিত।

৩. সক্রেটিস, Socrates (খ্রীঃ পূঃ ৪৬৯-৩৯৯)। প্রাচীন গ্রীসের বিশ্বনন্দিত দার্শনিক। তিনি ছিলেন পৃথিবীতে নীতি-নৈতিকতার প্রবর্তক। প্লেটো (Plato) তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য।

৪. কান্ট, Imannel Kant (১৮০৯-১৮৮২)। জার্মান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী।

৫. ডারউইন, Charles Rovert Darwin (১৮০৯-১৮৮২)। অবিস্মরণীয় জীব-বিজ্ঞানী, ‘Origin of Species’ তার প্রাণীজগতের ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বেও বিরোধী বিপ্লবাত্মক গ্রন্থ।

৬. মার্কস, Karl Marx (১৮১৮-১৮৮৩)। রাইনল্যান্ডে জন্ম, ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সাম্যবাদী মতবাদের প্রবক্তা। ‘Das Capital’ তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ। যাকে বলা হয় ‘Bible of the Proleteriat’। ৭. ওয়ার্ডওয়ার্থ, William Wordsworth (১৭৭০-১৮৫০) ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি।

০৫. অবসাদ

অবসাদ নানা রকমের। তাদের মধ্যে কয়েকটি আবার সুখের পথে অন্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি অন্তরায় সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র শারীরিক অবসাদ, যদি মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, তা হলে তা সুখের একটা কারণ হতে পারে। এতে ভাল ঘুম হয়, ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং ছুটির সম্ভাবিত আমোদসমূহকে মাধুর্যে ভরে তোলে। কিন্তু তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কৃষক রমণীরা উন্নত দেশসমূহের বাইরের সব দেশে ত্রিশেই বুড়ি হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে পড়ে। শিল্পায়ন প্রথার প্রথম যুগে অতি পরিশ্রমে ছোট ছোট ছেলেদের দৈহিক বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যেত এবং প্রায় তারা মারা যেত। চীন এবং জাপানে এখনো তা হচ্ছে, যেখানে শিল্পায়ন নতুন। আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলিতে এই প্রথা এখনো দেখা যায়। শারীরিক শ্রম একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে চালাতে গেলে তা বর্বরোচিত অত্যাচারে পরিণত হয়। প্রায়ই এধরনের অত্যাচার করে শ্রমিকদের জীবনকে দুঃসহনীয় করে তোলা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অংশে, যা হোক, দৈহিক অবসাদ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে শিল্পব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে। বর্তমানকালে উন্নত সমাজে যে রকমের অবসাদ সবচেয়ে ভয়ানক তা হল স্নায়ুবিক অবসাদ। বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে, এই অবসাদ ধনবানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল এবং ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমজীবীদের মধ্যে অনেক কম দেখা যায়।

আধুনিক জীবনে স্নায়বিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। প্রথমত পুরো কাজের সময়ে, কাজ করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে শহরের কর্মীরা সব সময় নানারকম শব্দ দূষণের মুখোমুখি হয়। এটা সত্যি অধিকাংশ শব্দে সে মনোযোগ না দেওয়ার বিদ্যাটা শিখে নেয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই শব্দ তার শক্তিকে ক্ষয় করে দেয়। তা তার জন্যে আরও ক্ষতির কারণ হয় এই জন্যে যে, ঐ শব্দ না শোনার জন্যে অবচেতন মনে একটা চেষ্টা চলতে থাকে, যা স্নায়ুকে পীড়িত করে। তাছাড়া আমাদের অজান্তে আরো একটি জিনিস আমাদের মনে অবসাদ তৈরী করে এবং তা হচ্ছে অবিরাম অজ্ঞাত পরিচয় লোকদের সাথে দেখা হওয়া। অন্যান্য সব প্রাণীর মতো মানুষেরও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে স্বশ্রেণীর প্রত্যেক অপরিচিতকে মনে মনে পরীক্ষা করে নেওয়া, সেই আগন্তুকের সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করবে না শত্রুর মতো তা ঠিক করা। ভিড়ের সময় মাটির নিচে পাতাল রেলে যারা যাতায়াত করেন তাদের এই প্রবৃত্তিকে চেপে রাখতে হয় এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও যারা গায়ে গায়ে চাপাচাপি করে বসেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে এক অবরুদ্ধ ক্রোধ অনুভব করেন। সকলের তাড়া থেকে সকালের গাড়ি ধরার এবং তার ফলে অজীর্ণতা। ফলশ্রুতিতে যতক্ষণে অফিসে পৌঁছে দিনে কাজ শুরু করা না যায়, ততক্ষণে কালো কোট পরিহিত কর্মীটির স্নায়ু ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। তখন সমগ্র মনুষ্যসমাজকেই তার আবর্জনা বলে মনে হয় তার মনিবও ঠিক একই অবস্থায় অফিসে আসেন। এবং কর্মীর মানসিক ক্ষতিপূরণ করার কোনও ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন না। ছাঁটাই হওয়ার ভয় থেকেই সমপূর্ণ ব্যবহার দেখাতে বাধ্য হয় কর্মীটি, কিন্তু এই অস্বাভাবিক আচরণ তার স্নায়বিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়। যদি কর্মীরা সপ্তাহে একবার মনিবের নাক টেনে লম্বা করার সুযোগ পেতেন তাহলে তার সম্বন্ধে কর্মীরা কী ভাবেন তা প্রকাশ পেত এবং তাতে তাদের স্নায়বিক চাপ অনেক কমে যেতে পারত। কিন্তু মনিবের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। তাই এটা থেকে কোনও ফল লাভ করা যেত বলে মনে হয় না। কর্মচারীর কাছে ছাটাই হওয়ার ভয় যেমন, নিয়োগকর্তা মনিবের কাছে দেউলিয়া হওয়ার ভয়ও তেমন। অবশ্য একথা ঠিক, অনেকে এত বড় আসনে আছেন যে তাদের এই ভয় নেই। কিন্তু এই ধরনের উচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে তাদের বছরের পর বছর কঠিন সগ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের বিশ্বের সকল দেশের ঘটনাবলীর ওপর সক্রিয় দৃষ্টি রাখতে হয়েছে এবং তার সাথে তাদের প্রতিযোগীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। এইসব কিছুর মিলিত ফল হল, যখন সত্যিই সাফল্য এল, তখন দেখা গেল সাফল্যলাভকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। যখন আর দরকার নেই তখনো তিনি তাকে ছাড়তে পারছেন না। একথা সত্যি যে, ধনীদের পুত্ররা রয়েছে, কিন্তু তারা ধনী হয়ে না জন্মালে যেসব উদ্বেগে ভুগত, ঠিক তার অনুরূপ উদ্বেগ নিজেদের জন্যে তৈরী করে নিতে তারা সফলকাম হয়। বাজি ধরে, জুয়া খেলে তারা তাদের পিতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে। প্রমোদে গা ভাসিয়ে ঘুমের সময় কমিয়ে দিয়ে শরীরকে দুর্বল করে এবং যখন তারা কিছুটা শান্ত হয়, তখন পিতারা তাদের জন্যে যে সুখের ব্যবস্থা করেছেন তা ভোগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, পছন্দের অথবা প্রয়োজনের তাগিদ থেকে, অধিকাংশ আধুনিক মানুষ স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতিকর জীবন কাটায় এবং সবসময় তারা এত পরিশ্রান্ত থাকে যে, সুরার সাহায্য ছাড়া কোনও আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।

যে সব ধনী বোধহীন তাদের কথা ছেড়ে দিয়ে সাধারণভাবে যাদের অবসাদ কঠিন জীবনসংগ্রামের সাথে যুক্ত, তাদের কথায় আসা যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এদের অবসাদ আসে দুশ্চিন্তা থেকে। দুশ্চিন্তা এড়ানো যায় উন্নততর জীবনদর্শন গ্রহণ করে এবং আর একটু মানসিক-শৃঙ্খলার সাহায্যে। অধিকাংশ নারী ও পুরুষ তাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিমাত্রায় অপারগ। এ কথায় আমি বলতে চাই যে, যেখানে প্রতিকারের কোনও উপায় নেই সেখানেও তারা উদ্বেগজনক বিষয়ের চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারে না। মানুষ ব্যবসাবিষয়ক চিন্তাকে বিছানায় সঙ্গী করে নিয়ে যায়। যে সময়ে তাদের পরের দিনের ঝামেলা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নতুন শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন, তখন তারা তখনকার প্রতিকারহীন দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে। তারা পরবর্তী দিনে সঠিক চলার পথ কী হবে তা নিয়ে ভাবতে চায় না। তাদের ভাবনা হচ্ছে অর্ধ-উন্মাদের লক্ষণযুক্ত নিদ্রাহীনতার রোমন্থন। পরদিন সকাল পর্যন্ত এই মধ্যরাতের উন্মাদ-ভাব তাদের মনে জড়িয়ে থাকে। ফলে তাদের বিবেচনা-বোধ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মেজাজ খারাপ হয় এবং যে-কোনও বাধায় তা সহজে রেগে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। জ্ঞানী ব্যক্তি যন্ত্রণার কথা ভাবেন একা উদ্দেশ্য নিয়ে। অন্য সময়ে তারা আলাদা কিছু নিয়ে ভাবেন এবং রাত্রিতে কিছুই ভাবেন না। আমি এমন কথা বলতে চাই না যে, গভীর সংকটে যেমন, যখন ধ্বংস আসন্ন অথবা একজন মানুষের সন্দেহ করার কারণ থাকে তার স্ত্রী তাকে প্রতারনা করছে, তখন তার পক্ষে কিছু চিন্তা না করা সম্ভব। অবশ্য কেউ যদি তার মনকে বিশেষভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থাকে তা আলাদা কথা। তবে তারা সংখ্যায় বড় কম। তারাই শুধু তাৎক্ষণিকভাবে যার প্রতিকার হবে না, তেমন বিষয়ে উদ্বেগহীন থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ দিনের সাধারণ সব অসুবিধা যদি তার সম্পর্কে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব। সাধারণ মনকে আবাদ করতে পারলে সুখ এবং কর্মদক্ষতা কী পরিমাণ বেড়ে যায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই মন সঠিক সময়ে একটি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে, সবসময় অল্প চিন্তায় মগ্ন থাকবে না। যখন কোনও কঠিন বা উদ্বেগাকুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়। যত তাড়াতাড়ি সব উপায় পাওয়া যাবে তাতেই সবচেয়ে গভীর চিন্তা প্রয়োগ করা উচিত এবং একবার সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তা সংশোধন করা ঠিক নয়, যদি না একবারে নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায়। অব্যবস্থিত চিত্ততার মতো ক্লান্তিকর আর কিছু নেই, এমন অর্থহীনও কিছু নেই।

যেসব বিষয় দুশ্চিন্তার কারণ তার অপ্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলে অনেক দুশ্চিন্তা কমে যায়। আমি অনেক সভায় ভাষণ দিয়েছি, প্রথমদিকে শ্রোতাদের দেখে আমি ভয় পেতাম এবং ঘাবড়ে গিয়ে ভালভাবে বলতে পারতাম না। এই কঠিন পরীক্ষাকে আমি এমনই ভয় পেতাম যে, সব সময় মনে ইচ্ছা হত বক্তৃতার আগেই যেন আমার পা ভেঙে যায়। বক্তৃতা যখন শেষ হত আমি স্নায়ুর যন্ত্রণায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়তাম। তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে ভাবতে শেখালাম, আমি ভাল বলি বা খারাপ বলি, কোন ক্ষেত্রেই পৃথিবীর ক্ষতি বা লাভ কিছুই নেই। দেখা গেল ভাল বা খারাপ বলা নিয়ে দুশ্চিন্তা যত কমিয়ে আনলাম, ততই আমার ভাষণ তত কম খারাপ হতে লাগল। এমনিভাবে স্নায়ুযন্ত্রণা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেল। এইভাবে অনেক স্নায়বিক অবসাদ সম্পর্কেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমাদের কাজসমূহ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যা আমরা স্বাভাবিকভাবে ভাবি। আমাদের সাফল্য বা ব্যর্থতায়, মোট কথা, বিশেষ কিছুই আসে যায় না। এমন কী গভীর দুঃখও বাঁচতে পারে। যেসব বিপদকে একসময় মনে হয়েছে যে, তারা জীবনের সুখ চিরদিনের জন্যে নষ্ট করে দেবে, সময়ের সাথে সাথে তাদের তীব্রতা এতই কমে যায় যে মনে করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু সব আত্মকেন্দ্রিক বিষয়ের ওপরের বাস্তব হচ্ছে কোনও মানুষের অহংবোধ জগতের খুব একটি বড় অংশ নয়। কোনও ব্যক্তি যদি ভাবনা এবং কামনাকে অহংবোধের অতীত বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন, তাহলে তিনি সব বিপদের মধ্যে অবস্থান করেও একটু শান্তি পেতে পারেন যা কোনও অহংসর্বস্ব ব্যক্তির পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।

যাকে বলা হয় স্নায়ুর স্বাস্থ্যবিদ্যা, তা নিয়ে খুব কমই অনুশীলন করা হয়েছে। শিল্পকারখানা বিষয়ক মনস্তত্ত্ব অবশ্য অবসাদ নিয়ে বিষম অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং একথা খুব সযত্নপ্রসূত পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি যদি দীর্ঘসময় ধরে কোনও কাজ করতে থাকে তা হলে শেষ পর্যন্ত তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু এই ফলাফলের জন্যে এত বৈজ্ঞানিক আড়ম্বরের প্রয়োজন ছিল না। মনস্ততত্ত্ববিদরা অবসাদ দিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। যার পরিধি বেশ ব্যাপক। যার মধ্যে স্কুলগামী শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনও পরীক্ষাই মূল সমস্যাকে স্পর্শ করেনি। অবসাদের গুরুত্বপুর্ণ কারণ হচ্ছে অবশ্যই আধুনিক জীবনের আবেগ। বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অবসাদ বিশুদ্ধ পেশীজাত অবসাদের মতো ন্দ্রিার মধ্যেই তার ক্ষতিপূরণ করে নেয়। কোনও ব্যক্তির যদি আবেগহীন বুদ্ধিজাত কাজ বেশি করতে হয়, যেমন দীর্ঘ গণনাসংক্রান্ত কাজ, তবে তিনি তার প্রতিদিনের অবসাদ দিনের শেষে নিয়মিত ঘুমিয়ে দূর করেন। অতিরিক্ত কাজের চাপে যে ক্ষতি হয়, তা শুধু সেই কাজের জন্যে নয়, সেই ক্ষতি হয় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের জন্যে। আবেগজাত অবসাদের অসুবিধা এই যে তা বিশ্রামের অন্তরায়। লোকে যতই ক্লান্ত হয় ততই তার পক্ষে তা দূর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্নায়ুবৈকল্যের একটা লক্ষণ হচ্ছে নিজের কাজকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং কাজ থেকে ছুটি নিলে সব কিছু বরবাদ হয়ে যাবে এই ধারণা। আমি যদি চিকিৎসক হতাম, এরকম যার বিশ্বাস তাদের প্রত্যেককে ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র দিতাম। স্নায়ুবৈকল্যে যা মনে হয় কাজের চাপে ঘটেছে, আসলে তার প্রত্যেকটি আমি যতটা জানি তা ঘটেছে কিছু আবেগ থেকে উৎপন্ন উদ্বেগ থেকে, যা থেকে রোগী পালাবার জন্যে পথ খুঁজে নেন কাজের মধ্যে। কারণ তার যে দুর্ভাগ্য ঘটুক তার চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়ার মতো অন্য কোনও পথ খোলা থাকে না বলেই তিনি কাজ ছাড়তে চান না। অবশ্য এই দুশ্চিন্তা দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকেও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তার কাজ আর দুশ্চিন্তা একসূত্রে বাঁধা। কিন্তু সেই অবস্থাতে তার বিচারশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং উদ্বেগের তাড়নায় তার দুশ্চিন্তা হয়তো তাকে কাজের দিকে ঠেলে দেয় এবং এইজন্যেই দেউলিয়া হওয়ার সর্বনাশ আগেই ঘটে যায়। যদি তিনি কাজ কম করতেন তাহলে তা দেরিতে ঘটত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আবেগ উদ্ভুত উদ্বেগ স্নায়ুবৈকল্যের কারণ, কাজ নয়।

উদ্বেগের মনস্তত্ত্ব কোনও ভাবেই সরল নয়। মানসিক শৃঙ্খলার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ কোনও বিষয়ে ঠিক সময়ে চিন্তা করার অভ্যাসই হল সেই শৃঙ্খলা। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত চিন্তার অপব্যয় কম করে দিনের কাজ শেষ করা যায়। দ্বিতীয়ত এটি নিদ্রাহীনতার প্রতিষেধক এবং তৃতীয়ত এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপরতা এবং দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা অবচেতন বা অচেতন মনকে স্পর্শ করতে পারে না এবং যখন কোনও ঝামেলা দেখা দেয় এই ধরনের ব্যবস্থা যদি চেতনার গভীরে প্রবেশ করতে না পারে তাতে কোনও ফল পাওয়া যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা চেতনার ওপর অবচেতনার ক্রিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, কিন্তু অবচেতনার ওপর চেতনার ক্রিয়া নিয়ে তেমন কিছু করা হয়নি। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যবিদ্যায় শেষেরটির মূল্য অনেক বেশি এবং অবচেতনার সীমায় কখনো যদি যৌক্তিক বিশ্বাস গড়ে তুলতে হয় তাহলে এ বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে তা উদ্বেগ-সম্পর্কিত বিষয়ে প্রয়োগ করা যায়। একথা নিজেকে বলা খুব সহজ যে এই ধরনের দুর্ভাগ্য দেখা দিলে তা খুব ভয়ানক হবে না। কিন্তু এটি শুধুমাত্র সচেতন বিশ্বাসরূপে থাকলে ততক্ষণ এটি রাত্রির অনিদ্রাও বন্ধ করবে না, দুঃস্বপ্নও বন্ধ করতে পারবে না। আমার নিজের বিশ্বাস হল, যথেষ্ট বেগ এবং তীব্রতা যোগ করলে সচেতন চিন্তা অবচেতনার মধ্যে রোপিত করা সম্ভব। অবচেতনার অধিকাংশ পূর্বের তীব্র আবেগসচেতন চিন্তা দিয়ে গঠিত, বর্তমানে তারা সমাহিত অবস্থায় রয়েছে। এইভাবে সমাহিত করার কাজ স্বেচ্ছায় করা যায় এবং এইভাবে অবচেতনাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। আমি দেখেছি যে, আমাকে যদি কখনো কোনও কঠিন বিষয়ের ওপর কিছু লিখতে হয়, তাহলে আমি একটি উৎকৃষ্ট পথ খুঁজে নিই। আমি খুব গভীরভাবে চিন্তা করি এবং আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই করি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন ধরে। এই সময় শেষ হলে আমি আদেশ করি যে কাজটি আপাতত বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ুক। তারপর কয়েকমাস পার হয়ে যাওয়ার পর আমি সচেতনভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা শুরু করি এবং তাতে দেখতে পাই যে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এই কৌশল আবিষ্কারের আগে কাজ শেষ হওয়ার অন্তবর্তী মাসগুলিতে কাজের অগ্রগতি নেই বলে দুশ্চিন্তায় ভুগতাম। সেই দুশ্চিন্তার জন্যে কাজ যে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত তা নয়, বরঞ্চ অন্তবর্তী মাসগুলিও অকারণে নষ্ট হয়ে যেত। অথচ আমি এখন এই সময়ে অন্য কাজে মন দিতে পারি। দুশ্চিন্তা নিয়ে সমরূপ নানারকম পথ খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। যখন কোনও দুর্ভাগ্য ভয় দেখায় তখন খুব গভীর এবং শান্তভাবে ভেবে দেখুন তা সবচেয়ে বেশি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। সম্ভাব্য এই চরম দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়ে ভেবে দেখুন বাস্তবে এই দুর্ভাগ্য সত্যিই ততটা ভয়ানক নয়। এইরকম যুক্তি সবসময় পেয়ে যাবেন, কারণ দুর্ভাগ্য চরমরূপ গ্রহণ করলেও এমন কিছু ঘটে না যার কোনও সৃষ্টিমূলক গুরুত্ব আছে। দুর্ভাগ্যের সম্ভাবনার মুখে, তার দিকে শান্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে যদি নিজেকে বলা যায়, বেশ তো, যাই ঘটুক তাতে আমার কিছুই এসে যায় না, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা কমে গেছে আশাকেও ব্যাপকভাবে ছাড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকবার করার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু পরিশেষে যদি কঠিন দুর্ভাগ্যের মুখে দাঁড়াতে মানসিক প্রস্তুতিতে কোনও গলদ না থাকে, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা বাতাসে উড়ে গেছে এবং তাকে প্রতিস্থাপন করেছে একধরনের উল্লাস।

ভয়কে দূরে রাখার ব্যাপক সাধারণ কৌশলের এটি একটা অংশমাত্র। দুশ্চিন্তা একপ্রকার ভয় এবং সব ধরনের ভয় থেকেই জন্ম হয় অবসাদের। যে ব্যক্তি ভয় অনুভব করতে শেখেননি তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় অবসাদ অতিমাত্রায় কমে যায়। যে ভয় সবচেয়ে ভয়ংকর তা সেইখানেই দেখা যায় যেখানে আমরা তার মুখোমুখি হতে চাই না। অসময়ের মুহূর্তে ভয়ংকর সব চিন্তা মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয়। সেসব কোন ধরনের হবে তা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির মনের কোণে কোন না কোন ভয় লুকিয়ে আছে। কারো কাছে এই ভয় ক্যানসার, কারো কাছে তা আর্থিক বিপর্যয়, তৃতীয় জনের কাছে তা কলঙ্কজনক গোপন কথা ফাঁস হওয়া, চতুর্থ জনের কাছে তা সন্দেহের দাহ, পঞ্চম জন ভেবে রাতে অস্থির হয়ে উঠছেন যে প্রথম বয়সে শোেনা নরকানলের কথা। সম্ভবত সত্যি, মনে হয় এরা সকলেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে ভুল কৌশলের সাহায্য নিচ্ছেন। যখনই তাদের মনে ভয় দেখা দেয়, তারা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করেন, আমোদ প্রমোদ অথবা কাজ অথবা যা খুশি নিয়ে মেতে উঠে চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে দেন। কিন্তু প্রত্যেক ধরনের ভয় মনোযোগ না দেওয়ার জন্যে আরো খারাপ হয়ে যায়। মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অর্থই হচ্ছে, যে ভূতের বিভীষিকা থেকে দৃষ্টি ফেরানো হচ্ছে, তাকে মান্যতা দেওয়া। সব রকমের ভয় সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করা। গভীর মনঃসংযোগ করে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভয়ের সাথে পরিচিত হওয়া না যায়, ততক্ষণ। অবশেষে এই পরিচয় তার বিভীষিকার ধারাকে ভোঁতা করে দেবে। বিষয়টাই বিরক্তিকর মনে হবে এবং আমাদের চিন্তাও তা থেকে দূরে চলে যাবে। কিন্তু আগের মতো তার জন্যে কোনও চেষ্টার প্রয়োজন হবে না, তা সরে যাবে তার সম্বন্ধে কোনও উৎস নেই বলে। যখন আপনার কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করতে মন চাইবে, তা যাই হোক, সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা হল তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। স্বাভাবিকভাবে যা করা হত তার চেয়ে বেশি। যাতে শেষ পর্যন্ত সে বিষয়ে মোহটা দূর হয়ে যায়।

যে বিষয়ে আধুনিক নৈতিকতা অত্যন্ত ক্রটিপুর্ণ তা হল ভয়ের প্রশ্ন। একথা সত্যি যে দৈহিক সাহসিকতা, বিশেষ করে যুদ্ধের সময় পুরুষদের কাছে প্রত্যাশিত। কিন্তু অন্যান্য কারণে সেই সাহসিকতা প্রত্যাশিত নয় এবং নারীদের কাছ থেকে কোনও ধরনের সাহসিকতাই আশা করা হয় না। পুরুষ তাকে পছন্দ করুক, তা যদি কোনও নারী কামনা করে তাহলে সাহসী নারীকে তার সাহসের কথা গোপন করতে হয়। দৈহিক বিপদভিন্ন অন্য বিষয়ে সাহসী লোক সম্পর্কে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। জনমত সম্পর্কে নিস্পৃহ ঔদ্ধত্য বলে ভাবা হয় এবং সে পুরুষ জনগণের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে সাহসী হয় তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সবই যা হওয়া উচিত তার বিপরীত। প্রত্যেক ধরনের সাহস, তা নারী বা পুরুষ যার ক্ষেত্রেই হোক, সৈনিকের দৈহিক সাহসের তুল্য প্রশংসা পাওয়া উচিত। যুবকদের ভিতরকার দৈহিক সাহসের সাধারণত্ব একথার প্রমাণ দেয় যে, জনমতের দাবি এই সাহসের জন্ম দিতে পারে। সাহস বেশি হলে দুশ্চিন্তা কমে যায়। সুতরাং ক্লান্তিও কমে যায়। আধুনিক নারী-পুরুষ যে ধরনের স্নায়ুবিক অবসাদে ভুগছে তার অধিকাংশই সচেতন অথবা অবচেতন ভয় থেকে জন্ম নিচ্ছে।

প্রায় সব ধরনের অবসাদের উৎস হচ্ছে উত্তেজনার প্রতি আকর্ষণ। যদি কোনও মানুষ অবসর সময় ঘুমিয়ে কাটাতে পারে, তা হলে তিনি সক্ষম থাকেন। কিন্তু কাজের সময়টা তার কাছে শুষ্ক লাগে এবং অবসর পেলেই তিনি আনন্দ উপভোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অসুবিধা হচ্ছে এই যে, যে সব উপভোগের জিনিস সহজে পাওয়া যায়, যার বাইরের চাকচিক্য বেশি, সেসবের বেশিরভাগ স্নায়ুকে ক্ষয় করে। উত্তেজক আমোদ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে হয় তা বিকৃত মনোভাবের, না হয় কোনও সহজাত অতৃপ্তির পরিচয় দেয়। সুখীবিবাহের প্রথম অবস্থায় প্রায় ব্যক্তিই উদ্দীপক উপভোগের প্রয়োজন বোধ করেন না। কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বিবাহ এত দীর্ঘদিন পর্যন্ত আটকে রাখতে হয় যে, শেষপর্যন্ত উপার্জনের দিক থেকে যখন আর কোনও অসুবিধা থাকে না, তখন দেখা যায় উদ্দীপক আমোদ উপভোগটা এর মধ্যেই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এবং তা মাত্র স্বল্প সময়ের জন্যে আটকে রাখা সম্ভব। বর্তমানে বিবাহের যে আর্থিক চাপ বহন করতে হয় তা এড়িয়ে যদি জনমত কোনও যুবককে একুশ বছর বয়সে বিবাহের অনুমতি দিত তা হলে অনেক মানুষই কাজের মতো অবসাদজনক আমোদ-প্রমোদের পথে পা বাড়াত না। এমনই হওয়া উচিত, এরকম সুপারিশ করা অবশ্য নীতিবিগর্হিত এবং বিচারক লিন্ডসের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা থেকেই অনুধাবন করা যাবে। দীর্ঘকালের সম্মানজনক কর্মজীবন সত্ত্বেও তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল, তিনি বড়দের রক্ষণশীলতার জন্যে তরুণরা যেসব দুর্ভোগ ভোগ করে সেসব থেকে তাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আমি আর এ বিষয়ে বেশিদূর যাব না। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আরো কিছু আলোচনা করব।

.

সাধারণ ব্যক্তি যেসব আইন এবং বিধিবিধান বদলাতে পারেন না, কিন্তু তার মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়, তার পক্ষে উৎপীড়ক নীতিবিদদের তৈরী এবং সুরক্ষিত পরিস্থিতির সাথে পেরে ওঠা কঠিন। কিন্তু এটা বুঝতে পারা উচিত যে, উদ্দীপক আমোদ-প্রমোেদ সুখের পথে এগিয়ে দেয় না। যতদিন আরো তৃপ্তিদায়ক উপভোগ তার আয়ত্তের বাইরে থাকবে, ততদিন উদ্দীপক জিনিস ছাড়া তার পক্ষে জীবনকে সহ্য করাই প্রায় অসম্ভব মনে হবে। এই অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি একটিমাত্র কাজ যা করতে পারেন তা হচ্ছে নিজের উপভোগের সীমা নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্বাস্থ্য ও কাজের পক্ষে ক্ষতিকারক অবসাদজনক প্রমোদে মত্ত না হওয়া। তরুণদের বাধাবিঘ্ন দূর করার প্রকৃত উপায় হচ্ছে সামাজিক নীতিমালার পরিবর্তন সাধন। এর মধ্যে তরুণদের ভেবে দেখা উচিত যে, পরে তাদেরও বিয়ে করার মতো অবস্থা আসবে। অতএব যা সুখী বিবাহকে অসম্ভব করে তুলতে পারে এমনভাবে জীবন কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ এ থেকে বিপদ সহজেই ঘটে যেতে পারে স্নায়ু অবসন্ন হলে। তখন বিয়ে করাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে।

স্নায়বিক অবসাদের সবচেয়ে খারাপ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা ব্যক্তি এবং বাইরের জগতের মধ্যে একটা আবরণ টেনে দেয়। বাইরের পৃথিবীর ধারণা তার কাছে পৌঁছায় অপূর্ণ, অস্বচ্ছ এবং পরিবর্তিতরূপে। তিনি তখন অন্য কোনও ব্যক্তিকে সহ্য করতে পারেন না, আহারে তৃপ্তি পান না, সূর্যালোকে আনন্দ পান না। সামান্য কয়েকটি জিনিসের প্রতি তার তীব্র মনোযোগ থাকে। অন্য সব কিছুর প্রতি তিনি উদাসীন। ফলে অবসাদ ধীরে ধীরে বেড়েই চলে এবং একসময় তা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, তখন তার চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয় এ সবই পূর্ব অধ্যায়ে আলোচিত, পৃথিবীর সাথে শূন্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কের শাস্তি। কিন্তু আমাদের বর্তমান নগরাঞ্চলে যেভাবে জন-বিস্ফোরণ ঘটছে তাতে মাটির সাথে কী করে সংযোগ রক্ষা করা যাবে তা ভেবে পাওয়া সহজ নয়। যাই হোক, এখানে আবার আমরা সেই বিশাল সামাজিক সমস্যার কাছাকাছি চলে এসেছি যা নিয়ে এই গ্রন্থে কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই।

 ০৬. ঈর্ষা

দুশ্চিন্তার পরেই অসুখী হওয়ার এক শক্তিশালী কারণ সম্ভবত ঈর্ষা। আমার বলা উচিত এই ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা মানুষের সর্বাপেক্ষা সনাতন এবং গভীরতম ক্রোধ-প্রবৃত্তির অন্যতম। বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে শিশুদের এটি খুব বেশি চোখে পড়ে এবং প্রত্যেক শিক্ষাদানকারীর উচিত এই প্রবৃত্তিকে খুব স্নেহময় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা। একটি শিশুকে বঞ্চিত করে অন্য এক শিশুর প্রতি সামান্য পক্ষপাতও সাথে সাথে তার চোখে পড়ে এবং তাতে সে রেগে যায়। যারা শিশুদের দেখাশোনা করেন, তাদের চরম, কঠোর, অপরিবর্তিত এবং সমভাগে বণ্টনযোগ্য ন্যায়বিচারের পথে চালিত হতে হবে। কিন্তু ঈর্ষা ও বিদ্বেষ (বিদ্বেষ ঈর্ষারই বিশেষ এক রূপ) বিষয়ে শিশুরা বড়দের তুলনায় একটু বেশি খোলামেলা। এই আবেগ শিশুদের মধ্যে যেমন বড়দের মধ্যেও একই রকম দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ পরিচারিকাদের কথা বলা যায়। আমার মনে পড়ে একজন বিবাহিতা পরিচারিকা গর্ভধারণ করার পর আমরা বলেছিলাম সে কোনও ভারী জিনিস তুলুক, আমরা তা চাই না। তার অব্যবহিত ফল দেখা গেল অন্যসব পরিচারিকারাও ভারী জিনিস তোলা বন্ধ করে দিল। তখন সেরকম কাজের দরকার হলে আমাদের নিজেদেরই তা করে নিতে হত। ঈর্ষা হল গণতন্ত্রের ভিত্তি। হেরাক্লিটাস(১) বলেন এফেসাসের নাগরিকদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। কারণ তারা বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে কেউ প্রথম স্থানীয় হবে না। গ্রীকরাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনই প্রায় এই ক্রোধ-প্রবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। আধুনিক গণতন্ত্র সম্বন্ধেও একথা সত্যি। তবে একটি আদর্শবাদী মতবাদ রয়েছে, যার মতে গণতন্ত্রই হল আদর্শ রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থা। আমি নিজে এই মতবাদকে সত্যি বলে মনে করি। কিন্তু ব্যবহারিক রাজনীতিতে এমন কোনও বিভাগ নেই, যেখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্যে আদর্শবাদী মতবাদ যথেষ্ট শক্তিশালী। যখন বড় কোনও পরিবর্তন ঘটে যায়, তখন তাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যে যেসব মতবাদ দেখা দেয় তা সবসময় ছদ্মবেশী মানসিক চাঞ্চল্য। মাদাম রোলার স্মৃতিকথা পড়ে দেখুন, যিনি বারংবার জনসেবায় উদ্বুদ্ধ মহিয়সী নারীরূপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেখা যাবে যা তাকে এমন উদ্দীপ্ত গণতন্ত্রীতে পরিণত করেছিল তা হল অভিজাত বাসগৃহ দেখার পর তার ভৃত্যদের বাসস্থান দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা।

সাধারণ সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জীবনে ঈর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

যখন ভূগর্ভস্থ রেলে বসে থাকেন তখন পাশ দিয়ে যদি কোনও সুসজ্জিতা মহিলা চলে যান, তখন অন্য মহিলাদের চোখের দিকে তাকাবেন, দেখবেন তাদের নিজেকে সম্ভবত আরো ভালরূপে সজ্জিতা দুচারজন ছাড়া সেই পাশ কাটানো মহিলার প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে এবং নানাভাবে তার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। এই সাধারণ ঈর্ষার একটি রূপ হচ্ছে কুৎসার প্রতি আসক্তি। অন্য নারী সম্পর্কে যে কোনও কুৎসা, তুচ্ছ প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও সাথে সাথে বিশ্বাস করা হয়। উন্নত নীতিজ্ঞানও একই উদ্দেশ্যসাধন করে। যারা ঘটনাক্রমে এর বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলে, তাদের ঈর্ষা করা হয় এবং তাদের অন্যায়ের জন্যে শাস্তি প্রদানকে পূণ্য কাজ বলে মনে করা হয়। এই বিশেষ ধরনের পূণ্য নিশ্চয় নিজেরই পুরস্কার।

ঠিক একই জিনিস আবার দেখা যাবে পুরুষদের মধ্যেও। পার্থক্যটা শুধু এই যে নারীরা অন্য সব নারীকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবে, কিন্তু পুরুষরা একই পেশাজীবী হলে তবেই পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। এইটাই সাধারণ নিয়ম। পাঠক, আপনি কখনো অবিবেচকের মতো এক চিত্রশিল্পীর কাছে অন্য শিল্পীর প্রশংসা করেছেন? আপনি কী কখনো একই দলের একজন রাজনীতিবিদের প্রশংসা অন্য রাজনীতিবিদের কাছে করেছেন? যদি করে থাকেন, তা হলে শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রে আপনি বিদ্বেষের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। লেবনিজ(২) এবং হাইজেনসের(৩) মধ্যে যেসব পত্র বিনিময় হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি চিঠিতে দেখা যায় নিউটনের(৪) মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। এই অনুমান থেকে অনেক দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা পরস্পরকে লিখেছে ‘মিঃ নিউটনের মতো অতুলনীয় প্রতিভার বিচার ক্ষমতা আচ্ছন্ন হয়ে পড়া কি পরিতাপের বিষয় নয়? এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তি একের পর এক চিঠিতে স্পষ্টতই বিষয়টি মনে মনে উপভোগ করেছেন এবং কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন। বাস্তবক্ষেত্রে যে ঘটনা নিয়ে তারা শোকের ভণিতা করেছেন, তা ঘটেইনি, যদিও নিউটনের কিছু খামখেয়ালি আচরণ এই ধরনের গুজবের জন্ম দিয়েছিল।

সাধারণ মানুষের সবরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঈর্ষা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। ঈর্ষান্বিত লোক শুধু যে অন্যের ওপর দুর্ভাগ্য চাপাতে চায় তা নয়, সুযোগ পেলে চাপিয়ে দেয় এবং সে নিজেও ঈর্ষায় অসুখী হয়। নিজের যা আছে তা থেকে আনন্দলাভ না করে অন্যের যা আছে তা নিয়ে দুঃখ পায়। সে অন্যের যেসব সুবিধা ভোগ করছে, সম্ভব হলে তা থেকে বঞ্চিত করে। অথচ যেসব সে নিজে পেলে তা তাদের মতোই তার কাছে কামনীয় হত। যদি এই মনোবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তা সকল সৌন্দর্যের পক্ষে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এমনকী বিশেষ দক্ষতার সফল প্রয়োগেও। শ্রমিক যখন পায়ে হেঁটে তার কাজে যায় তখন চিকিৎসক রোগী দেখতে গাড়িতে যাবেন কেন? যেখানে সকলে প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাস করছে তখন বিজ্ঞান গবেষককে কেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বাস করতে দেওয়া হবে? কেন বিশ্বের পক্ষে মূল্যবান এবং দুর্লভ জ্ঞানের অধিকারী কোনও ব্যক্তিকে গৃহকর্মের ভাবনা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে? ঈর্ষা এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে মানুষের স্বভাবে একদিকে কিছুর অভাব থাকলে অন্যদিকে তার পরিপূরক কিছু থাকে, যেমন প্রশংসার মনোবৃত্তি। যিনি মানবজাতির সুখবৃদ্ধি কামনা করেন, তার উচিত প্রশংসা বাড়ানো এবং ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা কমানো।

কিন্তু ঈর্ষার প্রতিষেধক কি? সন্তদের কাছে স্বার্থত্যাগরূপ প্রতিষেধক আছে। যদিও তাদের ভিতর এক সন্ত অন্য সন্তকে ঈর্ষা করছেন এমনটা অসম্ভব নয়। বহু বছর ধরে উচ্চ স্তম্ভে বাস করে সেন্ট সিমিয়ান স্টাইলাইটস যদি শুনতেন অন্য কোনও সন্ত আরো দীর্ঘদিন এবং আরো সরু কোনও স্তম্ভে বাস করছেন তা হলে সম্পূর্ণ খুশী হতেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। সন্তদের কথা থাকুক, সাধারণ নর-নারীর পক্ষে ঈর্ষার একমাত্র ওষুধ হচ্ছে সুখ লাভ করা। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এই যে ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা নিজেই সুখের পথে একটি মারাত্মক বাধা। শৈশবের দুরবস্থা ঈর্ষাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। যে শিশু দেখে তাকে ছেড়ে তার কোনও ভাই বা বোন বেশি আদর পাচ্ছে তখন থেকে সে ঈর্ষা করতে শেখে। সে যখন বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে আসে, তখন সেইসব অবিচার খুঁজে বেড়ায়, যা তার প্রতি হওয়া সম্ভব। যদি অবিচার হয়, সাথে সাথে তা তার চোখে পড়ে। যদি তা না হয়, তাহলে সেই অবিচার নিয়েই সে কল্পনা করে, এমন লোক তো অসুখী হবেই।

সে বন্ধুদের কাছেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কারণ কোন সময় কল্পনাজাত অবহেলা এড়িয়ে চলার কথা সে মনে রাখতে পারে না। কেউ তাকে পছন্দ করছে না, সেকথা সে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে প্রথমে। পরে সে বিশ্বাসকে নিজের ব্যবহারের সাহায্যে সত্যি করে তোলে। শৈশবের আরেকটি দুর্ভাগ্য হচ্ছে যেসব পিতামাতার বাৎসল্যবোধ কম তাদের সন্তান হওয়া। এই অবস্থায় নিজের বাড়িতে আদরের কোনও ভাইবোন না থাকলেও অন্য পরিবারের বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের তার চেয়েও বেশি আদর করছে দেখতে পারে। এতে শিশুদের প্রতি তার ঘৃণা জন্মাবে, নিজের বাবা-মার ওপরও এবং বড় হলে তার অবস্থা বাইবেলে বর্ণিত ইসমাইলের মতো হয়েছে মনে হবে। কোনও কোনও রকম সুখ প্রত্যেকের স্বাভাবিক জন্মগত অধিকার। তা থেকে বঞ্চিত হওয়া তাকে মানসিকভাবে বিকৃত আর বিষাক্ত করে তোলে।

কিন্তু ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি বলতে পারে, আমাকে এসব কথা বলে কী লাভ যে, সুখ হল ঈর্ষার প্রতিষেধক। আমি যতক্ষণ ঈর্ষা বোধ করি ততক্ষণ সুখের সন্ধান পাই না, আর তুমি বলছ সুখ না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঈর্ষা হতে বিরত হতে পারব না। কিন্তু বাস্তব জীবন এত যুক্তির ধার ধারে না। ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার কারণগুলি যদি জানতে পারা যেত, তাহলে এই রোগটি সারাবার পথে অনেক অগ্রগতি হত। কোনও তুলনার ভাষায় চিন্তা করার অভ্যাস ভয়ানক। যদি সুখদায়ক কিছু ঘটে তা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা উচিত, তখন ভাবা উচিতই নয় যে, অন্য কোনও লোক হয়তো এমন সুখ উপভোগ করে যা এর তুলনায় বেশি। ঈর্ষাকাতর লোকটি বলবে, “ঠিক কথা, রোদে ভরা উজ্জ্বল দিন, এখন বসন্তকাল, পাখিরা কুজন করছে, ফুলদল বিকশিত; কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সিসিলির বসন্ত এর চেয়ে সহস্র গুণ বেশি মনোরম। সেখানে হেলিকনের কুঞ্জবনে পাখিদের গান আরও মধুর এবং শারণের গোলাপ আমার বাগানের যে কোনও গোলাপের চেয়ে আরও বেশি মনজুড়ানো। এসব ভাবতে ভাবতে ঈর্ষাকাতর লোকটির মনের আকাশে সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়, পাখির গান অর্থহীন কোলাহলে পরিণত হয়, ফুলগুলির দিকে আর তাকাতে ইচ্ছা করে না। এইভাবে জীবনে সব আনন্দকে সে দূরে ঠেলে দেয়। সে ভাবে, আমার প্রেমিকা খুব সুন্দরী, আমরা পরস্পরকে কত ভালবাসি, কিন্তু শেবার রাণি কী অপরূপাই না ছিলেন! হায়রে সলোমন যেসব সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি যদি তা পেতাম!’ এই ধরনের সব তুলনা অর্থহীন এবং নির্বুদ্ধিতা। শেবার রাণি হোক অথবা পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হোক, যদি আমাদের অতৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে উভয়ক্ষেত্রেই সে কারণ সমান মূল্যহীন। বুদ্ধিমান অন্যের কী আছে আর কী নেই তা নিয়ে ভেবে নিজের আনন্দকে নষ্ট করে না। প্রকৃতপক্ষে ঈর্ষা এক ধরনের অন্যায়, যার কিছু অংশ নৈতিক, কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক। ঈর্ষার নিজের কোনও রূপ নেই, শুধু তুলনার সাহায্যে তাকে অনুভব করা যায়। মনে করুন আমি যে বেতন পাচ্ছি তা আমার প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর। যাতে আমার তৃপ্ত থাকা উচিত। কিন্তু আমি জানতে পারলাম, এমন একজন, যে আমার চেয়ে কোনও দিকেই বড় নয়, সে আমার দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ আমি যদি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ি তা হলে আমি যা পাচ্ছি যা আমার তৃপ্তিদায়ক হওয়া উচিত, তা ম্লান হয়ে গেল এবং আমার ওপর অবিচারের ধারণা আমাকে ক্ষয় করতে শুরু করল। এসবের যথাযথ প্রতিকার হচ্ছে মানসিক শৃঙ্খলা এবং অর্থহীন চিন্তা করার অভ্যাস ত্যাগ করা। মূল কথা হচ্ছে, সুখ অপেক্ষা ঈর্ষা করার মতো বড় কিছু নেই। যদি আমি ঈর্ষাকে দূর করতে পারি তাহলে আমি সুখকে পেয়ে যাব এবং তখন আমি হব ঈর্ষার পাত্র। যে ব্যক্তি আমার চেয়ে দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন। এই চিন্তার কোনও শেষ নেই। যদি আপনি গৌরব চান তা হলে হয়তো নেপোলিয়নকে(৬) ঈর্ষা করবেন। কিন্তু নেপোলিয়ন সীজারকে(৭) ঈর্ষা করতেন। সীজার করতেন আলেকজান্ডারকে(৮) এবং নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আলেকজান্ডার ঈর্ষা করতেন হারকিউলিসকে(৯)। যার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। অতএব একমাত্র সাফল্যের দিক থেকে আপনি ঈর্ষাকে এড়াতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসে অথবা পূরাণে সব সময় এমন লোক পাওয়া যাবে যিনি আপনার চেয়ে বেশি সফল। আপনি ঈর্ষা থেকে দূরে থাকতে পারেন। যদি যে আনন্দ আপনার কাছে আসবে, তা উপভোগ করেন, যে কাজ আপনার করা উচিত তা করেন অহেতুক যাদের আপনি বেশি সৌভাগ্যবান মনে করেন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা না করেন।

অপ্রয়োজনীয় বিনয়ের সঙ্গে ঈর্ষার সম্পর্ক গভীর। বিনয়কে একটি গুণ বলেই মনে করা হয়। কিন্তু আমার নিজের সন্দেহ খুব বেশি, বিনয়ের বাড়াবাড়ি হলে তাকে আর গুণ বলা যায় কিনা। বিনয়ী লোকের মনে বিশেষ প্রত্যয় জাগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। তারা সার্থকভাবে পারবেন এমন কাজ শুরু করতেও সাহস পান না। বিনয়ীদের বিশ্বাস, তারা যাদের সঙ্গে সাধারণভাবে মিশে থাকেন, তারা সব বিষয়েই বড়। তাই তারা বিশেষভাবে ঈর্ষার শিকার হন, যার জন্যে তাদের মনে ঈর্ষা থেকে অতৃপ্তির জন্ম হয়। আমি মনে করি, কোনও বালককে বড় করে তোলার সময় সে যে খুব ভাল, এই কথাটা বলার পক্ষে অনেক কিছু আছে। আমার মনে হয় না কোনও ময়ুর তার পুচ্ছের জন্যে অন্য ময়ুরকে ঈর্ষা করে, কারণ প্রত্যেকটি ময়ুর মনে করে তার পুচ্ছই পৃথিবীতে সুন্দরতম। এর ফলেই ময়ুরেরা শান্তিপ্রিয় বিহঙ্গ। কল্পনা করুন, কোনও ময়ুরকে শেখানো হল, নিজেকে নিয়ে সুন্দর ভাবনা অন্যায়, তা হলে সে অন্য ময়ুরকে পেখম মেলতে দেখামাত্র নিজেকে বলত, “আমি কিছুতেই কল্পনা করব না যে, আমার পেখম ওর চেয়ে সুন্দর, কারণ তা হবে আত্ম-অহংকার। কিন্তু হায়, তাহলে তো আমি ওর মতো সুখী হতাম। ঐ জঘন্য পাখিটা নিজের সৌন্দয্য সম্বন্ধে এতটা আত্মবিশ্বাসী! ওর কটা পালক যদি ছিঁড়ে দিই, তাহলে আর তুলনার কোনও ভয় থাকবে না। সম্ভবত সে তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে এবং প্রমাণ করবে যে এটি একটি খারাপ ময়ুর, যে অময়ুরোচিত আচরণের অপরাধে দোষী এবং সে তাকে ময়ুরদের নেতৃমণ্ডলীর অধিবেশনে অভিযুক্ত করবে। ক্রমে সে এই নীতি প্রতিষ্ঠা করবে যে, বিশেষভাবে সুন্দর পুচ্ছধারী ময়ুরেরা প্রায় সবসময় খারাপ হয় এবং ময়ুররাজ্যের জ্ঞানী শাসকদের উচিত ঝুলে পড়া বিশীর্ণ পালকধারী নিরহংকার ময়ুরকেই ভাল ময়ুর বলে নির্বাচন করা। এই নীতি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার পর সে সুন্দর শ্রেষ্ঠ সব ময়ুরদের একসাথে করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সুন্দর ময়ুরদের মনোহরণ পুচ্ছ অতীতের এক অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে যাবে। নীতিধর্মের ছদ্মবেশে এই হচ্ছে ঈর্ষার জয়লাভ। কিন্তু যেখানে প্রত্যেক ময়ুর নিজেকে অন্যের চেয়ে বেশি সুন্দর মনে করছে, সেখানে এইসব দমননীতির কোনও প্রয়োজন নেই। প্রতিযোগিতায় প্রত্যেকটি ময়ুর প্রথম পুরস্কার পেতে আশা করে এবং প্রত্যেকেই সেখানে তার নিজের ময়ুরীকে মূল্যবান মনে করে। তাই সে বিশ্বাস করে প্রথম পুরস্কার সেই পেয়েছে।

ঈর্ষা অবশ্যই প্রতিযোগিতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যে সৌভাগ্য আমাদের নাগালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে কখনো আসবে না তাকে আমরা ঈর্ষা করি না। যে যুগে সামাজিক স্তরভেদ ঈশ্বরের বিধান বলে নির্ণীত হয়ে গেছে, সেই যুগে ধনী দরিদ্রের ভেদকেও ঈশ্বরের বিধান বলে মান্য করার বাধ্যতা চলে এসেছে। সেখানে দরিদ্ররা ধনীদের ঈর্ষা করে না, ভিক্ষুকরা কোটিপতিদের ঈর্ষা করে না। কিন্তু অন্য ভিক্ষুকরা যদি সাফল্য লাভ করে, তাহলে অবশ্যই তাদের ঈর্ষা করবে। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক অবস্থানের অস্থায়িত্ব এবং গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের

সাম্যনীতিতে ঈর্ষার পরিসর অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান মুহূর্তে এটি ক্ষতিকর। কিন্তু আরো ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থায় পৌঁছাবার জন্যেই এই অন্যায়কে সহ্য করে যেতে হবে। অসম ব্যবস্থাকে যুক্তি দিয়ে দেখলে তাকে অন্যায় বলেই মনে হবে যদি অবশ্য সেই অসমতা গুণের উৎকর্ষের ওপর না দাঁড়ায়। যখনি তাকে অন্যায় বলে দেখা হবে তখন সে ঈর্ষার জন্ম হবে তার প্রতিকার সেই অন্যায় দূর না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। সুতরাং আমাদের যুগে ঈর্ষা এক অদ্ভুত রকম ভূমিকা পালন করছে। দরিদ্র ধনীকে ঈর্ষা করে, দরিদ্রতর জাতিরা ধনী জাতিদের ঈর্ষা করে, নারী ঈর্ষা করে পুরুষদের, সতী নারীরা ঈর্ষা করে অসতীদের, তারা শাস্তি পাচ্ছে না বলে। যদিও এই কথাটাই সত্যি যে ঈর্ষা বিভিন্ন শ্ৰেণী, বিভিন্ন জাতি ও নারী পুরুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক শক্তি। একই সাথে একথাও সত্যি যে ঈর্ষার ফলে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা হয়, তা কিন্তু ভাগ্যহীনদের সুখ বাড়ায় না। যেসব আবেগ ব্যক্তিজীবন নষ্ট করে দেয়, তা সমাজজীবনও নষ্ট করে দেয়। একথা মনে করা অনুচিত যে ঈর্ষার মতো ক্ষতিকর কিছু থেকে ভাল ফল পাওয়া যাবে। সুতরাং যারা আদর্শবাদী নীতির কারণে সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বৃদ্ধি কামনা করেন তাদের অবশ্যই আশা করা উচিত যে, ঈর্ষা ছাড়া অন্য কোনও শক্তিই হবে সেই পরিবর্তনের যন্ত্র।

সব খারাপ জিনিসের মধ্যেই পরস্পর একটা যোগসূত্র থাকে এবং একটি খারাপ থেকে অন্য একটি খারাপের জন্ম হতে পারে। সাধারণভাবে দেখা যায় অবসাদ ঈর্ষার একটি কারণ। যখন নিজের কাজ শেষ করার পক্ষে নিজের শক্তিকে অপ্রতুল মনে হয় তখন সাধারণভাবে তার মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, তাদের প্রতি ঈর্ষা জেগে উঠবেই। ঈর্ষা কমানোর একটা সহজ উপায় হচ্ছে তাই অবসাদ কমানো। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে এমন একটা জীবন বেছে নেওয়া যা প্রবৃত্তিকে সুখজনক করে তোলে। যে ঈর্ষা স্বাভাবিক পেশাজাত বলে মনে হয় এমন অনেক ঈর্ষার বাস্তব উৎস হল যৌনতা। বিবাহিত জীবন সুখের হলে এবং মনের মতো সন্তান পেলে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সন্তানকে উপযুক্তভাবে মানুষ করার মতো প্রচুর সংস্থান থাকবে, ততক্ষণ সে অন্য লোকদের তার অতিরিক্ত বৈভব বা সাফল্যের জন্যে ঈর্ষা করবে না। মানুষের সুখের উপকরণগুলি এতই সাধারণ যে, ভদ্রলোকরা তা স্বীকার করতে চান না যে তাদের অভাব কীসের। যে কোনও সুসজ্জিতা রমণীকে দেখলেই যেসব রমণী ঈর্ষিত দৃষ্টিতে তাকান তাদের কথা আগেই বলেছি। তারা যে তাদের সহজ প্রবৃত্তিজাত জীবনধারায় সুখী নন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রবৃত্তিজাত সুখ ইংরেজিভাষী মানুষের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে খুব দুর্লভ। এই ব্যাপারে সভ্যতা মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে। ঈর্ষা কমাতে হলে তার কারণ খুঁজে বের করতেই হবে এবং যদি কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে আমাদের সভ্যতার জন্যে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে, যা থেকে উৎপন্ন ঘৃণিত উন্মত্ততায় ধ্বংস হয়ে যাবে সেই সভ্যতা। প্রাচীনকালে লোকে শুধু তাদের প্রতিবেশীদের ঈর্ষা করত, কারণ তাদের পরিচিতের সেই ছিল সীমা। এখন শিক্ষা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিকে না চিনেও বৃহত্তর মানবসমাজ তাদের কাছে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠে। ছায়াছবির মাধ্যমে ধনীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তারা জানতে পারে বলে মনে করে। সংবাদপত্র তাদের বিদেশী জাতির অসভ্যতা সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়। প্রচারের মাধ্যমে যাদের চামড়ার রং তাদের চেয়ে আলাদা তাদের নোংরা কার্যকলাপের কথাও তারা জানতে পারে। হলুদ জাতি ঘৃণা করে সাদাদের, সাদা কালোদের এবং এইভাবেই চলতে থাকে। বলা যেতে পারে এসব প্রচারের কুফলজাত। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় কোনও গভীরতা নেই। প্রচার কেন বন্ধুত্বের মনোভাব তৈরী না করে, ঘৃণা সৃষ্টিতে অধিকতর সাফল্য লাভ করে? এর স্পষ্ট কারণ হচ্ছে মানুষের মনকে বর্তমান সভ্যতা যেভাবে তৈরী করেছে তাতে সে বন্ধুত্বের চেয়ে ঘৃণার দিকেই বেশি করে ঝুঁকে পড়েছে। সে ঘৃণাপ্রবণ কারণ সে অতৃপ্ত, কারণ সে গভীরভাবে অনুভব করে সম্ভবত নিজের অজান্তে সে কোনও কারণে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত অন্যেরা আমাদের ঠকিয়ে প্রকৃতির দান, মানুষের সব আনন্দ উপভোগের ভাল ভাল জিনিসগুলি নিয়ে নিয়েছে। আধুনিক মানুষ যেসব সুখ ভোগ করে সেসবের আসল সমষ্টি আদিম যুগের সমাজে যেসব সুখ দেখা যেত তার চেয়ে সন্দেহাতীতভাবে অনেক বেশি। কিন্তু তা আরও কত বাড়ানো যেতে পারে সেই চেতনাই যেন বেশি তাদের মধ্যে। সন্তানদের নিয়ে যখনই পশুশালায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে, তখনই আপনি যেসব বানর ব্যায়ামের কসরত দেখাচ্ছে না বা বাদাম ভেঙে মুখে দিচ্ছে না তাদের চোখে এক অদ্ভুত অব্যক্ত বেদনা দেখতে পাবেন। আপনি কল্পনা করতে পারেন তারা ভাবছে তাদের মানুষ হয়ে জন্ম। নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তার রহস্য উদ্ধার করতে পারছে না। বিবর্তনের পথে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জ্ঞাতিরা এগিয়ে গেছে তারা পড়ে রয়েছে পিছনে। সভ্য মানুষের সত্ত্বাও একইরকম, পশুশালায় বানরের মতোই পীড়িত ও বেদনাহত। সে বুঝতে পারে প্রায় তার নাগালের মধ্যেই তার চেয়ে ভাল কিছু রয়েছে, কিন্তু সে জানে না কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াবে, কীভাবেই বা তাকে লাভ করবে। নৈরাশ্যে আক্রান্ত হয়ে সে তারই মতো পথহারা এবং অসুখী মানুষদের ওপর রেগে যায়। বিবর্তনের পথে চলতে চলতে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি যেটি অন্তিম পর্যায় নয়। এই পর্যায়কে আমাদের অতিক্রম করে যেতে হবে অতি দ্রুত, কারণ যদি আমরা তা না পারি তাহলে আমাদের অধিকাংশ মধ্যপথে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অবশিষ্টেরা সন্দেহ আর ভয়ের অরণ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং ঈর্ষা অশুভ হলেও-এর ফল ভয়ানক হলেও সম্পূর্ণরূপে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে নয়। এটি আংশিকভাবে একটি বীরসুলভ বেদনার প্রকাশ, এই বেদনা তাদের অন্ধরাত্রে পথ চলা আরো ভাল বিশ্রামের স্থান পেতে অথবা মৃত্যু আর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। এই নৈরাশ্যের মধ্যে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে হলে সভ্য মানুষ তার হৃদয়কে উদার করবে। যেমন সে করেছে তার মনকে। নিজেকে অতিক্রম করার শিক্ষা তাকে শিখে নিতে হবে এবং তা করতে গিয়ে তাকে জেনে নিতে হবে সমগ্র বিশ্বের মুক্তির পথ।

———
১. হেরাক্লিটাস্, Heraclitus (খ্রিঃ পূঃ ৫৩৫-৪৭৫), প্রাচীন গ্রীসের বস্তুবাদী, অজ্ঞেয় এবং অলৌকিক তত্ত্বের বিরুদ্ধবাদী দার্শনিক।

২. লেবনিজ, Leibniz Gottfried (১৬৪৬-১৭১৬)। জার্মান গণিতবিদ, পদার্থবিদ্যা এবং দর্শনেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

৩. হাইজেনস, Christian Huygens (১৬২৯-১৬৯৫)। জন্ম নেদারল্যান্ডে। বিখ্যাত পদার্থ এবং গণিতবিদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তাঁর অবদান অসামান্য।

৪. নিউটন, Sir Issac Newton (১৬৪২-১৭২৭), বস্তুজগতের ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের আবিষ্কারক। তাঁকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

৫. সেন্ট সিমিয়ান স্টাইলাইটস, St Simeon stylites (খ্রিঃ পূঃ ৩৯০-৪৯৫), সিরিয়ার সিসানে জন্ম। সিরিয়ার আলেপ্লেতে একটি স্তম্ভের ওপর উপবিষ্ট হয়ে একইভাবে ৩৭ বছর সাধনা করেছিলেন।

৬. নেপোলিয়ন, পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

৭. সীজার, Julias Caesar (খ্রীঃ পূঃ ১০২-৪৪), রোমের অদ্বিতীয় বীর জুলিয়াস সীজার। ইতিহাসে তাঁর মতো চরিত্রের দেখা খুব কম মেলে।

৮. আলেকজান্ডার, Alexander (খ্রীঃ পূঃ ৩৫৬-৩২৩), বিশ্বের দিগ্বিজয়ীদের তালিকায় প্রথম নাম–Alexander the Great।

৯. হারকিউলিস, Hercules, গ্রীক পূরাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। গ্রীক পুরাণে তাকে উপদেবতার (Demigod) মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

০৭. পাপের চেতনা

পাপের চেতনা সম্পর্কে প্রথম অধ্যায়ে কিছু আলোচনার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। এবার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মূলগত মনস্তাত্ত্বিক কারণে অসন্তোষ দেখা দেয়, পাপের চেতনা তাদের মধ্যে অন্যতম।

পাপ নিয়ে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় মানসিকতা একটা রয়েছে, কিন্তু কোনও আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদ তা স্বীকার করেন না। মনে করা হত, বিশেষভাবে প্রোটেস্ট্যান্টরা, কেউ কোনও কাজ করতে প্রলুব্ধ হলে, বিবেকই তাকে বলে দেয় কোন্ কাজ পাপময়। সে কাজ শেষ হলে তার দুটি বেদনাদায়ক অনুভূতি হয়– প্রথমটি হচ্ছে মর্মবেদনা, যার কোনও মূল্য নেই; অপরটি হচ্ছে অনুশোচনা, যা তার পাপকে মুছে ফেলতে পারে। প্রোটেস্ট্যান্ট দেশসমূহে যারা এই মতবাদে বিশ্বাস হারিয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেক কমবেশি পরিবর্তন করে পাপ বিষয়ে রক্ষণশীল মতটি গ্রহণ করেছে অবশ্য কিছুকালের জন্যে। আমাদের কালে অংশত মনঃসমীক্ষার ফলে সব বিপরীত হয়ে গেছে। অরক্ষণশীলরাই যে শুধু প্রাচীন পাপ-তত্ত্ব মানেন না তা নয়, যারা এখনো নিজেদের রক্ষণশীল বলে বিশ্বাস করেন তারাও অনেকে মানেন না। বিবেককে এখন আর কোনও রহস্যময় কিছু বলে মনে করা হয় না। কারণ এতদিন তা রহস্যময় ছিল বলেই ঐশীবাণী বলে মনে করা হত। আমরা জানি যে বিবেক বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করে এবং উদারভাবে বলতে গেলে সব জায়গায় উপজাতিদের সংস্কৃতির সাথে তা অঙ্গাঙ্গী জড়িত, তা হলে কোনও ব্যক্তিকে যখন বিবেক দংশন করে তখন প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে?

‘বিবেক’ শব্দটি স্বাভাবিকভাবে কয়েকটি আলাদা অনুভূতির অর্থবোধক, যার সহজতমটি হচ্ছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। পাঠক, আপনি নিশ্চয় সম্পূর্ণ দোষহীন জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু আপনি যদি এমন কোনও মানুষের কাছে জানতে চান, যিনি কোনও সময় এমন অন্যায় কিছু করেছেন ধরা পড়লে যার শাস্তি হত। ধরা পড়া অবধারিত জানলেও অন্যায় কাজের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন। আমি বলি না যে পেশাগত চোর সম্বন্ধেও একথা মিলে যাবে, কারণ কিছু পরিমাণ কারাবাসকে সে পেশাগত ঝুঁকি হিসাবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু একথা প্রযোজ্য হতে পারে সম্মানিত অপরাধীদের বেলায়। যেমন কোনও ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, যিনি অবস্থার চাপে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অথবা কোনও ধর্মযাজক যিনি প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে ইন্দ্রিয়কে সংযত করতে পারেননি। ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকলে তারা অপরাধের কথা বিস্মৃত হতে পারেন। কিন্তু ধরা পড়লে অথবা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাদের মনে হয় ন্যায়ের পথেই তাঁদের থাকা উচিত ছিল এবং এই ইচ্ছা তাদের পাপের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের মনে প্রখর চেতনা জাগিয়ে তোলে। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ও এই অনুভূতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যে ব্যক্তি তাস খেলায় প্রতারণা করে অথবা প্রতিশ্রুত ঋণ পরিশোধ করে না সে যদি ধরা পড়ে, তাহলে দলবদ্ধ লোকের তিরস্কারের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে নিজের মধ্যে কিছুই খুঁজে পায় না। এ বিষয়ে সে ধর্মসংস্কারক, রাজদ্রোহী বা বিপ্লবীর সাথে তুলনীয় নয়। কারণ তারা মনে করেন বর্তমানে যেভাবে তাদের পরিত্যাগ করছে, আগামীদিন তাদের সেভাবেই শ্রদ্ধা জানাবে। বর্তমানে তাদের ভাগ্যে যাই ঘটুক আগামীদিন তাদের সমর্থন করবে। এই ব্যক্তিবর্গ জনগণের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের অপরাধী মনে করেন না। কিন্তু যারা প্রচলিত নৈতিকতা সম্পূর্ণ স্বীকার করেও তার বিরুদ্ধচারণ করেন, তারা খুবই দুঃখ ভোগ করেন। যদি সমাজ তাদের বহিষ্কৃত করেন এবং এই বিপদের ভয়ে অথবা বিপদ ঘটে গেলে যে দুঃখ পান, তাতে সহজেই তাঁরা মনে করতে পারেন যে তাদের কাজই ছিল পাপ-পূর্ণ।

কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্ববাহী যে পাপের চেতনা তার মূল খুব গভীরে। এই মূল খুঁজতে হবে অবচেতনের ভিতর। জনগণের অননুমোদনের ভয়ে তা চেতনের ভিতর দেখা দেয় না। চেতন অবস্থায় কিছু কাজ পাপরূপে চিহ্নিত হয় কিন্তু অন্তদৃষ্টির সাহায্যে তাকে দেখা যায় না। যখন একজন মানুষ এই ধরনের কাজ করেন তখন তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারেন না। তাঁর ইচ্ছা হয় এইরকম লোক হওয়াই তার উচিত ছিল যিনি পাপ বলে যা বিশ্বাস করেন তা থেকে দূরে থাকতে পারেন। তিনি নৈতিকতার দিক থেকে শুধু তাদেরই শ্রদ্ধা করেন, যাদের অন্তর তিনি পবিত্র বলে মনে করেন। তিনি কমবেশি দুঃখের সাথে বুঝতে পারেন যে তাঁর পক্ষে সন্ত হওয়া সম্ভব নয়। এই সাধুত্ব সম্পর্কে তাঁর যা ধারণা তা সম্ভবত এই যে, তা সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে পালন করা প্রায় অসম্ভব। ফলে একটা পাপবোধ নিয়েই তিনি জীবন কাটিয়ে দেন। মনে করেন যা কিছু মহৎ তা তার জন্যে নয় এবং মনে করেন ভাবাবেগপূর্ণ অনুতাপের মুহূর্তগুলিই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।

প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এর শিকড় লুকিয়ে আছে তার ছ’বছর বয়সের আগে তার জননী ও ধাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া নীতিশিক্ষার মধ্যে। ঐ সময়ের আগেই তিনি শিখেছে শপথ করা অন্যায় এবং যতদূর সম্ভব নারীসূলভ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা ব্যবহার না করা এবং খারাপ লোকেরাই মদ পান করে। ধূমপান উচ্চস্তরের গুণাবলীর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি শিখেছেন মিথ্যা কথা কখনো বলা উচিত নয়। সবার উপরে যৌনাঙ্গ নিয়ে যে কোনওরকম কৌতূহল ঘৃণা কাজ। এইসব তিনি মায়ের মতো বলেই জেনেছেন এবং সেই মতো তার সৃষ্টিকর্তার মত বলেই মনে করেছেন। মায়ের স্নেহভরা ব্যবহার অথবা মা যদি অবহেলা করেন তাহলে ধাত্রীর স্নেহ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ এবং তা লাভ করেছেন যখন পর্যন্ত তিনি নৈতিক-বিধান ভাঙ্গার পাপী বলে পরিচিত হননি। অতএব তিনি সেইসব অস্বচ্ছ আচরণের সাথে যুক্ত হয়েছেন যা তার জননী এবং ধাত্রী অনুমোদন করেন না। ক্রমে তিনি বড় হয়েছেন এবং তাঁর এই নীতি-বিধান কোথায় থেকে এসেছে তা ভুলে গেছেন। আর ভুলে গেছেন এইসব বিধি-বিধান না মানলে তাকে প্রথম জীবনে কী কী শাস্তি পেতে হত। কিন্তু তারপরও তিনি সেসব ছুঁড়ে ফেলে দেননি এবং এসব অমান্য করলে তার ভাগ্যে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে, সেই অনুভূতিও তার নষ্ট হয়নি। এইসব শিশুসুলভ নীতিশিক্ষার অধিকাংশের কোনও যৌক্তিক ভিত্তি নেই এবং এই শিক্ষা এমন যে, সাধারণ মানুষের সাধারণ আচরণে তা প্রয়োগ করাও চলে না। কোনও লোক যদি, যাকে খারাপ ভাষা বলে তা ব্যবহার করে, উদাহরণস্বরূপ যুক্তিপূর্ণ দিক থেকে এমন কথা বলা চলে না যে, সে তেমন ভাষা ব্যবহার করে না তার চেয়ে যে নিকৃষ্ট। তা সত্ত্বেও বাস্তবে প্রত্যেকটি লোক সন্ত সম্পর্কে কল্পনা করতে গিয়ে শপথ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজনীয় গুণ বলে মনে করে। যুক্তির আলোয় দেখলে এটি বুদ্ধিহীনতা ছাড়া অন্য কিছু নয়, মদ এবং তামাক সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। মদ সম্পর্কে দক্ষিণের দেশসমূহে এই মনোভাব দেখা যায় না, বরঞ্চ সেখানে এই মনোভাবে কিছু অপবিত্রতা রয়েছে। কারণ আমাদের প্রভু এবং তার প্রধান শিষ্যরা মদ্যপান করতেন। তামাক সম্পর্কে কোনও ধারণা না রাখাই ভাল, যেহেতু তামাকের ব্যবহার জানার অনেক আগে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তদের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু এখানে যুক্তিপূর্ণ বিচার সম্ভব নয়। তামাক পেলেও কোনও সন্ত তা খেতেন না। এই পর্যবেক্ষণের মূলে রয়েছে, কোনও সন্তের পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব ছিল না যা তাকে আনন্দ দান করতে পারে। এটাই সর্বশেষ বিশ্লেষণ। সাধারণ নীতিবোধের মধ্যে এই তাপসিক উপাদান সবার মনে অচেতনভাবেই প্রবেশ করেছে কিন্তু আমাদের নৈতিকতার বিধানকে যুক্তিহীন করে তুলতে এই বোধ সবদিক থেকেই প্রভাব বিস্তার করেছে। যুক্তিপূর্ণ নৈতিকবোধে যে কোনও লোকের আনন্দ লাভ প্রশংসনীয় এবং এমন কী নিজেরও, যদি না তাকে নষ্ট করতে নিজেকে বা অপরকে একই সাথে সমভারাক্রান্ত বেদনা দেওয়া না হয়। তাপসিকতার ধারণা থেকে যদি আমরা অব্যাহতি পাই, তবে আদর্শ ধার্মিক মানুষ তিনি-ই হবেন, যিনি সবরকম ভাল জিনিস উপভোগ করার অনুমতি দেবেন, যদি না কোনও খারাপ কাজ সেই উপভোগকে লঙ্ঘন করে না যায়। মিথ্যাভাষণের প্রশ্ন আবার তোলা যাক। আমি অস্বীকার করি না পৃথিবীতে মিথ্যার আধিক্য রয়েছে এবং সত্যতা বৃদ্ধি পেলে আমরা আরো উন্নত থাকতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, একথা আমি অবশ্যই অস্বীকার করি এবং আমার মনে হয় প্রতিটি যুক্তিবাদী তা করবেন। একদা গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণকালীন একটি ক্লান্ত খেকশিয়াল দেখেছিলাম যার তখন শেষ অবস্থা। তবুও জোর করে দৌড়াচ্ছে প্রাণের ভয়ে। কয়েক মিনিট পরেই শিকারীদের সাথে দেখা হল। তারা জানতে চাইল আমি শিয়ালটিকে দেখেছি কি না। আমি বললাম, দেখেছি। তারা এরপর প্রশ্ন করল, শিয়ালটি কোন দিকে গেছে। তখন আমি মিথ্যা কথা বললাম। এখানে সত্য উচ্চারণ করলে আমি আরো ভাল লোক হতাম বলে আমি মনে করি না।

কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে শৈশবের নৈতিক শিক্ষা সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়। যদি কোনও কঠোর বাবা-মা কিংবা ধাত্রীর কাছে কোনও শিশু এই বিষয়ে প্রথাগত শিক্ষা পেয়ে থাকে, তা হলে ছ’বছরের মধ্যেই তার মনে যৌনাঙ্গ এবং পাপের যোগাযোগ নিয়ে এমন ধারণা দৃঢ়প্রোথিত হয়ে যাবে যে, জীবনভর সেই শিক্ষা আর বিস্মৃত হবে না। এই বোধ অবশ্য ঈডিপাস কমপ্লেক্সে আরো দৃঢ় হয়, কারণ যে নারীকে সে শৈশবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে তার সঙ্গে সবরকম স্বাধীন যৌনতা অসম্ভব। তার ফলে অনেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নারীকে যৌন সম্পর্কে হীন মনে করে এবং নিজেদের পত্নীরা যদি যৌন-সঙ্গমকে ঘৃণা না করে তবে তাদের সম্মান করতে পারে না। অথচ স্ত্রী যদি কামশীতল হয়, তাহলে সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই সে তৃপ্তির সন্ধান করবে অন্য জায়গায়। তার ক্ষণিকের যৌনতৃপ্তি তাকে অপরাধবোধে বিষাক্ত করে তোলে। তাই সে বিবাহ বা বিবাহ-বহির্ভুত কোনও নারীর সাথেই সম্পর্ক নিয়ে সুখী হতে পারে না। আবার নারীদের বেলায় পবিত্র হওয়ার শিক্ষায় জোর দিলে একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। নারী তখন সংস্কারবোধ থেকেই স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে এবং তা থেকে আনন্দলাভ করতে ভয় পাবে। বর্তমানে অবশ্য এ বিষয়ে পঞ্চাশ বছর আগে নারীর যে অবস্থান ছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে। একথা অবশ্য বলা যায় যে, বর্তমানে শিক্ষিতদের ভিতর পুরুষদের যৌনজীবন আরো বেশি বিকৃত এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে নারীদের পাপবোধের তুলনায়।

খুব ছোটদের যৌনতা বিষয়ে যে প্রাচীন শিক্ষা চলে আসছে তার কুফল নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে একটা ব্যাপক সচেতনতা এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই বিষয়ে পালনীয় সঠিক নিয়ম সরল। শিশু বয়ঃসন্ধিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে, যেই হোক তাকে যৌনতার ব্যাপারে কোনও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যাবে না এবং একই সাথে স্বাভাবিক দৈহিক ক্রিয়া ঘৃণার যোগ্য এমন কোনও ধারণা তার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার সময় যখন এগিয়ে আসবে, তখন মনে রাখতে হবে সেই শিক্ষা যেন যুক্তিপূর্ণ হয় এবং প্রত্যেক বিষয় তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমান গ্রন্থে আমি শিক্ষা বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। এই গ্রন্থে আমি বরং যুক্তিহীন পাপের চেতনা জাগানো অবিজ্ঞজনোচিত শিক্ষা থেকে যে সব কুফল দেখা দেয়, তা বয়স্করা কীভাবে দূর করতে পারে তা নিয়েই বলতে চাই।

পূর্ববর্তী অধ্যায় সমূহে আমাদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এখানেও তাই। সমস্যাটি হল আমাদের সচেতন চিন্তা যে যুক্তিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তার দিকে অবচেতনভাবে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করা। কোনও মানুষের কখনো নিজের মানসিক অবস্থায় ভেসে যাওয়া উচিত নয়। তাতে বারবার এই মুহূর্তে আবার পরক্ষণেই কোনও না কোনও জিনিসে বিশ্বাসের বদল হয়। ক্লান্তিতে, রোগে, মদ্যপানে এবং অন্যান্য কারণে পাপের চেতনা বেড়ে যায় সচেতন ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে বলে। এইসব মুহূর্তে (মদ্যপান করার সময় ছাড়া) মানুষ যা অনুভব করে তা তার নিজের উচ্চতর সত্ত্বার প্রত্যাদেশরূপে মনে করা হয়, “শয়তানটা রুগ্ন ছিল, শয়তানটা সন্ত হয়ে যাবে।” কিন্তু এটা ভাবা অযৌক্তিক যে সবল থেকে দুর্বল মুহূর্তে অতিরিক্ত অর্ন্তদৃষ্টি লাভ হয়। দুর্বল মুহূর্তে শিশুসুলভ সব কল্পনাকে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কিন্তু তার জন্যে প্রাপ্তবয়স্ক লোকের, যে নিজের দক্ষতার ওপর পূর্ণ আস্থাশীল, তার বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে সেই শিশুসুলভ বিশ্বাসকে গ্রহণযোগ্য মনে করার কোনও কারণ নেই। পক্ষান্তরে কোনও ব্যক্তি যদি তার পূর্ণ বিচারশক্তিতে আস্থাশীল হয়ে কিছু বিশ্বাস করে, তাহলে সেই বিশ্বাস তার কাছে সবসময়ের মানদণ্ডরূপে গণ্য হওয়া উচিত। সঠিক কৌশল প্রয়োগ করতে পারলে অবচেতনতার উৎস থেকে উৎসারিত শিশুসুলভ অভিভাবনাগুলিকে দমন করা সম্পূর্ণভাবেই সম্ভব, এমন কী তার আধেয়কেও পরিবর্তন করা যায়। যখনই আপনি, যুক্তি খারাপ ভাবছে না, এমন কাজের জন্যে দুঃখ অনুভব করতে আরম্ভ করবেন, তখনই আপনি দুঃখের যে অনুভূতি তার কারণ কী তা পরীক্ষা করে দেখবেন এবং সেসব যে অবাস্তব তা নিজেকে বিস্তারিতভাবে বোঝাবেন। আপনার সচেতন বিশ্বাস এমন শক্ত এবং জোরালো হবে, যাতে তা আপনার মনের অবচেতনায় ছাপ রেখে যায়, যা আবার এত শক্ত হবে যাতে আপনার শৈশবে জননী বা ধাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ছাপকে অতিক্রম করে যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে একবার যুক্তি এবং পরক্ষণেই আবার অযুক্তির মুহূর্তে ফিরে গিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন না। অযৌক্তিকতাকে কাছ থেকে দেখুন, দৃঢ়সংকল্প হোন যে তাকে আপনি সম্মান করবেন না এবং কোনওভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে দেবেন না। যখন তা আপনার চেতনায় অর্থহীন চিন্তা বা অনুভূতি চাপাতে চেষ্টা করবে তখনই সমূলে তাদের উপড়ে ফেলবেন, তাদের পরীক্ষা করবেন এবং ত্যাগ করবেন। অর্ধেক যুক্তি এবং অর্ধেক শিশুসুলভ বুদ্ধিহীনতার দোলায় নিজেকে দোদুল্যমান প্রাণীর মতো করে তুলবেন না। আপনার শৈশব যারা নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন তাদের স্মৃতির প্রতি যদি অশ্রদ্ধা দেখাতে হয় তার জন্যে ভয় পাবেন না। তারা আপনার কাছে তখন কঠোর এবং জ্ঞানী মনে হয়েছিল। কারণ শৈশবে আপনি দুর্বল এবং বুদ্ধিহীন ছিলেন। এখন আপনি তা নন, তাই আপনার দায়িত্ব অভ্যাসের জোরে যে সম্মান এখনো দেখাচ্ছেন তা তাদের প্রাপ্য কিনা তা বিবেচনা করে দেখার জন্যে তাদের আপাত দৃশ্যশক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে পরীক্ষা করে দেখা। ছোটদের ঐতিহ্য পরম্পরায় যে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে পৃথিবীর কোনও উপকার হয়েছে কিনা এই প্রশ্ন গুরুত্ব সহকারে নিজেকে করুন। ভেবে দেখুন একজন আচার-স্বীকৃত ধার্মিক ব্যক্তির মনন-সৃষ্টিতে কতটুকু বিশুদ্ধ কুসংস্কারের উপকরণ প্রয়োজন হয়েছে এবং আরো ভেবে দেখুন, অবিশ্বাস্য সব নিষেধবিধি দিয়ে কাল্পনিক নৈতিক বিপদসমূহ কীভাবে ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের যেসব বাস্তব বিপদের মুখে পড়ার ভয় আছে তাদের ব্যাপারে কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। কোন্ কোন্ ক্ষতিকর কাজের দিকে সাধারণ লোকের আকর্ষণ থাকে? আইনকে বাঁচিয়ে ব্যবসাতে প্রতারণা, অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রতি রূঢ় আচরণ, স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, প্রতিযোগীদের প্রতি বিদ্বেষ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হিংস্রতা– এইসবই হল সত্যিকারের অন্যায়, যা সম্মানীয় এবং সম্মানিত নাগরিকদের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায়। এইসব অন্যায়ের সাহায্য নিয়েই একজন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশে দুর্দশা বিস্তারিত করে এবং সভ্যতাকে ধ্বংস করার কাজে যতটুকু দেবার তা দিয়ে দেয়। তবুও, এই ধরনের মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু এসব কাজের জন্যে নিজেকে সমাজ পরিত্যক্ত অথবা স্বর্গীয় সুবিধা পাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত মনে করে না। এইসব কাজ তার দুঃস্বপ্নের মধ্যে আনত দৃষ্টিতে তিরষ্কার রত তার মায়ের মূর্তিটি তুলে ধরে না। কেন তার অবচেতন নৈতিকতা যৌক্তিকতা থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন? কারণ শৈশবে সে যাদের হাতে মানুষ হয়েছে তারা যে নৈতিকতায় বিশ্বাসী ছিল তার মধ্যে কোনও যুক্তি নেই। কারণ এই নৈতিকতা সমাজের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্য কী সেই শিক্ষা থেকে জন্ম নেয়নি। কারণ এ হচ্ছে প্রাচীন যুক্তিহীন নিষেধবিধির ছোট ছোট খণ্ড দিয়ে তৈরী। কারণ মরণাপন্ন রোমান সমাজকে যে আত্মিক ব্যাধি পীড়িত করেছিল এর মধ্যেই নিহিত ছিল এর উপাদান। আমাদের নামমাত্র যে নৈতিকতাবোধ তা যাজক এবং মানসিকভাবে দাস মনোবৃত্তির নারীদের তৈরী। সময় এসে গেছে বিশ্বের স্বাভাবিক জীবনে স্বাভাবিক ভূমিকা যাদের গ্রহণ করতে হবে তাদের এই যন্ত্রণাকর এবং বাতিল জিনিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শিক্ষা নেওয়ার।

.

কিন্তু যদি ব্যক্তিগত সুখকে বাড়ানো এবং মানুষকে একই মানে বাস করতে সক্ষম করার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহকে সফল করতে হয়, তাহলে দুই মানের মধ্যে দোলায়িত না হয়ে যুক্তির সাহায্যে যা পাওয়া যায় তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা এবং অনুভব করা প্রয়োজন। অধিকাংশ মানুষই শৈশবের সব কুসংস্কার হালকাভাবে ত্যাগ করে মনে করে তাদের আর কিছু করণীয় নেই। তারা বুঝতেই পারে না যে, সেসব কুসংস্কার এখনো তাদের মনের গভীরে অজ্ঞাতবাস করে রয়েছে। যুক্তির পথে কোন বিশ্বাসে পৌঁছাতে হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত। যাতে তা থেকে কী ঘটতে পারে তা আগেই অনুধাবন করা যায়। নিজের মধ্যেই সন্ধান করা উচিত নতুন বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিকর কোনও পূর্ব বিশ্বাস এখনও বেঁচে আছে কিনা। পাপের চেতনা প্রখর হলে এবং মাঝে মাঝে তা হবেই, তখন তাকে প্রত্যাদেশ বা মহৎ কিছুর জন্যে আহ্বান মনে না করে তাকে একটি রোগ এবং দুর্বলতা বলে মনে করা উচিত। এর ব্যতিক্রম হবে শুধু পাপের চেতনা যেখানে যুক্তিপূর্ণ নীতি দ্বারা নিন্দিত হয় সেখানে। মানুষ নৈতিকতাবর্জিত হোক এমন কোনও পরামর্শ আমি দিচ্ছি না, আমি শুধু বলছি তারা যেন কুসংস্কারজাত নৈতিকতা পরিহার করে। কারণ এটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।

কিন্তু কোনও মানুষ যদি তার নিজের যৌক্তিক বিধান ভঙ্গ করে তার পরেও পাপের চেতনা জীবনকে উন্নততর করার শ্রেষ্ঠ উপায় কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। পাপ-চেতনার মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা হীন। যাতে কোনও আত্মমর্যাদা নেই। আত্মমর্যাদার অভাব কখনো কারো মঙ্গল করেনি। যুক্তিবাদী মানুষ নিজের অবাঞ্ছিত কাজকে, অপরের অবাঞ্ছিত কাজকে যে দৃষ্টিতে দেখে, সেভাবেই দেখবে। যে কাজগুলি ঘটনার কারণে সৃষ্ট এবং তা যে অবাঞ্ছিত, তা ভালভাবে উপলব্ধি করে তাকে এড়াতে হবে, অথবা যেখানে তা সম্ভব তা যেসব ঘটনার কারণে ঘটতে পারে, তা এড়াতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে পাপের চেতনা উন্নত জীবনের সহায়ের কারণ না হয়ে ঠিক তার বিপরীতই হয়। মানুষকে তা অসুখী করে, নিজেকে হীন বলে ভাবতে শিক্ষা দেয়। অসুখী হওয়ার কারণে সে প্রায় হয়তো অন্যদের ওপর অতিরিক্ত দাবি জানাতে থাকে, যা তাদের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি করে। নিজেকে হীন মনে হওয়াতে তার চেয়ে উন্নত লোকদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। তার পক্ষে প্রশংসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ঈর্ষা করা সহজ হয়ে যায়। সে সবার কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। অন্যের প্রতি উন্মুক্ত ও উদার মনোভাব শুধু যে অন্যকেই আনন্দ দেয় তা নয়। যে এর অধিকারী তার জন্যেও পরম সুখের উৎস। এই ধরনের লোক সাধারণত সকলেই পছন্দ করে। কিন্তু পাপের চেতনা যার মনকে অধিকার করে থাকে তার পক্ষে এই ধারণা গড়ে তোলা খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভব। এটা হচ্ছে সুস্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসের ফল। এটা সব মননের সংহতি দাবি করে, যা দিয়ে আমি চেতনার সবগুলি স্তরকে বোঝাতে চাই– চেতন, অবচেতন, অচেতন, সব, যারা একত্রে সম্মিলিতভাবে ক্রিয়া করবে। সব সময় নিজেদের মধ্যে বিরোধিতায় মেতে থাকবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমন্বয় সুচিন্তিত শিক্ষার দ্বারা সম্ভব হয়। কিন্তু শিক্ষা যেখানে জ্ঞানশূন্য, সেখানে এই কাজ খুব কঠিন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন মনোবিশ্লেষকরা। কিন্তু আমার বিশ্বাস প্রায় সব ক্ষেত্রেই রোগীরাই এই কাজ করতে পারে, অবস্থা চরম পর্যায়ে জেনেই বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। একথা বলা উচিত নয়; “আমার এসব মনস্তাত্ত্বিক শ্রম দেওয়ার মতো সময় নেই। আমি ব্যস্ত মানুষ। আমার সময় কাজের মধ্যে ঠাসা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে কাজ করার জন্যে আমি আমার অচেতন মনের ওপর ভার দিলাম।” ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে যে পরিমাণ আনন্দ ও কর্মদক্ষতা নষ্ট করে এমন অন্য কিছু করে না। যে সময় ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন বিভক্ত অংশকে সমন্বয় করার কাজে খাটে, সেটাই হল কার্যকরভাবে সময়-ব্যয়। আমি বলছি না কেউ প্রতিদিন নিয়মি একঘণ্টা সময় আত্মসমীক্ষার জন্যে তুলে রাখুক। আমার মতে এটি শ্রেষ্ঠ উপায় নয় কারণ এতে আত্মসমীক্ষার জন্যে তুলে রাখুক। আমার মতে এটি শ্রেষ্ঠ উপায় নয় কারণ এতে আত্মমগ্নতা বাড়ায় এবং এটাও আরোগ্যযোগ্য ব্যাধির একটা অংশ। সুসমন্বিত ব্যক্তিত্ব সবসময় বহির্মুখী। আমি যা বলতে চাই, তা হল, মানুষ তার মনকে স্থির করবে দৃঢ়তার সাথে, যা সে যৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করে তা নিয়ে। এর বিপরীত অযৌক্তিক বিশ্বাসকে প্রশ্নাতীত চলে যেতে অনুমতি দেবে না অথবা তার ওপর কোনওরূপ প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না, যদি তা ক্ষণকালের জন্যেও হয়। এটা হচ্ছে যুক্তির সাথে নিজের মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্ন। যেসব মুহূর্তে প্রলুব্ধ হতে হয় শিশুর মতো হতে। কিন্তু যুক্তির যদি প্রবল জোর থাকে তাহলে সময় খুব কম লাগে। সুতরাং এই কালক্ষেপণকে অগ্রাহ্য করা উচিত।

অনেক মানুষের কাছে যৌক্তিকতা পছন্দনীয় নয়। যেখানে এই রকম অবস্থা, সেখানে যেসব কথা আমি বলছি তা অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হবে। অনেকের এমন ধারণা রয়েছে যে, যুক্তিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তার মনের গভীরতর সব আবেগকে হত্যা করে। আমার মনে হয় এই বিশ্বাস মানুষের জীবনে যুক্তি স্থান নিয়ে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছে। আবেগ সৃষ্টি করা যুক্তির কাজ নয়। যদিও মানুষের মঙ্গলের পথে বাধা সৃষ্টিকারী আবেগকে খুঁজে বের করা এবং প্রতিহত করা তার কাজের একটা অংশ। যৌক্তিক মনস্তত্ত্বের কাজের অংশ হল সন্দেহাতীতভাবে ঘৃণা এবং ঈর্ষাকে বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করা। এটা একটা ভুল ধারণা যে এইসব আবেগকে কমিয়ে আনার সাথে সাথে যুক্তি নিন্দা করে না এমন সব আবেগের শক্তিও কমিয়ে দেওয়া হয়। আবেগময় ভালবাসায়, বাৎসল্যে, জনহিতকর কাজে, শিল্প অথবা বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠায় এমন কিছু নেই যা যুক্তি কমাতে চাইবে। যুক্তিবাদী মানুষ যখন এইসব আবেগ অনুভব করবে, সে খুশী হবে যে সে এইসব অনুভব করে, যার শক্তি কমানোর কোনও কারণও নেই, কারণ এইসব আবেগ সুন্দর জীবনেরই অঙ্গ, যে জীবন সুখ বয়ে আনে নিজের জন্যে এবং অন্যের জন্যেও। এইসব আবেগের মধ্যে কোন অযৌক্তিকতা নেই এবং অনেক যুক্তিহীন মানুষ শুধুমাত্র গতানুগতিক আবেগগুলি অনুভব করে। কোনও মানুষের ভয় পাওয়ার কারণ নেই যে, সে যদি নিজেকে যুক্তিবাদী করে তোলে তাহলে জীবন আনন্দহীন হয়ে যাবে। বরং যৌক্তিকতা মূলত অভ্যন্তর সমন্বয়ভাবে চিন্তা করতে পারে। সে নিজের শক্তি স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারে। পক্ষান্তরে যে মানুষ অভ্যন্তর দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত সে তা পারে না। নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকার মতো স্বাদহীন আর কিছু নেই। যেমন নেই শক্তি ও মনোযোগ বাইরে ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো আনন্দময় আর কিছু। আমাদের ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতা খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং পাপের চেতনা সম্পর্কে ধারণা এই অজ্ঞানতাজাত আত্মকেন্দ্রিকতারই একটা অংশ। ভুল নৈতিকতার মাধ্যমে সৃষ্ট অবস্থার ভিতর দিয়ে যে মানুষ কখনো পার হয়ে যায়নি, তার কাছে যুক্তি অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু যে একবার অন্তত পাপের চেতনায় রোগগ্রস্ত হয়েছে তাকে সারিয়ে তুলতে যুক্তি প্রয়োজনীয়। মনে হয় মানসিক বিকাশের জন্যে এই রোগের প্রয়োজন রয়েছে। আমার মনে হয় যে মানুষ যুক্তির সাহায্যে এই অবস্থা পার হয়ে গেছে সে একটা উচ্চতর স্তরে উঠে গেছে এবং যে মানুষের এই রোগ এবং তার নিরাময় সম্বন্ধে কোনওটারই অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়নি সে ততটা উচ্চস্থানে উঠতে পারে নি। আমাদের সময়ে যৌক্তিকতার প্রতি ঘৃণা খুবই বিস্তৃত। যার কারণ মূলত এই যে, যুক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অত্যন্ত অগভীর। যে মানুষ নিজেকে নিজের বিরোধী করে তোলে সে উদ্দীপক এবং চিত্তহরণকারী জিনিসের প্রতি মোহ অনুভব করে। সে জোরালো উত্তেজনা পছন্দ করে কিন্তু তার কোনও উপযুক্ত কারণ নেই। সে এইসব করে নিজেকে বহির্মুখী করার জন্যে এবং চিন্তা করার বেদনাময় দায় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে। যে কোনও ধরণের উত্তেজনা তার কাছে একরকমের প্রমত্ততা এবং সে আসল সুখ কী তা কল্পনা করতে পারে না বলে। বেদনা থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পাওয়া তার কাছে একমাত্র প্রমত্ততার ভিতর দিয়ে, সম্ভব বলেই মনে করে, এটা মনের গভীর স্তরে অবস্থিত একটি রোগের লক্ষণ। যে ক্ষেত্রে এই রোগ নেই সেখানে মেধার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা থেকে সবচেয়ে আনন্দ লাভ করা যেতে পারে। যে মুহূর্তে মন সবচেয়ে ক্রিয়াশীল থাকে, বিস্মরণ কম হয় তখনই গভীর আনন্দের স্পর্শ পাওয়া যায়। যে আনন্দের জন্য প্রমত্ততা প্রয়োজন হয়, তা সে যে ধরণেরই হোক, সে আনন্দ কৃত্রিম এবং অতৃপ্তিকর। সত্যিকার তৃপ্তিদায়ক আনন্দের সাথে থাকে মানসিক শক্তির পূর্ণ সক্রিয়তা এবং যে পৃথিবীতে আমরা জীবন কাটাই তার সম্পর্কে পূর্ণতম জ্ঞান।

০৮. নির্যাতন-বাতিক

চরম আকারের নির্যাতন-বাতিক উন্মত্ততার একটি স্বীকৃত রূপ। কোনও কোনও মানুষের ধারণা অন্যেরা তাকে হত্যা করতে চায়, অথবা বন্দী করতে চায় অথবা অন্য কোনও গুরুতর ক্ষতি করতে চায়। এই কাল্পনিক নির্যাতনকারীদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার ইচ্ছা তাদের প্রায়ই হিংসামূলক কাজে প্ররোচিত করে, যে জন্যে তাদের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অন্যান্য ধরনের মস্তিষ্কবিকৃতির মতো এটা একটি বিশেষ প্রবণতার বাড়াবাড়ি মাত্র, যা যেসব মানুষ স্বাভাবিক বলে পরিচিত তাদের মধ্যে দেখা যায় না তা নয়। এর চরম অবস্থাসমূহ নিয়ে আমি আলোচনা করব না কারণ তা মনোবিদদের ব্যাপার। আমি মৃদুতর অবস্থাসমূহ নিয়ে কিছু বলব। কারণ সেগুলি প্রায় ক্ষেত্রে অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আর সেসব নিশ্চিতরূপে উন্মত্ততার সীমায় যখন না পৌঁছায় রোগী নিজেই তার ব্যবস্থা করতে পারে, অবশ্য যদি তাকে সঠিক রোগ নির্ণয়ে সম্মত করানো যায় এবং সে বুঝতে পারে এই বাতিকের উদ্ভব তার নিজের ভিতর থেকেই হয়েছে, অন্যের কল্পিত শত্রু বা নিষ্ঠুরতা থেকে নয়।

নারী বা পুরুষ, এমন এক ধরনের মানুষের সাথে আমরা পরিচিত, যারা চিরদিন নিজেদের অকৃতজ্ঞতা, নিষ্ঠুরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার কাছে বলিপ্রদত্ত বলে মনে করে। এই ধরনের মানুষদের ক্ষেত্রে তাদের কথা প্রায় বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় এবং যারা তাদের বেশিদিন ধরে চেনে না তাদের কাছ থেকে প্রচুর সহানুভূতি পায়। স্বাভাবিকভাবে তারা আলাদা আলাদা ভাবে যেসব গল্প বলে তার মধ্যে অসম্ভাব্য কিছুই থাকে না। যেসব দুর্বহারের কথা তারা বলে তা নিঃসন্দেহে মাঝে মাঝে ঘটে থাকে। কিন্তু যারা তাদের হাতে এইরকম যন্ত্রণা ভোগ করে সেই দুর্জনদের সংখ্যা দিনে দিনে এত বাড়তে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত শ্রোতার মনে কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। সম্ভাবনা রীতির নিয়মে কোনও বিশেষ সমাজে বিভিন্ন ধরনের যেসব লোক বাস করে তারা সারা জীবন সমপরিমাণ দুর্ব্যবহার পায়। যদি কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর একজন লোক, তার নিজের মধ্যেই নিহিত থাকার সম্ভাবনা বেশি এবং হয় সে যে যন্ত্রণা ভোগ করেনি তাই ভোগ করছে বলে কল্পনা করছে অথবা অচেতনভাবে এমন ব্যবহার করছে, যাতে অন্যের মনে অনিয়ন্ত্ৰণীয় বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে। অভিজ্ঞ লোকেরা তাই যারা নিজেদের বিশ্বের দ্বারা উৎপীড়িত বলে নিজেদের মনে করেন, তাদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের সহানুভূতি না পেয়ে এই হতভাগারা মনে করে প্রত্যেকটি লোক তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এ অবস্থার প্রতিবিধান সহজ নয়, কারণ তা সহানুভূতি পেলে যেমন, সহানুভূতি না পেলে তেমন বেড়েই যায়। নির্যাতন-বাতিকগ্রস্ত মানুষ যখন দেখে যে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বিশ্বাস করা হচ্ছে তখন সে তা আরও অলংকৃত করে বলতে থাকে এবং একসময় তা বিশ্বাসযোগ্যতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। অন্যদিকে সে যদি দেখে তার কথা বিশ্বাস করা হচ্ছে না, তখন সে তার প্রতি মানুষের বিচিত্র ধরনের নির্দয়তার একটি উদাহরণ সেই লোকের মধ্যে দেখতে পায়। এই রোগ এমন যে শুধু বোঝাঁপড়ার মাধ্যমে তার নিরাময় সম্ভব এবং সেই উদ্দেশ্য সফল করতে হলে এই বোধ রোগীর মনেও প্রতিষ্ঠা করাতে হবে। এই অধ্যায়ে আমি কিছু সাধারণ পরামর্শ দেব, যার সাহায্যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের মধ্যে কী পরিমাণ নির্যাতন-বাতিক রয়েছে (যা থেকে সকলেই কমবেশি ভুগছে), তা সন্ধান করতে পারবে এবং তাদের চিহ্নিত করা গেলে পরিত্যাগ করাও সহজ হবে। সুখের অন্বেষণে এটি একটি প্রয়োজনীয় অংশ। কারণ, প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি খারাপ আচরণ করে, এই কথা যদি আমরা সবসময় ভাবি, তা হলে সুখী হওয়া একেবারেই অসম্ভব।

বিদ্বেষপূর্ণ জল্পনা নিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি লোক যে ধারণা পোষণ করে, তাতে দেখা যায় যুক্তিহীনতার একটি সর্বজনীন ধরণ পরিচিতদের সম্পর্কে এমন কি বন্ধুদের সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ রটনা প্রচার করার লোভ কম লোকেই সংবরণ করতে পারে। তবু যখন মানুষ তার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রচারের কথা শোনে তখন ক্ষুব্ধ এবং স্তম্ভিত হয়। একথা তারা মনেই করে না যে, তারা যেমন অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার করে অন্যেরাও তেমনি তাদের বিরুদ্ধে একই কাজ করে। এই ধারণা মৃদু স্তরের। কিন্তু এর আধিক্য ঘটলে মানুষ নির্যাতন-বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমরা নিজেদের প্রতি যে কোমল ভালবাসা এবং গভীর সম্মান বোধ করি অন্যদের কাছ থেকেও সেই অনুভূতি কামনা করি। আমরা এ কথাটা ভাবি না যে, আমরা অন্যকে নিয়ে যা চিন্তা করি, অন্যেরা আমাদের সম্পর্কে ভাল কিছু চিন্তা করুক তা আমরা আশা করতে পারি না। এ রকম যে হয় না তার কারণ আমাদের যোগ্যতা অনেক বেশি এবং তা স্পষ্ট আর অন্যের যোগ্যতা, যদি কিছু থেকেও থাকে তবে তা শুধু বদান্য দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। কোনও না কোনও ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে ভীষণ কিছু বলেছে এ কথা শুনলে আপনার মনে পড়ে যাবে তার বিরুদ্ধে উচিত এবং ন্যায্য, যা আপনি করতে পারতেন তা থেকে নিরানব্বই বার বিরত থেকেছেন এবং ভুলে যাবেন যে শততম বারে একটা অসতর্ক মুহূর্তে তার সম্পর্কে সত্যি আপনি কী ভাবেন তা প্রকাশ করে ফেলেছেন। তখন কিন্তু আপনার মনে হবে, এই কী আপনার সংযমের পুরস্কার? ক’বার আপনি মুখ খোলেন নি, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি শুধু জানেন আপনি শততম বলে কী বলেছেন, তা হলে আমার ধারণা প্রথমেই প্রায় সব বন্ধুত্বের অবসান হয়ে যেত। দ্বিতীয় যে ফলটি পাওয়া যায় সেটি খুব চমৎকার হতে পারত। কারণ বন্ধুহীন জগৎ অসহ্য হয়ে উঠত এবং তখন আমরা পরস্পরকে যে সম্পূর্ণ কলঙ্কশূন্য মনে করি না, তা মিথ্যার আবরণে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ না করে পরস্পরকে ভালবাসতে শিখতাম। আমাদের বন্ধুদের অনেক ত্রুটি রয়েছে তা আমরা জানি। কিন্তু তবুও সাধারণভাবে তারা মনের মতো মানুষ এবং তাদের আমরা পছন্দ করি, কিন্তু তারাও অসহনীয়। আমরা আশা করি, তারা মনে করুক জগৎ সংসারে সব মানুষের ক্রটি আছে, শুধু আমাদের নেই। যখন আমাদের ত্রুটির কথা স্বীকার করতে বাধ্য হই, তখন আমরা এই প্রত্যক্ষ ব্যাপারটার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করি। সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন থাকার ধারণা কারও থাকা উচিত নয় এবং তার জন্যে তাদের অহেতুক দুর্ভাবনাও কিছু নেই।

নির্যাতন-বাতিকের শিকড় প্রবেশ করেছে আমাদের নিজেদের যোগ্যতাবিষয়ে অতিরঞ্জক ধারণার অতি গভীরে। ধরা যাক আমি একজন নাট্যকার, প্রত্যেকটি নিরপেক্ষ ব্যক্তির কাছে এটা নিশ্চয় স্পষ্ট যে আমি এই যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তার পরেও কোনও কারণে আমার নাটক খুব কম অভিনীত হয় এবং যখন হয়ও, সফল হয় না। এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা কি? স্পষ্টই বোঝা যায় কোনও না কোনও কারণে সকল ব্যবস্থাপক, অভিনেতা এবং সমালোচক একসাথে মিলে আমার বিরুদ্ধাচরণ করছে। এর কারণ আমার নিজের কাছে মহা গৌরবের। আমি নাট্যজগতের মহারথীদের পায়ে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করেছি। আমি সমালোচকদের চাটুকারিতা করিনি। আমার নাটকসমূহে এমন সব স্পষ্ট কথা রয়েছে যা তাদের আঘাত করলে তা অসহনীয় হয়ে উঠবে। আর এই কারণে আমার অন্য সকলকে লঙ্ঘন করে যাওয়া যোগ্যতার স্বীকৃতি মেলে না।

এরপর ধরা যাক যন্ত্র আবিষ্কারের কথা। সে কোনও দিন তার আবিষ্কারের মূল্য অন্য কোনও ব্যক্তিকে দিয়ে পরীক্ষা করাতে পারল না। যন্ত্র উৎপাদকেরা ছকবাঁধা পথে চলে। নুতন কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। আর তাদের নিজেদেরই যন্ত্র উদ্ভাবনের লোক রয়েছে, তারাই অস্বীকৃত নতুন নতুন প্রতিভার অধিকার প্রবেশ রোধ করতে সফল হয়। অবাক হওয়ার কথা শিক্ষিত গোষ্ঠীর কাছে লেখার পাণ্ডুলিপি পাঠালে তারা তা হারিয়ে ফেলেন অথবা না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দেন। যেসব ব্যক্তিদের কাছে আবেদন জানানো হয়, তারা কোনও অজানা কারণে তাতে সাড়া দেন না। এসব ব্যাপারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? বেশ বোঝা যায় বিশেষ কিছু লোকের একটা মিলন সমিতি আছে। যারা শুধু নিজেদের মধ্যেই নতুন সব উদ্ভাবনের ফল ভাগ করে নিতে চান। যে লোক তাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত নন, তার কোনও কথা তারা শোনেন না।

এরপর আরেকজন মানুষ যার অভিযোগ বাস্তব ঘটনার সাথে জড়িত এবং যথার্থ, কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে সাধারণভাবে দেখে এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে জগতের চাবি তার দুর্ভাগ্যের মধ্যেই রয়েছে। আমরা মনে করতে পারি সে হয়তো গুপ্তচর বিভাগের কোনও কলঙ্ক সম্পর্কে জানতে পেরেছে যা সরকারের স্বার্থে গোপন থাকা প্রয়োজন। তার পক্ষে এই উদ্ভাবনের জন্যে প্রচার পাওয়া কঠিন। কিন্তু এই কলঙ্ক কাহিনী যদিও তাকে উত্তেজিত করেছে যারা তাঁর কাছে মহৎ প্রাণ মানুষ বলে বিবেচিত, তাঁরা এর প্রতিকারে সামান্যতম ব্যবস্থা গ্রহণেও স্বীকৃত নন। তার বর্ণিত ঘটনা যথার্থ হলেও তার ধারণা হল, নানা অপরাধকে সমর্থন দিয়ে যারা ক্ষমতাশালী হয়েছে সেইসব অপরাধ চাপা দিয়ে রাখতেই তারা সারাক্ষণ নিজেদের ব্যস্ত রাখে। এ ধরনের রোগীদের সারিয়ে তোলা বেশ কঠিন, কারণ দৃষ্টিভঙ্গীতে আংশিক সত্যতা থাকে। অনেক বেশি বিষয়ে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে যেটুকুর সংস্পর্শে তারা এসেছে, তাই তাদের মনে স্বাভাবিকভাবে গভীর প্রভাব রেখে দিয়ে গেছে, এটা তাদের ভুল মাত্রাজ্ঞান দেয়। ফলে যা ঘটে, তা হল, সাধারণ ঘটনার চেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনায় তারা অহেতুক বেশি গুরুত্ব আরোপ করে।

আর এক ধরনের লোক যারা প্রায়ক্ষেত্রে বাতিকগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তারা হলেন পরোপকারী। তারা লোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাদের উপকার করে বেড়ান এবং তারা কোনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে ভয়ে, বিস্ময়ে শিউরে ওঠেন। পরের উপকার করার উদ্দেশ্যকে যতটা দোষহীন ভাবা হয় বাস্তবে তা নয়। ক্ষমতালিপ্সার মধ্যে ছলনা আছে, এর রয়েছে নানা ছদ্মবেশ। অন্যের উপকার করা হচ্ছে বলে যা বিশ্বাস করা হয় তার থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায়, প্রায় ক্ষেত্রে তার মূলে থাকে সেই ক্ষমতালিপ্সা। লোকের উপকার করার অর্থ বলতে সাধারণভাবে তাদের কোনও আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা বোঝায়। যেমন মদ্যপান বা জুয়া খেলা বা অলসতা বা অন্য কিছু। এক্ষেত্রে এমন একটা উপাদান দেখা যায় যার অনেকটা সামাজিক নৈতিকতার উত্তম দৃষ্টান্ত। যেমন তাদের প্রতি আমরা বিরত থাকি বন্ধুদের শ্রদ্ধা ধরে রাখার জন্যে। বলা যায় যারা ধূমপানের বিরুদ্ধে আইন তৈরীর জন্যে (এ ধরনের আইন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে আছে অথবা ছিল) তাঁরা নিঃসন্দেহে ধূমপায়ী নন এবং তাদের কাছে অন্যের সুখদায়ক ধূমপান বেদনার উৎস। তারা যদি প্রত্যাশা করে থাকেন যারা পূর্বে ধূমপানের আসক্ত ছিল তাদের একটি প্রতিনিধিদল এই জঘন্য দুষ্কর্ম থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানাতে আসবে, তাহলে তাঁরা হতাশ হবেন। এরপর তাঁরা ভাবতে পারেন যে, জনকল্যাণে তারা জীবন সমর্পণ করেছেন এবং এজন্যে যাদের কৃতজ্ঞ হওয়ার সবচেয়ে বেশি কারণ ছিল তারাই সেটা প্রকাশ করার সুযোগ খুঁজে পেল না এবং এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অসচেতন হয়ে রইল।

যে সব গৃহকত্রী পরিচালিকাদের নৈতিকতা পাহারা দিয়ে রাখেন তাদেরও গৃহ পরিচারিকাদের সম্পর্কে একই ধরনের মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে ভৃত্যসমস্যা এমন প্রবলরূপ নিয়েছে যে, পরিচারিকাদের প্রতি এ ধরনের অনুগ্রহ প্রদর্শন দেখা যায় না।

রাজনীতির উচ্চস্তরে একই রকম ঘটনা দেখা যায়। যে রাষ্ট্রনেতা ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন এই জন্যে যে তিনি জনকল্যাণে উচ্চমাত্রায় এবং মহৎ কিছু করতে পারবেন, যার জন্যে তিনি নিজের আরাম পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন এবং যার জন্যে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সেই তিনি যখন দেখেন জনসাধারণ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তখন তাদের অকৃতজ্ঞতায় তিনি হতবাক হয়ে যান। একথা তার মনেই হয় না যে তার কাজের মধ্যে জনসেবার উদ্দেশ্য না থাকতে পারে অথবা ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার আনন্দই তাঁকে সেসব কজে প্রেরণা যুগিয়েছে। রাজনৈতিক সভায় বা দলীয় মুখপত্রে যেসব বাধা ভাষা ব্যবহার করা হয়, ক্রমে সেইসব তাঁর কাছে সত্যি বলে মনে হয় এবং তিনি দলীয় বাগাড়ম্বরকে উদ্দেশ্যের যথার্থ বিশ্লেষণ বলে ভুল করেন। বিরক্ত এবং মোহমুক্ত হয়ে পৃথিবী থেকে অবসর নেন যখন পৃথিবীও তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তিনি এই বলে অনুতাপ করেন যে কেন তিনি জনকল্যাণরূপী একটি কৃতজ্ঞতাবিহীন কাজে নেমেছিলেন।

এই উদাহরণগুলি থেকে চারটি সাধারণ নীতির পরিচয় পাওয়া যাবে, যদি তার সত্যতা ভালভাবে উপলব্ধি করা যায় তাহলে নির্যাতন-বাতিকের নিরাময় সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দেবে। প্রথমটি হল : আপনার উদ্দেশ্য আপনার কাছে যতটা পরার্থবাদী বলে মনে হচ্ছে সবসময় ততটা নয়, সে কথা অবশ্যই মনে রাখবেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে : নিজের যেগ্যেতা সম্পর্কে অতিরিক্ত ধারনা পোষণ করবেন না। তৃতীয়টি হচ্ছ : নিজের সম্পর্কে আপনার যে পরিমাণ উৎসাহ অন্যের কাছ থেকে ততটা আশা করবেন না। এবং চতুর্থটি হচ্ছে : আপনাকে নির্যাতন করার জন্যে অধিকাংশ লোক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এমন কল্পনা করবেন না। আমি পরপর এইসব সাধারণ নীতি সম্পর্কে কিছু বলছি।

পরকল্যাণব্রতী এবং নির্বাহিকদের পক্ষে তাদের অভিপ্রায় নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা প্রয়োজন। এই ধরণের ব্যক্তিদের কল্পনায় পৃথিবী বা তার অংশবিশেষ কী রকমের হওয়া উচিত তার একটা দৃশ্য থাকে এবং তারা কখনো সঠিকভাবে, কখনো বা ভুলভাবে মনে করেন যে, সেই কল্প-দৃশ্য বাস্তবে রূপায়িত করলে সমগ্র মানবসমাজ অথবা তার কোনও অংশের পরম মঙ্গল হবে। কিন্তু তারা একথাটা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারেন না যে, যারা তাদের কাজের ফলে উপকৃত হবেন তাদের প্রত্যেকেরই, কে কেমন পৃথিবী চায়, সে সম্পর্কে তাদের নিজস্ব মতো প্রকাশের সমান অধিকার রয়েছে। নির্বাহী ব্যক্তিদের প্রত্যেকের নিশ্চিত ধারণা যে তাঁদের কল্পিত দৃশ্যই যথার্থ এবং তার সঙ্গে যার অমিল হবে সে ভুল। কিন্তু তার কল্পিতচিত্র যে নিশ্চয়তা দিচ্ছে বাস্তবে তা যথার্থ কিনা তার কোনও প্রমাণ নেই। তা ছাড়া বিশ্বাস হচ্ছে প্রায় সময় দেখা যায় শুধুমাত্র আনন্দ লাভের ছদ্মবেশ যা উঠে এসেছে যেসব পরিবর্তন তিনি ঘটাতে চান সেখান থেকে, যেখানে তিনি নিজেই তার কারণ। ক্ষমতাপ্রিয়তা ছাড়াও আরো একটি উদ্দেশ্য দেখা যায় তা হল দম্ভ, যে এসব ব্যাপারে প্রবলভাবে ক্রিয়া করে। আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি পার্লামেন্টের সদস্যপদ প্রার্থী মহৎ, আদর্শবাদী যখন দেখেন যে ভোটদাতারা ধরেই নিয়েছে যে তিনি নামের শেষে ‘এম. পি’ অক্ষর দুটি লেখার গৌরব অর্জন করার জন্যেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তখন তিনি তাদের বিশ্বনিন্দুকতার ভাব দেখে বিস্মিত হন। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর যখন তিনি চিন্তা করার সময় পান, তখন তার মনে হয় হয়তো বিশ্বনিন্দুক ভোটদাতারাই সঠিক, আদর্শবাদ সাধারণ উদ্দেশ্যকেও একরকম অদ্ভুত ছদ্মবেশ পরিয়ে দেয়। সুতরাং আমাদের জনপ্রতিনিধিদের কাছে কিছু প্রকৃতনিন্দা অপ্রীতিকর হয় না। চলিত নৈতিকতা যতটা জনকল্যাণ লোকের মনে জাগে, তারা অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের অতীত এবং যারা নিজেদের মহৎ গুণের জন্যে গর্বিত তারা প্রায় সময়েই কল্পনা করেন যে সেই দুর্লভ আদর্শে তাঁরা পৌঁছে গেছেন। মহৎ ব্যক্তিদের বিভিন্ন কার্যধারার মধ্যেও আত্ম-স্বার্থের উদ্দেশ্য থাকে, তবে তার জন্যে দুঃখপ্রকাশের কোনও প্রয়োজন নেই, কেন না ব্যাপারটা অন্যরকম হলে মানুষ জাতি হিসাবে বেঁচে থাকতে পারত না। যে মানুষ অন্যেরা খেল কিনা শুধু তাই দেখতে সময় নষ্ট করে এবং নিজের খাওয়ার কথা ভুলে যায়, তার বিনাশ অবধারিত। অবশ্য শক্তির বিরুদ্ধে পুনরায় সংগ্রাম করার জন্যেই শুধু সে কিছু খেয়ে নিতে পারে। এই কারণে কিছু খেলে তা সম্পূর্ণ হজম হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ এতে পরিপাকের যে রস নিঃসরণ হওয়ার কথা তা যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষরিত হয় না, তাই কাজের কথা হচ্ছে খাওয়ার প্রয়োজনেই তার তা করা উচিত এবং ভোজনের সময় জনকল্যাণের ইচ্ছায় আপুত থাকা উচিত নয়।

এবং আহার সম্বন্ধে যা সত্যি, অন্য সব ব্যাপারেও তা সমান সত্যি। যা কিছু করতে হবে তা প্রচুর পরিমাণে করতে হলে কোনও উদ্দীপনার সাহায্য প্রয়োজন এবং স্বার্থ জড়িত না থাকলে উদ্দীপনা আসে না। এদিক থেকে দেখতে গেলে আমি স্বার্থের উদ্দেশ্যের সাথে আরো কিছু যুক্ত করতে চাই এবং তা হচ্ছে জৈব-সম্পর্কিত ব্যক্তিদের স্বার্থ। যেমন শত্রুর বিরুদ্ধে স্ত্রী এবং সন্তানদের রক্ষা করার সহজ প্রবৃত্তি। এই মাত্রার পরার্থবাদ মানুষের সাধারণ প্রকৃতির অংশ কিন্তু যে মাত্রা সাধারণ নৈতিকতা দাবি করে তা খুব কম ক্ষেত্রেই খাঁটিভারে পাওয়া যায়। যেসব ব্যক্তি নিজেদের নৈতিক উৎকর্ষতা নিয়ে উচ্চ প্রশংসা পেতে চান, তারা যে মাত্রায় আত্মস্বার্থহীনতা লাভ করেছেন কিনা সন্দেহ। তা তারা অর্জন করেছেন বলে বিশ্বাস করেন। এবং এই কারণেই সতোর মর্যাদালাভের চেষ্টার সাথে এক ধরনের আত্মপ্রতারণা যুক্ত হয়, আর তা থেকেই অতি সহজেই জন্ম নেয় নির্যাতন-বাতিক।

আমার চারটি সাধারণ নীতির দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়, তার নীতি সম্পর্কিত অংশে এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু নৈতিক যোগ্যতা ছাড়া অন্য যোগ্যতা সম্পর্কেও অতিরিক্ত ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। যে নাট্যকারের কোনও নাটকই সাফল্য লাভ করেনি তার শান্তভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সেগুলি ভাল নাটক নয়। এই ধারণা সমর্থনযোগ্য নয় বলে সাথে সাথে বাতিল করে দেওয়া ঠিক নয়। যদি দেখা যায় ধারণার সাথে বাস্তবের সঙ্গতি আছে, তা হলে একজন পরিচয়দায়ক দার্শনিকের মতো তিনি তা গ্রহণ করবেন। একথা সত্যি যে যোগ্যতা স্বীকৃতি পায়নি এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতি পেয়েছে এমন দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক বেশি। যদি কোনও প্রতিভা সমকালে মূল্য না পেয়ে থাকেন, তা হলেও যে পথে তিনি এগিয়েছেন তা থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়, স্বীকৃতি না পাওয়া সত্ত্বেও। পক্ষান্তরে তিনি যদি অহংসর্বস্ব প্রতিভাহীন ব্যক্তি হন, তিনি পথ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেই ভাল করবেন। এই দুইজনের মধ্যে কে কোন দলের মধ্যে পড়েন তা জানবার কোনও উপায় নেই যদি একজন তার শ্রেষ্ঠ কর্ম অস্বীকৃত হওয়ার জন্যে বেদনায় আহত হয়ে থাকেন। আপনি যদি প্রথম দলে পড়েন তাহলে আপনার অধ্যবসায়কে বলব বীরোচিত। যদি দ্বিতীয় দলের হন তাহলে বলব হাস্যকর। আপনার মৃত্যুর শতবর্ষ পরে জানা যাবে আপনি কোন্ দলভুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে একটি পরীক্ষা করা যেতে পারে, যদিও তা অব্যর্থ সে কথা বলা যায় না, যদি নিজেকে আপনি একজন প্রতিভাবান মনে করেন কিন্তু প্রকাশকালে আপনি কী জরুরী তাগিদ অনুভব করেন কোনও ধারণা বা অনুভূতি তুলে ধরার জন্যে অথবা আপনি প্রশংসা অর্জনের ইচ্ছা থেকে তাড়িত হন? প্রকৃত শিল্পী তার শিল্পকর্ম শেষ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং আশা করেন যে তাঁর কাজ প্রশংসিত হবে। কিন্তু কেউ যদি প্রশংসা নাও করেন তাহলেও তিনি তাঁর শিল্পরীতি পরিবর্তন করবেন না। কিন্তু যার কাছে অন্যের প্রশংসা লাভ করাই মুখ্য, তার নিজের মধ্যে কোনও জোর নেই নিজস্ব কোনও শিল্পরীতি গঠনের। শিল্পকর্ম প্রশংসা না পেলে এমন ধরনের শিল্পীর সেই কাজ ছেড়ে দেওয়া উচিত। আরো সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, জীবনে যে শাখাই আপনি বেছে নিন, যদি দেখেন যে আপনার পারদর্শিতা সম্বন্ধে আপনি যতটা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, অন্যেরা তা করছেন না, তাহলে নিশ্চিত মনে ভাববেনও না তারাই ভুল করছেন। আপনি যদি এইভাবে ভাবতে থাকেন, তাহলে সহজেই এই বিশ্বাসের শিকার হবেন যে, আপনার যোগ্যতা যাতে স্বীকৃতি না পায় তার জন্যে একটি ষড়যন্ত্র চলছে আর এই বিশ্বাসই, নিশ্চিত থাকুন যে আপনার জীবনে সুখের অন্তরায় হয়ে উঠবে। আপনার যোগ্যতা যতটা আপনি আশা করেছিলেন ততটা নয়। একথা মেনে নিতে মুহূর্তের জন্যে আপনি ব্যথাতুর হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু এই ব্যথাও একসময় শেষ হবে, তার পরেও আবার সুখী জীবন ফিরে আসা সম্ভব।

আমাদের তৃতীয় সাধারণ নীতি হচ্ছে অন্যের কাছ থেকে বেশি আশা না করা। আগে এটাই রীতি ছিল কোনও মহিলা দীর্ঘকাল রোগে শয্যাশায়ী থাকলে তিনি আশা করতেন অন্তত তার একটি কন্যা তার সেবাশুশ্রূষায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত করবে। তার জন্যে যদি মেয়েটিকে অবিবাহিতা থাকতে হয়, তবুও। অন্যের কাছ থেকে এই ধরনের পরার্থপরতা কামনা করা যুক্তি বিরোধী। কারণ পরার্থবাদীর কাছে এই প্রত্যাশা যত ক্ষতির অহংবাদীর কাছে ততটাই লাভের। অন্যের সাথে বিশেষ করে নিকটজন এবং প্রিয়জনদের সাথে ব্যবহারে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, যদিও কথাটি সব সময় মনে রাখা কঠিন, তারা জীবনকে দেখে তাদের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে যা তাদের অহংবোধকে অন্যের জন্যে নিজের জীবনের মূল পথ পরিবর্তন করবে। এতটা আশা তাদের কাছে প্রত্যাশা করা অনুচিত। এমন একটা সময় আসে যখন স্নেহের আকর্ষণ এত তীব্র হয় যে চরম আত্মত্যাগও স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আত্মত্যাগ যদি স্বাভবিক না হয় তা করা উচিত নয় এবং তা না করার জন্যে নিন্দিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। লোকে প্রায়ই অন্যের যে আচরণের নিন্দা করে তা যথাযথ সীমা অতিক্রম করা সর্বগ্রাসী অহংবোধের বিরুদ্ধে তা অন্যের স্বাভাবিক অহংবোধের সুস্থ প্রতিক্রিয়ার চেয়ে বেশি নয়।

আমাদের উল্লেখিত সাধারণ নীতি হচ্ছে আমরা নিজেদের বিষয়ে চিন্তা করতে যত সময় নষ্ট করি, অন্যেরা আমাদের বিষয়ে চিন্তা করতে অনেক কম সময় নষ্ট করে, এই সত্যি কথাটা বুঝতে পারা। নির্যাতন-বাতিকে যে উন্মাদ হয়ে গেছে সে কল্পনা করে সব ধরণের লোক, যাদের প্রকৃতপক্ষে অনেক কাজ এবং সমস্যা রয়েছে তারা ঐ ভাগ্যহত উন্মাদের ক্ষতি সাধনের জন্যে সকাল-দুপুর-রাত্রি নিজেদের ব্যস্ত করে রেখেছে। অনুরূপভাবে যে নির্যাতন বাতিকগ্রস্ত তুলনামূলকভাবে একটু ভাল সে সবরকম কাজকেই নিজের সম্পর্ক থেকে দেখে অথচ তা নয়। প্রকৃপক্ষে তার কোনও অস্তিত্বই নেই। অবশ্য এই ধারণা তার আত্মশ্লাঘাকে পরিতৃপ্ত করে। অনেক বছর ধরে ব্রিটিশ সরকার প্রধানত নেপোলিয়নকে পরাস্ত করার কাজে ব্যাপৃত ছিল। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি, যার কোনও গুরুত্ব নেই কল্পনা করে অন্যেরা সর্বক্ষণ তার কথা ভাবছে তখন বুঝতে হবে সে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। ধরা যাক, কোনও নৈশভোজসভায় আপনি একটি ভাষণ দিয়েছেন। সচিত্র কাগজসমূহে অন্যান্য বক্তাদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু আপনার কোনও ছবি নেই। এর কারণ কীভাবে দেখা হবে? আপনার মনে হবে অন্যান্য বক্তারা আপনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কারণে নয়, এর কারণ নিশ্চয়ই পত্রিকার সম্পাদকেরা আপনাকে অগ্রাহ্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কেন তারা এমন নির্দেশ দেবেন? এর কারণ নিশ্চয়ই তারা আপনার মহান গুরুত্বকে ভয় পান। এইভাবে আপনার ছবির অপ্রকাশ, আপনার মনে হবে, আপনাকে অবহেলা করার বদলে সূক্ষ্মভাবে আপনাকে অভিনন্দন জানানো। কিন্তু এই ধরণের আত্মপ্রতারণা নির্দোষ আনন্দ দিতে পারে না। আপনার মনের পিছনে যে মন আছে, সে জানতে পারছে প্রকৃত ঘটনা এর বিপরীত এবং তা নিজের কাছে যথাসম্ভব গোপন রাখার জন্যে ক্রমে ক্রমে আপনাকেই নানা ধরনের উদ্ভট হেতু উদ্ভাবন করতে হবে। এসব বিশ্বাস করার চেষ্টা থেকে শেষ পর্যন্ত মনের ওপর যে চাপ পড়বে তা অত্যন্ত বেশি। তা ছাড়া এই বিশ্বাসের সাথে জড়িত হয়ে যাবে যে আপনি ব্যাপক শত্রুতার লক্ষ্যবস্তু যা আপনার মনে অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে অনুভূতি জাগিয়ে রাখবে তা হচ্ছে পৃথিবীর সাথে আপনার সদ্ভাব নেই। আর এই অনুভূতি আপনার আত্মমর্যাদাবোধকে বাঁচিয়ে রাখবে। যে তৃপ্তির ভিত্তি আত্মপ্রতারণা, তা দৃঢ় নয়। সত্য যতই অতৃপ্তিকর তোক প্রথমবারেই তার সাথে সমতা রেখে জীবনকে গঠন করার দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।

 ০৯. জনতের ভয়

খুব কম লোকই সুখী হতে পারে, যদি সামগ্রিকভাবে তাদের জীবনধারা ও পৃথিবী নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী, যাদের সাথে তাদের সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বিশেষভাবে যেসব প্রতিবেশীদের সাথে বাস করতে হয়, তারা অনুমোদন না করে। বর্তমান সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আলাদা আলাদা গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তাদের নৈতিকতাবোধ ও বিশ্বাসও পরস্পর থেকে ভিন্নতর। এই অবস্থা শুরু হয়েছে যোড়শ শতকের পোপবিরোধী ধর্ম বিপ্লবের সময় থেকে সম্ভবত বলা উচিত বেঁনেসার সময় থেকে এবং ক্রমেই প্রবলতর হয়ে উঠছে। প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের কথা বলা যায়, তারা যে শুধু ধর্মতত্ত্বে আলাদা তাই নয়, অনেক বৈষয়িক ব্যাপারেও তারা আলাদা। অনেকগুলি কাজ অভিজাত শ্রেণীর অনুমোদিত ছিল, যা সহ্য করত না মধ্যবিত্ত শ্রেণী (বুর্জোয়া)। তারপর আগমন ঘটল উদারপন্থী এবং স্বাধীন চিন্তার সমর্থকদের। তারা ধর্মীয় কর্তব্য পালন স্বীকার করতেন না। আমাদের নিজেদের কালে ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে লোকেরা খুব বেশি রকমভাবে ভাগ হয়ে গেছে সমাজতন্ত্রী এবং অন্যান্য দলে, যেখানে শুধু রাজনীতি নেই, রয়েছে জীবনের সকল বিভাগ। ইংরেজি ভাষাভাষি দেশসমূহে এই বিভক্তি অসংখ্য। কিছু দল চিত্রশিল্পকে নন্দিত করে। কিছু দল মনে করে ওটা শয়তানের চিন্তা, অন্তত আধুনিক হলে তো কথাই নেই। কারো কারো মতে সাম্রাজ্যে আনুগত্য একটি মহৎ গুণ, কারো মতে এটি পাপ, আবার কারো মতে এটা এক ধরনের বুদ্ধিহীনতা। সাধারণ নৈতিকতায় বিশ্বাসী মানুষ ব্যভিচার একটি ঘৃণ্যতর অপরাধ বলে মনে করে। আবার এক বিপুল সংখ্যক লোক একে প্রশংসাযোগ্য মনে না করলেও ক্ষমাযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে। ক্যাথলিকদের বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কিন্তু অধিকাংশ অ-ক্যাথলিক একে বৈবাহিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় অপনোদক বলে গ্রহণ করে।

এই ধরনের বিচিত্র সব দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে কোনও নির্দিষ্ট রুচি ও বিশ্বাসযুক্ত মানুষ এক গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেকে সমাজচ্যুত মনে করবে, কিন্তু অন্য গোষ্ঠীর কাছে তিনি সম্পূর্ণ সাধারণ এবং স্বাভাবিক মানুষ বলে গৃহীত হবেন। এইভাবে অনেক অসন্তুষ্টি জন্ম নেয় বিশেষভাবে তরুণদের মধ্যে, কোনও তরুণ বা তরুণীর মনে কোনওভাবে যেসব ধারণা জন্ম নেয়, তা যেন বাতাস থেকে ধরা। কিন্তু তারা দেখতে পায় যে বিশেষ সামাজিক পরিবেশে তারা বাস করছে সেখানে এইসব ধারণা (খ্রিস্টান) ধর্মমন্দির থেকে পাওয়া অভিশাপ যেন। তাই তরুণ সমাজের মনে সহজেই এটা মনে হতে পারে, তারা যে সামাজিক পরিবেশের সাথে পরিচিত তা সমগ্র বিশ্বের মধ্যে প্রতিনিধি স্থানীয়। তারা বিশ্বাস করতেই চাইবে না, যেসব মতো তারা ধৃষ্টতা বলে বিবেচিত হতে পারে মনে করে এখানে প্রকাশ করতে ভয় পায়, সেইসব অন্য জায়গায় ভিন্ন পরিবেশে এ যুগের অত্যন্ত সাধারণরূপে বিবেচিত হবে। দেখা যায়, পৃথিবী সম্বন্ধে অজ্ঞতার কারণে নানা ধরনের অনেক অনাবশ্যক দুঃখ ভোগ করে কখনো শুধুমাত্র তরুণ বয়সে, কখনো জীবনভর। এই অন্তরণ শুধু যে বেদনার উৎস, তা নয়, এতে বিপরীত পরিবেশের বিরুদ্ধে মানসিক স্বাধীনতা রক্ষার অপ্রয়োজনীয় কাজে শক্তির অনর্থক অপচয় হয় এবং একশটির মধ্যে নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে ধারণাসমূহের যুক্তিপূর্ণ পরিণতির পক্ষে পরিচালিত করতে এক ধরনের ভয়ের সঞ্চার হয়। ব্ৰন্টি ভগ্নিরা(১) তাদের বই প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনও সহানুভূতিশীল লোকের দেখা পাননি। এসব এমিলিকে স্পর্শ করেনি। তিনি তেজস্বিনী ছিলেন এবং তাতে দীপ্তি ছিল। কিন্তু শারলেট এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কারণ, প্রতিভা থাকলেও তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একজন গৃহশিক্ষিকার। এমিলি ব্রন্টির মতো ব্লেকও(২) মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ অন্তরীণ ছিলেন। কিন্তু তিনি এমিলির মতোই নিজের ভুল দিকটাকে শুধরে নিতে পেরেছিলেন। তিনি যে নির্ভুল ছিলেন এবং তাঁর সমালোচকরাই ভুল ছিলেন সে বিষয়ে তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। জনমত বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী নিচের কটি চরণে প্রকাশিত হয়েছে :

একমাত্র লোক যে আমার পরিচিত
যে আমার বমন-উদ্রেক কোনও রকমে
বন্ধ করেছিল, তার নাম ফুঞ্জেলি–
তিনি ছিলেন একসাথে তুর্কি এবং ইহুদি।
সুতরাং প্রিয় খ্রিস্টান বন্ধুগণ
তোমরা কি করছো?

কিন্তু অন্তৰ্জীবনে এমন শক্তি ধারণ করেন তেমন লোকের সংখ্যা বেশি নয়। প্রায় প্রত্যেকের পক্ষেই সহানুভুতিশীল পরিবেশ সুখের জন্যে প্রয়োজন। অবশ্য অধিকাংশ লোকই নিজেদের চারপাশে যে পরিবেশ খুঁজে পায় তা সহানুভূতি ভরা। তারা তরুণ বয়সে প্রচলিত সব কুসংস্কার আত্মভূত করে নেয় এবং চতুর্পাশে যেসব বিশ্বাস এবং রীতিনীতির সন্ধান পায় তার সাথে সহজভাবে মানিয়ে নেয়। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক লোকের পক্ষে, যাদের কোনও রকম বুদ্ধিবৃত্তিক বা শৈল্পিক দক্ষতা রয়েছে এই ধরনের সব কিছু নির্বিবাদে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কোনও লোক যদি ছোট মফঃস্বল শহরে জন্মান, তবে শৈশব থেকেই তার মানসিক উৎকর্ষের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তার প্রত্যেকটির বিরোধিতার দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত দেখবে। যদি তার গভীর কোনও বই পড়তে ইচ্ছা করে, অন্য ছেলেরা তাকে অবজ্ঞা করবে। শিক্ষকেরা বলবেন এই ধরনের বই মনকে বিক্ষিপ্ত করে। যদি তার শিল্পের প্রতি আকর্ষণ দেখে তাহলে সমবয়সীরা তাকে ভাববে পৌরুষহীন আর গুরুজনরা মনে করবে অনৈতিক। যদি সে কোন সম্মানজনক পেশা গ্রহণ করতে চায়, যা তার নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের কাছেই অসাধারণ মনে হয় তাহলে তারা বলবে সে নিজেকে সম্প্রদায়ের ওপরে তুলতে চায়। আরও বলবে যা তার বাপ-দাদার জন্যে ভাল তার জন্যেও মঙ্গল। যদি সে তার বাবা মায়ের ধর্মীয় মতবাদ বা রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে সমালোচনার প্রবণতা দেখায়, তা হলে সে নিজের জন্যে সমূহ বিপদ ডেকে আনবে। এইসব কারণে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর বিকাশশীল বয়ঃসন্ধিকালটা খুব দুঃখের সময়। তাদের যেসব সঙ্গী খুব সাধারণ মানের তাদের জন্যে এই সময়টা আনন্দ এবং উপভোগের কারণ হতে পারে, কিন্তু যারা নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে চায় এবং ঘটনাচক্রে তার যে পরিবেশে তারা জন্মেছে সেখানে বড়দের মধ্যেও পায় না। সমবয়সীদের মধ্যেও পায় না।

এইরকম তরুণ-তরুণীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন তারা মনে হয় মনের সঙ্গী পেয়ে যায় এবং কয়েক বছর আনন্দে কাটায়। যদি তারা ভাগ্যবান হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পরেও এমন কাজ পেয়ে যেতে পারে যেখানে মনের সঙ্গী পাওয়া তখনো হয়তো সম্ভব। লন্ডন বা নিউইয়র্কের মতো মহানগরে বাস করছে এমন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সাধারণত যাদের সাথে মনের মিল হয় তেমন একদল সঙ্গী পেতে পারে। যেখানে তাদের কোনও লুকোচুরি বা ভণ্ডামির প্রয়োজন তাদের হবে না। কিন্তু কাজের স্বার্থে তারা যদি ছোট কোনও জায়গায় থাকতে বাধ্য হয়, বিশেষভাবে যেখানে সাধারণ লোকের শ্রদ্ধা ধরে রাখার প্রয়োজন হয়, যেমন দরকার হয় চিকিৎসক বা আইনজীবীব, তাহলে তাদের জীবনভর নিজের আসল ধারণা ও বিশ্বাসকে নিত্যদিন সংস্পর্শে আসা অধিকাংশ লোকদের কাছ থেকে অবশ্যই গোপন রাখতে হবে। বিশাল দেশ হওয়ার কারণে, আমেরিকার পক্ষে এটা বিশেষ করে সত্যি। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে অভাবিত সব জায়গার নিঃসঙ্গ লোকদের দেখা মিলবে। যারা বইয়ে এমন সব জায়গার কথা পড়েছে, যেখানে যেতে পারলে তাদের একাকীত্ব ঘুচতে পারে, কিন্তু সেখানে বাস করার সুযোগ তারা পায় না। তারা যেখানে থাকে সেখানে মন খুলে কথা বলার ন্যূনতম সুযোগ পর্যন্ত নেই। যারা ব্লেক ও এমিলি ব্রন্টির মতো উচ্চমার্গের লোক নন, তাদের পক্ষে এমন পরিবেশে প্রকৃত সুখ লাভ করা অসম্ভব। এটি সম্ভব করতে হলে এমন কোনও পথ খুঁজে নিতে হবে, যার সাহায্যে জনমতের পীড়ন হয় কমানো, না হয় এড়ানো যেতে পারে এবং যার দ্বারা বুদ্ধিমান সংখ্যালগুর দল নিজেদের জানতে পারবে এবং পরস্পরের সমাজকে উপভোগ করতে পারবে।

অনেক ক্ষেত্রেই অকারণ ভীরুতা অনাবশ্যকভাবে ঝামেলা বাড়িয়ে দেয়। জনমতকে যারা ভয় করে, জনমত তাদেরই ওপর বেশি অত্যাচার করে, যারা ভয় করে না তাদের কিছুই করে না। যারা কুকুর দেখে ভয় পায় কুকুর তাদের দেখে বেশি ঘেউ ঘেউ করে এবং তাদের কামড়াতে তৎপর হয়। কিন্তু যারা কুকুরকে উপেক্ষা করে তাদের সে কিছু করে না। মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও অনেকটা এইরকম। যদি তাদের দেখে আপনি ভয় পান তাহলে তারা বুঝবে আপনি তাদের ভাল শিকার, আর আপনি যদি নির্লিপ্ততা দেখান তাহলে তারা নিজেদের ক্ষমতার বিষয়ে সন্দিহান হবে এবং আপনাকে ছেড়ে দেওয়াই ভাল বলে মনে করবে। আমি অবশ্য চরম অবজ্ঞা প্রকাশের কথা চিন্তা করছি না, আপনি যদি রাশিয়ার প্রচলিত মতবাদ কেনসিংটনে ধরে রাখেন অথবা কেনসিংটনে প্রচলিত মতবাদ রাশিয়ায় বসে ধারণ করেন, তবে তার পরিণাম অবশ্যই আপনাকে মেনে নিতে হবে। আমি এরকম চরম অবস্থার কথা ভাবছি না। আমি ভাবছি প্ৰচলিত রীতিনীতি থেকে সামান্য বিচ্যুতি, যেমন যথাযথভাবে পোশাক না পরা কিংবা কোনও গীর্জার সাথে সম্পর্ক না রাখা অথবা বুদ্ধিদীপ্ত বই পড়া থেকে বিরত থাকা। এসব ত্রুটি যদি খেলার ছলে এবং উদাসীনতার কারণে ঘটে, কোনও জেদ থেকে নয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা হলে খুব রক্ষণশীল সমাজেও তা সহ্য করা হবে। ক্রমে সর্বজনস্বীকৃতভাবে পাগলের পদলাভও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে যা সহ্য করা হয় না তার ক্ষেত্রে সে ধরনের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। এটি এক বিশেষ ধরনের ভাল প্রকৃতি এবং সৌহার্দ্যের বিষয়। রক্ষণশীল লোকেরা প্রচলিত রীতিনীতির ব্যতিক্রম দেখলে ক্রুদ্ধ হয় প্রধানত এই কারণে যে এটা তাদের কাছে নিজেদের সমালোচনা বলে মনে হয়। চলিত রীতিনীতির অনেক স্খলনকে তারা ক্ষমা করতে পারে যদি দেখে সেই লোক প্রফুল্ল মেজাজে এবং বন্ধুত্বের সাথে নির্বোধতম লোকটিকেও বুঝিয়ে দিতে পারে যে সে তাদের সমালোচনা করবে না।

কিন্তু যাদের পছন্দ এবং মতো দলের লোকদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, তাদের ভর্ৎসনা এড়িয়ে চলার এই রীতি অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাদের সহানুভূতিহীনতা তাদের জন্যে অস্বস্তির কারণ হয় এবং বাইরে বড় ধরনের ঝামেলা সামলে নিতে কিংবা এড়াতে পারলেও তাদের মনে কলঙ্কপ্রিয়তা জাগিয়ে তোলে। যেসব লোক নিজের গোষ্ঠীর সাথে রীতিনীতির ব্যাপারে মানিয়ে চলতে পারে না তাদের মনে খোঁচা লাগে এবং অস্বস্তি হয় এবং তাদের বিস্তৃত সরস মনোভাব থাকে না। এই একই লোক যদি আর এক দলে রপ্তানী হয়, যেখানে তার মতকে কেউ অদ্ভুত মনে করবে না, তাহলে মনে হবে যেন তার সম্পূর্ণ চরিত্রই বদলে গেছে। আগে ছিল গম্ভীর, সংকুচিত এবং নিভৃতচারী; এখন প্রফুল্লময় এবং আত্মবিশ্বাসী। আগে ছিল কৌণিকতাযুক্ত, এখন সরল ও মসৃণ, আগে ছিল আত্মকেন্দ্রিক, এখন সামাজিক এবং বহির্মুখী।

সুতরাং যেখানেই সম্ভব, তরুণেরা, যারা নিজেদের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছে না, তাদের এমন পেশা বেছে নিতে চেষ্টা করা উচিত, যা তাদের সুযোগ দেবে মনের মতো পরিবেশ পেতে। এতে যদি উপার্জনের দিক থেকে অনেকটা ক্ষতি হয়, তবুও, অনেক সময় এরা জানেই না এরকম সম্ভব। কারণ বিশ্ব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সীমিত এবং তারা সহজেই মনে করতে পারে তারা বাড়িতে যেসব কুসংস্কারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তা ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। এ বিষয়ে বয়স্ক লোকেরা তরুণদের অনেক সহায়তা দিতে পারেন, কারণ এতে মানুষ সম্পর্কে বিশদ অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।

যখন কোনও তরুণ তার পরিবেশে বেমানান হয়, তখন মনস্তাত্ত্বিক গণ্ডগোলই যে তার কারণ এটা অনুমান করা বর্তমান সময়ের মনোবিশ্লেষণ রীতি। আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণরূপে ভুল। ধরা যাক, কোনও তরুণের বাবা-মা বিবর্তনবাদকে মনে করে অগ্রহণযোগ্য মতবাদ। অন্য কিছু নয় শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তাই এই ধরনের ঘটনায় প্রয়োজন হয় তরুণটির সাথে তার বাবা-মার সহানুভূতির বন্ধন ছিন্ন করতে। নিজের পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নিতে পারা অবশ্যই দুর্ভাগ্যের। কিন্তু তা এমন দুর্ভাগ্য নয় যে, যে কোনও মূল্যে তাকে এড়াতে হবে। পরিবেশ যেখানে বুদ্ধিহীন, পক্ষপাতমূলক সংস্কারাচ্ছন্ন অথবা নিষ্ঠুর, যেখানে তাকে মেনে নিতে না পারা যোগ্যতারই পরিচয়বাহী। প্রায় প্রত্যেক পরিবেশেই কিছু পরিমাণে হলেও এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গ্যালিলিও(৩) এবং কেপলারের(৪) ছিল “বিপদজনক মতবাদ” (জাপানে যেমন বলা হয়)। আজকের দিনেও তেমন ব্যক্তি রয়েছেন। এ রকম বরেণ্য ব্যক্তি তাঁদের মতবাদের জন্যে সামাজিক শত্রুতার মুখে পড়বেন যাকে তাদের বিরুদ্ধ মতবাদীরা প্ররোচিত করে। সামাজিক বোধ এই মাত্রায় বেড়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যেটা কামনীয় তা হচ্ছে এই ধরনের শত্রুতা যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলা এবং অকার্যকর করার পথ খুঁজে বের করা।

বর্তমান বিশ্বে এই সমস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি উদয় হয় তরুণ বয়সে। কোনও ব্যক্তি যদি একবার উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত পেশাটি গ্রহণ করতে পারে, তাহলে সে সামাজিক অত্যাচার প্রায়ক্ষেত্রেই এড়িয়ে চলতে পারে। কিন্তু তার যখন বয়স কম এবং যোগ্যতাও পরীক্ষিত হয় নি, তখন তার ভাগ্য সম্পূর্ণ অজ্ঞ লোকের হাতে গিয়ে পড়তে পারে। যারা তাদের অজানা বিষয়ে মতামত দেওয়ারও যোগ্য বলে মনে করে নিজেদের এবং বিশ্ব সম্বন্ধে এত বিপুল অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তাদের চেয়ে বয়সে অনেক কম এক তরুণ তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী, এই রকম কোনও ধারণায় নিজেদের চূড়ান্ত অপমানিত মনে করে। অনেকে যারা শেষ পর্যন্ত অজ্ঞতার অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছে তাদের এমন কঠিন যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং দীর্ঘদিন অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তাদের মন তিক্ত হয়ে উঠেছে এবং তাদের শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। একটি সহজ মতবাদ রয়েছে যে, প্রতিভা তার পথ খুঁজে নেবেই আর এই মতবাদকে বিশ্বাস করে অনেকেই মনে করে তরুণ প্রতিভা নির্যাতিত হলেও তার খুব বেশি ক্ষতি হয় না। এই মতবাদকে স্বীকার করে নেওয়ার তেমন কোনও যুক্তি নেই। খুন জানাজানি হবেই’ অনেকটা এই মতবাদের তুল্য। মনে হয়, আমরা যতগুলি খবর জানতে পারি, তা সবই ধরা পড়ার পর। কিন্তু আমরা জানি না এমন আরো কত খুনের কথা, যাদের খবর আমাদের কানেও আসেনি। এইভাবে যাদের কথা আমরা শুনেছি, সেসব প্রতিভা প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করেই দীপ্ত হয়েছেন, কিন্তু তাতে একথা অনুমান করার কোনও কারণ নেই যে, অনেক প্রতিভা মুকুলিতই হতে পারেনি। অধিকন্তু এই কথা প্রতিভাবানদের বেলায় নয়, সাধারণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বেলায়ও বলা চলে। কারণ তারাও সমাজের পক্ষে সমভাবে প্রয়োজনীয়। এটা কোনও ভাবে নির্যাতন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপার নয়। অতিক্ত মন এবং অক্ষতিগ্রস্ত শক্তি নিয়েও বেরিয়ে আসার ব্যাপার। এইসব কারণেই তরুণদের চলার পথ অতি দুর্গম করে তোলা উচিত নয়।

বয়োবৃদ্ধরা তরুণদের সব ইচ্ছাকে সম্মান দেখাবেন এটা অবশ্যই কামনীয়, কিন্তু তরুণরা বয়োবৃদ্ধদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাবে, সেটা অবশ্য কামনীয় নয়। এর কারণ খুব সহজ। উভয় ক্ষেত্রেই তা তরুণদের জীবনের ব্যাপার, বয়োবৃদ্ধদের নয়। তরুণরা যখন বৃদ্ধদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, যেমন বিধবা বা বিপত্নীক মা-বাবার পুনর্বিবাহে আপত্তি জানায়, তাহলে তারা ততটুকু অন্যায় করে, বড়রা ঠিক ছোটদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে যতটুকু অন্যায় করেন। বড় হোক কিংবা ছোট বিচারশক্তি অর্জন করার বয়সে পৌঁছে গেলে তাদের নিজেদের পছন্দে চলার অধিকার স্বীকার করতে হবে। এমন কী অন্যায় করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুমি একজন তরুণ, তোমার ইচ্ছা নাট্যমঞ্চে যোগ দেওয়ার; কিন্তু তোমার বাবা-মার এতে আপত্তি, এই কারণে যে, তারা এটাকে অনৈতিক বা নিচুস্তরের সামাজিক কাজ বলে মনে করেন। তারা যতদূর সম্ভব তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন, হয়তো বলবেন তাদের কথা না শুনলে তারা তোমাকে পরিত্যাগ করবেন, বলবেন এমন কাজ করলে তুমি কিছুদিনের ভিতর অনুতাপে দগ্ধ হবে, যতরকম খারাপ হবে সব একে একে তোমাকে বলবেন এবং বোঝাবেন তুমি যা করতে চাও তা করে বহু তরুণের সর্বনাশ হয়েছে। তারা হয়তো ঠিকই মনে করেছেন, তোমার পক্ষে নাট্যমঞ্চ উপযুক্ত নয়। হতে পারে তোমার তেমন অভিনয় দক্ষতা নেই অথবা তোমার কণ্ঠস্বর খুব খারাপ। যদি তাই হয় সে কথা তুমি অল্পদিনের মধ্যেই জানতে পারবে থিয়েটার শিল্পীদের কাছ থেকে। তারপরও অন্য একটা পেশা নির্বাচন করার যথেষ্ট সময় তুমি পাবে । বাবা-মার যুক্তি তোমার চেষ্টা থেকে দূরে থাকার যথেষ্ট কারণ হতে পারে না। তাদের এত সব যুক্তি সত্ত্বেও তুমি নিজের ইচ্ছায় দৃঢ় থাক, তাহলে তারা অল্পদিনের মধ্যেই শান্ত হয়ে যাবেন। এমন কী, তোমার বা তাদের অনুমানের অনেক আগেই। অন্যদিক যদি পেশাদারদের অভিজ্ঞ মতামত তোমাকে নিরুৎসাহিত করে তো আলাদা ব্যাপার। কারণ পেশাদারদের অভিমত সূচনাকারীদের মেনে নেওয়া উচিত।

আমার মনে হয়, সাধারণভাবে, বিশেষজ্ঞদের মতামত না ধরে যে কোনও বিষয়ে ছোট বা বড় যাই হোক, অন্যদের মতামতের ওপর একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জনমতকে ততটাই সম্মান জানানো উচিত যতটা নিয়মসংগত, যা অনাহার এড়ানো বা কারাগারের বাইরে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয়। কিন্তু তা অতিক্রম করে গেলে এটা হবে অহেতুক নির্যাতনের কাছে মাথা নত করা এবং সুখের সব রকম পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। খরচের ব্যাপার ধরা যেতে পারে। অনেক লোককে দেখা যায়, তারা নিজেদের পছন্দ যা অনুমোদন করেন, তা থেকে ভিন্ন বিষয়ে অর্থ খরচ করেন, কারণ তাদের ধারণা ভাল একটা গাড়ি থাকলে অথবা সুন্দর নৈশভোজ খাওয়াবার ক্ষমতা থাকলেই তারা প্রতিবেশীদের সম্মান অর্জন করতে পারবেন। বাস্তব ব্যাপার হল, যে কোনও ব্যক্তি, যার গাড়ি কেনার ক্ষমতা আছে অথচ মনের দিক থেকে দেশভ্রমণ বা একটি ভাল গ্রন্থাগার পছন্দ করেন, শেষ পর্যন্ত অন্যেরা যেভাবে চলতে চান সেভাবে না চলেন, তাহলে অনেক বেশি মর্যাদা পাবেন। অবশ্য জোর করে জনমতকে অস্বীকার করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ত্ব নেই, সেটাও জনমতের আধিপত্য মেনে নেওয়ার মত, যদিও একটু ঘুরপথে। কিন্তু যদি আন্তরিকভাবে তার প্রতি নিস্পৃহ থাকা যায় তা শক্তির পরিচায়ক এবং সুখের উৎস হয়ে উঠবে। যে সমাজে নারীপুরুষ সকলেই একই ধরনের আচরণ করে, তার চেয়ে যে সমাজে তারা প্রচলিত প্রথার কাছে খুব বেশি মাথা নোয়ায় না, সেই সমাজ অনেক বেশি মনোহর। যেখানে প্রতিটি মানুষের চরিত্র ব্যক্তিগতভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, সেখানেই মানুষের স্বভাবের বৈচিত্র্য রক্ষিত হয় এবং নতুন মানুষের সাথে দেখা হওয়াটা উপকারী হয়। কারণ তারা যাদের সাথে একবার দেখা হয়েছে তাদের পদমর্যাদা তাদের জন্মের ওপর নির্ভরশীল, তারা নিজের খেয়ালখুশী মতো ব্যবহারের সুযোগ পায়। আধুনিক বিশ্বে আমরা সামাজিক স্বাধীনতার উৎসটি হারাতে চলেছি। সুতরাং সবকিছু একাকার হয়ে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে সুচিন্তিত ধারণা কামনীয়। আমি বলতে চাই না মানুষ ইচ্ছা করে খামখেয়ালি হয়ে উঠুক, কারণ তা রীতি মেনে চলার মতোই অপ্রীতিকর । আমি বলতে চাই মানুষ স্বাভাবিক হোক এবং তাদের স্বাধীন ইচ্ছামূলক পছন্দ অনুসরণ করে চলুক যতক্ষণ পর্যন্ত তা নিশ্চিতভাবে অভিজাতদের মতো না হয়। বর্তমান বিশ্বে দ্রুত চলাচল ব্যবস্থার সুযোগে মানুষ আর আগের মতো নিকটতম ভৌগোলিক প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভরশীল নয়। যাদের গাড়ি আছে তারা বিশ মাইলের ভিতর বাস করে এমন যে কোনও লোককে প্রতিবেশি মনে করতে পারেন। তাই তাদের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। যে কোন জনাকীর্ণ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে মানুষ বিশ মাইলের মধ্যে মনের সঙ্গী খুঁজে পায় না, তাকে নিশ্চিতভাবেই হতভাগ্য বলা যায়। নিকট প্রতিবেশীদের সাথে পরিচিত হওয়া উচিত, এই ধারণা ঘনবসতিপূর্ণ নগরে আর বেঁচে নেই, কিন্তু ছোট শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে এখনো রয়ে গেছে। সামাজিকতার জন্যে নিকটতম প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভরশীলতা যখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, তখন এই ধারণাও অর্থহীন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র কাছে থাকা লোকের মধ্যে সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার পরিবর্তে মনের মতো সঙ্গী নির্বাচন করার সুবিধা বেড়ে গেছে। সমজাতীয় পছন্দ ও সমমতের মানুষের সঙ্গলাভ সুখ বাড়িয়ে তোলে। এই পথেই সামাজিক সম্পর্ক নানাভাবে গড়ে উঠবে এটা আশা করা যায় এবং এই পথেই যে নিঃসঙ্গতা এখনো বহু মানুষকে বেদনায় ভরে তুলছে তা কমে যাবে বলে আশা করা যায় এবং তা প্রায় শূন্যেই অন্তর্লীন হবে। এতে সন্দেহাতীতভাবে তাদের সুখ বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পথে চলা লোকদের কাছে পেয়ে তারা যে বর্বর আনন্দ উপভোগ করে তার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে। আমি মনে করি না এটা এমন কোনও আনন্দ নয় যাকে রক্ষা করার জন্যে কোনওরূপ ভাবনার প্রয়োজন আছে।

অন্যান্য ভয়ের মতো জনমতের মতো ভয় যন্ত্রণাদায়ক এবং বিনাশের পথে বাধাস্বরূপ। এ রকম ভয় প্রবল হলে কোনও বড় কিছু করাই সম্ভব নয় এবং যে চিত্তস্বাধীনতায় আসল সুখ পাওয়া যায়, তা অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ আমাদের স্বতোৎসারিত চিত্তবৃত্তি থেকে যে জীবনধারা গড়ে ওঠে তাই হল সুখের মূল উৎস। আমাদের প্রতিবেশী বা আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া আকস্মিক কোনও পছন্দ বা ইচ্ছা থেকে আহরিত জীবনধারা নয়। নিকটতম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ভয় নানা কারণে আগের তুলনায় কমে গেছে সেটা ঠিক, কিন্তু নতুন এক ভয়ের কারণ দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সংবাদপত্র কী বলবে সেই মতামত নিয়ে ভয়। মধ্যযুগের ডাইনি-শিকারের মতো ভয়ংকর ভয়ের ঘটনার সাথেই শুধু এর তুলনা করা যায়। যখন কোনও সংবাদপত্র কোনও নিরীহ লোককে অন্যের দোষের ভারবাহী ব্যক্তি হিসাবে বেছে নেয় তার পরিণাম হয় ভয়ংকর। সৌভাগ্যক্রমে অধিকাংশ মানুষ অখ্যাত হওয়ার জন্যে এই পরিণাম এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রচার রীতি যতই আরো নিখুঁত হতে থাকবে, এই ব্যাপারে ততই সামাজিক নির্যাতনের এই অভিনব কৌশলটির সাহায্যে আরও বেশি বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। যিনি একবার এর হাতে বলি হয়েছেন, তার পক্ষে কোনভাবেই এই গুরুতর বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া চলে না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বপক্ষে যত কথাই বলা হোক, আমি মনে করি, বর্তমান মানহানির আইনে যেভাবে রয়েছে সেই সীমারেখা তার চেয়ে বেশি স্পষ্ট করে টানা উচিত এবং নিরীহ মানুষদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে এমন যে কোনও বিষয় সংবাদপত্রে প্রকাশ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এমন কী তারা এমন কিছু যদি করে থাকে বা বলে থাকে, যা বিদ্বেষপূর্ণভাবে প্রকাশ করলে তাদের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তারও প্রকাশ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এই অন্যায়ের একমাত্র চূড়ান্ত প্রতিকার হচ্ছে জনগণের দিক থেকে আরও বেশি সহনশীল হতে অভ্যস্ত হওয়া। সুখের সন্ধানে সহনশীলতা বৃদ্ধির শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে সুখী মানুষের সংখ্যা বাড়ানো যাতে তারা তাদের সহচরদের বেদনাহত করাকেই জীবনের প্রধান সুখ বলে মনে না করে।

———-
১. ফ্রন্টি ভগ্নিরা, Bronte Sisters। ভিক্টোরীয় যুগের ব্ৰন্টি ভগ্নিরা হলেন ঔপন্যাসিক এমিলি ব্ৰন্টি (১৮১৮-৪৮), শার্লেট ব্ৰন্টি (১৮২৬-৫৫) এবং এ্যান ব্ৰন্টি (১৯২০-৪৯)। স্বল্প জীবনের অধিকারিণী এই তিন ভগ্নির উপন্যাসে বিক্ষুব্ধ, নির্যাতিত আশার বিদ্রোহ ঘোষণা এবং নারীসমাজের পূর্ণতর জীবনের অধিকারের প্রশ্ন প্রখরভাবে ফুটে উঠেছে।

২. ব্লেক, William Blake, (১৭৫৭-১৮২৭)। ইংরেজ কবি ও চিত্রকর, যোগ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন মৃত্যুর পর।

৩. গ্যালিলিও, Galileo, (১৫৬৪-১৬৪২)। ইতালির বিখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর বিপজ্জনক মতবাদ হল, ‘Eppar si move’– পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। এই মতবাদ বাইবেল-বিরোধী। সেজন্যে বৃদ্ধবয়সে তাঁকে নির্যাতিত হতে হয়, ভোগ করতে হয় কারাদণ্ড। ১৯৯৪ সালে তার মৃত্যুর ৩৫২ বছর পর ভ্যাটিকান চার্চ তাঁর মতবাদ মেনে নেয়।

৪. কেপলার, Johaunes Kepler (১৫৭১-১৬৩০), জার্মান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং প্রকৃতি-দার্শনিক।

 ১০. সুখলাভ কি তবু সম্ভব?

এ পর্যন্ত আমরা অসুখী মানুষদের সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এখন আমরা সুখী মানুষদের নিয়ে আরো মনোরম আলোচনা করব। আমরা কয়েকজন বন্ধুর সাথে মত বিনিময় করে এবং তাঁদের বই পড়ে আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে যে, বর্তমান পৃথিবীতে সুখলাভ অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করে, বিদেশে ভ্রমণ করে এবং উদ্যানপালকের সাথে আলোচনা করে অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখেছি এই ধারণার কোনও অস্তিত্ব নেই। এর আগের একটি অধ্যায়ে আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে আমি কিছু বলেছি। এই অধ্যায়ে আমি জীবনে যে সব সুখী লোকের সংস্পর্শে এসেছি তাদের নিয়ে সমীক্ষা করব।

সুখ দু’রকমের, যদিও এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে বেশ কটা পর্যায় রয়েছে। যে দু’রকমের সুখের কথা বলছি, তা হচ্ছে রূপহীন এবং রূপময় অথবা দৈহিক এবং আত্মিক অথবা হৃদয়-উৎসারিত এবং মস্তিষ্ক-জাত। এতসব বিকল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় করা নির্ভর করবে কী প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে তার ওপর। আমি কোনও পূর্বপরিকল্পিত বিশ্বাস প্রমাণ করতে যাচ্ছি না, আমি শুধু বলে যাব। দু’রকমের সুখের পার্থক্য বর্ণনার সহজতম উপায় হচ্ছে একটি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারেন, অন্যটি শুধু যারা লিখতে পড়তে পারেন তাদের জন্যেই এই কথাটি বলা। আমি যখন বালক ছিলাম, তখন আমি আনন্দে ভরপুর একটি লোককে জানতাম যার কাজ ছিল কূপ খনন করা। অতি দীর্ঘ দেহ, অবিশ্বাস্য রকম পুষ্ট পেশী, সে পড়তে বা লিখতে জানত না। ১৮৮৫ সালে যখন সে পার্লামেন্টের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পেল তখন প্রথম জানতে পারল এই ধরণের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। তার সুখ মস্তিষ্ক উৎসারিত কোন কিছুর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এই সুখ, প্রকৃতির আইন অথবা প্রাণীজগতের প্রজাতিদের পূর্ণতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা অথবা সাধারণের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্বত্ব অথবা যীশুখ্রিস্টের পুনরাবির্ভাবে বিশ্বাসীদের জয়, অথবা বুদ্ধিজীবীদের কাছে জীবনকে উপভোগ করতে অন্য যেসব মতবাদ প্রয়োজন তার কোনওটার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি। তার সুখের ভিত্তি ছিল দৈহিক শক্তি, পর্যাপ্ত কাজ এবং পাথরের অলঙঘনীয় বাধাকে পরাজিত করা। আমার উদ্যানপালকের সুখের প্রজাতি একই। ছোট জাতের খরগোশের সাথে তার নিত্যদিনের সগ্রাম, আর তাদের সম্বন্ধে সে বলশেভিকদের সম্পর্কে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা যেভাবে বলে সেও ঠিক সেভাবেই বলে। সে মনে করে ঐ খরগোশগুলি কুটিল, চতুর এবং হিংস্র এবং তার মতে ওদের সমান ধূর্ততা না থাকলে ওদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন। নরওয়ের উপকথায় বর্ণিত ভ্যানথালার নায়কেরা প্রতিদিন একটি বিশেষ বন্যবরাহ শিকার করত এবং প্রতি সন্ধ্যায় তাকে হত্যা করত। কিন্তু কোনও অলৌকিক কারণে সে প্রতিদিন সকালে প্রাণ ফিরে পেত। আমার উদ্যানপালকও ঠিক একইভাবে একদিন তার শত্রুকে বধ করতে পারে নির্ভয়ে কারণ পরদিন সে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে এমন ভয় তার নেই। তার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে তবু সে সারাদিন কাজ করে এবং এই কাজের জন্যে সাইকেলে ষোল মাইল পাহাড়ি পথ প্রতিদিন তাকে আসা-যাওয়া করতে হয়। কিন্তু তার আনন্দের উৎস নিঃশেষ হয় না কখনো, আর তা যোগান দেয় ঐ খরগোশ।

কিন্তু আপনারা বলতে পারেন, আমাদের মতো উচ্চপর্যায়ের মানুষের জন্যে এইরূপ সহজ আনন্দ উন্মুক্ত নয়। খরগোশের মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা আর কতটুকু আনন্দ পেতে পারি? আমি মনে করি এটা খুব দুর্বল যুক্তি। পীত জ্বরের জীবাণু থেকে খরগোশ অনেক বড় কিন্তু তবুও উচ্চস্তরের লোক তার সাথে যুদ্ধ করে আনন্দ পেতে পারে। আনন্দের মধ্যে আবেগের যে উপাদান, সেখানে আমার উদ্যানপালক এবং একজন উচ্চশিক্ষিতের যে আনন্দ তা আলাদা করা যায় না। যেসব কাজের ভিতর দিয়ে আনন্দ পাওয়া যায় শিক্ষা শুধু সেখানে পার্থক্য তৈরী করে। কোনও কিছুতে সার্থকতা লাভের আনন্দ এমনই যে, আগে সাফল্য অনিশ্চিত বলে মনে হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত তাতে সফলতা লাভ হয়। এই কারণে সম্ভবত নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ না করাই সুখের একটি উৎস। যে মানুষ নিজের ক্ষমতাকে কম করে দেখে সে সবসময় সাফল্যে অবাক হয়, আর যে তার ক্ষমতাকে বেশি করে দেখে, সে সবসময় ব্যর্থতায় অবাক হয়। প্রথম রকমের অবাক হওয়া আনন্দের, পরেরটি বেদনার। তাই নিজের সম্বন্ধে অহংকার পোষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যদিও নিচু ধারণা পোষণ করে উৎসাহহীন হওয়াও উচিত নয়।

সমাজের উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে বর্তমানে যে বিজ্ঞানসেবকরা সবচেয়ে সুখী, তাঁদের মধ্যে যারা অতি বিখ্যাত তাঁদের অনেকেই আবেগের দিক থেকে খুব সরল । তাঁরা তাঁদের কাজের ভিতর যে তৃপ্তি পান, তা এতই গভীর যে, ভোজনে এমন কী বিবাহ থেকেও আনন্দ লাভ করতে পারেন। শিল্পী এবং সাহিত্যিকরা বিবাহে অসুখী হওয়াকে পালনীয় কর্তব্য বলে ভাবেন। কিন্তু বিজ্ঞানসেবীরা প্রায়ই পুরানো প্রথার গৃহী জীবনে পরম সুখ লাভ করেন। এর কারণ হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠ অংশ তাঁদের নির্দিষ্ট কাজে নিমগ্ন থাকে এবং যেখানে তার কোনও কাজ নেই, সেখানে তাকে অনধিকার প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কারণ আধুনিক পৃথিবীতে বিজ্ঞান প্রগতিশীল এবং ক্ষমতাশীল। এবং তার গুরুত্বে তাঁরা অথবা সাধারণ লোক, কারো সন্দেহ নেই। সুতরাং তাঁদের কাছে জটিল আবেগের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ সরল আবেগ কোনও পথেই বাধা পায় না। আবেগের জটিলতা নদীর জলের ফেনার মত। ফেনার জন্ম হয় নদীর চলমান স্রোতধারা বাধা পেলে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মূল শক্তি অব্যাহত থাকে ততক্ষণ উপরিভাগে কোনও আলোড়ন থাকে না এবং অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে যে শক্তি ধরাও পড়ে না।

বিজ্ঞানীর জীবনে সুখের সকল শর্তই পাওয়া যায়। তার কাজেই তাঁর পূর্ণশক্তি ব্যবহৃত হয় এবং তিনি যে সাফল্য অর্জন করেন তার গুরুত্ব শুধু তাঁর নিজের কাছেই নয়, জনসাধারণের কাছেও গৃহীত হয়। এমনকী তাদের কাছে তা বিন্দুমাত্র বোঝার মতো না হলেও। এক্ষেত্রে তিনি শিল্পী অপেক্ষা বেশি ভাগ্যবান। জনসাধারণ যখন কোনও ছবি বা কবিতা বুঝতে না পারে, তখন তারা ধরেই নেয় যে ছবিটি খারাপ বা কবিতাটি ভাল নয়। যখন তারা বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বুঝতে না পারে, তখন তা মনে করে (ঠিকই করে) যে তাদের শিক্ষা অপ্রতুল। কাজেই আইনস্টাইন(১) সম্মানিত হন এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা ছাদের চিলেকোঠায় অনাহারে, অবহেলায় পড়ে থাকেন এবং সেজন্যে বিজ্ঞানীরা সুখী এবং চিত্রশিল্পীরা অসুখী। খুব কম মানুষই যথার্থ সুখী যাকে অবিরাম জনসাধারণের সংশয়বাদের বিরুদ্ধে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। যদি না তিনি নিজেকে একটি গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ করে বাইরের জগতের শীতলতাকে ভুলে থাকতে পারেন। বিজ্ঞানীদের এই ধরনের দল গঠনের প্রয়োজন হয় না কারণ তাঁর সহকর্মী ছাড়া আর সকলেই তাকে সম্মান করেন। অপরদিকে, চিত্রশিল্পী নিন্দিত হবেন না নিন্দার্য হবেন, এই দুইয়ের মাঝখানে এক বেদনাময় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে থাকেন। তার ক্ষমতা যদি প্রথম শ্রেণীর হয়, তা হলে তাঁকে এটা বা অপরটা যে কোনও একটা দুর্ভাগ্যে ভুগতেই হবে। যদি তিনি তার ক্ষমতা ব্যবহার করেন তা হলে নিন্দিত হবেন এবং যদি না করেন তা হলে নিন্দাহ হবেন। অবশ্য সবসময় সব জায়গায় এরকম ঘটেনি।

এমন সময় ছিল যখন গুণী শিল্পীরা তাদের তরুণ বয়সে পর্যন্ত প্রশংসা পেয়েছেন। দ্বিতীয় জুলিয়াস(২) মাইকেল এঞ্জেলোর(৩) প্রতি দুর্ব্যবহার করলেও তিনি যে দক্ষ শিল্পী নন, তা কখনো ভাবেন নি। বর্তমান যুগের ধনপতিরা প্রধান শিল্পীদের তাদের সৃজন ক্ষমতা চলে গেলে তাঁদের প্রচুর অর্থ দান করতে পারেন, কিন্তু কখনো তাদের সৃষ্টিকে নিজের চেয়ে বড় বলে ভাবেন না। সম্ভবত শিল্পীরা গড়ে বিজ্ঞানীদের চেয়ে যে কম সুখী তার পিছনে এইসব ঘটনার অবদানও রয়েছে।

আমার নিশ্চিত ধারণা, পশ্চিমের স্বদেশের তরুণরা তাদের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার উপযুক্ত প্রয়োগক্ষেত্র না পাওয়ার কারণে অসন্তোষে ভুগছে। পূর্বদেশসমূহে অবস্থা কিন্তু এরকম নয়। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্ভবত রাশিয়াতে তরুণরা বেশি সুখী। সেখানে তারা এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করছে এবং তা করার জন্যে তাদের রয়েছে এক উদ্দীনাময় বিশ্বাস। প্রাচীনদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনাহারে রাখা হয়েছে, নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে অথবা অন্য কোনওভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে যাতে প্রত্যেক পশ্চিম দেশে তারা তরুণদের ক্ষতি করার অথবা কিছু করার মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বাধ্য করে, তেমন কিছু করতে না পারে। জ্ঞানাভিমানী পাশ্চাত্যবাসীদের কাছে তরুণ রাশিয়ানদের বিশ্বাস অমার্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু এর বিরুদ্ধেই বা বলবার কী আছে? সে সত্যি নতুন এক পৃথিবী সৃষ্টি করছে, তার মনের মতো পৃথিবী। যখন তার কাজ শেষ হবে, তখন রাশিয়ার মানুষ বেশি সুখী হবে। পশ্চিমের অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা এই নতুন পৃথিবীতে সুখী না হতে পারেন, কিন্তু তাদের তো সেখানে বাস করতে হবে না, তাই যে কোনও বাস্তবধর্মী বিচারে তরুণ রাশিয়ানদের বিশ্বাসকে সমর্থন করা যায় এবং তত্ত্বভিত্তিক কারণ ছাড়া একে অমার্জিত বলে নিন্দা করাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না।

ভারত, চীন এবং জাপানে রাজনৈতিক অবস্থার ওপর বাইরের প্রভাব তরুণ শিক্ষিতদের সুখে অন্তরায় হয়, কিন্তু সেখানে ভিতরের কোনও বাধা নেই যা রয়েছে পশ্চিমের দেশে। এমন অনেক কাজ রয়েছে যা তরুণদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এবং এইসব যতটা সফল হয় ততটাই তারা সুখী হয়। তারা মনে করে জাতীয় জীবনে তাদের একটা গুরুত্ববহ ভূমিকা রয়েছে এবং এমন সব লক্ষ্য রয়েছে যা অনুসরণ করা কঠিন হলেও তা অর্জন করা অসম্ভব নয়। পাশ্চাত্যের উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বনিন্দুকতা বোধ দেখা যায়, যার সৃষ্টি আরাম এবং ক্ষমতাহীনতার যোগফল থেকে। ক্ষমতাহীনতা মানুষকে অনুভব করতে শেখায় যে, কোনও কিছুই কাজের নয় এবং আরাম এইসব বেদনাদায়ক অনুভূতিকে কোনওভাবে সহনশীলতার মধ্যে ধরে রাখে। প্রাচ্য দেশসমূহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জনমতের ওপর আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করার আশা করে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশের ছাত্ররা তা পারে না। কিন্তু পাশ্চাত্যের ছাত্রের মতো প্রচুর উপার্জন করার সুযোগ তাদের অনেক কম। ক্ষমতাহীন অথবা অসচ্ছল হওয়ার কারণে সে হয় সংস্কারক অথবা বিপ্লবী, কিন্তু বিশ্বনিন্দুক হয় না। জনগণের ব্যাপার কোন পথে চলবে তার ওপর সংস্কারক অথবা বিপ্লবীর আনন্দ নির্ভর করে। কিন্তু সম্ভবত সে যখন ফাঁসির দড়ি পরতে চলেছে, তখন একজন স্বাচ্ছন্দ্যভোগী বিশ্বনিন্দুকের চেয়ে বেশি বাস্তব আনন্দ অনুভব করে। এক চীনা যুবকের কথা মনে পড়ছে আমার যে আমার স্কুল দেখতে এসেছিল। সে চীনের প্রগতিবিরোধী অঞ্চলে এইরকম একটি স্কুল স্থাপন করবে বলে দেশে ফিরে যাচ্ছে। সে জানে এর ফলে তার হয়তো শিরচ্ছেদ হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে এমন এক শান্ত আনন্দ অনুভব করছিল যার জন্যে আমি তাকে ঈর্ষা করি।

আমি এমন মন্তব্য করতে চাই না যে এ ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ সুখই হচ্ছে সম্ভাব্য একমাত্র সুখ। বাস্তবে এই সুখের পথ যাদের জন্যে খোলা, তারা হচ্ছে সংখ্যালঘু কারণ তার জন্যে প্রয়োজন এক ধরণের বিশেষ দক্ষতা এবং স্বার্থের প্রসারতা, যা খুব সাধারণ নয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাই শুধু তাদের কাজে আনন্দ পেতে পারেন তা নয়। নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনেতারাও যে শুধু কোনও মতকে সমর্থনের ভিতর আনন্দ পেতে পারেন তাও নয়। কাজের আনন্দ যে কোনও মানুষের জন্যে উন্মুক্ত, যদি তিনি বিশেষ দক্ষতার অধিকারী হন, যদি না তিনি সাধারণের প্রশংসা পাওয়ার জন্যে তা করেন তাহলে তিনি তার দক্ষতা প্রয়োগের মধ্যেই তৃপ্তি পেতে পারেন। আমি একজনকে জানতাম, যিনি শৈশবেই দুই পায়ের ব্যবহার-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তবু তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবন অবিচলিত সুখে অতিবাহিত করেছেন। এই সুখ তিনি লাভ করেছিলেন পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ একটা গ্রন্থ রচনা করে, যার বিষয়বস্তু ছিল গোলাপের কীট। এই বিষয়ে সবসময় তাঁকেই আমি প্রধান বিশেষজ্ঞ বলে মনে করি। অনেক সংখ্যক শখ-বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমি পাইনি। কিন্তু যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, তাদের কাছে সব সময় শুনেছি যারা শঙ্খ বিষয়ে গবেষণা করেন তাঁরা এর মধ্যে একধরণের পরিতৃপ্তি খুঁজে পান। একসময় আমি একজনকে জানতাম প্রেসের কম্পোজিটর হিসাবে পৃথিবীতে তাঁর তুলনীয় কেউ ছিল না এবং যারা সুন্দর সুন্দর হরফ তৈরী করতেন তারা তাঁর সাহায্য চাইতেন। তিনি সবার কাছ থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা পেতেন। যাদের শ্রদ্ধাকে কখনো কোনও ভাবে লঘু করে দেখা যায় না। কিন্তু তিনি যে আনন্দ লাভ করতেন তা সেই শ্রদ্ধালাভ থেকে ততটা নয়, যতটা পেতেন তার নিজের নৈপুণ্য প্রয়োগ থেকে এবং এই সেই আনন্দ যা লাভ করেন একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী তার নৃত্য থেকে, যার সাথেই শুধু তুলনীয় তা কাজ থেকে পাওয়া আনন্দ। আমি আরো অনেক কম্পোজিটরকে জানি যারা গণিতবিদ্যার বিভিন্ন হরফ, প্রাচীন নেস্টেরিয়ান হরফ অথবা কিউনিফর্ম হরফ এবং যা কিছু ভিন্নধর্মী এবং কঠিন তা সাজিয়ে দিতে পারদর্শী ছিলেন। তাদের পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল কিনা তা আমি জানতে পারিনি। কিন্তু কাজের সময় তাদের সৃজনদক্ষতা পূর্ণ চরিতার্থতা লাভ করত।

এটা বলা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে পুর্বে শিল্পীরা তাদের কাজের দক্ষতায় যে আনন্দ পেতেন আমাদের এই যন্ত্র-যুগে শিল্পীরা সেই আনন্দ পাবেন তেমন সুযোগ নেই। একথা সত্য যে মধ্যযুগের শিল্পীমহল যে ধরনের কাজ করতেন, বর্তমানের কারিগরদের কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু যান্ত্রিকযুগের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্ব এবং প্রয়োজন রয়েছে। একদল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং সূক্ষ্ম কলকজা তৈরী করে, একদল নকসা তৈরী করে, একদল বিমান যান্ত্রিকের কাজ করে, একদল গাড়ি চালায় এবং আরো নানা ধরনের কাজে বহু কারিগর নিয়োজিত। যাদের ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রকাশ একেবারেই সীমিত। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন যুগে ফসলের মাঠে মজুর এবং কৃষক, যতদূর আমি দেখেছি, মোটরচালক অথবা ইঞ্জিন চালকের মতো সুখী নয়। তবে একথা সত্যি যে কৃষক নিজের জমি আবাদ করে, তার কাজে বৈচিত্র্য আছে। সে নিজে চাষ করে, বীজ বোনে, ফসল কাটে, কিন্তু সে প্রকৃতির অধীন এবং এ বিষয়ে সে সচেতন। অন্যদিকে যে মানুষ আধুনিক যন্ত্র চালায় সে নিজের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন, সে জানে মানুষই হল প্রকৃতির প্রভু, দাস নয়। তবে একথাও অবশ্য সত্যি যে শুধুমাত্র যারা যান্ত্রিক মনের, যারা দিনের পর দিন বৈচিত্র্যহীন একই যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে তাদের কাজে কোনও স্বাদ নেই এবং সেই কাজ যতই স্বাদহীন হোক, ততই তা যন্ত্রের সাহায্যে করা যাবে। যান্ত্রিক উৎপাদনের চরম লক্ষ্য, এ কথা সত্যি যা থেকে আমরা অনেক দূরে, সেটা হচ্ছে একটা পদ্ধতি যাতে প্রত্যেকটি অনাকর্ষণীয় কাজ যন্ত্রের সাহায্যে করা যাবে। আর সেখানে যে কাজে বৈচিত্র্য এবং প্রেরণা আছে সে কাজের জন্যে মানুষকে আলাদা করা যেতে পারে। এইরকম পৃথিবীতে কাজে একঘেয়েমি কম হবে এবং অবসাদও কমে যাবে যা কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে কখনো হয়নি। চাষব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষ অনাহারের কবল থেকে বাঁচার জন্যে একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকে মেনে নিয়েছে। যখন শিকারের সাহায্যে মানুষ খাদ্য সগ্রহ করত এবং তখন কাজই ছিল তার কাছে আনন্দ। তার প্রমাণ ধনবানরা এখনও আনন্দ উপভোগের জন্যে পূর্বপুরুষদের এই শিকার বৃত্তিকে অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু কৃষিকাজ প্রবর্তনের পর থেকে মানুষ নীচতা, দুর্ভোগ এবং উন্মত্ততার এক সুদীর্ঘ যুগে প্রবেশ করেছে। যা থেকে মাত্র এখন তারা মুক্ত হয়ে যন্ত্রের কল্যাণময় কাজের সাথে যুক্ত হতে চলেছে। মাটির স্পর্শের যে অনুভূতি তা শুনতে ভাল লাগে অনুভূতিপ্রবণদের মুখে, ভাল লাগে হার্ডির(৪) সৃষ্টি, দার্শনিক কৃষকদের পক্ক জ্ঞানের কথা, কিন্তু গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকটি তরুণের একমাত্র কামনা শহরে কাজ পাওয়া, যেখানে সে মুক্তি পাবে জল-হাওয়ার দাসত্ব এবং আলোহীন দীর্ঘ শীতের সন্ধ্যার একাকীত্ব থেকে এবং কলকারখানা এবং প্রেক্ষাগৃহের মানবিক পরিবেশে প্রবেশ করতে পারবে। সাধারণ মানুষের সুখের প্রথম উপাদান হল সাহচর্য এবং সহযোগিতা এবং তা কৃষি থেকে শিল্পে অনেক পূর্ণতার সাথে পাওয়া যায়। আমি শুধু নির্যাতিত দেশসমূহের বিপ্লবী, সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীদের কথা বলছি না, আমি অনেক অবনমিত ধরণের বিশ্বাসের কথাও চিন্তা করছি। আমি এমন কয়েকজন লোককে জানি যারা বিশ্বাস করতেন ইংরেজরা ইফ্রেইম ও মানাস(৫) উপজাতির বংশধর, তাদেরও আনন্দের কোনও সীমা নেই। আমি এই কথা বলছি না যে পাঠক এইসব ধারণা বিশ্বাস করুন, কারণ যে বিশ্বাসের কোনও ভিত্তি নেই, যা আমার কাছে ভুল বিশ্বাস বলে মনে হয় তা থেকে সুখ লাভ করতে। এই একই কারণে আমি পাঠককে এই কথা বিশ্বাস করতে জোর দিচ্ছি না যে, মানুষ একমাত্র বাদামের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকুক। যদিও যতদূর পর্যন্ত আমার পর্যবেক্ষণ পৌঁছায়, আমি দেখেছি এই ধরণের বিশ্বাসে নিশ্চিন্ত আনন্দ লাভ হয়, যা বিশুদ্ধ। সুখের জন্যে কোনও কোনও বিশ্বাসে যাদের উৎসাহ যথার্থ, তারা এর মধ্যেই তাদের অবসর সময়ের একটা কাজ পেয়ে যান এবং জীবনটা শূন্য– এই যাদের অনুভূতি তারাও তাদের মনোরোগের এক পূর্ণ প্রতিকার পেয়ে যান। কোনও একটা শখে ডুবে থাকা, অজ্ঞাত বিশ্বাসে আনুগত্য পোষণ করা থেকে খুব দূরে নয়। একজন প্রখ্যাত জীবিত গণিতবিদ তাঁর সময়কে গণিত চর্চা এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ এই দুই কাজের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। আমি মনে করি প্রথমটাতে যখন তিনি অগ্রসর হতে পারেন না, সেইসব মূহুর্তে দ্বিতীয়টার মধ্যে তিনি সান্ত্বনা পেতেন। গণিতের প্রতিপাদ্য প্রমাণে দূরূহতা একমাত্র দুঃখ নয়, যা ডাকটিকিট সংগ্রহ দূর করতে পারে অথবা ডাকটিকিটই একমাত্র জিনিস নয় যা সগ্রহ করা যায়। একবার বিবেচনা করে দেখুন, পুরোনো চিনেমাটির জিনিস, নস্যির কৌটো, রোমান মুদ্রা, তীরের ফলা, প্রস্তরযুগের যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কল্পনার ভিতর কী বিশাল উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে মানসপটে। একথা সত্যি যে আমাদের মধ্যে অনেকেই এত উচ্চস্তরের যে এইসব সরল আনন্দে কোনও মূল্য পায় না। এসব আনন্দ আমরা সকলেই ছোটবেলায় উপভোগ করেছি, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক এসবকে এখন বয়স্কদের জন্যে অনুপযুক্ত মনে করছি। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, অপরের পক্ষে অনিষ্টকর নয়, এমন যে কোনও আনন্দকেই মর্যাদা দেওয়া। উচিত। আমি নিজে নদীর তথ্য সগ্রহ করি। ভলগা নদীর ভাটি এবং ইয়াংসি নদীর উজান বেয়ে চলার পথে আনন্দ পেয়েছি এবং আমাজন ও ওরিনোকো নদী কখনো দেখিনি বলে আমার খুব দুঃখ। এই ধরণের সব আনন্দের অনুভূতি খুব সরল। আমি তার জন্যে লজ্জিত নই। অথবা বেসবল খেলায় উৎসাহীদের কথা বিবেচনা করুন, প্রবল আগ্রহের সাথে তারা সংবাদপত্র পড়েন আর রেডিওর ধারা বর্ণনা তাদের মনে দারুণ রোমাঞ্চ জাগায়। আমেরিকার এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁর বই পড়ে আমার মনে হয়েছিল তার মন বিষাদময়তায় ভরা, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই সময়ে রেডিওতে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বেসবল খেলার ফল ঘোষিত হচ্ছিল। তিনি সেই মুহূর্তে আমার কথা ভুলে গেলেন, ভুলে গেলেন সাহিত্য এবং আমাদের জাগতিক জীবনের সব দুঃখ-যন্ত্রণা। তাঁর প্রিয় দলের জয়লাভে তিনি আনন্দে চিৎকার করতে লাগলেন। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর বই পড়ার সময়, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের দুর্ভাগ্যে আর কষ্ট পাইনি।

খেয়াল এবং শখ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবত অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌল আনন্দের উৎস নয়, কিন্তু শুধু বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর একটা উপায়। কোনও কোনও কঠিন বেদনার মুখোমুখি হওয়াকে মুহূর্তের জন্যে ভুলে থাকা, মৌল আনন্দ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল যার ওপর, যাকে বলা হয় মানুষ এবং বস্তুর ওপর। সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহল।

মানুষের বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহল স্নেহময় আবেগের একটি ধরণ। কিন্তু এই রূপে নয়, যার মধ্যে কর্তৃত্ব বা অধিকারের ভাব থাকে অথবা কাছ থেকে জোর সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা। শেষোক্ত ধরণটি প্রায় ক্ষেত্রে দুঃখের কারণ হয়। যে ধরণটি সুখের কারণ ঘটায় তা হচ্ছে মানুষকে গভীরভাবে লক্ষ্য করা, তা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে আনন্দ পাওয়া, যারা সংস্পর্শে আসবে তাদের কৌতূহল বা আনন্দ প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা, তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে না চাওয়া অথবা তাদের কাছ থেকে উৎসাহজনক প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করা। যে ব্যক্তি অন্যদের সম্পর্কে আন্তরিকভাবে এইরকম ভাবেন তিনি যেমন অন্যদের কাছে আনন্দের উৎস, বিপরীতভাবে তারাও তার কাছে মমতার গ্রাহক। তার সাথে অন্যদের সম্পর্ক হালকা অথবা গভীর হোক তার কৌতূহল এবং মমতা দুয়েরই জন্যে তৃপ্তিকর, অকৃতজ্ঞতায় বিষময় নয়। কারণ অকৃতজ্ঞতা তিনি পাবেন না এবং পেলে তা খুব কম লক্ষ্য করবেন যে মেজাজ-বৈশিষ্ট্য অন্য লোকের স্নায়ুর ওপর চাপ দিয়ে তাকে প্রায় ক্রুদ্ধ করে তোলে, সেই একই মেজাজ-বৈশিষ্ট্যতার কাছে মৃদু আমোদের উৎস হয়ে উঠবে। অন্য লোক কঠিন পরিশ্রম করেও যা পান না, তা তিনি বিনা শ্রমে পেয়ে যাবেন। নিজেকে নিয়েই নিজে সুখী থাকাতে তিনি একজন মনোরম সঙ্গী হবেন এবং এতে তাঁর সুখ আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু এর সবই যেন নির্ভেজাল হয়,এসব যেন কর্তব্যবোধের তাগিদ থেকে এক ধরণের আত্মত্যাগের ধারণা থেকে না আসে। কর্তব্যবোধ কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কে আক্রমণাত্মক, মানুষ অন্যের কাছে পছন্দের হতে চায়, করুণার পাত্র হতে চায় না, অনেক লোককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং চেষ্টাবিহীন পছন্দ করা মনে হয় ব্যক্তিগত আনন্দের সব উৎসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

পূর্ব অনুচ্ছেদে আমি বিভিন্ন জিনিসে সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহলের কথা বলেছি। কথাটি আরোপিত মনে হতে পারে। কোনও জিনিসের বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভব করা অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু ভূতত্ত্ববিদ পাথর নিয়ে, পুরাতত্ত্ববিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন কীর্তি নিয়ে যে বন্ধুত্বভাব ধারণ করেন তা ঐ কৌতূহলের অনুরূপ। আর এই কৌতূহল ব্যক্তি বা সমাজের যে মনোভাব তারই একটি উপাদান হতে পারে। কোনও জিনিস যদি বন্ধুভাবাপন্ন না হয়ে শত্রু ভাবাপন্ন হয়, তাহলে তার প্রতিও কৌতূহল বজায় রাখা সম্ভব। কোনও মানুষ মাকড়সার স্বাভাবিক বাসস্থান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন কারণ তিনি মাকড়সাকে ঘৃণা করেন এবং সেখানেই বাস করতে চান যেখানে তারা সংখ্যায় কম। এই কৌতূহল সে তৃপ্তি দেবে না, যা লাভ করেন ভূতত্ত্ববিদ পাথর থেকে। আমাদের চতুষ্পর্শ্বের অবস্থানরত জীবদের চেয়ে অব্যক্তিগত জিনিসে কৌতূহল দৈনন্দিন সুখের উপকরণ হিসাবে সম্ভবত কম মূল্যবান, তবুও এর গুরুত্ব কম নয়। পৃথিবীর বিস্তৃতির যেন সীমা নেই কিন্তু আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। যদি আমাদের সুখ ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ রাখা যায়, তাহলে জীবন যেটুকু দিতে পারে তার থেকে বেশি না করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এবং বেশি দাবি করার অর্থই হল যা পাওয়া সম্ভব তার চেয়ে কম পাওয়া। যে মানুষ নিজের দুঃখ ভুলে থাকতে পারেন, খ্রিস্টিয়ে ট্রেন্টের কাউন্সিল বা নক্ষত্রের জন্ম ইতিহাস নিয়ে খাঁটি কৌতূহলের কারণে, তিনি যখন নৈর্ব্যক্তিক পৃথিবী-পরিক্রমণ শেষে নিজের পরিবেশে ফিরে আসেন তখন তিনি দেখতে পান এমন একটি ভারসাম্য ও প্রশান্তি তিনি লাভ করেছেন যাতে সব দুঃখকে জয় করা সহজতম পথেই সম্ভব হয়েছে এবং এর মধ্যেই নশ্বর হলেও তিনি এক নির্ভেজাল আনন্দ লাভ করেছেন।

সুখলাভের গোপন সূত্রটি হচ্ছে এই আপনার কৌতূহলকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর সীমায় ছড়িয়ে দিন। আপনার যেসব ব্যক্তি বা বিষয়ে কৌতূহল তাদের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া বৈরীভাবাপন্ন না হয়, বন্ধুসুলভ হোক। পরবর্তী অধ্যায়সমূহে সুখলাভের সম্ভাব্য উপায়গুলির এই প্রাথমিক সমীক্ষাটি আরো বিস্তারিত করা হবে এবং তার সাথে দুঃখের মনস্তাত্ত্বিক উৎসসমূহের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় এবং সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

——
১. আইনস্টাইন, Albert Einstein (১৮৭৯-১৯৫৫)। অপেক্ষিকতাবাদের (Theory of relativity) জনক। দক্ষিণ জার্মানীতে জন্ম। তার তত্ত্ব প্রভাবিত করেছে আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের সব শাখাকে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে ‘বোস-আইনস্টাইন’ সংজ্ঞার উদগ্যাতা। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মানুষ ছিলেন, শান্তি আন্দোলনে তার অবদান অসামান্য। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন ও সুস্পষ্ট। এই বিজ্ঞান সাধক বলেছিলেন, ‘The most beautiful thing we can experience is teh mysterious.’

২. দ্বিতীয় জুলিয়াস, Pope Julius II (১৪৪৩-১৫১৩)। তিনি বিখ্যাত রোমান রাজা এবং ধর্মগুরু ছিলেন। তখনো চার্চ এবং রাষ্ট্র আলাদা হয়নি। তাঁর বীরত্বের খ্যাতি এবং যোদ্ধা পোপের জন্যে তিনি ‘Papa Terrible’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

৩. মাইকেল এঞ্জেলো, Michael Angelo (১৪৭৫-১৫৬৪)। ইটালির নবজাগরণের যুগের (Renaissance) বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী, তার চিত্রকলা আধুনিক মানুষদের কাছে বিস্ময়।

৪. হার্ডি, Thomas Hardy (১৮৪০-১৯২৯)। ভিক্টোরীয় যুগের কবি এবং ঔপন্যাসিক। তাঁর সাহিত্যে নিষ্ঠুর নিয়তি এবং জীবনের গভীর দুঃখবাদের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁকে ‘English Author of the naturalist movement’ রূপে অভিহিত করা হয়। ৫. ইফ্রেইম ও মানাস, Ephraim and Manasseh, বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament)– এ বর্ণিত যোসেফের দুই পুত্র। সুসমাচারের (Gospel) অন্তর্লীন সত্যের আবিষ্কর্তা, যাতে নির্দেশিত হয়েছে খ্রিস্টবাদীদের জীবনযাপনের বিধি এবং অনন্ত জীবনের কথা।

১১. উদ্দীপনা

এই অধ্যায়ে, যাকে সুখী মানুষের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এবং বিশ্বজনীন চিহ্ন বলে মনে করি, সেই উদ্দীপনা নিয়ে আলোচনা করব।

এই উদ্দীপনা বলতে কী বোঝায় সম্ভবত তা বুঝিয়ে বলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে মানুষ ভোজনের সময় বিভিন্নভাবে যে আচরণ প্রকাশ করেন তা নিয়ে আলোচনা করা। আহারের বস্তু যত ভালই হোক, অনেকের কাছে আহার শুধুই বিরক্তিকর, তারা এতে কোনও স্বাদ পান না। আগে তারা উৎকৃষ্ট খাদ্য খেয়েছেন সম্ভবত প্রত্যেক আহারের সময়। ক্ষুধা অতি কাতর না হওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকার কোনও অভিজ্ঞতা তাদের নেই এবং তারা যে সমাজে বাস করেন সেই সমাজের আচরিত রীতি হিসাবেই তারা খাদ্যকে দেখেছেন। অন্যান্য সব কিছুর মতো আহারও তাদের কাছে ক্লান্তিকর। কিন্তু এটা নিয়ে অকারণ ব্যস্ত হওয়া অর্থহীন। কারণ অন্য কোনও কিছুই এর চেয়ে কম ক্লান্তিকর নয়। তারপর ধরুন স্বাস্থ্যহীনদের কথা, তারা কর্তব্যবোধ থেকে খান, কারণ চিকিৎসকের নির্দেশ হল দেহের পুষ্টির জন্যে কিছু তাদের খেতেই হবে। তারপর ভোজনবিলাসীদের কথা, তারা খুব আশা নিয়ে শুরু করেন, কিন্তু তারপর দেখেন রান্না যতটা ভাল হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি। তারপর পেটুকদের কথা। যারা খাওয়ার আয়োজন দেখলেই লোলুপের মতো খেতে থাকে এবং বেশি খেয়ে ফেলেন। তারপর অতিভোজনের অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন। সবার পরে যাদের কথা বলছি তারা ভাল ক্ষুধা নিয়ে খেতে বসেন, আনন্দের সঙ্গে যতটা প্রয়োজন ততটাই খান এবং শেষ করেন। আর যারা জীবনের ভোজে বসেছেন, জীবনের যা কিছু সুন্দর তার প্রতিও তাদের আগ্রহ সমতুল্য। ভোজনকারীদের মধ্যে সবার শেষে যার কথা বললাম, তিনি সুখী মানুষের অনুরূপ। ক্ষুধার সাথে খাদ্যের যে সম্পর্ক, জীবনের সাথে উদ্দিপনারও তাই। যে মানুষ আহারে বিরক্তিবোধ থেকে আহার করেন তিনি তপস্বীর সমতুল্য। আর পেটুক ইন্দ্রিয়বিলাসীর সগোত্র। পেটুক ছাড়া অন্য সকলে, যে ব্যক্তি স্বাভাবিক ক্ষুধা বোধ করে তাকে ভালভাবে দেখে না এবং নিজেদের তার অপেক্ষা উচ্চস্তরের মনে করেন। ক্ষুধার খাদ্যকে উপভোগ করা এদের কাছে অমার্জিতসুলভ আচরণ এবং জীবনকে উপভোগ করাও তাই। কারণ জীবন বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর ঘটনায় পূর্ণ এবং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার উৎস। যাদের তারা সাধারণ মানুষ বলে তুচ্ছ করেন তাদের মোহমুক্তির উচ্চতা থেকে নিচের স্তরের মানুষরূপেই দেখেন। আমি এই দৃষ্টি ভঙ্গীকে মোটেই সমর্থন করি না। সবরকম মোহমুক্তিকেই আমি একটি রোগ বলে মনে করি। কোনও বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ কোনও বিষয়ে অনিবার্যরূপে মোহমুক্তি ঘটতে পারে, একথা সত্যি; কিন্তু যখনই ঘটুক অবিলম্বে সেই রোগটা সারিয়ে নেওয়া উচিত এবং তাকে জ্ঞানের উচ্চতর পর্যায়রূপে ভাবা ঠিক নয়। ধরা যাক কোনও একজন লোক স্ট্রবেরি ফল খেতে পছন্দ করেন, অন্যজন পছন্দ করেন না, তাহলে কোন্ দিক থেকে পরের লোকটি আগের জনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হন? সেইসব স্ট্রবেরি ভাল অথবা ভাল নয় তার কোনও বস্তু বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ প্রমাণ নেই। যিনি স্ট্রবেরি পছন্দ করেন তার কাছে ওটা ভাল, যিনি করেন না তার কাছে ওটা ভাল নয়। কিন্তু যিনি পছন্দ করেন, তিনি তার থেকে একটা আনন্দ পান, অন্যে তা পান না। তাই যিনি আনন্দ পান, তার কাছে ততটুকু উপভোগ্য এবং যে পৃথিবীতে দুইজনকেই বাস করতে হয়, সেখানে তিনিই বেশি মানিয়ে নিতে পারবেন। এই তুচ্ছ বিষয়ে যা সত্যি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাই সত্যি। যে ব্যক্তি ফুটবল খেলা দেখে আনন্দ পান, আর যিনি পান না, তার চেয়ে সেই পরিমাণ বড়, যে ব্যক্তি বই পড়ে আনন্দ পান, আর যিনি পান না, তার চেয়ে আরো বেশি বড়, কারণ বই পড়ার সুযোগ অনেক বেশি পাওয়া যায় ফুটবল খেলা দেখার চেয়ে। যিনি যত বেশি জিনিসে উৎসাহী, তার জন্যে আনন্দের উপকরণ ততটাই বেশি। কারণ ভাগ্যের দয়ার ওপর তিনি নির্ভরশীল নন। কারণ তিনি একটা হারালে অন্যটা খুঁজে নিতে পারেন। মানুষের জীবনায়ু বড় কম, তাই সব বিষয়ে উৎসাহী হওয়া যায় না। কিন্তু সময়কে ভরিয়ে রাখার জন্যে যত বেশি বিষয়ে উৎসাহী হওয়া যায় তত ভাল। আমরা সকলেই অন্তবৃত রোগের প্রবণতার দিকে ঝুঁকে থাকি, যিনি তার সামনে পৃথিবীর বিচিত্র সব দৃশ্য ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টিকে ফিরিয়ে অন্তশূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা যেন এমন কিছু কল্পনা না করি যে এই অন্তত মানুষটির অসন্তোষের মধ্যে চমকপ্রদ কিছু রয়েছে।

সসেজ তৈরীর দুটি যন্ত্রের গল্প বলি। একদা কুশল হাতের তৈরী দুটি উৎকৃষ্ট যন্ত্র ছিল, যাদের কাজ ছিল শূকর মাংস থেকে সুস্বাদু সসেজ তৈরী করা। এদের একটি যন্ত্র সসেজ তৈরীতে খুবই উৎসাহী ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে তৈরী করত। অন্য যন্ত্রটি বলল, “শুকর মাংসে আমার কী হবে, আমার নিজের কাজ ওর চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক এবং বিস্ময়কর।” সে এরপর শূকর মাংস নিতে অস্বীকার করে নিজের ভিতরকার সব কিছু পরীক্ষা করতে আরম্ভ করল, এইভাবে স্বাভাবিক খাদ্য বিহীনতায় তার ভিতরের সব কলকজা অকেজো হয়ে পড়ল এবং যতই সে তা নিয়ে সমীক্ষা করতে লাগল ততই তা তার কাছে শূন্য এবং তুচ্ছ মনে হতে লাগল। এই উৎকৃষ্ট যন্ত্রটার শুকর-মাংসের লোভনীয় রূপান্তর ঘটাবার যে দারুণ ক্ষমতা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেল, সে জানতেই পারল না তার ক্ষতির পরিমাণ। যে ব্যক্তি তার জীবনের উদ্দীপনা হারিয়েছেন তার সাথে তুলনা করে চলে এই দ্বিতীয় সসেজ-যন্ত্রটির আর যিনি তা ধরে রেখেছেন তার সাথে তুলনা চলে প্রথম যন্ত্রটির। মানুষের মন এক অদ্ভুত যন্ত্র। যেসব পদার্থ তাকে দেওয়া হয়, অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সে তাদের সংযুক্ত করে দেয়, কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে উপকরণ না পেলে সে শক্তিহীন হয়ে যায়। তবে মনকে তার প্রয়োজনীয় উপকরণ নিজেকেই সগ্রহ করে নিতে হয়, সসেজ-যন্ত্রকে যা করতে হয় না। ঘটনার প্রতি আমাদের যে আগ্রহ, তার মাধ্যমেই তারা অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়। যদি তারা আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে তারা আমাদের কাজে লাগে না। যে মানুষের মনোযোগ অন্তর্মুখী তিনি দৃষ্টিকে আকর্ষণ করার মতো কিছু দেখতে পান না, পক্ষান্তরে যার মনোযোগ বহির্মুখী, নিজের ভিতর তিনি খুঁজে পান, সেইসব দুর্লভ মুহূর্তে বিচিত্র রকমের সব উপকরণ খণ্ডিত হয়ে আবার মিশে গিয়ে, দর্শনীয় এবং শিক্ষণীয় কত নতুন নতুন রূপে ফুটে উঠেছে।

উদ্দীপনার রকম অসংখ্য। শারলক হোমসের(১) কথা মনে করুন। তিনি পথ থেকে একটা টুপি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, তিনি এই টুপির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, এই টুপির মালিক মদ্য পানের ফলে অধঃপতন ডেকে এনেছে এবং তার পত্নী আর আগের মতো তাকে ভালবাসে না। এইভাবে হঠাৎ পাওয়া কোনও বস্তু যার মনে এত গভীর উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে তার কাছে জীবন কখনো বিরক্তিকর হতে পারে না। গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় কত রকমের জিনিস লক্ষ্য করা যেতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন। কেউ হয়তো পাখিদের বিষয়ে উৎসাহী, কেউ গাছপালায়, কেউ ভূতত্ত্বে, কেউ কৃষিতে, কেউবা অন্য কিছুতে। এর মধ্যে যে বিষয়ে আপনার আগ্রহ তাই আপনাকে আনন্দ দেবে, অন্য সব কিছু যদি সমান হয় এবং এর একটিতে যদি আগ্রহী হয়ে থাকেন তিনি, তাহলে সবদিকে আগ্রহহীন ব্যক্তির চেয়ে তিনি এই বিশ্বের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত।

বিভিন্ন মানুষের সহচরদের প্রতি আচরণ কত বিচিত্র রকমভাবে আলাদা, দীর্ঘ রেলভ্রমণে একজন যাত্রী তার সহযাত্রীদের একজনকেও লক্ষ্য করলেন না। অথচ অন্য একজন তাদের সবার সম্পর্কে একটা ধারণা গঠন করে নিলেন, তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন, তাদের কার কেমন অবস্থা তা নিয়েও অনুমান তৈরী করে। নিলেন, এমন কী তাদের অনেকের গোপন কথাও, মনে হয় তিনি জেনে নিলেন। অন্যদের সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির আচরণের মধ্যে যতটুকু পার্থক্য, অন্যদের ব্যাপারে ধারণা-গঠনেও ততটুকু পার্থক্য। কারো কারো কাছে আবার প্রত্যেক মানুষই বিরক্তিকর, অন্যেরা কারো সাথে পরিচিত হলে খুব সহজেই এবং স্বল্প সময়ে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করে নেন, যদি তাকে অন্যরকম ভাবার নিশ্চিত কোনও কারণ না থাকে। আবার একই বিষয় ভ্রমণের কথা ধরা যাক। কিছু মানুষ আছেন যারা দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করেন, সবসময় সেরা হোটেলে ওঠেন, বাড়িতে যেমন খাবার খান ঠিক তেমন খান। দেশে যেমন অলস ধনীদের সাথে আড্ডা দিতেন, সেখানেও তাই করেন। বাড়িতে নিজেদের ডিনার-টেবিলে যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন সেখানেও সেই একই বিষয়ে চর্বিত-চর্বন করেন। যখন তারা ফিরে আসেন অনেক ব্যয়বহুল ভ্রমণের একঘেয়েমি যে শেষ হল, সেটাই হয় তাদের কাছে একমাত্র আরামের অনুভূতি। অন্য এক ধরনের লোক তারা যেখানেই যান, সেখানকার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন; স্থানীয় লোকদের সাথে ভাব জমান, স্থানীয়ভাবে সামাজিক বা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ দেখে নেন, সেখানকার বিশেষ খাওয়া খান, সেখানকার রীতিনীতি এবং স্থানীয় ভাষা শিখে নেন এবং যখন বাড়ি ফিরে আসেন তখন বয়ে আনেন সুখকর নতুন কিছু ভাবনা যা উপভোগ করবেন দীর্ঘ শীতের সন্ধ্যায়।

এইসব আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তির জীবনে ভোগের উদ্দীপনা আছে, তার সুবিধা যার নেই তার চেয়ে বেশি। এমনকি অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও তার কাজে লাগে। আমি খুব খুশী যে চীনের জনতা এবং সিসিলির একটি গ্রামের ঘ্রাণ আমি পেয়েছি, যদিও আমি বলছি না যে সে সময় আমার তা অত ভাল লেগেছিল। দুঃসাহসী লোক জাহাজডুবি, বিদ্রোহ, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড এবং সবরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা উপভোগ করে যতক্ষণ তা স্বাস্থ্য হানির সীমা ছাড়িয়ে না যায়। ভূমিকম্প হলে তারা নিজেকে হয়তো বলে : ‘এই হল ভূমিকম্প! তারা খুশি হয় এই নতুন একটি বিষয়ে পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান সমৃদ্ধ হল বলে। এইরকম লোক যে ভাগ্যের হাতে বিড়ম্বিত হন না, একথা বললে সত্য বলা হবে না, কারণ তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাদের উদ্দীপনাও কমে যেত, যদিও নিশ্চিতভাবে সে কথা বলা যায় না। এমন এমন লোকদের জানি যাদের বছরের পর বছর ধীরে ধীরে যন্ত্রণা দেওয়ার ফলে তাদের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা উদ্দীপনা হারান নি। কোনও কোনও রোগ উদ্দীপনা নষ্ট করে দেয়, অন্যগুলি করে না। আমি জানি না জৈব রসায়নবিদরা এই দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তার সন্ধান পেয়েছেন কিনা, সম্ভবত জৈব রসায়নবিদ্যা আরো উন্নত হলে এমন ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হবে যা খেলে প্রত্যেকটি জিনিসে নিশ্চিতরূপে আমাদের আগ্রহ জন্মাবে। কিন্তু সেদিন না আসা পর্যন্ত কিছু লোক সব বিষয়ে আগ্রহী হন কেন এবং কিছু লোক কোনও বিষয়েই আগ্রহী নন কেন, সে ব্যাপারে আমাদের সাধারণ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত অনুমানের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে।

উদ্দীপনা কখনো সাধারণ, কখনো বৈশিষ্ট্য সুচক। এটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণও হতে পারে। বরো লিখিত ‘রোমানি রাই’(২) উপন্যাসের একটি চরিত্রের কথা পাঠকদের মনে থাকতে পারে। তিনি স্ত্রীকে হারানোর পর, যার প্রতি ছিল তার অবিচল নিষ্ঠা, সাময়িকভাবে তার মনে হয়েছিল জীবন যেন শূন্য হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠলেন চায়ের পাত্রে এবং চায়ের বাক্সে লেখা চীনা লিপিতে এবং একটি ফরাসী-চীন ব্যাকরণের সাহায্যে এবং সেই উদ্দেশ্যে ফরাসী ভাষা শিখে ধীরে ধীরে তার পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হলেন। এর ফলে জীবনের প্রতি তার একটা নতুন উৎসাহ জন্মাল, যদিও তিনি এই চীনা ভাষার জ্ঞান অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করেন নি। আমি এমন লোকদের জানি যারা খ্রিস্টান অতীন্দ্রিয়বাদীদের প্রচলিত মতো সম্পর্কে যা কিছু জানবার তা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতে এবং অন্যদের দেখেছি হবস(৩)-এর গ্রন্থাবলীর প্রথম দিককার সংস্করণ এবং পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ এবং সেগুলি মিলিয়ে দেখা নিয়ে নিবিষ্ট থাকতো কোথায়, কীসে কোন্ মানুষের আকর্ষণ তা আগে বলা অসম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কোনও কোনও বিষয়ে অতি আগ্রহী হতে পারে এবং একবার যদি তেমন কোনও আগ্রহ জাগে তা হলে তাদের জীবন একঘেয়েমির কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে। বিশেষ কোনও বিষয়ের ওপর আগ্রহ, জীবনের সাধারণ উদ্দীপনার চেয়ে কম তৃপ্তিদায়ক সুখের উৎস, কারণ তা মানুষের সময়ের সবটুকু পূর্ণ করতে পারে না। তাছাড়া যে বিশেষ বিষয়ে তার উৎসাহ, সে বিষয়ে সব জানতে পারার বিপদও আছে।

নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে ভোজের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের যেসব মানুষের কথা উল্লেখ করেছিলাম তার মধ্যে পেটুকও ছিল, কিন্তু আমরা তার প্রশংসা করতে পারিনি। পাঠক ভাবতে পারেন যে সব উদ্দীপ্ত লোককে প্রশংসা করা হয়েছে তাদের সাথে পেটুকের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট নয়। কিন্তু আরো নির্দিষ্টভাবে দু’ধরনের মানুষের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার সময় এখন এসেছে।

প্রত্যেকেই জানেন প্রাচীনরা সংযমকে চরিত্রের একটা আবশ্যকীয় গুণ বলে মনে করতেন। রোমান্টিকতা এবং ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে অনেকে এই ধারণা পরিত্যাগ করেন এবং প্রবল প্রবৃত্তি উৎসারিত সব আবেগকে প্রশংসা করেন, এমন কী যদি তারা বায়রনের নায়কদের মতো ধ্বংসাত্মক এবং সমাজবিরোধী হন তবুও। প্রাচীনদের মতো স্পষ্টভাবে উদ্ধৃষ্টও সৎ জীবনে বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা খুব প্রয়োজন এবং এসবের মধ্যে কোনও একটাকে এত দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যাতে অন্যসব কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পেটুক লোক ভোজনের কাছে আর সব আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছে আর তার ফলে জীবনের সমগ্র আনন্দকে কমিয়ে দিয়েছে। ভোজনের মতো অন্যান্য প্রবৃত্তিও চরমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পোশাকের ব্যাপারে সম্রাজ্ঞী জোসেফিন ছিলেন পেটুকদের মত, প্রথমদিকে নেপোলিয়ন জোসেফিনের পোশাক তৈরীর বিল নিজে মিটিয়ে দিতেন, যদিও ক্রমাগত প্রতিবাদের মাত্রা বাড়িয়ে চলতেন। অবশেষে তিনি জোসেফিনকে বললেন, তাঁর সংযম-শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এবং ভবিষ্যতে বিলের অংক যুক্তিসংগত মনে হলে তবেই তিনি তা পরিশোধ করবেন। যখন তার পরবর্তী পোশাক তৈরীর বিল আসে, তখন কিছু সময়ের জন্যে তিনি বোধের শেষপ্রান্তে চলে যান, কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে নেন। তিনি যুদ্ধমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দাবি জানালেন যুদ্ধের তহবিল থেকে তার পোশাকের বিল পরিশোধ করতে হবে। মন্ত্রী জানতেন তাকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা তার রয়েছে, সুতরাং তিনি তাই করলেন। এরই ফলে জেনোয়া ফরাসীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কোনও কোনও বইতে আমি এরকম পড়েছি তবে এই কাহিনী কতটুকু সত্যি তা আমি বলতে পারব না। সত্যি হোক বা অতিরঞ্জিত

হোক, আমাদের উদ্দেশ্যসাধনের পক্ষে দুই-ই সমান উপযোগী, কারণ এই কাহিনী আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কোনও নারীর পোশাকের প্রতি আসক্তি তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে যদি তার সুযোগ থাকে তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার। পানাসক্ত পুরুষ এবং কামাসক্ত নারীকে একই জিনিসের উদাহরণরূপে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এইসব ব্যাপারে মুল নীতি খুবই স্পষ্ট। আমাদের আলাদা সব রুচি এবং বাসনা জীবনের সাধারণ কাঠামোর মধ্যে মানিয়ে নেয়। এরা যদি সুখের উৎস হতে চায়, তবে তাদের, আমাদের স্বাস্থ্যের সাথে, আমাদের প্রিয়জনদের স্নেহের সাথে এবং যে সমাজে আমরা বাস করি তার শ্রদ্ধার সাথে সুসঙ্গত হতেই হবে। কোনও কোনও প্রবৃত্তিকে এইসব সীমা অতিক্রম না করিয়েও অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নেওয়া চলে, অন্যদের নয়। কোনও ব্যক্তি, ধরা যাক দাবা খেলা পছন্দ করেন, তিনি যদি অবিবাহিত হন এবং পরনির্ভরশীল না হন, তা হলে তার প্রবৃত্তিকে কোনও বিশেষ সীমায় বেঁধে রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি তার স্ত্রী এবং সন্তান থাকে এবং স্বাধীন আয়ের উৎস না থাকে তাহলে এই প্রবৃত্তিকে তাকেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলেও পানাসক্ত এবং পেটুককে নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে বিবেচনা করলে বুদ্ধিহীন বলা যেতে পারে, কারণ তাদের অসংযম স্বাস্থ্যের ক্ষতিকারী এবং তারা কয়েক মিনিটের আনন্দের বিনিময়ে কয়েক ঘণ্টার দুঃখ ভোগ করে। কতকগুলি নির্দিষ্ট জিনিস দিয়ে যে কাঠামোটা তৈরী, বেদনার কারণ হতে দিতে না চাইলে যে কোনও বিশেষ প্রবৃত্তিকে সেই কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে। সেই জিনিসগুলি হচ্ছে স্বাস্থ্য, মানসিক ও দৈহিক কর্মক্ষমতার সাধারণ অধিকার, প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য উপযুক্ত উপার্জন এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামাজিক কর্তব্য যেমন স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতিপালন। দাবা খেলার জন্যে যে ব্যক্তি এইসব পরিত্যাগ করেন তিনি নিশ্চিতভাবেই পানাসক্তের মতো নিন্দনীয়। আমাদের এমন লোকের অপরাধ চোখে পড়ে না তার কারণ এমন লোক সংখ্যায় খুব কম এবং অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী না হলে দাবা খেলার মতো বুদ্ধিমত্তার খেলায় সহজে কেউ ডুবে থাকবেন না। সংযমের জন্যে গ্রীকদের যে অনুমোদিত বিধি রয়েছে এই ধরনের আচরণ তার মধ্যেই পড়ে। দাবাকে যথেষ্ট ভালবেসে যে তোক দিনে কাজ করতে করতে সন্ধ্যায় দাবা খেলার জন্যে অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করে থাকেন তিনি। ভাগ্যবান। কিন্তু যে লোক সারাদিন দাবা খেলার জন্যে কাজ বন্ধ রাখেন তিনি সংযমের মতো গুণ হারিয়ে ফেলেন। টলস্টয় সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যখন তরুণ ছিলেন, তাঁর খ্যাতির পূর্বের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্যে তাঁকে সামরিক ক্রস পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণের দিন তিনি দাবা খেলায় এমনই ডুবে ছিলেন যে খেলা ছেড়ে পুরস্কার গ্রহণ করা হয়নি। সে বিষয়ে টলস্টয়কে তেমন দোষ দেওয়া যায় না। কেননা সামরিক পদক লাভ করলেন কী করলেন না তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে উদাসীন থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্য কোনও লোকের পক্ষে এ কাজ করা অবশ্যই নির্বুদ্ধিতা হত।

যে নীতির কথা বলা হল, তার ব্যতিক্রম হিসাবে বলা যায়, কোনও কোনও কাজ এমনই মহৎ যে, যার জন্যে অন্যসব কাজকে পরিত্যাগ করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করা যায়। যদি কোনও ব্যক্তি স্বদেশ রক্ষায় জীবন দান করেন, তবে স্ত্রী সন্তানদের কপর্দকশূন্য অবস্থায় রেখে যাওয়ার জন্যে কেউ তার নিন্দা করবে না। যদি কোনও বিজ্ঞানী কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের জন্যে গবেষণা করেন এবং শেষ পর্যন্ত তার প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে, তা হলে পরিবারকে দারিদ্রের যন্ত্রণা সহ্য করিয়েছেন বলে কেউ তার নিন্দা করবে না, কিন্তু যদি তার সেই আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের চেষ্টা কখনো সফল না হয়, তাহলে জনমত তাকে বাতিকগ্রস্ত বলবে। কিন্তু এরকম বলা অন্যায়, কারণ এরকম কাজে সাফল্য আসবে কিনা তা পূর্বেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। খ্রিস্ট যুগের প্রথম সহস্রাব্দে কোনও ব্যক্তি যদি সন্ন্যাস গ্রহণের জন্যে পরিবার ত্যাগ করে যেতেন তা হলে লোকে প্রশংসা করত। আজকাল কেউ এ কাজ করলে বলা হবে পরিবারের জন্যে বাঁচার সংস্থান রেখে তবেই তার তা করা উচিত।

আমার মনে হয় পেটুক আর স্বাভাবিক ক্ষুধাতুর মানুষের মধ্যে সবসময়েই একটা গভীর মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য থেকে যায়। যে মানুষের কোনও বাসনা অতিরিক্ত ধাবমান হয়, অন্যসব বাসনার বিনিময়ে, সে সাধারণত এমন লোক যার মনের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে কোনও বেদনা। আর সেইজন্যেই সে যেন একটা ছায়ামূর্তির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করছে। পানাসক্তের বেলায় এটা স্পষ্ট দেখা যায়। ভুলে থাকবার জন্যে লোকে মদ খায়, তাদের জীবনে যদি ঐ রকম অপচ্ছায়ার উৎপাত না থাকত, তাহলে তারা মাতলামিকে কখনও মিতাচার থেকে বেশি গ্রহণীয় মনে করত না। লোক কাহিনীর চীনা বলেছিল, আমি মদ খাওয়ার জন্যে মদ খাই না। মাতাল হওয়ার জন্যে মদ খাই।’ এই হচ্ছে একপেশে এবং অত্যধিক সব প্রবৃত্তির পরিচিত রূপ। বস্তুর অন্তর্নিহিত আনন্দ খুঁজে দেখা হয় না, খোঁজা হয় তাকে উপলক্ষ্য করে বিস্মৃতি। যদিও মদাসক্তির ফলে যে বিস্মৃতি চাওয়া হয় তার সাথে এর বিস্তর পার্থক্য। বরোর বন্ধু, যিনি স্ত্রীকে হারাবার বেদনা সহ্য করার জন্যে চীনা ভাষা শিখেছিলেন, তিনিও বিস্মৃতিই চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা এমন একটা উপায়ে যা অনিষ্টকর নয় বরং তা তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছিল। এই রকম পলায়নী মনোভাবের বিরুদ্ধে বলবার কিছু নেই, কিন্তু যে লোক সুরাপান, জুয়াখেলা অথবা অন্য কোনও অলাভজনক উত্তেজক কাজের মধ্যে বিস্মৃতিকে খুঁজে বেড়ায়, তার কথা আলাদা। এটা সত্যি এই দুই সীমারেখার মধ্যবর্তী অবস্থানের উদাহরণও আছে। ক্লান্তিকর জীবন থেকে রেহাই পেতে যে লোক বেপরোয়াভাবে গাড়ি বা বিমান চালায় অথবা পর্বতশীর্ষে ওঠে, তার বিষয়ে কী বলা উচিত? তার এই জীবন নিয়ে ঝুঁকি যদি জনগণের উপকার করত, তা হলে তাকে প্রশংসা করা যেত। কিন্তু তা যদি না হয় তা হলে আমরা তাকে মাতাল অথবা জুয়াড়ি থেকে সামান্য ওপরে ছাড়া আর কী ভাবতে পারি?

অকৃত্রিম উদ্দীপনা, বিস্মৃতি সন্ধানের উদ্দীপনার যে ধরণ তার চেয়ে আলাদা, তা মানবিক সত্ত্বার এক স্বাভাবিক অংশ, যদি তা দুর্ভাগ্যবশত নষ্ট হয়ে না যায়। ছোট শিশুরা যা দেখে, যা শোনে তাতেই আকৃষ্ট হয়। তাদের কাছে পৃথিবী বিস্ময়ে ভরা। তারা সব সময় নতুন নতুন বিষয়ে খুব উৎসাহের সাথে জানবার কাজে ব্যস্ত থাকে, যদিও সে জানা পণ্ডিতদের জানা নয়। তারা শুধু যেসব জিনিস তাদের উৎসাহ সৃষ্টি করে শুধু তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে চায়। পশুরা, যখন তারা বয়স্ক হয়, যদি সুস্থ থাকে উদ্দীপনা ধরে রাখে। কোনও বিড়াল অপরিচিত ঘরে থাকলেও চুপ করে থাকবে না। সে চারিদিকে শুঁকে শুঁকে দেখবে যদি হঠাৎ করে কোনও উঁদুরের সন্ধান পাওয়া যায়। কোনও মানুষ যদি তার জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ না হন, তাহলে তিনি বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে স্বাভাবিক উৎসাহ বজায় রাখতে পারেন এবং যতকাল তা বজায় রাখবেন ততকাল জীবন তার কাছে আনন্দময় হয়ে থাকবে যদি না অন্যায়ভাবে তার স্বাধীনতা খর্ব করা হয় যা আমাদের জীবনপথে চলতে প্রয়োজনীয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই সভ্য সমাজের উদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যায়। আদিম মানুষ যখন ক্ষুধার্ত হয় তখন সে শিকার করে এবং এই কাজে সে প্রত্যক্ষ প্রেরণাকেই মান্য করে। যে লোক প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যায়, সেও মৌলভাবে একই প্রেরণা থেকে তা করে যেমন তার স্থায়ী জীবিকার তাগিদ থেকে। কিন্তু তার বেলায় প্রেরণা প্রত্যক্ষভাবে কাজ থেকে আসেনা এবং যখন তা অনুভূত হয় তখনো নয়। এই প্রেরণা কাজ করে গৌণভাবে বিমূর্ততা, বিশ্বাস এবং ইচ্ছার মাধ্যমে। যে সময় লোকটি কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সে ক্ষুধার্ত থাকে না, কারণ সে কিছুক্ষণ আগে মাত্র তার প্রাতঃরাশ খেয়ে নিয়েছে। সে জানে আবার তার ক্ষুধা পাবে এবং কাজে যাওয়ার অর্থ ভবিষ্যৎ ক্ষুধা-নিবৃত্তির একটি উপায়মাত্র। প্রেরণা অনিয়মিত, কিন্তু সভ্য সমাজে অভ্যাসকে নিয়মিত হতেই হয়। আদিম মানুষদের মধ্যে দলবদ্ধ কাজও যতটুকুই রয়েছে, তা স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রেরণাসঞ্চারী। যখন তারা দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে যায়, তখন ঢোলের বাজনা তাদের মনে যুদ্ধের উদ্দীপনা জাগায় এবং তারা যখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে তখন দলের প্রত্যেকটি মানুষ যুদ্ধের কাজে অনুপ্রাণিত হয়। বর্তমানের কোনও উদ্যোগ এইভাবে পরিচালিত করা যায় না। যখন রেলগাড়িকে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করতে হবে, তখন মোটরবাহকদের অথবা ইঞ্চিনচালকদের অথবা সিগন্যালম্যানদের আদিম সমাজের সঙ্গীত শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করা অসম্ভব, এ কাজ তাদের করতে হবেই বলে তারা সকলে নিজের নিজের কাজ করবে। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য গৌণ। এই কাজে তাদের প্রেরণা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কিন্তু এই কাজের জন্যে তারা যে মূল্য পাবে তার জন্যেই শুধু প্রেরণা আছে। সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের ভুল দেখা যায়। লোকেরা পরস্পর যে আলাপ করে তার মধ্যে তাদের কোনও ইচ্ছার প্রতিফলন থাকে না। তারা তা করে সেই আশায়, পরে এই আলাপ থেকে তাদের কোনও উপকার হলেও হতে পারে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রেরণার সীমাবদ্ধতা সভ্য মানুষকে জড়িয়ে রেখেছে। মনে খুব আনন্দ হলে সে প্রকাশ্য পথে নাচতে অথবা গান করতে পারে না, আবার দুঃখ পেলেও পথের পাশে বসে কাঁদতে পারে না। কেননা তাতে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। প্রথম বয়সে স্কুলে তাদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক জীবরে যতক্ষণ কাজ,ততক্ষণের জন্যে তার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত। এইসব কারণে উদ্দীপনাকে বাঁচিয়ে রাখা বেশ কঠিন, কারণ এর অবিরাম নিয়ন্ত্রণ থেকেই জন্ম নেয় ক্লান্তি এবং একঘেয়েমির বিরক্তি। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণা সুবিবেচনার সাথে নিয়ন্ত্রণ না করলে সভ্য সমাজ অস্তিত্ব সংকটে পৌঁছে যায়। কারণ এই প্রেরণা সরলতম সামাজিক সহযোগিতামূলক কাজের জন্ম দিতে পারলেও কিন্তু সেসব অতি জটিল কাজ করতে পারে না, যা আধুনিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দাবী করে। উদ্দীপনাকে এতসব বাধার ওপরে তুলতে হলে একজন লোকের প্রয়োজন সুন্দর স্বাস্থ্য এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি অথবা তার ভাগ্য যদি প্রসন্ন থাকে তাহলে সে এমন কাজ পাবে যা তার নিজের পক্ষেই আগ্ৰহজনক। স্বাস্থ্য, যা পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে বিগত শতবর্ষে সব সভ্য দেশেই জনস্বাস্থ্য ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু শক্তিকে মাপা কঠিন কাজ। স্বাস্থ্য উন্নত হলেও দৈহিক শক্তি পূর্বে যা ছিল তেমনটাই রয়েছে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সমস্যা এখানে অতিমাত্রায় সামাজিক, তাই স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে এই গ্রন্থে আমি কোনোও আলোচনায় যাব না। কিন্তু এই সমস্যার একটা ব্যক্তিগত এবং মনস্তত্ত্বমূলক দিক রয়েছে, যে বিষয়ে আমি পূর্বে অবসাদ নিয়ে আলোচনার সময় করেছি। সভ্য সমাজের শত বাধার মুখেও কোনও কোনও ব্যক্তি উদ্দীপনা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, আরো অনেকে তা করতে পারত যদি তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারত যেখানে তাদের শক্তির অনেক অংশ ব্যয় হয়ে যায়। কাজের জন্যে যতটুকু শক্তি দরকার, উদ্দীপনা তার চেয়ে অতিরিক্ত দাবি করে এবং ফলে মননযন্ত্রটি যাতে বাধাহীনভাবে চলে সেই দাবি উঠে আসে। যেসব কারণে এই চলা মসৃণতর হয় সে বিষয়ে আমি পরের অধ্যায়গুলিতে আরও কিছু বলব।

সম্মানবোধ সম্বন্ধে ভুল ধারণার জন্যে নারীদের মধ্যে উদ্দীপনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। নারীরা পুরুষদের বিষয়ে আগ্রহী হবে, অথবা জনসমক্ষে প্রফুল্লতা প্রকাশ করবে এটা অবাঞ্ছিত ছিল। পুরুষদের বিষয়ে তারা আগ্রহী হবে না এই শিক্ষা থেকে তারা সব বিষয়েই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র এক বিশেষ ধরনের বিশুদ্ধ আচরণ ছাড়া। নিষ্ক্রিয়তার মনোভাব তৈরীর শিক্ষা এবং জীবন থেকে পালানোর মনোভাব উদ্দীপনার প্রবল বিরোধী এবং নারীদের আত্মমগ্ন হতে উৎসাহিত করা, যা মহা সম্মানিত নারীদের বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে যদি তারা শিক্ষাহীন হয়। সাধারণ পুরুষদের খেলাধুলায় যে উৎসাহ থাকে তা তাদের থাকে না। তারা রাজনীতি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না। পুরুষদের প্রতি তাদের মনোভাব প্রথাগত নিস্পৃহতা, অন্য নারীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন বৈরীভাবাপন্ন এবং তার কারণ অন্যেরা তাদের চেয়ে কম সম্মানিতা, এই বোধ থেকে। তাদের অহংকার তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে থাকে অর্থাৎ তাদের সহনারীদের প্রতি আগ্রহহীনতাকে তারা গুণ বলে মনে করে, অবশ্য এর জন্যে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। নারীদের সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে যে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচলিত, তাই শুধু তারা মেনে চলে। তারা একটি অবদমন নীতির কাছে নিজেদের উৎসর্গ করেছে যার ভিতরের অন্যায়টি তারা বুঝতে পারেনি বলেই করুণার পাত্রী হতে হয়েছে। এইসব নারীদের কাছে যা অনুদার তাই ভাল মনে হয় এবং যা উদার তা মনে হয় খারাপ। তারা নিজেদের সামাজিক চক্রের মধ্যে আনন্দকে হত্যা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। তারা রাজনীতিতে নির্যাতনমূলক আইনকে ভালবাসে। সৌভাগ্যবশত এই ধরনের নারীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, যদিও যারা চিন্তার জগতে মুক্তিলাভ করেছে। তারা সেইসব নারীর সংখ্যা যতটা কমেছে বলে ভাবছেন, তার চেয়ে এখনও সেই সংখ্যা অনেক বেশি। কেউ যদি

আমার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করেন, তবে বলি, তিনি যেন একবার বাসাবাড়িগুলিতে একটা থাকার জায়গা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন এবং যেসব গৃহকত্রীর সাথে তার দেখা হবে তাদের আচরণ লক্ষ্য করেন, তা হলে তিনি দেখতে পাবেন তারা এমন একটা নারীসুলভ উৎকর্ষতার ধারণা নিয়ে বাস করছে, যা জীবনের সকল উদ্দীপনাকে ধ্বংস করার একটি প্রয়োজনীয় অংশ। তার ফলেই তাদের মন এবং হৃদয় সংকীর্ণ এবং বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যায়। নারী এবং পুরুষের উৎকর্ষের মধ্যে যথার্থভাবে ধারণা করলে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না, অন্ততপক্ষে প্রচলিত ধারণায় যে পার্থক্য তা নেই। নারীর পক্ষে যেমন পুরুষের পক্ষেও তেমন, উদ্দীপনাই হচ্ছে সুখ এবং মঙ্গলের জন্যে গোপন মন্ত্র।

———-
১. শার্লক হোমস, Sherlock Homes। আর্থার কোনান ডয়েল, Sir Arthur Conan Doyle (১৮৫৯-১৯৩০) রহস্য উপন্যাসের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত, পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। লন্ডনের ২২১, বেকার স্ট্রীট ছিল গোয়েন্দা শারলক হেমসের ঠিকানা (১৮৮১-১৯০৪)।

২. রোমানি রাই, Romany Rye, ঔপন্যাসিক জর্জ বরো, George Borrow (১৮০৫ ১৮৮১) এর বিখ্যাত উপন্যাস, রচিত হয় ১৮৫৭-তে। এই উপন্যাস লেখকের আত্মজৈবনিক বলে মনে করা হয়। শুধু উপন্যাস নয় জর্জ বরো ইংরেজি সাহিত্যে ভ্রমণ কাহিনী রচনার জন্যেও বিখ্যাত। সেসব কাহিনীতে চিত্রিত হয়ে আছে পথ চলার বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং যাযাবর জীবনের ভিন্ন সুর।

৩. হবস,Thomas Hobbes (১৫৮৮-১৬৭৯)। বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনীতিবিদ। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সংক্রান্ত কাজের জন্যে এখনো তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।

৪. সম্রাজ্ঞী জোসেফিন, Empress Josephine (১৭৬০-১৮১৪), অভিজাত বংশে জন্ম, অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। ১৮০৪-এ সম্রাজ্ঞী হন ফ্রান্সের। ফরাসী বিপ্লবের সময় সম্রাটসহ কারারুদ্ধ হন। স্বামীর গিললাটিনে মৃত্যু হলেও, তিনি মুক্তি পান। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন বিশ্ববিখ্যাত নেপোলিয়নকে। যিনি পরে ফ্রান্সের সম্রাট হন। নেপোলিয়ন তাঁকে যে ঘড়িটি উপহার দিয়েছিলেন সেটি ‘Empress Josephine Clock’ নামে বিখ্যাত।

৫. টলস্টয়, Leo Tolstoy (১৮২৮-১৯১০)। রাশিয়ার বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক। তাঁর ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’, ‘আনা করোনিনা’ এবং ‘রেজারেকসন’ বিশ্ব সাহিত্যে অমর সৃষ্টি। এক বিশাল পটভূমিকায় বিরচিত “ওয়ার অ্যান্ড পীস”-কে বলা হয় গদ্যে মহাকাব্য।

 ১২. স্নেহ-ভালবাসা

উদ্দীপনাহীনতার একটি প্রধান কারণ হল, আমাকে কেউ ভালবাসে না এই অনুভূতি। পক্ষান্তরে বিপরীতভাবে, সকলেই আমাকে ভালবাসে এই অনুভূতি উদ্দীপনা বাড়াতে যত সাহায্য করে, অন্য কোনও কিছু তা করে না। কেউ তাকে ভালবাসে না, এই অনুভূতির বিভিন্ন রকমের কারণ থাকতে পারে। তিনি নিজেকে এমন ভয়ংকর একটি মানুষ ভাবতে পারেন, যার জন্যে কারো পক্ষে তাকে ভালবাসা সম্ভব নয়। শৈশবে তিনি হয়তো অন্যান্য শিশুদের তুলনায় কম স্নেহ পেয়েছেন অথবা তিনি এমন লোক যাকে সত্যিই কেউ ভালবাসেন না। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু প্রথম জীবনের দুর্ভাগ্যের জন্যে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলাও এর কারণ হতে পারে। ভালবাসা না পাওয়ার অনুভূতি থেকে নানারকম মনোভাবের উদ্ভব হতে পারে। এরকম লোক হয়তো মরিয়া হয়ে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে নানা অসাধারণ দয়াশীলতার কাজ করতে পারেন। কিন্তু এমন হলে তার কাজে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ যারা তার দয়াশীলতায় উপকৃত হবেন তারা সহজেই তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারবেন। মানুষের প্রকৃতি এমনভাবে গঠিত যে, যারা ভালবাসা দাবি করেন না বলে মনে হয়, তাদেরই তা সহজে দেয়। তাই যে মানুষ কল্যাণকর কাজ করে ভালবাসা কিনতে চান, তিনি মানুষের অকৃতজ্ঞতার অভিজ্ঞতা থেকে মোহমুক্ত হন, তার কখনো মনে হয় না যে ভালবাসা তিনি কিনতে চান তার মূল্য, তার জন্যে যে বস্তুগত সুবিধা তিনি দান করছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও তার অনুভূতি তা মেনে নিতে পারে না। অন্য একজন মানুষ, অন্যেরা তাকে ভালবাসে না, এটা জেনে যুদ্ধ বাধিয়ে অথবা বিদ্রোহ সৃষ্টি করে অথবা ডীন সুইফটের(১) মতো বিষে কলম ডুবিয়ে পৃথিবীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে এই হল বীরের প্রতিক্রিয়া, এতে পৃথিবীর সকলের বিরুদ্ধে একা দাঁড়াবার মতো চরিত্রবল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই উচ্চতায় উঠতে কজন সক্ষম হন? নারী বা পুরুষের অধিকাংশই যদি নিজেদের ভালবাসার ক্ষেত্রে বঞ্চিত মনে করেন, তাহলে তারা এক ভীরু নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবে যান, যেখানে শুধুই অন্ধকার আর সেখানে মাঝে মাঝে ঈর্ষা আর বিদ্বেষের ঝলক ছাড়া আর কিছু জ্বলে ওঠে না। নিয়মানুযায়ী এই ধরণের লোকের জীবন অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং ভালবাসার অভাব থেকে তাদের মনে নিরাপত্তাহীনতা জন্ম নেয় আর তাকে মুক্তি পেতে তারা অভ্যাসের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করেন। যারা বৈচিত্র্যহীন কর্মধারার দাসত্ব স্বীকার করেন তাদের এই কাজের প্রেরণা আসে বাইরের শীতল পৃথিবীর ভয় থেকে এবং তারা মনে করে, পূর্বের চলা পথেই যদি তারা আবার চলে তা হলে তারা আর আঘাত পাবেন না।

যারা নিরাপত্তার অভাববোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন, তাদের চেয়ে তারাই বেশি সুখী হন যারা নিরাপত্তার বোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন। অন্ততপক্ষে যতদিন না নিরাপত্তা বোধ তাদের বিপদের মধ্যে না ফেলে। সব ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে যে বিপদে একজন নিমজ্জিত হয়ে পড়েন, নিরাপত্তাবোধই সেই বিপদ থেকে অন্যজনকে উদ্ধার করেন। এক গভীর গহ্বরের ওপরে অবস্থিত একটা সরু কাঠের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভয় পেলেই বেশি থাকে, ভয় না পেলে নয়। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও একই রীতি। ভয়হীন মানুষ অবশ্য হঠাৎ করে বিপদে পড়তে পারেন। কিন্তু অনেক বিপদসংকুল অবস্থার ভিতর থেকে অক্ষত অবস্থায় তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন, তবে একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এইরকম প্রয়োজনীয় আত্মপ্রত্যয়ের অসংখ্য ধরণ আছে। কেউ আত্মবিশ্বাসী পাহাড়ে, কেউ বা সমুদ্রে আবার অন্যজন হয়তো আকাশে। কিন্তু জীবনের প্রতি সাধারণ আত্মবিশ্বাস আসে সেই যথার্থ প্রয়োজনীয় ভালবাসা পেতে অভ্যস্ত হলে, অন্য কিছু থেকে নয়। উদ্দীপনার উৎসরূপে মনের যে অভ্যাস, তা নিয়েই আমি এই অধ্যায়ে আলোচনা করব।

ভালবাসা যা দেওয়া হয় তা থেকে নয়, যা পাওয়া যায় তা থেকেই নিরাপত্তা বোধ জন্ম নেয়। এই বোধ আরো বেশি জন্মায় যদি ভালবাসা পারস্পরিক হয়। জোর দিয়ে বলতে হলে বলতে হয়, শুধু স্নেহ ভালবাসা নয়, তার সাথে শ্রদ্ধা ও প্রশংসাও মিশে থাকে। অভিনেতা, ধর্মপ্রচারক, বক্তা, রাজনীতিক যাদের কাজই হল জনগণের প্রশংসা কুড়িয়ে পাওয়া, তারা ক্রমেই এদের সমর্থনের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। যখন তারা জনসাধারণের কাছ থেকে যোগ্য পুরস্কার পেয়ে যান, তখন তাঁদের জীবন উদ্দীপনায় ভরে ওঠে। কিন্তু যখন তা পান না। তারা অসন্তুষ্ট হন এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েন। বহুজনের কেন্দ্রীভূত ভালবাসা অন্যদের জন্যে তাই করে। যে শিশু বাবা-মার প্রিয়পাত্র, সে তাদের স্নেহকে প্রকৃতির বিধান হিসাবে গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সে বিশেষভাবে কিছু চিন্তা করে না, যদিও তার সুখের জন্যে এর গুরুত্ব অনেক। সে পৃথিবীকে নিয়ে চিন্তা করে। যেসব উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে এবং আরো সব দুঃসাহসিক ঘটনা তার ঘটতে পারে, যখন সে বড় হবে তা নিয়েও ভাবে। বাইরের নানা ব্যাপারে এই যে উৎসাহ, তার পিছনে রয়েছে সেই অনুভূতি যে, যত বিপদই আসুক বাবা মার স্নেহ তাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করবে। যদি কোনও কারণে কোনও শিশু বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তবে সে শিশু সাধারণভাবে ভীরু এবং দুঃসাহসিক কাজে অনুৎসাহী হয়। তার মন ভয়ে ভয়ে থাকে। নিজেকে সে করুণা করে এবং আনন্দময় অনুসন্ধিৎসার মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ রকম শিশু অবাক হওয়ার মতো কম বয়সে জীবন, মৃত্যু এবং মানব জীবনের পরিণাম নিয়ে ধ্যান করতে শুরু করে। সে অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। প্রথমে বিষাদময়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও বিশেষ দর্শনবিদ্যা বা ধর্মতত্ত্বের মধ্যে অবাস্তব সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। জগৎ বিশৃঙ্খল স্থান, এখানে আনন্দের জিনিস যেমন আছে নিরানন্দের জিনিসও আছে কিন্তু শৃঙ্খলাহীন পরমার্থ নিয়ে-এবং এই কামনার একটি বোধগম্য অবস্থা অথবা প্রতিরূপ সৃষ্টি মূলত ভয় থেকেই জাত, যাকে বলা হয় মুক্তস্থানাতঙ্ক বা এক ধরনের উন্মুক্ত স্থান সম্পর্কে ভীতি। নিজের পাঠাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে ভীরু ছাত্রটি নিজেকে নিরাপদ মনে করে। এই পৃথিবী সমরূপ শৃঙ্খলাপূর্ণ এই অনুভূতি যদি সে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারে, তা হলে পথে বের হওয়ার পরও সে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। সে যদি আরো বেশি স্নেহ পেত, তা হলে বাস্তব পৃথিবীকে আরো কম ভয় পেতে পারত এবং মনে এক আদর্শ পৃথিবী আবিষ্কার করতে হত না যা স্থান করে নিয়েছে তার বিশ্বাসে।

একথা কখনো সঠিক নয় যে, সব স্নেহ-ভালবাসা একই ধরনের সাহসিক অভিযানের পথে চলতে উৎসাহিত করে। যে স্নেহ দেওয়া হয়েছে তা যেন নিজেই ভীরু না হয়ে শক্তিশালী হয় এবং স্নেহের পাত্রের নিরাপত্তার চেয়েও তার উল্কর্ষতা বাড়িয়ে তোলে, যদিও তার নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন হতে হবে তা নয়। ভীরু জননী অথবা ধাত্রী যদি সবসময় শিশুদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে থাকে এবং মনে করে প্রত্যেকটি কুকুরই তাদের কামড়াবে অথবা প্রত্যেকটি গরুই উদ্যত শিং ষাঁড়, তা হলে তারা নিজেদের মনের ভীরুতাকেই শিশুদের মনে সঞ্চারিত করবেন এবং তা হলে শিশুরা ভাববে মা কিংবা ধাত্রীর কাছাকাছি না থাকলেই বিপদ। যে জননী সবসময় সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে চান তার কাছে সন্তানের এইরকম অনুভূতিই পছন্দনীয়। সন্তান পৃথিবীর সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিক, এই ইচ্ছার চেয়েও সে সবসময় তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকুক, এই ইচ্ছাটা তার বেশি হতে পারে। এরকম অবস্থার পরিণামকে সে স্নেহ না পেলে যা হত, তার চেয়েও বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। শৈশবে মনের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, সারা জীবন তার ছাপ থেকে যায়। অনেকের কাছে প্রেমে পড়া হল পৃথিবী থেকে পালিয়ে গিয়ে এমন একটা ছোট নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান, যেখানে তারা নিশ্চিতভাবে শ্রদ্ধা এবং প্রশংসা পায় তার যোগ্য না হয়েও, সত্যি থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের আরেক আশ্রয় তার নিজের বাড়ি, ভীতি এবং ভীরুতাই তাদের এই সাহচর্যের সন্ধান দেয় যা উপভোগ করলে সেই অনুভূতি অক্রিয় হয়ে যাবে। তারা পত্নীদের কাছে তাই চান, যা আগে তারা পেয়েছে অবিজ্ঞ মায়েদের কাছে, কিন্তু তারা অবাক হয়, যদি পত্নীরা তাদের বয়ঃপ্রাপ্ত শিশু মনে করে।

কোন্ স্নেহ শ্রেষ্ঠ তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুব সহজ নয়। কারণ তার মধ্যে কিছু মাত্রায় রক্ষণাত্মক বস্তু থাকা উচিত, যাদের আমরা ভালবাসি তারা কোনও আঘাত পেলে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। কিন্তু আমি মনে করি, দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা যা দুর্ভাগ্যের প্রতি সহানুভূতির, যে দুর্ভাগ্য ঘটে গেছে তার বিপরীত, ভালবাসা যতটুকু সম্ভব, অল্প হলেও একটা ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের সম্পর্কে ভয় অন্যের সম্পর্কে ভয়ের চেয়ে আংশিক ভাল। তার ওপর প্রায় সময়েই এই বোধ অধিকার-বাসনার ছদ্মবেশ। আশা করা হয় ভয় জাগিয়ে অন্যের ওপর আরো বেশি প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা যাবে। পুরুষ ভীরু নারীকে যে পছন্দ করে এটাও তার একটা কারণ, তাহলে তাদের রক্ষা করে দখল করা যায়। নিজের ক্ষতি না করে কোনও মানুষ অন্যের জন্যে কতটা উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে, তা নির্ভর করে তার চরিত্রের ওপর। যে মানুষ শক্তিমান এবং দুঃঃসাহসী, নিজের ক্ষতি ছাড়াই অনেক কিছু সহ্য করতে পারে। কিন্তু ভীরু মানুষ এইভাবে যেন বেশি কিছু না করে সেই ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করা উচিত।

প্রাপ্ত স্নেহ-ভালবাসার কাজ দ্বিধাবিভক্ত। এর আগে নিরাপত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ বয়সে এর মধ্যে আরেকটু বেশি জৈবিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং তা হচ্ছে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্ব। যৌনতা-সম্পর্কিত ভালবাসার প্রেরণা জাগাতে না পারা যে কোনও নারী বা পুরুষের জন্যে চরম দুর্ভাগ্য। কেন না এতে তারা বঞ্চিত হয়, জীবন যে শ্রেষ্ঠ আনন্দ তাদের দান করে, তা থেকে। এই বঞ্চনা এখন হোক বা পরে হোক, উদ্দীপনাকে ধ্বংস করে এবং অন্তর্মুখীতা তৈরি করে। শৈশবের কোনও ভাগ্য বিপর্যয় চরিত্রে এমন ত্রুটির কারণ হতে পারে যার জন্যে উত্তর-জীবনে ভালবাসা পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না, যে ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে। এটা নারীদের তুলনায় সম্ভবত পুরুষের ক্ষেত্রে বেশি বাস্তব, কারণ নারীকে আকর্ষণ করে সম্ভবত পুরুষের চরিত্র, আর পুরুষের আকর্ষণ থাকে নারীর রূপে। একথা অবশ্যই বলা উচিত যে, এ বিষয়ে পুরুষরা নারীদের তুলনায় নিজেদের ছোট করে, কারণ নারীরা পুরুষদের যেসব গুণে খুশী হয়, তার থেকে পুরুষরা নারীদের যেসব গুণে খুশী হয় তা কম কাম্য। আমি নিশ্চিত নই, উন্নত চরিত্র গঠন করা সুন্দর রূপ তৈরী করার চেয়ে সহজতর কিনা। কিন্তু যে কোনও ভাবে পরের ধাপটি ভালভাবে বোঝা বেশি প্রয়োজনীয় এবং নারীরা সহজেই তা অবলম্বন করে, কিন্তু আগের ধাপটি অর্জন করার জন্যে পুরুষদের যা করা দরকার তারা তা করে না।

কোনও মানুষ যে স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে থাকে তা নিয়েই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। এখন আমি, যে স্নেহ ভালবাসা দেওয়া হয় তার কথা বলব। এটা আবার দুই প্রকার। এর একটি সম্ভবত জীবনের উদ্দীপনার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান প্রকাশ, অন্যটা হল ভয়ের প্রকাশ। আমার কাছে প্রথমটা পুরোপুরি প্রশংসাযোগ্য, আর পরেরটা খুব বেশি হলে একটি সান্ত্বনা। আপনি যদি খুব সুন্দর দিনে মনোরম বেলাভূমির পাশ দিয়ে জাহাজে চলেন, আপনি সাগর-বেলার প্রশংসা করবেন এবং এতে আপনি আনন্দ পাবেন। এই আনন্দ সম্পূর্ণরূপে বাইরের দৃষ্টি থেকে লাভ করা এবং মনের কোনও তীব্র প্রয়োজনের সাথে তা সম্পর্কহীন। অন্যদিকে যদি আপনার জাহাজটা ডুবে যায় এবং বিকল হয়ে পড়ে এবং আপনি সাঁতার কেটে তীরে এসে ওঠেন, তখন তার প্রতি আপনার নতুন ধরনের ভালোগা জন্মাবে। তখন এই তীর হয়ে উঠবে তরঙ্গের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা এবং এর সৌন্দৰ্য্য অথবা কুৎসিত রূপ অবান্তর ব্যাপারে পরিণত হবে। নিরাপদ জাহাজের যাত্রীর মনে যে অনুভূতি, সুন্দর ভালবাসার সমগোত্রীয় তা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে সাঁতার কেটে তীরে উঠে আসা যাত্রীর অনুভূতির সাথে যা মেলে তা সুন্দর ভালবাসা নয়। এদের মধ্যে প্রথম ধরনের ভালবাসা সম্ভব সে মানুষের পক্ষে যে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে। পক্ষান্তরে নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে দেখা দেয় ভালবাসার পরের রূপটি। নিরাপত্তাবোধের অভাবের কারণে যে অনুভূতি তুলনায় তা অনেক বেশি বস্তুগত এবং আত্মকেন্দ্রিক কারণ ভালবাসার মানুষ এখানে মূল্যবান কারণ তার কাছ থেকে পরিষেবা পাওয়া যায় বলে সহজাত কোনও গুণের জন্যে নয়। একথা আমার বলার উদ্দেশ্য নয় যে, জীবনে এ ধরনের ভালবাসার কোনও বৈধ ভূমিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে সকল নির্ভেজাল ভালবাসার মধ্যেই এই দুইয়ের কিছু কিছু অংশ যুক্তভাবে রয়েছে এবং ভালবাসা যতটুকু নিরাপত্তা বোধহীনতাকে দূর করতে সক্ষম ততটুকু তা একজন মানুষকে তার অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়। যে অনুভূতি থেকে সে আবার সেই মুহূর্তে বিপন্ন এবং ভয়ার্ত জগতের সব অন্ধকার যে দূর হয়ে গেছে তা অনুভব করতে পারে। এই ধরনের ভালবাসার যে ভূমিকা জীবনে, তাকে স্বীকৃতি জানিয়েও আমাদের বলতে হয় এটা অন্যটার তুলনায় কম সুন্দর, কারণ এটা ভয়ের ওপর নির্ভর করে এবং ভয় একটি ক্ষতিকর জিনিস এবং আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক। সবচেয়ে সুন্দর ভালবাসায় মানুষ আশা করে নতুন সুখের, পুরোনো অ-সুখ থেকে পালাতে নয়।

সুন্দরতম ভালবাসা যে দেয় এবং যে পায়, দুজনের জন্যেই জীবন-প্লাবী । প্রত্যেকেই পরমানন্দের সাথে ভালবাসা গ্রহণ এবং দান করে এবং পারস্পরিক সুখের কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে আরো বেশি চিত্তহারী মনে করে। এ ছাড়া আরো এক ধরনের ভালবাসা আছে যেটা খুব যে কম তা নয় তাতে একজন অন্যজনের প্রাণশক্তি শুষে নেয়। একজন যা দেয় অন্যজন তা গ্রহণ করে কিন্তু প্রতিদানে প্রায় কিছুই দেয় না। এই ধরনের রক্তশোষণকারীর দলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোক আছে, তারা একের পর এক হতভাগ্যকে ধরে এবং বলিপ্রদত্ত প্রাণীর মতো জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়। এবং নিজেদের উন্নতি করে নেয় এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের তা শুষে নিয়েছে তারা হয়ে পড়ে নিষ্প্রভ, ম্লান এবং শক্তিহীন। এই ধরনের লোক নিজেদের স্বার্থের জন্যেই শুধু অন্যদের ব্যবহার করে কিন্তু তাদের সত্তাকে কখনো স্বীকৃতি জানায় না। তারা কিছু সময়ের জন্যে যাদের ভালবাসে বলে মনে করে, মৌলভাবে তাদের প্রতি কোনও উৎসাহ থাকে না। তারা শুধু নিজেদের কাজের প্রেরণার বিষয়ে আগ্রহী এবং সম্ভবত তা নৈর্ব্যক্তিক ধরনের। বোঝা যায় এটা তাদের স্বভাবের ক্রটি। কিন্তু তা এমন একটা রোগ যাকে সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং নিরাময় করা খুব সহজ নয়। প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রায়ই যুক্ত থাকতে দেখা যায়, এবং আমার মনে হয় মানুষের সুখ উৎপাদন অর্থে যে ভালবাসা, যা দুজনের আলাদা মঙ্গলের জন্যে নয়, বরং যা দুজনের মিলিত মঙ্গলের জন্যে, তাই হল প্রকৃত সুখের সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ। যে মানুষের অহমিকা ইস্পাতের দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ সেখানে ভালবাসার এই বিস্তার সম্ভব নয় এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ দান থেকে বঞ্চিত, তা পেশায় সে যত সফলই হোক। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালবাসাকে তার সীমানা থেকে দূরে রাখে তা সাধারণত প্রথম জীবনের দুঃখ, পরবর্তীকালে অবিচার অথবা এমন কোনও কারণ যা নির্যাতন বাতিকে পরিণত হয়েছে, তা মানব সমাজের প্রতি রাগ বা ঘৃণা থেকে জন্ম নেয়। পৃথিবীকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে হলে অতি-অহমিকা, যা একটি কারাগার, থেকে যে কোনও মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে। কোনও মানুষ এই আত্ম-কাব্য থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কিনা তার লক্ষণ দেখা যাবে তার যথার্থ ভালবাসার ক্ষমতা আছে কিনা তার মধ্যে। ভালবাসা পাওয়া কোনও ভাবেই যথেষ্ট নয়, ভালবাসা যা পাওয়া গেল তাকে মুক্ত করে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং যেখানে দুই একমাত্রায় বিরাজ করে সেখানেই ভালবাসা শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনা খুঁজে পায়।

পারস্পরিক ভালবাসা বিকাশের মনস্তাত্ত্বিক অথবা সামাজিক বাধা সবক্ষেত্রেই অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর জন্যে পৃথিবী সর্বকালেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যদি ভুল লোকের কাছে পড়ে, সেই ভয় থেকেই মানুষ সহজে কারো প্রশংসা করতে চায় না, তারা সহজে ভালবাসাও দিতে চায় না। যদি তা অপাত্রে দান করা হয় এই ভয়ে যদি তার কাছ থেকে অথবা সমালোচনাময় পৃথিবী থেকে দুঃখ পায়। নৈতিকতা এবং বৈষয়িকতা এই দুয়ের নামেই সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার ফলে যেখানেই ভালবাসার সম্পর্ক, সেখানেই উদারতা এবং সাহসিকতাকে নিরুৎসাহ করা হয়। এইসব উপদেশ-নির্দেশ মানবসমাজের বিরুদ্ধে ভীরুতা এবং ক্রোধ তৈরী করে। কারণ অনেক মানুষ জীবনভর জানতেই পারে না কী তার মৌলিক চাহিদা এবং তা থেকে সে বঞ্চিতই থেকে যায় এবং প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে নয় জনেরই বিশ্বের প্রতি সুখী ও উদার মনোভাব গড়ে তোলার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, যাদের অনৈতিক বলা হয়, তারা যাদের বলা হয় না তাদের চেয়ে উন্নত। যৌনতা সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ে যাকে বিশুদ্ধ ভালবাসা বলা হয়, তা প্রায় থাকেই না। থাকলেও খুবই কম, বরং সেখানে দেখা যায় মৌলিক বিরূপতা, প্রত্যেকেই অন্যের কাছে ধরা না দেওয়ার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই নিজেদের একাকীত্বকে রক্ষা করে চলে। প্রত্যেকেই অস্পৃষ্ট থাকে এবং সে জন্যেই তারা ব্যর্থ হয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কোনও বাস্তব মূল্য নেই। আমি বলি না, তাদের সযত্নে এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ তা করতে গেলে যেখানে আরো মূল্যবান এবং গভীর ভালবাসা জন্মাবার সম্ভাবনা, তার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি বলতে চাই, যে যৌন সম্পর্কের বাস্তব মূল্য আছে তা এমন, যেখানে কোনও বাক-সংযম নেই, যার মধ্যে দুজনের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব একসাথে মিলিত হয়ে নতুন এক সংযুক্ত ব্যক্তিত্বে রপ লাভ করবে সব রকমের সতর্কতার মধ্যে। ভালবাসায় সতর্কতা সম্ভবত যথার্থ সুখের পক্ষে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক।

—–
১. ডীন, সুইফট, Dean Jonathan Swift (১৬৬৭-১৭৪৫) আয়াল্যান্ডে জন্ম ইংরেজী ভাষার বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক সাহিত্যের রচয়িতা (Satirist)।

১৩. পরিবার

অতীতের উত্তরাধিকাররূপে আমরা যতগুলি প্রতিষ্ঠান লাভ করেছি, তার মধ্যে, বর্তমানে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে বিশৃঙ্খল এবং লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে, এমন আর কোনওটি হয়নি। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহ এবং বাবা মার প্রতি সন্তানের ভালবাসা সুখের একটি শ্রেষ্ঠ উৎস। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বর্তমানে বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক দশের মধ্যে নয়টি ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের দুঃখের উৎস হয়ে পড়েছে এবং শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে অন্তত একপক্ষের দুঃখের কারণ হয়েছে। নীতিগতভাবে পরিবারের পক্ষে মৌলিক তৃপ্তি দিতে পারার ব্যর্থতা, আধুনিক যুগের অসন্তোষের একটি গভীর কারণ, যে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বা নারী নিজের সন্তানদের সাথে সুখের সম্পর্ক রাখতে চায় অথবা তাদের একটা সুখী জীবনে রাখতে চায়, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত এবং ভাবনার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করা উচিত। পারিবারিক বিষয় এত ব্যাপক বিশাল যে এই গ্রন্থে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর সাথে জড়িত বিশেষ সমস্যার সাথে সুখের সন্ধান-এর সম্পর্ক রয়েছে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। যে সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবছি তার মধ্যেও পরিবার সম্পর্কে শুধু সেটুকুই আলোচনা করতে পারি, যেখানে সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন না করেও পরিবারের উন্নতি বিধানের ক্ষমতা প্রত্যেকটি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এই সীমাবদ্ধতা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুতর, কারণ আমাদের কালে পারিবারিক অসন্তোষের কারণ বিচিত্র ধরনের মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাবিষয়ক এবং রাজনৈতিক। ধনী সমাজের নারীদের কাছে এখন মাতৃত্বকে পূর্বের তুলনায় দুটি কারণে অনেক বোঝা বলে মনে করা হয়। এই দুটি কারণ হচ্ছে– একদিকে অবিবাহিতা মেয়েদের নিজস্ব জীবিকার পথ খুলে যাওয়া, অন্যদিকে গৃহ-পরিষেবার জন্যে লোকের অভাব। আগের দিনের মেয়েরা চিরকুমারী জীবনের অসহনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে বাধ্য হত। অবিবাহিতা মেয়েদের বাড়িতে অর্থনৈতিক নির্ভরতার ওপর বাঁচতে হত প্রথম জীবনে বাবার ওপর, পরে অনিচ্ছুক ভাইদের ওপর। দিন যাপনের মতো কোনও কাজ ছিল না তাদের এবং বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে আনন্দ উপভোগের কোনও স্বাধীনতাও ছিল না। তাদের যৌনজীবনে উৎসাহিত হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, আসক্তিও ছিল না। তাছাড়া বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম ঘৃণ্য বলেই তারা বিশ্বাস করত। তবু এমন সব পারিবারিক রক্ষা-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও ফন্দিবাজ লুব্ধকের ছলাকলায় পড়ে তার চরিত্র নষ্ট হত, তাহলে তার দুর্দশার সীমা থাকত না। ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ বইয়ে এরকম অবস্থায় একটি নির্ভুল বর্ণনা আছে।

“তার অপরাধ লুকাবার
তার লজ্জা সবার দৃষ্টি থেকে ঢেকে রাখার
তার দয়িতের অন্তরে অনুতাপ জাগাবার,
এবং তার অন্তর ভাঙার একটাই পথ–
তার মৃত্যুকে আলিংগন।”

আধুনিক কুমারী মেয়েরা এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না, যদি তার ভাল শিক্ষা থাকে তাহলে সাধারণভাবে সুখে থাকার মতো একটা জীবিকার ব্যবস্থা করা কঠিন নয় এবং সে বাবা-মার অধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে। বাবা-মা কন্যাদের ওপর অর্থনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বলে তারা এখন কন্যাদের নৈতিকতা অনুমোদন না করার ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হয়েছে। যে মেয়ে গঞ্জনা সহ্য করার জন্যে অপেক্ষা করবে না, তাকে গঞ্জনা দিয়ে লাভ নেই। উচ্চপেশাজীবী অবিবাহিতা তরুণী তাই বর্তমানকালে বুদ্ধিমত্তা এবং আকর্ষণীয়তায় যদি সাধারণ মানের নিচে না হয়, যতদিন সে সন্তানলাভের কামনা থেকে মুক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সে সম্পূর্ণভাবে নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু সন্তানকামনা প্রবল হলে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং তার কাজটিও হারাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এতদিন যে আরামের জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে তার থেকে অনেক নিচের স্তরে নেমে যায়, কারণ তার স্বামীর উপার্জন, সে আগে যা উপার্জন করত কোনওভাবে তার চেয়ে বেশি নয়। যে আয় থেকে এখন সংস্থান করতে হয় একটি পরিবারের, শুধুমাত্র একজন রমণীর নয়। স্বাধীনভাবে চলার পর এখন প্রয়োজনীয় খরচের জন্যে প্রতিটি পয়সা অন্যের কাছে চেয়ে নেওয়া তার জন্যে পীড়াদায়ক। এইসব কারণে এইরকম নারী মাতৃত্বলাভে দ্বিধাগ্রস্ত।

কোনও নারী তবুও যদি সব দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে উঠে মা হতে চায়, সে আগের প্রজন্মের নারীদের তুলনায় একটি নতুন এবং আতঙ্কজনক সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং তা হল গৃহ পরিষেবার অভাব অথবা নিম্নমানের পরিষেবা। এর ফলে সে বাড়ির সাথে বাঁধা পড়ে যায়, হাজাররকম সব তুচ্ছ কাজ করতে সে বাধ্য হয়, যা তার দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের পক্ষে অনুপযুক্ত। অথবা এসব যদি সে নিজে নাও করে তবু কাজে অবহেলাকারী পরিচারিকাদের তিরস্কার করতে করতে নিজের মেজাজ নষ্ট করে। সন্তানদের লালন-পালনের ভার কার ওপর দেওয়া হবে সে বিষয়ে যদি তার ভাল জ্ঞান থাকে, তবে নার্সদের হাতে তাদের সপে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়, তার ওপর পরিচ্ছন্নতা এবং শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ সতর্কতার ব্যাপার তো রয়েছেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে উচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নার্স রাখতে সমর্থ হয়। এইসব ছোট-বড় তুচ্ছ নানা বিষয়ের চাপে যদি সে তার সমস্ত লাবণ্য এবং কমনীয়তা এবং বুদ্ধিমত্তার তিন-চতুর্থাংশ হারিয়ে না ফেলে, তবে তাকে ভাগ্যবর্তী বলতে হবে। এইসব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় যে, এরকম নারী তাদের স্বামীদের কাছে ক্লান্তিকর এবং সন্তানদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে স্বামী যখন বাড়ি ফিরে আসে, স্ত্রী তখন সারাদিনের কষ্টের কাহিনী বলতে শুরু করে, তখন তা বিরক্তিকর। কিন্তু যে স্ত্রী এসব বলে না সে অন্যমনস্ক থাকে। সন্তানদের সম্পর্কে, সে তাদের পাওয়ার জন্যে যেসব স্বার্থত্যাগ তাকে করতে হয়েছে সে বিষয়ে সবসময় সে এমনই সচেতন, যার ফলে সে এর জন্যে আশার-অতীত যে পুরস্কার তা দাবি করবেই। সব সময়ে নানা তুচ্ছ বিষয়ে মনোসংযোগ করতে হয়েছে বলে সে ব্যস্তবাগীশ এবং সংকীর্ণমনা হয়ে গেছে। সে যতরকম অবিচার ভোগ করেছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর কারণ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে তাদের ভালবাসা হারিয়েছে। কিন্তু যদি সে তাদের অবহেলা করত এবং মনের আনন্দ ও দেহের লাবণ্য ধরে রাখত তাহলে তারা সম্ভবত তাকে ভালবাসত।

এইসব দুর্ভোগ প্রধানত অর্থনৈতিক, তাছাড়া আরও একটা সমস্যা রয়েছে যা সমান গুরুতর। সেটা হচ্ছে গৃহসমস্যা। বড় বড় নগরে অনেক লোক কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগে শহর এখনকার গ্রামাঞ্চলের মতোই ছিল। শিশুরা এখনো যে শিশু-ভোলানো ছড়াটি গায়,

“পলের গির্জার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ
গাছটি একেবারে আপেলে ভরা
লন্ডন শহরের ছোট ছেলেরা
তারা লাঠি নিয়ে ছুটছে সেগুলি পাড়তে
ছুটে চলেছে বেড়ার পর বেড়া পার হয়ে
যতক্ষণ না তারা পৌঁছে লন্ডন ব্রিজের কাছে।”

পলের গীর্জা আর নেই। আমি জানি না সেন্ট পল গীর্জা ও লন্ডন ব্রিজের মধ্যে যত বেড়া ছিল কখন তা অদৃশ্য হয়েছে। বহু শতাব্দী আগে লন্ডন শহরের ছোট ছোট ছেলেরা এরকম আনন্দ উপভোগ করতে পারত। এই শিশুতোষ ছড়া তাই নির্দেশ করে। কিন্তু খুব বেশি দিনের কথা নয় যখন অধিকাংশ মানুষ পল্লীঅঞ্চলে বাস করত, শহরগুলি এত বড় ছিল না। শহর ছেড়ে আসা যেত খুব সহজে এবং শহরের অনেক বাড়ির সাথে বাগান দেখা খুব সাধারণ দৃশ্য ছিল, কিন্তু এখন ইংল্যান্ডে শহরের লোকসংখ্যা গ্রামের তুলনায় অনেকগুণ বেশি বেড়েছে। আমেরিকাতে এই বৃদ্ধি এখনো কম, কিন্তু খুব দ্রুত তা বেড়ে চলেছে। লন্ডন এবং নিউইয়র্কের মতো নগর এতই বড় যে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে প্রচুর সময় লাগে। নগরে যারা বাস করে তারা সাধারণভাবে একটি ফ্ল্যাট নিয়েই তৃপ্ত থাকে, তার সাথে অবশ্য এক বর্গ ইঞ্চি মাটিও সংলগ্ন থাকে না। মধ্যবিত্তদের খুশী থাকতে হয় ন্যূনতম জায়গা নিয়ে। ছোট ছোট শিশুরা থাকলে ফ্ল্যাটে জীবন কাটানো কঠিন। সেখানে তাদের খেলার জায়গা নেই। তাদের কোলাহল থেকে দুরে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই তাদের বাবা-মার। এজন্যে উচ্চপেশাজীবীরা ক্রমেই শহরতলিতে থাকার দিকে ঝুঁকছে। শিশুদের কথা বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে এটা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু এতে মানুষের ক্লান্তি আরো বেড়ে যায় এবং পরিবারের জন্যে যতটুকু ভূমিকা সে পালন করতে পারত ততটুকু করার ক্ষমতা তার থাকে না।

এ ধরনের বড় বড় অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তার বাইরে। আমরা আলোচনা করছি। বর্তমানকালে সুখী হওয়ার জন্যে কী করতে হতে পারে তা নিয়ে। বর্তমান কালে বাবা-মা ও সন্তানদের সম্পর্কের ভিতর যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাধা রয়েছে সেইখানে যেতে পারলে আমরা এই সমস্যার কাছাকাছি চলে আসব। এই সমস্যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র থেকে জাত সমস্যাসমূহের একটি অংশ। প্রাচীনকালে ছিল মালিক এবং দাস। মালিক ঠিক করত কী করতে হবে এবং মোটামুটিভাবে তাদের দাসদের পছন্দ করত। কারণ তারাই ছিল তাদের সুখ-বৃদ্ধির যন্ত্র। দাস সম্ভবত তার মালিককে ঘৃণা করত। যদিও গণতান্ত্রিক মতবাদ এই ঘৃণা যতটা ব্যাপক ও সার্বজনীন বলে আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়, ততটা ছিল না। কিন্তু তবু তারা মালিকদের ঘৃণা করত এটা সঠিক হলেও, মালিকরা তা বুঝতে পারত না এবং যে কোনও ভাবেই হোক মালিকরা সুখী ছিল। গণতান্ত্রিক মতবাদ সাধারণভাবে গৃহীত হওয়ায় এর সব কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যেসব দাস আগে মালিকদের নীরবে মেনে চলত, তারাই এখন আর মালিকদের মানে না। যেসব মালিকদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ ছিল না, তারা এখন দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তার দোলায় দুলছে। ফলে সংঘর্ষ বেধেছে এবং উভয়পক্ষই অসুখী হয়েছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এসব আমি যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছি না, কারণ যেসব অসুবিধার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। সেই সময় পৃথিবী থেকে সুখ যে বিদায় নেয়, সে বিষয়ে চোখ বুজে থাকা অর্থহীন।

বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্কের যে পরিবর্তন সাধারণভাবে তা গণতন্ত্র প্রসারের একটি উদাহরণ। বাবা-মা সন্তানদের ওপর তাদের অধিকার বিষয়ে আগের মতো আর নিশ্চিত নয়। সন্তানেরা বাবা-মাকে যে শ্রদ্ধা করতেই হবে তেমন করে আর অনুভব করে না। বাধ্যতা নামে গুণটি আগের দিনে প্রশ্নহীনভাবে আদায় করে নেওয়া হত। এখন তা রীতি-বিরুদ্ধ হয়েছে এবং ঠিকই হয়েছে। শিক্ষিত বাবা-মাকে মনোবিশ্লেষণ ভীত করে তুলছে, যদি তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও ক্ষতি করে ফেলে সন্তানদের। তাদের চুম্বন করলে তাদের মনে ইডিপাস গূঢ়ৈষণা জাগতে পারে, আর না করলে তাদের মনে প্রবল ঈর্ষা সৃষ্টি হতে পারে। যদি তারা সন্তানদের আদেশ করে কাজ করতে বলে, তা হলে তাদের মনে এক ধরনের পাপবোধ জন্মাতে পারে, যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সন্তানেরা এমনসব অভ্যাসের অধীন হবে যা বাবা-মার কাছে বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুকে বুড়ো আঙুল চুষতে দেখলে তারা তার ভয়ংকর পরিণামের কথা ভাবে, কিন্তু তারা জানে না কী করে তা বন্ধ করতে হয়। যে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব একসময় ছিল শক্তির সুখময় প্রয়োগ, তা এখন হয়ে পড়েছে ভীরু, উদ্বিগ্ন এবং বিবেকতাড়িত সন্দেহ। পুরোনো দিনের নির্মল আনন্দ হারিয়ে গেছে, ঠিক এমন সময়ে যখন অবিবাহিতা মেয়েরা নতুন পাওয়া স্বাধীনতার জন্যে, মাতৃত্ব লাভের সিদ্ধান্ত নিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থত্যাগ করছে। এই পরিস্থিতিতে সচেতন জননীরা সন্তানের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করে না। কিন্তু অসচেতন জননীদের আশা অনেক বেশি। সচেতন জননীরা তাদের প্রকৃতিদত্ত স্নেহকে সংযত করে এবং সতর্ক হয়। অসচেতন জননীরা তাদের সন্তানের জন্যে যে আনন্দকে ত্যাগ করতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পেতে চায়। এক ক্ষেত্রে সন্তানদের স্নেহ উপবাসী থাকে অন্য ক্ষেত্রে তা আর্ত উদ্দীপক হয়। কোনও ক্ষেত্রেই এখানে পরিবার তার সবচেয়ে সেরাটা যা দিতে পারত, ছিল নির্মল এবং স্বাভাবিক আনন্দ তা পাওয়া যাবে না।

এইসব অসুবিধার জন্যে জন্মহার যদি নেমে যায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। মানুষের জন্মহার সাধারণভাবে কমতে কমতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যাতে মনে হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যেই জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করবে। সে সীমারেখা সচ্ছল লোকেরা অনেকদিন আগেই পার করে গেছে এবং তা শুধু কোনও একটা দেশে নয়, বিশেষভাবে সব উন্নতিপ্রাপ্ত সভ্য দেশসমূহে। সচ্ছল শ্রেণীতে জন্মহারের পরিসংখ্যান খুব বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত জীন আইলিনের গ্রন্থ থেকে দুটি বিষয় উদ্ধৃত করা যেতে পারে। দেখা যায় স্টকহোম নগরে ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালের ভিতর পেশাজীবী মহিলাদের উৎপাদিকা শক্তি সাধারণ জনসংখ্যার হিসাবে মাত্র একতৃতীয়াংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজের চার হাজার স্নাতকদের মধ্যে ১৮৯৬ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত নবজাত শিশুদের মোট সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অথচ প্রজন্মকে হ্রাস পাওয়ায় হাত থেকে বাঁচাতে আট হাজার শিশুর প্রয়োজন ছিল, যাদের মধ্যে এটাও কম সময়ে মারা যায়নি। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যে সভ্যতা শ্বেতকায়দের হাতে সৃষ্ট, তার একক একটি বৈশিষ্ট্য হল, তাদের নারী পুরুষরা যে অনুপাতে আত্মভূত করে সেভাবেই তারা বন্ধ্যাত্বপ্রাপ্ত হয়। সবচেয়ে যারা বেশি সভ্য, সবচেয়ে বন্ধ্যা তারা। সবচেয়ে কম সভ্য যারা সবচেয়ে বেশি ঊর্বর তারা। অবশ্য এদের মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তর রয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্য জাতিদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমত্তায় সবচেয়ে অগ্রবর্তী, তারা বিদায় নিচ্ছে। অল্প কয়েক বছরের ভিতর তারা সামগ্রিকভাবে সংখ্যায় কমে যাবে, যদি অবশ্য তুলনায় কম সভ্য অঞ্চল থেকে লোকজন অভিবাসন নিয়ে এসে সেই ঘাটতি পূরণ করে। আবার অভিবাসিতরা যখন পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে নেবে তাদেরও বন্ধ্যাত্ব লাভের পালা চলে আসবে। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে কোনও সভ্যতার যদি এটাই বিশেষত্ব হয়, তাহলে তা স্থায়ী হয় না। এদের মধ্যে জন্মহার বাড়াতে যদি প্রেরণা সৃষ্টি করা না যায়, তা হলে কিছু আগে না হয় পরে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং স্থান নেবে অন্য আরেক সভ্যতা, যেখানে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব প্রেরণার ভিতরেই এমন শক্তি থাকবে যা জনসংখ্যা কমতে দেবে না।

প্রত্যেক পাশ্চাত্য দেশের পেশাদার নীতিবাগীশরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন ধর্মোপদেশ এবং ভাবপ্রবণতার সাহায্যে। একদিকে তারা বলেন প্রত্যেক বিবাহিত দম্পতির কর্তব্য হল ততগুলি সন্তানলাভ করা, ঈশ্বর যা ইচ্ছা। করেন। সন্তানদের স্বাস্থ্য ও সুখ নিয়ে তাদের কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে পুরুষ ধর্মতাত্ত্বিকেরা মাতৃত্বের পবিত্র আনন্দের কথা প্রচার করে থাকেন এবং ভনিতা করে বলেন, রুগ্ন দারিদ্রপীড়িত বড় পরিবার হল সুখের আকর। রাষ্ট্র তাদের সাথে যোগ দেয় এই যুক্তিতে যে কামানের জন্যে প্রচুর খাদ্য চাই, নইলে এমন চমৎকার নিখুঁত সব মারণাস্ত্র যদি হত্যার জন্যে প্রচুর লোক না পায় তা হলে তাদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বহাল থাকবে কীভাবে। আশ্চর্য হওয়ার কথা, ব্যক্তিগতভাবে কোনও বাবা-মা এই যুক্তি যদি অন্যের প্রযুক্ত বলে যদিওবা মেনে নেয় নিজেদের বেলায় পুরোপুরি বধির হয়ে থাকে। ধর্মতাত্ত্বিক ও দেশপ্রেমিকদের মনস্তত্ব ভ্রমে ভরা। ধর্মতাত্ত্বিকরা যতক্ষণ নরকানলের ভয় দেখাতে পারবেন ততক্ষণ সফল হবেন। কিন্তু বর্তমানে খুবই কম লোক এই ভয়কে গুরুত্ব দেয় এবং এই রকম কোনও ভয়ই যে আচরণ, একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার তা নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট নয়। আর রাষ্ট্রের সম্পর্কে বলা যায় তাদের যুক্তি অত্যন্ত হিংস্র। জনগণ একমত হতে পারে যে, অন্যেরা কামানের খাদ্য হোক, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের এভাবে ব্যবহার করা হোক তা তারা চায় না। সুতরাং রাষ্ট্র যা করতে পারে তা হচ্ছে দরিদ্র লোকদের অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই চেষ্টা একমাত্র অনুন্নত পাশ্চাত্য দেশ ছাড়া অন্য জায়গায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। খুব কম নর-নারীই জনগণের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে সন্তান লাভ করতে চাইবে। এই বিষয়ে তাদের ধারণা যত স্পষ্টই হোক যখন কোনও দম্পত্তি সন্তান লাভ করে তখন তারা হয় এই বিশ্বাস থেকে করে যে সন্তান তাদের সুখের সাথে যুক্ত হবে, না হয় কী করে জন্মনিরোধ করা যায় তা তারা জানে না। শেষের কারণটাই এখনো বেশি কার্যকর কিন্তু ক্রমশ তার শক্তি কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র অথবা গীর্জা যাই করুক এই কমানো আটকানো যাবে না। সুতরাং শ্বেত জাতিদের যদি অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পিতৃত্ব মাতৃত্ব যাতে পিতা-মাতাকে আবার সুখ দিতে পারে তা করা প্রয়োজন।

বর্তমানের পরিস্থিতির কথা না ভেবে যদি মানব-প্রকৃতির কথা ভাবা যায়, তাহলে আমার মনে হয়, একথাটা সকলে বুঝতে পারবেন যে পিতৃ-মাতৃত্ব মনস্তত্ত্বের দিক থেকে জীবনকে দান করতে পারে শ্রেষ্ঠ এবং সর্বাপেক্ষা স্থায়ী আনন্দ। এটা অবশ্য পুরুষ অপেক্ষা নারীর ক্ষেত্রে বেশি সত্যি। আধুনিক-পূর্ব যুগের প্রায় সব সাহিত্যেই এই ধারণাকে গ্রহণ করা হয়েছে। হেকুবা প্রিয়াম অপেক্ষা তার সন্তানদের বেশি যত্ন নেন। ম্যাকডাফ তার স্ত্রী অপেক্ষা সন্তানদের প্রতি বেশি যত্নশীল। ওল্ড টেস্টামেন্টে নারী-পুরুষ উভয়েই বংশধর রেখে যাওয়ার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব। চীনে এবং জাপানে এখনো পর্যন্ত এই মনোভাব টিকে রয়েছে। অনেকে বলতে পারেন এই কামনা এসেছে পূর্বপুরষ পূজা থেকে। আমি কিন্তু এর বিপরীতটাকেই সত্যি বলে মনে করি। বলা যায় মানুষের অন্তরে পরিবারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার যে কামনা থাকে, পূর্বপুরুষ তারই প্রতিফলন। পেশাজীবী মহিলাদের কথা কিছু আগেই বলা হয়েছে। আবার বলি, তাদের মধ্যেও সন্তান লাভের কামনা প্রবল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কেননা তা না হলে তারা সেই কামনা পূর্ণ করতে যে পরিমাণ আত্মত্যাগ করে তা কেউ করত না। আমার দিক থেকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে, যত অভিজ্ঞতাই আমি অর্জন করি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ পেয়েছি পিতৃত্ব-লাভে। আমার বিশ্বাস পরিস্থিতির কারণে কোনও নারী অথবা পুরুষকে সন্তানলাভ থেকে যদি বঞ্চিত থাকতে হয়, তখন তাদের একটি গভীর অভাব অপূর্ণ থাকে আর তা থেকে এমন এক অতৃপ্তি ও উদাসীনতা জন্ম নেয় যার কারণ সম্পূর্ণ অজানা থেকে যায়। এই পৃথিবীতে সুখী হতে হলে, বিশেষ করে যৌবন অতিক্রান্ত হলে নিজেকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, যার দিন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, এইভাবে না ভেবে ভাবা উচিত সৃষ্টির প্রথম বীজ থেকে যে জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে এক অজ্ঞাত এবং সুদূর ভাবীকালের দিকে এগিয়ে চলেছে সে তারই অংশ। নির্দিষ্ট ভাষায় প্রকাশিত এই সচেতন অনুভূতি জগতের প্রতি অতি সভ্যতাসূলভ এবং মননশীল দৃষ্টিভংগীর সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি অস্পষ্ট, সহজাত আবেগরূপে এটি আদিম এবং প্রকৃতিজাত এবং এর অভাবটাই উচ্চসভ্যতাসূলভ। যে মানুষ এমন কোনও মহৎ এবং উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করতে সমর্থ, যার অবদান প্রসারিত হবে আগামীকালে, তিনি তার কাজের ভিতর দিয়েই তৃপ্ত করতে পারেন তার অনুভূতিকে। কিন্তু যেসব পুরুষ ও নারীর এমন অসাধারণ প্রকৃতির দেওয়া উপহার নেই, তাদের তৃপ্তির একমাত্র পথ সন্তানলাভ। যারা তাদের সৃজনীশক্তিকে নষ্ট হতে দিয়েছে তারা জীবনপ্রবাহ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তা করতে গিয়ে তারা নিজেদের শুকিয়ে যাওয়ার এক প্রবল ঝুঁকির সম্ভাবনাকে বেছে নিয়েছে। তাদের জন্যে, যদি তারা বিশেষভাবে নৈর্ব্যক্তিক হতে না পারে, মৃত্যু অবধারিত। যে পৃথিবীটা তাদের পরে আসবে তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই আর এই কারণে তাদের নিজেদেরই কাছে নিজেদের যা কিছু কাজ সব তুচ্ছ এবং মূল্যহীন মনে হবে। যেসব নর-নারীর সন্তান এবং সন্তানের সন্তানরা রয়েছে এবং তাদের সহজাত স্নেহের উৎস থেকে ভালবাসেন, তাহলে আগামী দিনগুলি তাদের কাছে মূল্যবান মনে হবে, অন্তত তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এবং শুধু কোনও নৈতিকতা বা কল্পনার প্রয়াসে নয়, সহজাত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এবং যে ব্যক্তির সব প্রভাব তাঁর ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে যতদূর বিস্তৃত হয়েছে সেই প্রভাবের পরম্পরা আরো অনেক দূর প্রসারিত হতে পারে। আব্রাহামের মত, যিনি এই ভাবনা থেকে তৃপ্তিলাভ করবেন যে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরা প্রতিশ্রুত সেই ভূমির অধিকার লাভ করবে, যদি তা পরে বহু প্রজন্মে নাও ঘটে এই অনুভূতি থেকেই তিনি ব্যর্থতাবোধের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাবেন, না হলে তাঁর সব আবেগ নষ্ট হয়ে যাবে।

পরিবারের ভিত্তি হল বাবা-মার তাদের সন্তানদের জন্যে এক বিশেষ রকমের স্নেহের অনুভূতি। তারা পরস্পরকে যেভাবে ভালবাসে, বা অন্যের সন্তানদের, তার চেয়ে আলাদা। এটা সত্যি যে কোনও কোনও বাবা-মার সন্তানদের প্রতি স্নেহের অনুভূতি কম থাকে অথবা থাকেই না। কিন্তু একথাও সত্যি কোনও কোনও নারী নিজের সন্তানের প্রতি যে প্রবল বাৎসল্য অনুভব করে, ঠিক অনুরূপ বাৎসল্য অন্যের সন্তানের জন্যে অনুভব করে। এই ব্যাপারে সহজ করে বলা যায়, বাৎসল্য এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি, যা সাধারণ মানুষ নিজের সন্তানের প্রতি অনুভব করে, অন্য কোনও মানুষের প্রতি নয়। এই আবেগ আমরা পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। এই বিষয়ে ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গী আমার কাছে খুব বেশি জৈব-বিজ্ঞান সম্মত বলে মনে হয় না, কারণ যে কোনও লোক কোনও মা-প্রাণীকে দেখলেই বুঝতে পারবে তার শাবকদের জনকের প্রতি তার যে আচরণ তা তার শাবকদের সাথে তুলনায় একেবারেই আলাদা। মানুষের মধ্যে যা দেখতে পাওয়া যায় তা একই সহজাত প্রবৃত্তির পরির্তিত এবং কম নির্দিষ্ট রূপ। এই বিশেষ সহজাত আবেগের জন্যে তা না হলে প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবার সম্পর্কে আর কিছুই প্রায় বলার প্রয়োজন হত না। কারণ তা হলে সন্তানদের লালন-পালনের ভার পেশাদার পালকের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যে জিনিস রয়েছে অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি বাবা-মার বিশেষ স্নেহ, তাহলে বাবা-মার সহজাত আবেগ নষ্ট হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত, তাদের কাছে এবং সন্তানদের কাছে। সমান মূল্যবান। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহের মূল্য প্রধানত এটা যে, তা অন্য যে কোনও স্নেহের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। বন্ধু বন্ধুকে ভালবাসে তার গুণের জন্যে প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে ভালবাসে মোহনীয় শক্তির জন্যে। এই গুণ এবং শক্তি যদি কমে যায় তা হলে বন্ধু ও প্রেমিক পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একমাত্র বিপদের সময়েই জনক-জননীর পর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করা যায়, অসুস্থ হলে, এমন কি ম বিনষ্ট হলেও, যদি বাবা-মা আদর্শবান হন। আমরা যখন গুণের জন্যে প্রশংসিত হই, তখন আনন্দ নাই, যদি আমরা অনেকেই যথেষ্ট বিনয়ী বলে মনে মনে অনুভব করি যে এমন প্রশংসা বিপদজনক। বাবা-মা আমাদের ভালবাসেন কারণ আমরা তাঁদের সন্তান এবং এই ঘটনা অপরিবর্তনীয়। কাজেই তাদের কাছেই আমরা অন্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করি। সাফল্য পাওয়া গেলে এই জিনিস মূল্যবান মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যর্থ হলে তা এমন সান্ত্বনা এবং নিরাপত্তা যা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সব মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সাধারণভাবে এক পক্ষের সুখ পাওয়া সহজ। কিন্তু দুপক্ষের জন্যে তা অনেক কঠিন। কারারক্ষক কয়েদিকে পাহারা দিয়ে সুখ পেতে পারে, মনিব তার অধীনস্থ কর্মীকে ভয় দেখিয়ে সুখ পেতে পারে, শাসক প্রজাদের শক্ত হাতে শাসন করে সুখ পেতে পারে এবং রক্ষণশীল পিতাও যে তাঁর পুত্রকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যে বেতের ব্যবহার করে সুখ পান, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এইসব কিছু হল একপক্ষের সুখ, এর সাথে জড়িত অপরপক্ষের তাতে অসন্তোষ ছাড়া অন্য কিছু নেই। এই ধরনের পক্ষপাতমূলক সুখে যে ভুল আছে আমরা তা বুঝি। আমরা বিশ্বাস করি সুস্থ মানবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে উভয়পক্ষের যাতে তৃপ্তি তাই হওয়া উচিত। এই কথা বিশেষভাবে বাবা-মা এবং সন্তানদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু তার ফলে মা বাবারা আগে যেমন সন্তানদের কাছ থেকে আনন্দ পেতেন এখন তা পান না, অন্যদিকে সন্তানেরা আগে যেমন মা-বাবার কাছ থেকে দুঃখ-যন্ত্রণা পেত এখন তা পায় না। আমি মনে করি না, আগের দিনের তুলনায় মা-বাবা কেন এখন কম। আনন্দ পাচ্ছে তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, যদিও বর্তমানে একথা বাস্তব, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি এটাও মনে করি না, কেন মা-বাবা সন্তানদের আনন্দকে বাড়াতে পারবেন না তার কোনও কারণ আছে। আধুনিক পৃথিবীর সমসম্পৰ্কর্তার যেটা উদ্দেশ্য অর্থাৎ মননীয়তা এবং সুন্দর আচরণ, অন্যের ব্যক্তিত্বের প্রতি কিছু শ্রদ্ধা, তা এখানেও প্রয়োজন। আর এটাই বর্তমানে সাধারণ জীবনের কলহপ্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সুখ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমে জৈবিক উপাদান থেকে তারপর সমতায় বিশ্বাসী বিশ্বের পক্ষে অন্যের প্রতি যে মনোভাব থাকা প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে তা বাবা-মা কীভাবে গ্রহণ করে সেইদিক থেকে।

পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের যে আনন্দ তার মৌল উৎস দ্বিধাবিভক্ত। তার একটি হচ্ছে উত্তরপ্রজন্মের ভিতর নিজেরই দৈহিক বিস্তারের অনুভূতি, যা বেঁচে থাকবে নিজের দৈহিক মৃত্যু হলেও এবং তা সম্ভব তার যখন পালা আসবে সেও ঠিক একইভাবে নিজেকে বিস্তার করবে পরবর্তী প্রজন্মের ভিতর এবং এইভাবেই সে তার বংশধারার প্রাণ-বীজকে অমরত্ব দিয়ে যাবে। অপরটি হচ্ছে ক্ষমতা এবং কোমলতার ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ। নবাগত শিশুটি অসহায়, তার অভাব পূরণের জন্যে রয়েছে সহজাত আবেগ এবং তা শুধু সন্তান স্নেহকে তৃপ্ত করে না, মা-বাবার প্রভুত্ব করার ইচ্ছাকেও তৃপ্ত করে। যতদিন শিশুকে অসহায় মনে হবে ততদিন তার প্রতি যে স্নেহ বর্ষিত হয় তাকে স্বার্থহীন মনে করা যায় না, কেন না এর মধ্যে থাকে নিজেরই দুর্বল অংশকে রক্ষা করার আবেগ। কিন্তু সন্তানের শৈশব থেকেই মা বাবার মনে মাতৃ-পিতৃসুলভ স্নেহ এবং সন্তানের মঙ্গল। এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়, সন্তানের ওপর ক্ষমতা বিস্তার কিছুটা সহজাত প্রকৃতিপ্রদত্ত হলেও। সন্তান যত দিক থেকে সম্ভব স্বাধীন হতে শিখুক এটাই চাওয়া উচিত, কিন্তু তা মা-বাবার ক্ষমতা বিস্তারের প্রবৃত্তি থাকলে অপ্রীতিকর মনে হবে। কোনও কোনও মা-বাবা এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সচেতন নন এবং সন্তানেরা বিদ্রোহ না করা পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যান। কিন্তু অন্যেরা এই বিষয়ে সচেতন বলেই পরস্পর বিরোধী আবেগের শিকার হন। এই দ্বন্দ্বে তাদের পিতৃ-মাতৃত্বের সুখ হারিয়ে যায়। সন্তানের ওপর সব যত্ন মমতা ঢেলে দেওয়ার পর তারা দুঃখের সাথে বুঝতে পারেন তারা যা আশা করেছিলেন, সন্তান তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম হয়েছে। তারা চেয়েছিলেন ছেলে সৈনিক হোক, কিন্তু দেখেন সে যুদ্ধবিরোধী হয়ে উঠেছে। অথবা টলস্টয়ের মতো তাঁরা ছেলেকে যুদ্ধবিরোধী হবে বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু সে যোগ দিয়েছে ব্ল্যাক হানড্রেডস সেনাদলে। কিন্তু পরের পরিণতির জন্যে মোটেই নয়, যে শিশু নিজেই খেতে শিখেছে তাকে যদি আপনি খাইয়ে দেন তাহলে শিশুর কল্যাণের ওপর আপনি নিজের ভালবাসার ক্ষমতাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন যদিও আপনি ভাবছেন স্নেহবশত আপনি তার কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছেন। যদি আপনি বিপদ সম্পর্কে তাকে খুব বেশি সচেতন করে দেন তা হলে মনে হবে সম্ভবত আপনি তাকে আপনার ওপর নির্ভরশীল রাখার কামনা থেকে তা করছেন। আপনি যে প্রতিপাদক মেহ তাকে দিয়ে থাকেন, আপনি তাতে সাড়া চান, তাহলে মনে হবে আপনি সম্ভবত তার আবেগের সাহায্যে তাকে ধরে রাখতে চান। হাজার রকমভাবে ছোট অথবা বড়, মা-বাবার অধিকারবোধের চেতনা তাদের বিপথে চালিত করে, যদি না তারা খুব সতর্ক এবং মনের দিক থেকে নির্ভেজাল হয়। আধুনিক মা-বাবারা এ বিষয়ে সচেতন। তবুও মাঝে মাঝে সন্তানদের সাথে আচরণে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, তার ফলে তাদের খুব বেশি উপকারে আসতে পারতেন না। কিন্তু যদি তারা তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভুল করতে দিতেন তাহলে বেশি উপকারে আসতে পারেন। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যদি তারা নিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে তা হলে তাদের মনে যে দুশ্চিন্তা আসে, অন্য কিছুতে তা আসে না। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অন্তরে পবিত্র হওয়া অনেক ভাল। মা-বাবা যথার্থই সন্তানের ওপর তাদের প্রভাবের চেয়ে ওদের। কল্যাণ কামনাই বেশি করেন। তা হলে তাদের কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয় তার জন্যে মনোবিশ্লেষণের লেখা পাঠ্য বই পড়ার প্রয়োজন নেই। তাঁরা নিজের অন্তরের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে তার নির্দেশ খুঁজে পাবেন এবং এসব ক্ষেত্রে মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর থাকবে এবং তাতে সন্তানের মনে বিদ্রোহ তৈরী হবে না এবং বাবা-মার মনেও হতাশার বোধ তৈরী হবে না। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেখানোর জন্যে প্রথম থেকে মা-বাবার কাছে যে দাবি, যা শুধুমাত্র একটা নীতি নয় তা নৈতিক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক যাই হোক। এর গভীরে আছে একটা অনুভূতি যা অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের সমতুল্য, যা অধিকার-মনোভাব এবং নির্যাতনকে অসম্ভব করে তুলবে। এই মনোভাব শুধুমাত্র সন্তানদের ক্ষেত্রেই আচরণীয় তা নয়, এটা সমভাবেই প্রযোজ্য বিবাহের ক্ষেত্রে এবং বন্ধুত্বেও। যদিও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এটা তত কঠিন নয়। সুন্দর পৃথিবীতে রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই মনোভাব খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটা এমন একটা দুরাশা যে এই সম্বন্ধে আর কোনও আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে যখন এই বিশ্বজনীন মনোভাবের প্রয়োজন, তাই এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি শিশুদের ক্ষেত্রে কারণ তাদের অসহায়তার জন্যে, কারণ তাদের ছোট আকার এবং ক্ষীণ শক্তির জন্যে অমার্জিত লোকেরা তাদের অবজ্ঞা করে।

কিন্তু এই গ্রন্থে আলোচিত সমস্যাগুলির দিকে আবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। আধুনিক বিশ্বে মাতৃত্ব-পিতৃত্বের পূর্ণ আনন্দ একমাত্র তারাই পেতে পারেন যারা, আমি এতক্ষণ ধরে যা বলে আসছি, অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি সম্মানের মনোভাবকে গভীরভাবে অনুভব করেন। তাহলে তাদের আর ক্ষমতা প্রীতিকে ক্লান্তিকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না এবং সন্তানেরা স্বাধীনতা পেলে উৎপীড়ক মা-বাবা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তার তিক্ত মোহমুক্তির যে আতংক তার কোনও প্রয়োজন নেই। যে মা-বাবার এই মনোভাব তাঁরা বাৎসল্যে অনেক বেশি আনন্দ পান, যে আনন্দ মাতৃত্ব-পিতৃত্বের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশের দিনে উৎপীড়ক মা-বাবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। এই পিচ্ছিল ভুবনে যিনি এখনো নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে সগ্রাম করে চলেছেন, তার পক্ষে যে আবেগ সম্ভব তার চেয়ে তিনি ভালবাসাকে কোমলতার সাহায্যে উৎপীড়ন থেকে মুক্ত করেছেন তিনি অনেক বেশি আনন্দ পেতে পারেন যা আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি কোমল যা জীবনের সস্তা ধাতুকে অতীন্দ্রিয় আনন্দের বিশুদ্ধ সোনায় রূপান্তরিত করতে পারে।

মাতৃ-পিতৃসুলভ হৃদয়াবেগকে খুব উচ্চ মূল্য দিলেও আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই না, যা প্রায় সকলেই করে থাকেন, যে জননীরাই তাদের সন্তানের জন্যে নিজেরাই যথাসাধ্য করবেন। এই বিষয়ে কিছু প্রচলিত রীতিনীতি রয়েছে বহু প্রাচীনকাল থেকে। তখনকার যুগে প্রাচীনারা নবীনাদের যে কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক ভালমন্দ উপদেশ দিয়ে যেতেন, তার বাইরে সন্তান পালন সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানা ছিল না। বর্তমান কালে সন্তান পালনের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে এবং যিনি এই বিষয়ের কোনও বিশেষ বিভাগে যে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তার হাতেই এই ভার তুলে দিলে সবচেয়ে ভাল হয়। তাদের শিক্ষার যে বিভাগ সমাজে শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করা হয় সেখানে তা অনুমোদিত। মা ছেলেকে ক্যালকুলাস শেখাবে এটা আশা করা যায় না, তা সে ছেলে মায়ের যত প্রিয়ই হোক। বই-পড়া শিক্ষা বিষয়ে এটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত যে, যে মা এই বিষয়ে কিছু জানেন না, তার চেয়ে যারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের কাছেই তা বেশি শিখতে পারে। কিন্তু সন্তান বিষয়ে অন্যান্য অনেক বিভাগে এটি অনুমোদিত নয়, কেন না তার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায় নি। নিঃসন্দেহে কিছু জিনিস মা-ই ভাল করতে পারে, কিন্তু সন্তান যত বড় হতে থাকে। ততই তাকে আরো বেশি জিনিস শেখাতে হয় যা অন্যেরা ভাল শেখাতে পারেন। সাধারণভাবে যদি সকলে স্বীকার করত, তা হলে মায়েরা অনেক পরিশ্রম থেকে। বেঁচে যেত যা তাদের জন্যে ক্লান্তিকর, কারণ এটা এমন বিষয় নয় যাতে তাদের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে। যে নারী নিজের জন্যে অথবা তার সমাজের জন্যে কোনও বিশেষ রকম পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেছে তা মাতৃত্বলাভ করার পরও যাতে সেই দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে সেই স্বাধীনতা তার থাকা উচিত। গর্ভধারণের শেষ কটি মাস এবং শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় সেই কাজে অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু শিশুর বয়স যখন নয় মাস হয়ে যায় তখন সেই শিশু মায়ের পেশাগত কাজে অলঙ্নীয় বাধা হতে পারে না। সমাজ যখনই মায়ের ওপর তার সন্তানের জন্যে যুক্তির অতিরিক্ত ত্যাগ স্বীকারের দাবি তুলে ধরে তখন মা, যদি তিনি অস্বাভাবিক ধরনের সাধু স্বভাবের না হন, তাহলে সন্তানের কাছে তার যা প্রাপ্য তার অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশা করবেন। যে জননীকে চলিত রীতিতে আত্মত্যাগী বলা হয়, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতি অস্বাভাবিকরকম স্বার্থপর, কারণ মাতৃত্ব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়াতে তাকে জীবনের সবটুকু মনে করলে তৃপ্তি পাওয়া যাবে না এবং অতৃপ্ত জনক-জননীর আবেগের দিক থেকে সন্তানের ওপর অধিকারি-বিস্তারী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

অতএব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সন্তান ও তার জননী- উভয়ের স্বার্থে মাতৃত্ব যেন জীবনের অন্যসব স্বার্থ এবং কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, তা দেখতে হবে যদি শিশুপালনের প্রকৃত প্রশিক্ষণ তিনি গ্রহণ করে থাকেন এবং যদি তাঁর নিজের সন্তানদের পালন করার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন হয়ে থাকে, তাহলে তার এই দক্ষতা আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত এবং শিশুপালনকে তার পেশা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। যে শিশুদের মধ্যে তাঁর নিজের সন্তানও অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। বাবা-মার কাছ থেকে রাষ্ট্র ন্যূনতম যেটুকু যদি তারা পূরণ করে তাহলে তাদের সন্তানদের কীভাবে বড় করে তুলবে এবং কে করবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তাদের থাকা উচিত। অবশ্য ধরে নিতে হবে যে, সন্তানেরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের তত্ত্বাবধানের বাইরে যাবে না। কিন্তু এমন রীতি চালু হওয়ার দাবি জানানো উচিত নয়। অন্য নারীরা যে কাজ খুব ভালভাবে করতে পারে প্রত্যেক জননী নিজেই তা করবে। যেসব মা সন্তানপালনে ব্যর্থতা ও অক্ষমতা অনুভব করে, যেমন অনেক মা করে থাকে তাদের উচিত যারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং যাদের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে কোনও দ্বিধা না করে তাদের হাতে সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। সন্তানদের মঙ্গলের জন্যে ঠিক কী করা উচিত, তা মেয়েদের শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে স্বর্গ-প্রেরিত কোনও প্রেরণা নেই। মানসিক উদ্বেগ যখন একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা অধিকার-প্রবণতার ছদ্মবেশ হয়ে যায়। জননীর ভাবাবেগপূর্ণ ব্যবহারে এবং অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশুরই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটে। বাবারা যে শিশুর জন্যে বেশি কিছু করতে পারে না এটা সবসময় স্বীকৃত হয়ে এসেছে, তবু সন্তানেরা মাকে যতটা ভালবাসতে পারে, বাবাকেও ততটাই পারে। যদি নারীদের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হয় এবং শিশুদের মন এবং দেহ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান যেভাবে বাড়ছে, তার সুবিধা যদি শিশুদের দিতে হয়, তা হলে সন্তানের সাথে জননীর সম্পর্ক আগামী দিনে ক্রমেই সন্তানের সাথে জনকের সম্পর্কের তুল্য করতে হবে।

——-
১. ভিকার অব ওয়েকফিল্ড (Vicar of Wakefield), অলিভার গোল্ডস্মিথ, Oliver gold smith (১৭৩০-১৭৭৪), রচিত কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসের রচনাকাল ১৭৬১ ৬২ এবং প্রকাশিত হয় ১৭৬৬ সালে। অলিভার গোল্ডস্মিথ এ্যাংলো আইরিশ লেখক এবং কবি। পেশায় চিকিৎসক।

২. জীন আইলিন, Jean Ayling (১৮৯৪-১৮৭৬)। তার আসল নাম Dorothy Mand Wincln মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাসেক্সে জন্ম, বিখ্যাত গবেষক। তাঁর গবেষণা গ্রন্থে, ‘The Retreat from Parenthood’ উচ্চবিত্ত, পেশাজীবীদের মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের সমস্যাকে অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখা হয়েছে।

 ১৪. কাজ

কাজকে সুখের কারণ রূপে স্থাপন করা উচিত না দুঃখের কারণরূপে, মনে হয় তা বিবেচনা করা হচ্ছে একটা সন্দেহজনক প্ৰশ্নরূপে। এমন অনেক কাজ আছে যা খুবই ক্লান্তিকর এবং অতিরিক্ত কাজ করা সব সময়েই খুব কষ্টকর। কিন্তু আমি মনে করি অধিকাংশ লোকের কাছে কাজটা যদি অতিরিক্ত না হয়, সেই কাজ সবচেয়ে নীরস হলে অলসতার চেয়ে কম দুঃখের। কাজের সবরকম শ্রেণী আছে। কাজের প্রকৃতি এবং কর্মীর দক্ষতা অনুযায়ী সেসব শ্রেণীর একপ্রান্তে যেমন থাকে একঘেয়েমির হাত থেকে মুক্তি, অন্যপ্রান্তে থাকে গভীরতম আনন্দ। অধিকাংশ লোক যেসব কাজ করে তার উল্লেখযোগ্য অংশই শুধু কাজ বলেই তা আকর্ষণীয় তা নয়। তবু এমন কাজেরও কয়েকটি বড় সুবিধার দিক রয়েছে। কাজে শুরুতে কী করা উচিত তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করেই দিনের অনেকটা সময় কাজ করা যায়। অধিকাংশ লোকই যখন তারা নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজে সময় কাটাবার স্বাধীনতা পায়, তখন কোন কাজে তারা প্রচুর আনন্দ পাবে তা চিন্তা করতে পারে না এবং যখন একটা কিছু ঠিক করে, তখন ভাবে অন্য কাজটা করলে হয়তো বেশি আনন্দের হত। অবসর সময় কীভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাটানো যায় সেটা স্থির করাই হচ্ছে সভ্যতার শেষ কাজ এবং এখন পর্যন্ত কম লোকই সেই স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে। তাছাড়া, পছন্দ করার কাজটাও তো ক্লান্তিকর। অসাধারণ উদ্যোগী ছাড়া, অন্যদের উপদেশ দেওয়া যদি খুব বেশি অসন্তোষজনক না হয়, তা হলে দিনের প্রতিটি ঘণ্টা কী করতে হবে তা বলে দেওয়া হয় তাহলে ভালই লাগে। অধিকাংশ কর্মহীন ধনীরা অবর্ণনীয় রকমের একঘেয়েমিতে ভোগে, যা থেকে মুক্তির জন্যে অনেক কঠিন মূল্য তাদের দিতে হয়। কখনো তারা মুক্তি খোঁজে আফ্রিকায় পশু শিকার করে, কখনও আকাশযানে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু এ ধরনের উত্তেজনাময় কাজের সংখ্যা সীমিত, বিশেষ করে যখন যৌবন অতিক্রান্ত হয়। সে জন্যে যেসব ধনীব্যক্তি বুদ্ধিমান তারা যদি গরীব হতেন তখন যেমন পরিশ্রমের কাজ করতেন, প্রায় তেমন পরিশ্রম করেন। আর ধনী মহিলারা এমন সব অসংখ্য নগণ্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, যার মাটি-কাঁপাননা গুরুত্ব বিষয়ে তাদের ধারণাকে কেউ বদলাতে পারবে না।

সুতরাং বিরক্তির প্রতিষেধক হিসাবে প্রথম এবং প্রধান স্থান হল কাজের। কারণ প্রয়োজনীয় অথচ নীরস কাজ করতে গিয়ে যে বিরক্তি জাগে তা কোনও কাজ না থাকার বিরক্তির তুলনায় কিছুই নয়। কাজের এই সুবিধার সাথে আরো একটা সুবিধা যুক্ত আছে তা হল ছুটির দিন যখন আসে তা অনেক বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠে। যদি অবশ্য এমন কঠিন কাজ কোনও মানুষকে করতে না হয়, যা তার জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়, তাহলে সে অলস লোকের কাজের চেয়ে ছুটির সময়ে তৃপ্তির স্বাদ পেতে অনেক বেশি উদ্দীপনা খুঁজে পাবে।

পারিশ্রমিক পাওয়া অধিকাংশ কাজের এবং বিনা পারিশ্রমিকের কিছু কাজের দ্বিতীয় সুবিধা এই যে, তা উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যে সাফল্য এবং সম্ভাবনা এনে দেয়। অধিকাংশ কাজের সাফল্য পরিমাপ করা হয় উপার্জন দিয়ে এবং যতদিন আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজ থাকবে তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না। একমাত্র শ্রেষ্ঠ কাজের ক্ষেত্রেই এই পরিমাপ প্রয়োগ করা হয় না। মানুষের উপার্জন বাড়ানোর ইচ্ছা যতটুকু সাফল্যের ইচ্ছাও ততটুকু কারণ অতিরিক্ত উপার্জনেই শুধু অতিরিক্ত আরাম পাওয়া যাবে। কাজ যত নীরসই হোক তাতে যদি সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা সহ্য করাও যায়– তা সেই প্রতিষ্ঠা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক অথবা নিজের সমাজ-চক্রের মধ্যেই থাকুক। উদ্দেশ্যের অবিচ্ছিন্নতাই হচ্ছে আগামী দিনের সুখের প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে একটি এবং প্রায় অধিকাংশ লোকের জীবনে তা আসে কাজের ভিতর দিয়ে। এই বিষয়ে সেসব রমণীদের গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়, তারা পুরুষদের তুলনায় অথবা যেসব রমণী বাইরে কাজ করে তাদের চেয়ে কম ভাগ্যবতী। যে নারী সংসারের কাজ করে তার জন্যে কোনও পারিশ্রমিক পায় না। তার নিজের অবস্থা ভাল করার কোনও উপায় নেই, স্বামী শুধু তাকে স্বীকার করে নেয় (সে কী করে তা প্রায় দেখেই না)। কিন্তু গৃহকর্মের জন্যে তার কোনও মূল্য নেই, যদি অন্য কোনও গুণ থাকে তবে সে তার মূল্য পায়। যেসব রমণী অবশ্য যথেষ্ট স্বচ্ছল তাদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। তারা সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে, সুন্দর বাগান করতে পারে এবং ক্রমে। প্রতিবেশীদের ঈর্ষার পাত্রী হয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা বড় কম। অধিকাংশ রমণীর পক্ষেই গৃহকর্ম সেই পরিমাণ তৃপ্তি দেয় না, যা পুরুষদের এবং পেশাজীবী নারীদের অন্যসব কাজ দেয়। সময় কাটাবার এবং যত অল্পই হোক, উচ্চাকাঙ্ক্ষা সার্থক করে তোলার জন্যে কিছু পথ খুলে দেওয়ার মূল্য কাজের মধ্যেই বেশি পাওয়া যাবে এবং যার কাজ বিরক্তিকর, তাকেও কর্মহীনের তুলনায় বেশি তৃপ্তি দেবে। কিন্তু কাজ যখন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তখন তা শুধুমাত্র একঘেয়েমি থেকে মুক্তির চেয়ে অনেক ওপরের স্তরের তৃপ্তি দিতে পারে। আমি যেসব কাজের আকর্ষণ কোমল, তা থেকে শুরু করে একজন মহান ব্যক্তির সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত করে রাখার মতো উপযুক্ত কাজ দিয়ে এই সাজানোটা শেষ করব।

দুটি প্রধান উপকরণ কাজকে আকর্ষণীয় করে : প্রথম, দক্ষতার প্রয়োগ এবং দুই. নির্মাণ।

অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দক্ষতা প্রয়োগ করতে ভালবাসে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সহজ হয়ে আসে অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের দক্ষতার আরও উন্নতি করতে পারে। শৈশবের প্রথম থেকেই কাজের প্রেরণা শুরু হয়। যে বালক মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে পায়ের ওপর দাঁড়াতে অনিচ্ছুক হয়। একটা বড় কাজে যে আনন্দ পাওয়া যায়, দক্ষতার খেলা থেকেও তা লাভ করা যায়। একজন আইনজীবী বা একজন রাজনীতিকের কাজের মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা তাসের ব্রীজ খেলা থেকে পাওয়া আনন্দের সমতুল্য। অবশ্য এখানে শুধু দক্ষতার প্রয়োগ নয়, দক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দও আছে। কিন্তু যেখানে এই প্রতিযোগিতার উপাদানটি অনুপস্থিত সেখানেও কঠিন কৃতিত্ব প্রদর্শন করা সম্ভব। যে ব্যক্তি আকাশে বিমান নিয়ে নানারকম কৌশল দেখাতে পারে এবং তাতে যে গভীর আনন্দ পায় তার জন্যেই জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে। আমি কল্পনা করতে পারি একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসক যে অবস্থায় কাজ করেন তা বেদনাদায়ক হলেও তিনি তার নিখুঁত সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের পর তৃপ্তি লাভ করেন। একই রূপ আনন্দ তীক্ষ্ণতার কিছু কম হলেও সাধারণ মানের কাজ থেকেও পাওয়া যায়। আমি প্লাম্বার কারিগরের কথা শুনেছি যে তার কাজ থেকে আনন্দ পায়, যদিও এমন কারো সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। নৈপুণ্যের সব কাজই আনন্দজনক হতে পারে যদি অবশ্য সেই নৈপুণ্য প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল হয় অথবা তাতে সেই সুযোগ থাকে যার সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। এইসব শর্ত যদি অনুপস্থিত থাকে তা হলে যে ব্যক্তি নৈপুণ্যের উচ্চতম ধাপে পৌঁছেছে তার কাছে কাজ আর আকর্ষণীয় থাকবে না। যে ব্যক্তি তিন মাইলের দৌড়ে প্রতিযোগিতা করে, যখন এই পেশায় যোগ দেওয়ার বয়স পার হয়ে যাবে তখন আর এই প্রতিযোগিতায় আনন্দ পাবে না। সৌভাগ্যের কথা, অনেক কাজ আছে যার নতুন অবস্থায় নতুন রকম নৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় এবং যে ব্যক্তি কর্মরত তার পক্ষে মধ্য বয়সে ক্রমে ক্রমে উন্নতির ধাপে উঠে যাওয়া সম্ভব হয়। কিছু দক্ষতার কাজ আছে যেমন রাজনীতি, তাতে সফল হওয়ার উপযুক্ত বয়স হল ষাট থেকে সত্তর, তার কারণ হচ্ছে এ ধরনের কাজে অন্য লোক সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অতি প্রয়োজনীয়। এইজন্যে সত্তর বছর বয়সের সকল রাজনীতিক সম বয়সের অন্যান্য লোকের চেয়ে বেশি সুখী। এই বিষয়ে তাদের একমাত্র প্রতিযোগী হচ্ছে বড়বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা।

উৎকৃষ্ট কাজের আরো একটি উপকরণ আছে যা সুখের উৎসরূপে দক্ষতা প্রয়োগের চেয়েও বেশি মূল্যবান, তা হচ্ছে সৃষ্টি করার কাজ। কিছু কাজে অবশ্যই, তবে অধিকাংশ কাজেই নয়, কিছু নির্মাণ করা যায় এবং কাজের শেষে যা কৃতিত্বের স্তম্ভরূপে থেকে যায়। কাজের গুণগত মানে কোনটি সৃষ্টি আর কোনটি ধ্বংস তা আলাদা করা যায়। সৃষ্টির কাজে প্রথমদিকে অবস্থাটি কিছু বিশৃঙ্খল থাকলে, কাজ শেষ হওয়ার পর লক্ষ্যটা বাঝা যায়। ধ্বংসের কাজে এর বিপরীতটাই ঠিক। এর প্রথম দিকে থাকে লক্ষ্য এবং শেষের দিকে হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল। সুতরাং বলা যায় ধ্বংসকারীর লক্ষ্যই হচ্ছে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা, যার ভিতর কোন উদ্দেশ্য ফুটে উঠবে না। কোনও দালান নির্মাণ করা বা ভেঙ্গে ফেলার কাজে এটি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং এই গুণমান আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করা যায়। দালান নির্মাণে পূর্বে রচিত পরিকল্পনার বাস্তবায়িত করতে হয়। কিন্তু সেটি ভেঙ্গে ফেলতে হলে তার সব উপকরণ কীভাবে থাকবে তা নিয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, পরবর্তী নির্মাণের জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বিনষ্টি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ কাজের একটি অংশমাত্র, আলাদা নয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় পরবর্তী নির্মাণের কথা মনে না রেখেই লোকে প্রথমে ধ্বংসের কাজ শুরু করে। দেখা যায় এই কথাটা সে এই বিশ্বাসে নিজের কাছেও গোপন রাখে যে, নতুন নির্মাণের জন্যেই সে সব কিছু ভেঙে পরিষ্কার করছে। কিন্তু এটা যদি ছলনা হয়, তবে তার সেই ছলনার মুখোশ খুলে ফেলা সাধারণত অসম্ভব নয়, শুধু তাকে প্রশ্ন করতে হয়, এর পরবর্তী নির্মাণের কাজটা কী। এই বিষয়ে এটা পরিষ্কার হবে যে, উত্তরে সে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না এবং বলার মতো উৎসাহও নেই তার। অথচ প্রাথমিক ধ্বংসের কাজে সে খুব নির্দিষ্টভাবে এবং উদ্দীপনার সাথে সব বলেছিল। অনেক বিপ্লবী, যুদ্ধবাদী এবং হিংসার দূতদের সম্পর্কে একথা বলা যায়, তবে কর্মপ্রেরণার উৎস হল ঘৃণা করে তাদের ধ্বংস করা। কিন্তু তারপর কী হবে সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। আমি একথা অস্বীকার করতে পারি না যে সৃষ্টির মতো ধ্বংসের মধ্যেও আনন্দ আছে। এই আনন্দ ভয়ংকর এবং কোনও কোনও মুহূর্তে আরো তীব্র, কিন্তু তাতে কোনও গভীরতা নেই কারণ ধ্বংসের যা পরিণাম তার মধ্যে তৃপ্তির স্থান থাকে না। আপনি আপনার শত্রুকে হত্যা করলেন, তখন সে মারা গেল আপনার সব কাজ শেষ এবং বিজয় থেকে যে তৃপ্তি পেলেন তা অতি দ্রুত মিলিয়ে যাবে। অন্যপক্ষে নির্মাণের কাজ যখন সমাপ্ত হয়, তখন তা নিয়ে ভাবতেও আনন্দ। তা ছাড়া পরে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না এমন পূর্ণাঙ্গভাবে তা কখনও শেষ হয় না। সবচেয়ে তৃপ্তিজনক উদ্দেশ্য তাই, যা একের পর এক সাফল্যের পথ খুলে দেয় যা কখনও থামে না। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে ধ্বংসের তুলনায় নির্মাণই সুখের বড় উৎস। আরো বিশুদ্ধভাবে বলা যায়, যারা সৃষ্টির কাজে যে আনন্দ পায়, আর ধ্বংসের কাজে যারা আনন্দ পায়, তাদের কোনও তুলনা চলে না। কারণ মনে একবার ঘৃণা জাগলে নির্মাণকাজে অন্য লোক যে আনন্দ পায়, তেমন আনন্দ সহজলভ্য নয়।

একথাও বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনও রকম নির্মাণ কাজের সুযোগ পেলে ঘৃণার অভ্যাস যত সহজে দূর করা যায়, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়।

বড় কোনও সৃষ্টিধর্মী কাজের সাফল্যে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা জীবনে প্রাপ্তব্য সেরা আনন্দসমুহের মধ্যে অন্যতম। যদিও দুর্ভাগ্যবশত এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ শুধু বিশেষভাবে দক্ষ লোকদের জন্যেই উন্মুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাফল্য থেকে যে আনন্দ তা থেকে কোনও মানুষকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না, যদি না দেখা যায় শেষ পর্যন্ত যে তার কাজই ছিল বিশেষভাবে খারাপ। এই তৃপ্তির অনেক প্রকারভেদ আছে। যে লোকটি একটি সেচ প্রকল্পের সাহায্যে তার পতিত জমিকে একটি গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত করে তুলেছে সে তাকে অত্যন্ত স্পষ্ট স্পর্শনযোগ্য রূপেই উপভোগ করবে। কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে। যে অল্প কজন রাষ্ট্রনায়ক বিশৃঙ্খল পরিবেশকে নতুন শৃঙ্খলায় রূপায়নে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কাজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে এ যুগে লেনিন একটি মহৎ উদাহরণ। শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ। শেক্সপীয়র তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন : যতদিন মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে, চোখে থাকবে দৃষ্টি, ততদিন এইগুলি বেঁচে থাকবে। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই ভাবনা তাঁকে দুর্ভাগ্যে সান্ত্বনা জুগিয়েছিল। তাঁর সনেটের ভিতর দিয়ে তিনি বলেছেন তার বন্ধুর সম্বন্ধে ভাবনা তাঁকে জীবনের সাথে আপোস করে চলতে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু যেসব সনেট তিনি বন্ধুর উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন সেসব যে তার বন্ধুর চেয়ে তাঁর এই উদ্দেশ্যপূরণে বেশি কার্যকর হয়েছিল, এমন একটি সন্দেহ আমার রয়ে গেছে। বড় শিল্পী এবং বড় বিজ্ঞানসেবকরা যে কাজ করেন তা নিজেই আনন্দপূর্ণ। যতক্ষণ তারা এই কাজ করবেন ততক্ষণ তারা যোগ্য লোকের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেয়ে যাবেন। এতে তারা সর্বাপেক্ষা মৌলিক ধরনের ক্ষমতার অধিকারী হন, যে ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং চেতনার ওপর প্রভাব। নিজেদের সম্পর্কে ভাল চিন্তা করার সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ তাদের রয়েছে। মনে হয় এইসব সুন্দর ঘটনার মিলন যে কোনও ব্যক্তিকে সুখী করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তবু এরকম ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ মাইকেল এঞ্জেলোর নাম করা যেতে পারে। তিনি খুব অসুখী মানুষ ছিলেন এবং বলতেন (না, আমি নিশ্চিত, তিনি সত্যি বলতেন না) যে, যদি তাকে তার দরিদ্র আত্মীয়দের ঋণ পরিশোধ করতে না হত, তাহলে তিনি ছবি আঁকার কষ্টটা আর সহ্য করতেন না। সবসময়ে না হলেও, অধিকাংশ সময়েই মহৎ শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতার সাথে মেজাজগত একটা অশান্তির যোগ থাকে এবং তা এতই প্রবল যে, শিল্পী তাঁর কাজ থেকে আনন্দ খুঁজে না পেলে বাধ্য হয়ে তাকে আত্মহত্যার পথে যেতে হয়। তাই আমরা মনে করতে পারি না যে মহৎ সৃষ্টি হলেই তা মানুষকে সুখী করবে, আমরা শুধু বলতে পারি এটি তাকে কম অসুখী করবে। বিজ্ঞানসেবীরা কিন্তু শিল্পীদের তুলনায় মেজাজগতভাবে অনেক কম সুখী এবং সাধারণভাবে যারা বিজ্ঞান নিয়ে মহৎ কাজ করেন তারা সুখী মানুষ। মূলত এই সুখ তারা লাভ করেন তাঁদের কাজ থেকে।

বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুখহীনতার একটা কারণ হল, বিশেষ করে যাদের সাহিত্যে দক্ষতা আছে, তাদের অনেকেই স্বাধীনভাবে নিজেদের মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। তারা শিক্ষাদীক্ষাহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত বৃহৎ সব সংস্থায় কর্মীরূপে কাজ করেন। সেসব পরিচালকদের নির্দেশে তাদের এমন সব জিনিস লিখতে হয়, যা তারা নিজেদের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন। যদি ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে অনুসন্ধান করা যায়, তাঁরা যে পত্রিকায় কাজ করেন তার নীতিমালায় তাদের বিশ্বাস রয়েছে কিনা, তাহলে জানা যাবে খুব কম সংখ্যক সাংবাদিকই মালিকদের নীতিতে বিশ্বাসী। বাকি অন্য সকলে শুধুমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে নিজেরা যে নীতিকে ক্ষতিকর মনে করে তার কাছেই তাদের দক্ষতা বিক্রি করে দেয়। এই ধরনের কাজে কখনও আসল তৃপ্তি থাকে না এবং কাজের সাথে আপোস করতে গিয়ে তাদের মন এমন বিষময় হয়ে ওঠে যে, সেই মন আর কোনও কিছু থেকেই আন্তরিকভাবে কোনও তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারে না। এরকম কাজ যাদের দায়ে পড়ে করতে হয় তাদের আমি নিন্দা করতে পারি না, কারণ এর যা বিকল্প তা হল অনাহার, যা আরো ভয়ানক। কিন্তু আমি মনে করি যেখানে কোনও ব্যক্তির সৃজনি প্রতিভার পক্ষে তৃপ্তিকর কাজ করা সম্ভব এবং সম্পূর্ণ অনাহারও এড়ানো যায়, সেখানে তাকে এই পরামর্শ দেওয়া চলে, সেখানে উচ্চ সাম্মানিক হলেও তা বর্জন করে নিজের সুখ এবং তৃপ্তিদায়ক কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে যথার্থ সুখ লাভ করা সম্ভবই নয় বলতে হবে। যে লোক নিজের কাজের জন্যে সংকুচিত সে খুব কমই আত্মসম্মান লাভ করে।

সৃষ্টিশীল কাজের তৃপ্তি, এখন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের বিশেষ সুবিধা হলেও অনেক লোকের পক্ষে এই বিশেষ সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। যে লোক নিজেই নিজের কাজের নিয়ন্তা সে এটা অনুভব করতে পারে। অথবা যে লোকের কাছে তার কাজ প্রয়োজনীয় মনে হবে এবং সেই কাজে যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন, সেও তা অনুভব করতে পারবে। মনের মতো সন্তানকে গড়ে তোলা একটি কঠিন সৃষ্টিমূলক কাজ। যা গভীর তৃপ্তি দিতে পারে। যে মা এটি সম্ভব করতে পেরেছে সে অবশ্যই অনুভব করতে পারবে যে তার পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী এমন কিছু মূল্যবান জিনিস পেয়েছে যা অন্যভাবে পাওয়া যেত না।

জীবনকে সামগ্রিকরূপে দেখার প্রবণতার মধ্যে মানুষে-মানুষে বিস্তর পার্থক্য। কিছু লোকের পক্ষে এরকম দেখা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং কিছু কাজ তৃপ্তির সাথে করতে পারলেও তা তাদের সুখের জন্যে প্রয়োজনীয়। আবার কিছু লোকের কাছে জীবন হল পরপর ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশ, তাদের নির্দিষ্ট কোনও গুগতি নেই, পরস্পরের মধ্যে কোনও ঐক্যসূত্রও নেই। আমার মনে হয়, প্রথমে যাদের কথা বললাম তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সুখলাভ করতে সক্ষম, কারণ তারাই ক্রমশ সেইরকম অবস্থা তৈরী করে নেবে যা থেকে তারা আনন্দ এবং আত্মসম্মান পেতে পারবে। অপরদিকে অন্যেরা, একবার এদিক, আরেকবার ওদিক করে বিশৃঙ্খল ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খাবে। কখনো কোনও বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে না। জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার অভ্যাস হল, জ্ঞান এবং বিশুদ্ধ নৈতিকতা– এই দুয়েরই অপরিহার্য অঙ্গ এবং আর যা প্রাধান্য পাওয়া উচিত, তা হল শিক্ষা। সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য জীবনকে সুখী করার জন্যে যথেষ্ট নয়। সুখী জীবনের জন্যে তাই হল অপরিহার্য অঙ্গ। আর সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য প্রধানত কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

১৫. নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ

যেসব বড় রকমের আকর্ষণকে ঘিরে মানুষের জীবন গড়ে উঠেছে এই অধ্যায়ে আমি তা নিয়ে আলোচনা না করে, ছোট রকমের আকর্ষণ যা তার অবসরকে ভরে রাখে এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে পূর্ব থেকেই নিয়োজিত তার চাপ থেকে মুক্ত করে, তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাধারণ লোকের জীবনে তার পত্নী, সন্তান, তার কাজ এবং আর্থিক অবস্থা এসব কিছু তার উদ্বেগ এবং গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার প্রধান অংশ দখল করে থাকে। এমনকী তার যদি বিবাহ-বহির্ভূত কোনও প্রেমের সম্পর্ক থাকে, তবু তার জন্যে মনে হয় ততটা গভীর দুশ্চিন্তা হয় না, যতটা হয় তার পারিবারিক জীবনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। যে আকর্ষণ তাকে কাজের সাথে জড়িত করেছে, তাকে আমি আপাতত নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ বলতে চাই না। যেমন একজন বিজ্ঞানসেবীকে তার বিষয় সংক্রান্ত সব ধরনের গবেষণার সাথে সমতা রেখে চলতেই হয়। এই ধরনের গবেষণায় তার মনোভাবে যে উদ্দীপনা এবং প্রাণশক্তি দেখা যায় তা তার বৃত্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত আন্তরিকতা। কিন্তু যদি তিনি তাঁর বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন বিজ্ঞানের অন্য কোনও শাখার গবেষণার কথা পড়েন, তাহলে তিনি তা পড়বেন ভিন্ন ধরনের আগ্রহ নিয়ে। বৃত্তিগত মন নিয়ে নয়, নিবিড়ভাবেও নয় এবং আরো আকর্ষণীয়ভাবে। সেখানে যা বলা হয়েছে তা যদি তিনি নির্দিষ্ট মনেও পড়েন তবু তা হত তার কাছে একটি আরামের ব্যাপার। কারণ সেই গবেষণাপত্র তার দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়। যদি সেই বই তাঁর কাছে আকর্ষণীয় বোধ হয়, তবে তা নৈর্ব্যক্তিক, যা তাঁর নিজের বিষয়ের ওপর বই হলে বলা যেত না। মানুষের জীবনের মূল কাজের বাইরে যেসব আকর্ষণ আছে, এই অধ্যায়ে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই।

অসন্তোষ, অবসাদ এবং স্নায়ুপীড়ার একটি কারণ হচ্ছে জীবনের পক্ষে বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন জিনিসে আকৃষ্ট হওয়ার অক্ষমতা। এর ফলে সচেতন মন কিছু ছোট ধরনের ব্যাপার থেকে বিশ্রাম পায় না এবং সে সবের প্রত্যেকটিতে সম্ভবত কিছু উদ্বেগ এবং কিছু দুশ্চিন্তার উপাদান যুক্ত আছে। একমাত্র ঘুমের সময় সচেতন মন নিষ্ক্রিয় কিন্তু অবচেতন মন পুরোপুরি সক্রিয় থাকে এবং জ্ঞানের পথে বিকশিত হয়। এর ফল হল উত্তেজনা বৃদ্ধি, বিচক্ষণতার অভাব, অসহিষ্ণুতা এবং মাত্ৰাজ্ঞানের অভাব দেখা দেয়। এই সবই হল অবসাদের কারণ এবং প্রক্রিয়া। মানুষ যখন অতিমাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার বাইরের আকর্ষণ কমে যায়, যতই তা কমতে থাকে ততই বাইরের আকর্ষণ তাকে যে মুক্তির স্বাদ দিচ্ছিল তা হারিয়ে যায় এবং সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই দুষ্টচক্রের শেষ পরিণাম হচ্ছে একেবারে ভেঙ্গে পড়া। বাইরের আকর্ষণ বিশ্রাম দেয় এই জন্যে যে, তাতে কোনও কাজের আহ্বান থাকে না। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ইচ্ছাকে পরিচালনার কাজ খুব ক্লান্তিকর, বিশেষ করে যখন তা খুব তাড়াতাড়ি করতে হয় এবং অবচেতন মনের সাহায্য ছাড়া করতে হয়। যারা মনে করে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মনকে বিশ্রাম দিতে হবে, তারা সঠিকভাবেই তা মনে করে। অবচেতন মনের ক্রিয়া শুধু ঘুমন্ত অবস্থাতেই চলে না, সচেতন মন অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকলে তার ক্রিয়া সচল থাকে। যে মানুষ কাজ শেষ হলে কাজের কথা ভুলে যেতে পারে এবং পরদিন কাজ শুরুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ভুলে থাকতে পারে এবং যে লোক মধ্যবর্তী সময়েও কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, তার চেয়ে পূর্বোক্ত লোক অনেক ভালভাবে কাজ করতে পারে। নিজের কাজ ছাড়া কোনও লোকের যদি অন্য বিষয়ে আগ্রহ থাকে তার পক্ষে যার কাজ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে আগ্রহ নেই, তার তুলনায় যখন কাজের কথা ভুলে থাকা প্রয়োজন হয়, ঠিক তখন ভুলে থাকা সহজতর হয়। তবে যে শক্তি সমস্ত দিনের কাজের শেষে ফুরিয়ে যায়, অন্য বিষয়ে আকর্ষণ থাকার জন্যে তা যেন আবার প্রয়োজন না হয়। ইচ্ছাশক্তি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও যেন তাতে না থাকে। জুয়া খেলার মতো অর্থ বিনিয়োগের কোনও ঝুঁকি যেন না থাকে। তা ছাড়া সে সব কাজে মন অবসাদগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনও উত্তেজনা যেন না থাকে, যা আগে থেকেই সচেতন বা অবচেতন মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে।

এমন অনেক আমোদ রয়েছে যা এইসব শর্ত পূরণ করতে পারে। খেলা দেখা, থিয়েটার দেখা, গলফ খেলা এই বিষয়ে অনিন্দনীয়। যার বই পড়ার নেশা আছে তার পক্ষে নিজের পেশা সম্পর্কিত বই বাদ দিয়ে অন্য বই পড়লে তৃপ্তিদায়ক হতে পারে। দুশ্চিন্তার কারণ যত জরুরী হোক সমস্ত দিন জেগে থাকার মুহূর্তে তা নিয়ে ভাবা উচিত নয়।

এই বিষয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সাধারণভাবে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় সহজে কাজ ভুলে থাকতে পারে। মেয়েদের কাজ যেহেতু গৃহের মধ্যে তাই তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক। কারণ তাদের কাজের স্থান পরিবর্তন হয় না, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তা নয়। অফিসের কাজের শেষে পুরুষেরা বাড়ি ফিরে মনকে নতুন করে তুলতে সাহায্য করে। যদি আমি ভুল না করে থাকি, তাহলে বলা যায়, যেসব মহিলার কাজ বাড়ির বাইরে তারা এ বিষয়ে পুরুষের চেয়ে প্রায় ততটুকু আলাদা, যতটুকু আলাদা যার বাড়িতে কাজ করে তারা। তাদের কাছে যেসব জিনিসের ব্যবহারিক মূল্য নেই, তাতে উৎসাহিত হওয়া বেশ শক্ত তাদের পক্ষে। তাদের উদ্দেশ্যেই তাদের ভাবনা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সম্পর্ক দায়িত্বহীন কোনও বিষয়ে তারা কখনো আগ্রহী হয় না। এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে সেকথা আমি অস্বীকার করি না, আমি শুধু সাধারণ নিয়মের কথা বলছি। মেয়েদের কলেজে যদি কোনও পুরুষ শিক্ষক না থাকে তাহলে মহিলা শিক্ষকরা সন্ধ্যায় বাজার করার গল্প করে। কিন্তু ছেলেদের কলেজে পুরুষ শিক্ষকরা তা করে না। এই বৈশিষ্ট্য মেয়েদের কাছে পুরুষদের তুলনায় অতিরিক্ত সচেতনতা বলে মনে হয়। কিন্তু আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এদের কাজের গুণগত মান কিছুমাত্রায় বাড়ে। বরং এতে দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং তা থেকে জন্ম নেয় রক্ষণশীলতার।

সবরকম নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণই মানসিক চাপ থেকে মুক্তির গুরুত্ব ছাড়াও অন্যভাবে কাজে লাগে। প্রথমেই বলতে হয়, তারা মানুষকে পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমরা পেশাগত কাজে, নিজেদের সমাজের পরিমণ্ডলে নিজেদের কাজের অনুরূপ কাজে ডুবে থাকি, যা এতই সহজ যে আমরা ভুলেই যাই যে সমগ্র মানবজাতির কাজের তুলনায় এই অংশটুকু কত ক্ষুদ্র। আমরা যা করি এই বিশ্বের কত শত জিনিস তার প্রভাবের বাইরে থাকে। কেন কোনও মানুষ তা মনে রাখবে? এর অনেকগুলি উত্তর আছে। প্রথমত প্রয়োজনীয় কাজের সাথে যতটুকু সংগতি রাখা যায় জগৎ সম্পর্কে ততটুকু আসল ধারণা অর্জন করা ভাল। ইহলোকে আমাদের অবস্থান বেশিদিনের জন্যে নয়। এই সময়ের মধ্যে এই অদ্ভুত গ্রহ এবং মহাবিশ্বে তার স্থান কোথায় তা নিয়ে যতটা সম্ভব জ্ঞানলাভ করতে হয়। আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ, তাই তা লাভ করার সুযোগকে অবহেলা করা আর থিয়েটারে গিয়ে নাটকের সংলাপ না শোনা একইরকম। এই বিশ্ব বহু বিয়োগান্ত অথবা মিলনান্তক, বীরোচিত অথবা উদ্ভট অথবা আশ্চর্যময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। যে মানুষের এইসব দৃশ্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই সে জীবনের একটি বড় সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

তাছাড়া পরিমিতিবোধ থাকাটা খুব মূল্যবান এবং তা অনেক সময়েই অত্যন্ত সান্ত্বনা প্রদায়ক। আমরা পৃথিবীর যে ক্ষুদ্র কোণায় বাস করি এবং জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে যে ক্ষণ মুহূর্ত পাওয়া,তা নিয়ে অকারণ উত্তেজিত হওয়া, স্নায়ুকে পীড়িত করা এবং তাকে অযথা বাড়িয়ে দেখার দিকে আমাদের সকলেরই একটা প্রবণতা আছে। এই উত্তেজনা এবং নিজেদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণার মধ্যে এমন কিছু নেই যা বাঞ্ছনীয়। এটা সত্যি যে এই ভাবনা আমাদের আরো কঠিন পরিশ্রম করাতে পারে, কিন্তু তা আমাদের কাজের দক্ষতা বাড়াতে পারে না। খারাপ উদ্দেশ্যে অনেক বেশি কাজ, ভাল উদ্দেশ্যে অল্প কাজ অনেক ভাল। যদিও যারা জীবনে কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাসী তারা এর বিপরীতটাকেই সমর্থন করবেন। কাজ নিয়ে যারা অতিরিক্ত ব্যস্ত তাদের সবসময় অন্ধ গোঁড়ামিতে পড়ে যাওয়ার বিপদ থাকে, যার মূল কথা হচ্ছে সবকিছু ভুলে গিয়ে একটি বা দুটি মনের মতো বিষয় মনে রাখা আর এই একটি বা দুটি বিষয় অনুসরণ করতে পারলে আর যা থাকে তা থেকে যে ক্ষতি হতে পারে তাকে তুচ্ছ মনে করা। মানুষের বিরাট জীবন কল্পনা এবং এই পৃথিবীতে তার স্থান সম্পর্কে উদারতর ধারণা তৈরী করাই হচ্ছে এই ধরনের গোঁড়ামির বড় প্রতিষেধক। এই ব্যাপারে এমন বৃহৎ প্রসঙ্গ তুলে ধরা বড় কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু এই ছোট ব্যাপার না ধরলেও সেই বৃহৎ প্রসঙ্গটির নিজেরই একটি বড় মূল্য রয়েছে।

বর্তমান উচ্চশিক্ষার একটি গলদ এই যে, এতে কোনও একটি নির্ধারিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্যে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা আছে কিন্তু হৃদয় মন যাতে উদার হয়, তার জন্যে নিরপেক্ষ সমীক্ষায় পৃথিবীকে দেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ধরুন আপনি কোনও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত আছেন এবং নিজেদের দলের জয়লাভের জন্যে কঠিন পরিশ্রম করছেন, এই পর্যন্ত সবই ভাল, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলাকালীন এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যাতে সবার মনে ঘৃণা হিংসা এবং সন্দেহ বেড়ে যায়, এমন পথে গেলে জয়লাভের পথ কিছুটা সুগম হয়। যেমন, আপনি বুঝতে পারবেন জয়লাভের পথ অনেক সহজ হবে যদি কোনও বিদেশী জাতিকে অপমান করা যায়। আপনার মানসিক প্রসারতা যদি বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে অথবা যদি আপনি এই মতে দীক্ষা নিয়ে থাকেন যে যাকে কর্মদক্ষতা বলা হয় তা ছাড়া আর সব কিছু প্রয়োজনহীন, তা হলে আপনি এই ধরনের সন্দেহজনক পথ অবলম্বন করতে পারেন। এইভাবে আপনি আপনার তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে জয়লাভ করবেন, কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী ফল হবে মারাত্মক। যদি অন্যদিকে মানুষের অতীত যুগ, তার বর্বর অবস্থা থেকে ধীর এবং আংশিক উন্মেষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবে অকল্পনীয় কালের তুলনায় মানুষের সমগ্র অস্তিত্বের অতি-সংক্ষিপ্ততা– এইসব ধারণা আপনার মনের অভ্যস্ত অঙ্গ হয়, আমি বলি, যদি এই চিন্তাধারা আপনার সাধারণ অনুভূতিকে ছাঁচে তৈরী করে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, যে ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধে আপনি রত আছেন, তা এমন জরুরী নয়, যাতে আমরা যে অন্ধকার থেকে এত দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছি, তাহলে সেই ফেলে আসা পথে আবার এক ধাপ ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিকে স্বীকার করে নেওয়া। শুধু তাই নয়, যদি আপনি তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে পরাজিতও হন তাহলে তার ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে সেই একই বোধ আপনাকে হীন অস্ত্রধারণ করতে দেবে না। তাৎক্ষণিক সব কার্যকলাপকে অতিক্রম করে আপনার মনে উদিত হবে সেই লক্ষ্য যা অনেক দূরে এবং খুব ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, যেখানে পৌঁছানোর চেষ্টায় আপনি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ নন বরং মানজাতিকে যে বিশাল বাহিনী সভ্যতার অস্তিত্বময় জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, আপনি সেই বাহিনীরই একজন। আপনি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গী পেয়ে থাকেন, আপনার ব্যক্তিগত ভাগ্য যাই হোক এক গভীর সুখ কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবে না। সর্ব যুগের মহামানবদের সাথে আপনার আত্মিক বন্ধন তৈরী হবে এবং কোনও ব্যক্তির মৃত্যুকে মনে হবে একটি তুচ্ছ ঘটনা।

আমার ইচ্ছানুযায়ী যদি উচ্চশিক্ষা সংগঠনের ক্ষমতা থাকত আমি তাহলে প্রাচীন রক্ষণশীল ধর্মসমূহের, তরুণদের মনে যার আবেদন খুব কম এবং যেসব নীতি অনুযায়ী সবচেয়ে কম বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুর্বোধ্য ও সংস্কার বিরোধী, বদলে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতাম যাকে ঠিক ধর্ম বলা যায় না কারণ তা হত শুধু কিছু নির্ধারিত সত্যের প্রতি মনোসংযোগ করা। আমি চেষ্টা করতাম তরুণরা যাতে অতীতকে প্রাণবন্তরূপে জানতে পারে এবং স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে মানুষের ভবিষ্যৎ তার অতীত থেকে অনেক অনেক দীর্ঘ, যা পরিমাপের যোগ্য নয়। যাতে তারা গভীরভাবে বুঝতে পারে, যে গ্রহে আমরা জীবন কাটাচ্ছি তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং এই গ্রহে যে জীবনের আবির্ভাব হয়েছে তা একটি সাময়িক ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই সাথে আমি ঐ ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতাবোধের পাশাপাশি আরেক গুচ্ছ তথ্য তুলে ধরতাম, তরুণদের মনকে প্রভাবিত করতে যে মানুষ কত মহৎ হতে পারে, তার জ্ঞান কত অসীম হতে পারে। সমগ্র মহাবিশ্বে এমন কিছু নেই যা তার সমান মূল্য বহন করে। স্পিনোজা বহুকাল আগে মানুষের বন্ধন এবং মানুষের মুক্তির কথা বলে গেছেন। তার লেখার ধরণ এবং ভাষা এত কঠিন দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র ছাড়া অন্যদের পক্ষে সহজবোধ্য নয়। কিন্তু আমি যা বলতে চাই তার সারমর্ম, তিনি যা বলে গেছেন তার সাথে প্রায় অভিন্ন।

মানুষ একবার যদি বুঝতে পারে যত অস্থায়ী বা সংক্ষিপ্ত ভাবেই হোক, কিসে আত্মা মহান হয়, তা হলে সে আর নিজেকে ক্ষুদ্র এবং স্বার্থপর হতে দেবে না। তুচ্ছ দুর্ভাগ্যে বিচলিত বা ভবিষ্যতের ভাবনায় ভীত হতে দেবে না, যদি দেয় তাহলে কখনো সে আর সুখী হতে পারবে না। যে মানুষ আত্মার মহত্বে সক্ষম সে মনের বাতায়ন সম্পূর্ণ খুলে দেবে, যাতে সেই পথ বেয়ে বিশ্বের সর্ব অংশ হতে মুক্ত সমীর প্রবাহিত হতে পারে। সে তখন নিজেকে এবং জীবনকে এবং জগৎকে মানুষের সীমার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সত্যরূপে দেখতে পাবে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং অণু প্রমাণ, এ কথা বুঝতে পেরে সে অনুভব করতে পারবে, পরিচিত এই বিশ্ব, মূল্যবান যা কিছুই ধারণ করুক তা প্রতিটি মানুষের মনে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এবং সে দেখবে যে মানুষের মনের দর্পণে বিশ্ব প্রতিবিম্বিত, সে এক অর্থে বিশ্বের মতোই বৃহৎ। যে মানুষ অবস্থার দাস তার মনকে যেসব ভয় তাড়িত করে তা থেকে বেরিয়ে এসে সে এক গভীর আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করবে এবং তার বাইরের জীবনের সকল ভাগ্য পরিবর্তনের মধ্যেও সুখী মানুষ বলে আনন্দের গভীরে ডুবে থাকবে।

এইসব বড় বড় দূর কল্পনা ছেড়ে আমরা যে অব্যবহিত প্রসঙ্গে কথা উত্থাপন করেছিলাম, সেখানে ফিরে যেতে পারি যেমন নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণের কথায়। অন্য একটা দিক থেকে এইসব আকর্ষণ সুখের পথে সাহায্য করতে পারে। খুব সৌভাগ্যের জীবনেও অনেক সময় দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। খুব কম মানুষ আছে, অবিবাহিতরা ছাড়া যে নিজের স্ত্রীর সাথে কখনো ঝগড়া করেনি, খুব কম বাবা-মা আছে যারা নিজেদের সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়নি, খুব কম ব্যবসায়ী আছে যারা আর্থিক সংকট এড়াবার চেষ্টা করেনি, খুব কম পেশাদার ব্যক্তি আছে যারা কখনো ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়নি। এইরকম সময়ে উদ্বেগের বাইরে অন্য কিছুতে উৎসাহী হওয়া বিরাট মঙ্গল। এই সময়ে উদ্বেগ সত্ত্বেও যখন করার মতো কিছু থাকে না, তখন কেউ দাবা খেলে, কেউ গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে, কেউ জনপ্রিয় জ্যোতির্বিদ্যায় ডুবে থাকে। অন্য একজন হয়তো ক্যালডি’র উর নামক স্থানের পুরাতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে বই পড়ে সান্ত্বনা পায়। এই চারজনের প্রত্যেকেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। বরং যে লোকটি মনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কিছুই করেনি এবং তার কষ্টকে তার ওপর প্রভুত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেনি। এবং প্রয়োজনে নিজেকে যখন সময় আসবে, বিপদের মুখোমুখি হওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত করে তুলেছে। অত্যন্ত প্রিয়জনের মৃত্যুতে সান্ত্বনার বাইরে যে বেদনা তার সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে যে নিজেকে দুঃখের হাতে তুলে দেয় তার ভাল কিছু হয় না। দুঃখ অনিবার্য এবং তা আসবেই, তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা উচিত, তা কমানোর যত রকম পথ আছে অবলম্বন করা উচিত, কোনও কোনও লোক যেমন করে, বলা যায়, দুর্ভাগ্য থেকে দুর্দশার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে বের করে নিতে চায় তাকে শুধুমাত্র ভাবপ্রবলতা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আমি একথা অস্বীকার করি না যে কোনও মানুষ দুঃখে ভেঙ্গে পড়তে পারে, কিন্তু তবুও আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে এই ভাগ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে প্রত্যেকটি মানুষের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত এবং যে কোনও উপায়ে হোক, সে উপায় যত তুচ্ছ হোক, যদি তা নিজেই ক্ষতিকর অথবা মর্যাদাহানিকর না হয়। যে সব উপায় আমি ক্ষতিকর এবং মর্যাদাহানিকর মনে করি, তার মধ্যে আমি মাতলামি এবং মাদকাসক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করি। এদের উদ্দেশ্যই হল চিন্তার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া এর প্রতিকার নয়, প্রতিকার হচ্ছে নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত করা অন্তত যে কোনও মূল্যে বর্তমান দুর্ভাগ্যের কাছ থেকে দূরের কোনও খাতে প্রবাহিত করা। কিন্তু জীবন যদি সামান্য কটা জিনিসে সব আকর্ষণকে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং সেই সামান্য কটাও যদি দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব শক্ত। দুর্ভাগ্য এলে যদি তাকে বহন করতেই হয় তাহলে সুখের সময়ে আগেই আকর্ষণের বিষয়বৈচিত্র এবং সংখ্যার প্রসারণ করে নেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তাহলে যে মনের ভাব বর্তমানকে বহন করতে পারছে না, তার চেয়ে ভিন্ন মনোভাব এবং আলাদা আকর্ষণ যেখানে আছে সেই শান্তিপূর্ণ স্থানে যাওয়ার জন্যে মন প্রস্তুত থাকবে।

প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য এবং উদ্দীপনা যে মানুষের আছে, সে প্রতি আঘাতের পর নতুন আকর্ষণের দ্বারা সব দুর্ভাগ্যকে লঙ্ঘন করে যাবে। তার কাছে পৃথিবী এত ছোট হয়ে যাবে না যাতে একটি মাত্র ক্ষতি ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। এক বা একের অধিক ক্ষতির কাছে হার মানা এমন ঘটনা নয় যা কোমলতার প্রমাণরূপে প্রশংসিত হতে পারে। বরং একে প্রাণপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা বলেই ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। আমাদের স্নেহ-মমতা-প্রেম মৃত্যুর দয়ার ওপর নির্ভরশীল আমাদের প্রিয়জনদের ওপর যে কোনও সময় চরম আঘাত হানতে পারে। তাই আমাদের জীবনে সেই সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়, যা আমাদের জীবনের সকল অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে দুর্ঘটনার অধীন করে রাখতে পারে।

এইসব কারণে যে মানুষ বুদ্ধিমত্তার সাথে সুখের অন্বেষণ করছে তার পক্ষে যেসব মূল আকর্ষণের ওপর তার জীবন গড়ে উঠেছে, তার বাইরেও আরো কিছু অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকা প্রয়োজন।

—-
১. স্পিনোজা, Benedict de Spinoza (১৬৩২-১৬৭৭)। জাতিতে ইহুদী, তার বাবা-মা ইনকুইজিসনের ভয়ে পর্তুগাল থেকে অভিবাসন নিয়ে নেদারল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন। যুক্তিবাদী মুক্ত দার্শনিক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ। তিনি সর্বেশ্বরবাদী অদ্বৈতবাদে (pantheistic Monist) বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এবং পৃথিবীর মধ্যে কোনও দ্বৈতবাদ থাকতে পারে না। পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদের নতুন তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। ‘Ethie’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

 ১৬. প্রচেষ্টা ও সমর্পণ

সুবৰ্ণ মধ্যম মতবাদ হিসাবে চিত্তাকর্ষক নয়, আমি মনে করতে পারি, যখন আমি তরুণ ছিলাম ঘৃণা এবং অবজ্ঞার সাথে এই মত বর্জন করেছিলাম, কারণ সেসব দিনে বীরোচিত চরম কিছুই ছিল আমার কাছে বরণযোগ্য। যা হোক সত্য সবসময় উৎসাহব্যঞ্জক হয় না এবং যে সব জিনিসকে বিশ্বাস করা হয় উৎসাহব্যঞ্জক বলে, বাস্তবে তাদের অনুকূলে তেমন কিছু প্রমাণ মেলে না। সুবর্ণ মধ্যম যে অনুৎসাহব্যঞ্জক মতবাদ এটা হয়তো একটি উদাহরণ, কিন্তু অনেক বড় ব্যাপারে এটা সত্য নীতি।

একদিকে প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সমর্পণ– এই দুইয়ের ভারসাম্য রাখতে সুবর্ণ মধ্যমকে প্রয়োজনীয় বলে গ্রহণ করতে হবে। এই দুটি নীতিরই চরম সমর্থকরা রয়েছেন। সমর্পণ বা ভাগ্যকে বরণ করার নীতি প্রচার করেছেন সাধুপুরুষ ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা। আর প্রচেষ্টা বা উদ্যমশীলতার নীতি প্রচার করেছেন দক্ষ কুশলী এবং পৌরুষদীপ্ত খ্রিস্টানেরা। এই দুই বিপরীত মতের প্রবক্তাদের নীতিতে খণ্ডিত সত্য আছে, পুরো সত্য নেই। আমি এই অধ্যায়ে একটা ভারসাম্য আনয়নের চেষ্টা করব এবং প্রচেষ্টার পক্ষকে সমর্থন করে শুরুটা করব।

সুখ, কয়েকটি দুর্লভ ক্ষেত্র ছাড়া, এমন জিনিস নয় যা শুধুমাত্র শুভ ঘটনার যোগাযোগ ছাড়া পাকা ফলের মতো মুখে এসে পড়বে। আর এই কারণেই আমি এই বইয়ের নাম রেখেছি সুখের সন্ধানে’। কারণ পরিহারযোগ্য এবং অপরিহানীয় দুর্ভাগ্যে, রোগ এবং মানসিক জটিলতায়, সংগ্রাম এবং দারিদ্র্যে এবং বিদ্বেষে ভরা, এই পৃথিবীতে যে পুরুষ ও নারী সুখী হতে চায়, তাকে প্রত্যেক মানুষ যে অসংখ্য রকম পথে সুখ খুঁজে বেড়ায় তার জন্যে সংগ্রাম করে যেতে হবে। খুব কমক্ষেত্রেই এর জন্যে বড় রকমের উদ্যোগ প্রয়োজন হতে পারে। সহজ স্বভাবের লোক, যে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ অর্জন করেছে, যার স্বাস্থ্য ভাল, রুচি উন্নত, সে জীবনকে খুব আরামের সাথে উপভোগ করতে পারে এবং চারপাশের জীবনসংগ্রামের গোলমা দেখে অবাক হয়ে তার কারণ খুঁজে বেড়ায়। সুন্দরী আরামপ্রিয় রমণী যদি এমন কোন ধনবান পতিকে বরণ করে, যে তার কাছে কোনও আয়াসসাধ্য কাজ চাইবে না এবং বিয়ের পর যদি চর্বি বৃদ্ধিতে কোনও আপত্তি না করে, তাহলে সেও এক ধরনের অলস আরাম উপভোগ করবে, যদি অবশ্য তার সন্তানের বিষয়ে সৌভাগ্য থাকে। অধিকাংশ লোক ধনী নয়, অনেক ভাল স্বভাব নিয়ে জন্মায় না, অনেকের অস্বস্তিজনক সব প্রবৃত্তি থাকে, তার কাছে শান্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত জীবন অসহনীয় রকমের একঘেয়ে মনে হয়। স্বাস্থ্য হচ্ছে আশীর্বাদ কিন্তু তা রক্ষা করা যাবেই এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। বিয়ে অবধারিতভাবে পরম সুখের উৎস নয়। এইসব কারণে অধিকাংশ নারী-পুরুষের জন্যে সুখ অবশ্যই একটি সফল অর্জন। দেবতার দান নয় এবং এই অর্জনে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী উভয়েরই প্রচেষ্টা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্মুখী প্রচেষ্টার মধ্যে সমর্পণের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তাই আপাতত আমরা বহির্মুখী প্রচেষ্টার কথা বিবেচনা করেছি।

যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রে, পুরুষ অথবা নারী, যাদের জীবিকার জন্যে কাজ করতে হয় তাদের এ সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন এমনই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে তার ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা সত্য যে ভারতীয় ভিক্ষুকরা বিনা প্রচেষ্টায় ধর্মভীরু মানুষের সামনে শুধু ভিক্ষাপাত্রটি এগিয়ে দিয়েই জীবিকার সংস্থান করতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশসমূহে শাসক-কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উপার্জনকে ভাল দৃষ্টিতে দেখে না। তা ছাড়া এই কাজটিকে উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুর দেশে যেমন আরাম দেয়, সেসব দেশে তা নয়। শীতকালে, যে কোনওভাবে খুব কম লোক পাওয়া যাবে যারা গরম ঘরের কাজ ফেলে বাইরে অলসভাবে ঘুরে বেড়াবে। সুতরাং পশ্চিমী দেশে শুধু সমর্পণ সৌভাগ্যের অনেক পথের মধ্যে একটি নয়।

পাশ্চাত্যের দেশসমূহে অনেক মানুষের সুখের জন্যে যা প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু অতিরিক্ত অর্থের চাহিদা থাকে। কারণ তা তাদের কাছে সাফল্যের অনুভূতি তৈরী করে। কোনও কোনও পেশায় যেমন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই অনুভূতি বেশি উপার্জনশীল নয় এমন লোকের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ পেশায় উপার্জনের পরিমাণকে সাফল্যের মানদণ্ডরূপে ধরা হয়। এইখানে আমরা এমন একটি প্রসঙ্গকে স্পর্শ করেছি যার সম্পর্কে প্রায় ক্ষেত্রেই কিছু সমর্পণের উপাদান বাঞ্ছনীয়। কারণ এই প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে বড় ধরনের সাফল্য শুধু অল্পসংখ্যক লোকের পক্ষেই মাত্র সম্ভব।

বিবাহ এমন একটা বিষয় যার সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতেও পারে অথবা নাও হতে পারে। যেখানে একটি লিঙ্গ যদি সংখ্যালঘু হয়, যেমন ইংল্যান্ডে পুরুষ এবং অষ্ট্রেলিয়ায় নারী, তা হলে সেই সংখ্যালঘুদের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই কম প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। আর যে লিঙ্গের সদস্যরা সংখ্যাগুরু তাদের বেলায় বিপরীতটাই সত্যি। মেয়েরা সংখ্যাগুরু হলে তারা যে পরিমাণ প্রচেষ্টা ও চিন্তা এই বিষয়ে ব্যয় করে, তা নারী বিষয়ক সাময়িকীতে যেসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় তা চর্চা করলেই সহজে বোঝা যাবে। যেখানে পুরুষরা সংখ্যাগুরু সেখানে তারা প্রায়ই খুব তাড়াতাড়ি কাজ হয় এমন পথ খুঁজে নেয় যেমন রিভলবার চালনায় দক্ষতা। এটা খুব স্বাভাবিক, কারণ সংখ্যাগুরু পুরুষরা এখন সভ্যতার প্রান্তসীমায় রয়ে গেছে। যদি কোনও মহামারী পক্ষপাতিত্ব করে ইংল্যান্ডের পুরুষদের সংখ্যাগুরুতে পরিণত করে, তাহলে তারা কী করবে জানি না, হয়তো তারা প্রাচীন প্রেমিক বীরদের পথ অবলম্বন করবে।

সন্তানদের যথার্থভাবে মানুষ করে তুলতে যে পরিমাণ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় তা এমনই সুস্পষ্ট যে কেউ তা অস্বীকার করবে না। যেসব দেশ সমর্পণে বিশ্বাসী এবং যাকে ভুল করে জীবনের প্রতি আধ্যাত্মিক দর্শন বলা হয়ে থাকে, যেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার খুব বেশি, ওষুধ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, নির্বীজকরণ, উপযুক্ত পথ্য এইসব জিনিস পার্থিব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পাওয়া যায় না। এসব লাভ করতে হলে প্রয়োজন বস্তুগত পরিবেশের দিকে শক্তি ও বুদ্ধিচালনা। যারা মনে করে বস্তুমাত্রই মায়া, তারা আবর্জনাকেও তাই মনে করে এবং এভাবে চিন্তা করতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর কারণ ঘটায়।

আরো সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যাদের স্বাভাবিক বাসনা পুষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায়নি, তাদের প্রত্যেকের স্বাভাবিক এবং ন্যায্য উদ্দেশ্যের মূলে রয়েছে কোনও শক্তি। মানুষ কোন শক্তিটি কামনা করবে তা নির্ভর করে তার সবচেয়ে প্রাধান্যকারী আসক্তির ওপর। কোনও মানুষ শক্তি কামনা করে অন্য মানুষের কাজের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে। আরেকজন কামনা করে অন্যের চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে, তৃতীয়জনের কামনা অন্যের আবেগের ওপর। একজন চাইছে বস্তুগত পরিবেশকে পরিবর্তন করতে, অন্যজনের কামনা বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ। জনকল্যাণকর প্রতিটি কাজের সাথে কোনও একটি মুক্তির কামনা বিজড়িত, যদি না এই উদ্দেশ্য সামলে রেখে দুর্নীতির সাহায্যে অর্থলাভ করা একমাত্র লক্ষ্য না হয়, তা হলে এই কথা সত্যি যে লোকটি মানুষের দুর্দশার অকৃত্রিম মানবতাবোধ জাত বেদনা থেকে কর্ম প্রেরণা লাভ করছে, তার দুঃখবোধ যদি বিশুদ্ধ হয়, তা হলে সে মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্যে ক্ষমতা কামনা করবে। একমাত্র যে মানুষ ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন সে তার সহমানুষ সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ উদাসীন। সুতরাং যেসব মানুষের সহযোগিতায় উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে, তাদের কর্মপদ্ধতির ভিতর কোনও কোনও ধরনের ক্ষমতার জন্যে কামনা থাকবেই এবং এটাকে স্বীকার করে নিতে হবে। ক্ষমতা কামনার প্রত্যেকটি ধরণ যেখানে জড়িত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ব্যর্থ হয়, তা হবে পারস্পরিক সমন্বয়ের একটি প্রচেষ্টা। পাশ্চাত্য দেশের মানসিকতায় এই উপসংহার খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্যে এমন লোকেরও অভাব নেই যারা ভান করছে, যাকে বলা হয় প্রাচ্যবিজ্ঞতা’ তা পাওয়ার জন্যে যে মুহূর্তে প্রাচ্যই তা পরিত্যাগ করেছে। সম্ভবত তাদের কাছে আমরা যা বলছি তা সন্দেহমুক্ত নয় এবং তাই যদি হয় তা হলে আমাদের বলাটা যথার্থ।

সুখের অধিকার অর্জনে সমর্পণেরও একটা ভূমিকা আছে। প্রচেষ্টার ভূমিকার চেয়ে তার গুরুত্ব কম নয়। বুদ্ধিমান লোক পরিহারক দুর্ভাগ্যের সামনে বসে না থাকলেও অবধারিত দুর্ভাগ্য এড়াতে সময় এবং আবেগ নষ্ট করবে না এবং যেসব দুর্ভাগ্য নিজে থেকেই পরিহারযোগ্য, তা পরিহার করতে যদি আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে নির্ধারিত সময় নষ্ট হয়, তা হলে তা পরিহার না করে বরং তা সহ্য করে যাবে। এমন অনেক লোক আছে যারা পছন্দ না হলে প্রত্যেকটি তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঝামেলা করে এবং যে শক্তি প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো যেত তা এইভাবে নষ্ট করে। এমনকী কাজ অত্যন্ত ব্যর্থতার চিন্তা সবসময় মনের শান্তিকে বিনষ্ট করতে থাকে। খ্রিস্টান ধর্ম ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে অর্পণ করার কথা বলেছে। এমনকী যারা এই বাগ-বৈশিষ্ট্য মেনে নিতে পারে না তাদের জন্যেও তাদের সবরকম কাজকে ব্যাপ্ত করে ঐরকম কিছু থাকা উচিত। কোনও ব্যবহারিক কাজে যে কর্মদক্ষতা প্রয়োজন তার অনুপাত, যে পরিমাণ আবেগ তাতে দেওয়া হয় তার সমান নয়। প্রকৃতপক্ষে আবেগ অনেক সময় কর্ম দক্ষতার প্রতিবন্ধক। যে মনোভাব দরকার তা হল নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করব কিন্তু ফল ছেড়ে দেব ভাগ্যের হাতে। সমর্পণ বা ভাগ্য বরণ দুরকমের একটির মূলে হতাশা, অন্যটির মূলে অদম্য আশা। প্রথমটি খারাপ, দ্বিতীয়টি ভাল। চরমভাবে পরাজিত হয়ে যে লোক বড় কিছু লাভ করার আশা পরিত্যাগ করেছে সে হতাশাজনিত সমর্পণ শিখতে পারে এবং যদি সে তা করে তাহলে সে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে দেবে। যে তার হতাশাকে ধর্মীয় নীতিকথায় ঢেকে রাখতে পারে অথবা তার হতাশাকে, তত্ত্বভাবনাই মানুষের যথার্থ লক্ষ্য–এই নীতির ছদ্মবেশে আড়াল করতে পারে। কিন্তু সে তার অন্তর্হিত পরাজয়কে যেভাবেই আড়াল করুক সে সাধারণভাবে অনুপযুক্ত এবং নীতিগতভাবে অসুখী হয়ে থাকবে। যে মানুষের সমর্পণ অদম্য আশার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার কর্মধারা আলাদা। যে আশা অপরাজেয় তাকে বৃহৎ এবং নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। আমার ব্যক্তিগত কার্যসূচি যাই হোক, আমি মৃত্যুর হাতে পরাজিত হতে পারি অথবা কোনও রোগের কাছে। আমার শত্রুরা আমাকে পরাস্ত করতে পারে। কাজ করতে গিয়ে হয়তো দেখা গেল এমন একটা অজ্ঞানতার পথে আমি এগিয়েছি যাতে সফল হতে পারব না। এইভাবে হাজার রকম উপায়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত আশার ব্যর্থতা অবধারিত হতে পারে কিন্তু যদি ব্যক্তিগত আশা, মানবজাতির কোনও বড় আশার অংশ হয়, তা হলে ব্যর্থ হলেও তাতে সম্পূর্ণ পরাজয়ের ভাব থাকবে না। যে বৈজ্ঞানিক নিজে কোনও বড় আবিষ্কারের কামনা করেন এবং বিষয়টির ওপর তার ব্যক্তিগত অবদান বড় না হয়, তা হলে নির্ভেজাল অহংভাবপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে যিনি গবেষণা করেন, তার নৈরাশ্যের তুলনায়, সম্পূর্ণ অন্যরকম হবে। বহু প্রয়োজনীয় কোনও সংস্কার সাধনের কাজ শেষ হল না এবং তিনি হয়তো এই কথাটি মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে, তার জীবদ্দশায় আর একাজ তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু যদি তার নিজের অংশগ্রহণ ছাড়াও মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আগ্রহ থাকে তাহলে তাঁর অসম্পূর্ণতার জন্যে পুরোপুরি নৈরাশ্যে ডুবে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

যেসব বিষয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছি তাতে সমর্পণ অত্যন্ত কঠিন। অন্য অনেক বিষয় আছে যাতে তা সহজ। এই বিষয়গুলি হচ্ছে যেখানে শুধু গৌণ উদ্দেশ্যগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু জীবনের প্রধান লক্ষ্যসমূহের সাফল্যের সম্ভাবনা বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনও লোক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও দাম্পত্য জীবনে অসুখী হওয়ার জন্যে মন বিক্ষিপ্ত থাকে, তা হলে তার পক্ষে বাঞ্ছিত সমর্পণ মেনে নিতে ব্যর্থতা দেখা দেবে। যদি তার কাজ সত্যি মন ভরে রাখার মতো হয়, তাহলে তার উচিত এই ধরনের সব আপতিক বাধাকে বৃষ্টির দিনের মতোই বিরক্তিকর মনে করা, কারণ এইরকম বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া বোকামি।

কোনও কোনও লোক ধৈর্যের সাথে সেইসব অসুবিধা সহ্য করতে পারে না, যা বাধা না পেলে আমাদের জীবনের একটা বড় অংশকে দখল করে রাখে। এরকম লোক গাড়ি ধরতে না পারলে ক্ষেপে যায় নৈশাহারের রান্না খারাপ হলে প্রচণ্ড রেগে যায়, চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হলে হতাশায় ডুবে যায়, পোশাক পরিচ্ছদ সময়মত স্টীমলড্রি থেকে ফিরে না আসলে সমস্ত শিল্প জগতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করে বসে। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে যে শক্তি নষ্ট হয়, তা যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগাতে পারলে একটা সাম্রাজ্য গড়া এবং ভাঙ্গার জন্যে যথেষ্ট। গৃহ পরিচারিকা যে ধুলা পরিষ্কার করেনি, রন্ধনকারী যে আলু সিদ্ধ করেনি, ঝাড়ুদার যে ঠিকমত ঝুল ঝাড়েনি বুদ্ধিমান লোক তা দেখেও দেখেন না। আমি বলতে চাই না যে তিনি এর প্রতিবিধান করেন না, সময় পেলে অবশ্যই করেন। আমি বলতে চাই যে, তিনি এসব আবেগ বর্জন করে করেন। উদ্বেগ, বিরক্তি ও উত্তেজনা এসব হল আবেগ যা কোনও উদ্দেশ্যই সিদ্ধ করে না। এসব যিনি প্রবলভাবে অনুভব করেন, তিনি হয়তো বলবেন, এসব আবেগ দমন করতে তিনি অপারগ এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, পূর্বে উল্লেখিত মৌলিক সমর্পণের চেয়ে অন্যকোনও কম প্রয়োজনীয় কিছুতে তাকে দমন করা যেতে না পারে। বড় নৈর্ব্যক্তিক আশা যা মানুষকে তার কাজে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা অথবা দাম্পত্য জীবনের দুঃখকে সহ্য করতে সক্ষম করে, তার সম্বন্ধে সেই একই প্রকার মনোযোগ তাকে গাড়ি ধরতে না পারার বা কাদায় ছাতা পড়ে যাওয়ার দুঃখেও ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেবে। তিনি যদি বদমেজাজি হন, তা হলে এর চেয়ে কম কিছুতে তার রোগ সারবে কিনা বলা কঠিন।

যে মানুষ সারাক্ষণ উত্তেজিত থাকেন, তাকে যদি উদ্বেগের সাম্রাজ্য থেকে উদ্ধার করা যায়, তাহলে তিনি জীবনকে অনেক বেশি আনন্দময় বলে নতুন করে খুঁজে পাবেন। পরিচিত বক্তিদের নিজস্ব যেসব আচরণ-বৈশিষ্ট্য এতকাল তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলত, এখন তার কাছে তা কৌতুকপ্রদ মনে হয়। যখন মিস্টার এ, তার টিয়েরা ডেল ফিউয়েগোর বিশপের পুরানো সত্য কাহিনীটি তিনশ সাতান্ন বার বিবৃত করা শেষ করবেন, তখন আর রেগে না গিয়ে শুধু কবার বলা হল তার সংখ্যা গুনে মজা পাবেন এবং পূর্বের মতো নিজের জানা কোনও কাহিনী বলার চেষ্টা করে বিষয় পরিবর্তনের বৃথা চেষ্টা করবেন না। যখন ভোরের গাড়ি ধরার তাড়ার সময় তার জুতোর ফিতে ছিঁড়ে যায়, তখন তা ঠিক করে নিয়ে তিনি ভাববেন এই বিপুলা পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনার বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই। যখন তিনি বিয়ের প্রস্তাবকালীন বিরক্তিকর কোন প্রতিবেশির আগমনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি ভাবেন মানুষমাত্রই এই ধরনের বিপত্তির সীমা নেই, যা আসে অদ্ভুত এবং বিচিত্র সাদৃশ্য এবং সমান্তরাল ঘটনা থেকে। আমার ধারণা প্রত্যেক নরনারীর মনে নিজের সম্পর্কে একটা ছবি তৈরী হয়ে আছে এবং যদি কোনও ঘটনা সেইসব নষ্ট করে তারা বিরক্ত হয়। এই বিরক্তি থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে শুধু একটি ছবি নয়, একটি পুরো চিত্রশালা তৈরী করে রাখা যাতে প্রয়োজনে যে ঘটনা উল্লেখ করা হল, তার উপযুক্ত একটিকে নির্বাচন করা যায়। যদি কোনও ছবি হাস্যকর মনে হয়, তবে আরো ভাল। নিজেকে সবসময় বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো দেখা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়, নিজেকে সর্বক্ষণ কৌতুক নাটকের বিদূষক রূপে দেখার কথাও আমি বলছি না, কারণ যারা এমন করে তারা আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। অবস্থানুযায়ী উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে সামান্য কৌশল প্রয়োজন। অবশ্য যদি নিজেকে বিস্মৃত হয়ে আদৌ কোনও ভূমিকা গ্রহণ না করা হয় সেটা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু কোনও ভূমিকায় অভিনয় করা যদি দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে মনে করতে হবে স্থায়ী অভিনয়কারী কোনও নাট্যদলের অভিনেতারূপে এবং তাতেই একঘেয়েমিকে এড়ানো যাবে।

অনেক সক্রিয় লোকের মত হল, তাঁরা যে কর্মশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্পের সাহায্যে সফল হন বলে মনে করেন, সেখানে তা বিন্দুমাত্র সমর্পণ এবং হাস্যরসের সামান্য ঝলকও তা নষ্ট করে দিতে পারে, এটা তাদের বিশ্বাস। এসব লোকেরা আমার মতে ভ্রান্ত। কাজের মূল্য আছে এমন কাজ তাঁরাও করতে পারেন, যারা কাজের গুরুত্ব অথবা সহজ-সাধ্যতার ধারণা নিয়ে আত্মপ্রতারণা করেন না। যারা শুধু আত্মপ্রতারণার সমর্থন পেলেই কাজ করতে পারেন, তাদের উচিত পেশাগত কাজ শুরু করার আগে সত্যকে সহ্য করার শিক্ষা আয়ত্ত করা। কারণ এখন না হয় পরে কোনও সময়, এই যে অবাস্তব ধারণার কারণে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা, তা তাদের কাজকে হিতকর না করে ক্ষতিকর করবে। ক্ষতি করার তুলনায় কিছু না করা ভাল। পৃথিবীর অর্ধেক প্রয়োজনীয় কাজ শুধু ক্ষতিকর কাজের সাথে যুদ্ধ করতেই নষ্ট হয়। বাস্তবের মূল্য বুঝতে কিছু সময় নষ্ট হলে প্রকৃতপক্ষে তা নষ্ট হয় এবং এরপর যে কাজ করা হবে তা যাদের কাজে বিরামহীন অহমিকার প্রেরণার প্রয়োজন হয় তার চেয়ে কম ক্ষতিকর। নিজের সম্পর্কে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছার সাথে এক ধরণের সমর্পণ বা ভাগ্যবরণ জড়িয়ে আছে। এই ধরনের যদিও প্রথমদিকে কিছু বেদনা থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং সম্ভাব্য একমাত্র রক্ষাকবচ। যা আত্মপ্রতারকদের নৈরাশ্য এবং মোহমুক্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। যা প্রতিদিন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তাকে বিশ্বাস করার মতো ক্লান্তিকর এবং শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তার মতো চরম বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না। এইরকম প্রচেষ্টা থেকে মুক্ত হওয়াই হল নিরাপদ এবং স্থায়ী সুখের অপরিহার্য শর্ত।

১৭. সুখী মানুষ

একথায় কোনও দ্বিধা নেই যে, সুখের কিছু অংশ বাইরের ঘটনাবলী এবং কিছু অংশ নিজের ওপর নির্ভরশীল। এই বইতে আমি যে অংশ আমাদের নিজের ওপর নির্ভরশীল তা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং তার ফলে, এই মতে উপনীত হয়েছি যে, এই অংশ সম্পর্কিত যে সমস্যা তার সমাধানের ব্যবস্থাপত্র অত্যন্ত সহজ। অনেকে মনে করেন, যার মধ্যে আমরা অবশ্যই মিস্টার ক্রাচকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, যার কথা আমরা পূর্বের কোনও অধ্যায়ে তুলে ধরেছি, কোনও না কোনও ধর্মবিশ্বাস ছাড়া সুখ অসম্ভব। অনেকে মনে করেন, যারা নিজেরা অসুখী, তাদের দুঃখের কারণ খুব জটিল এবং উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিসূত্রজাত। আমি বিশ্বাস করি না এসব জিনিস সুখের অথবা দুঃখের কারণ হতে পারে। আমার মনে হয় সেসব শুধুই লক্ষ্মণ। যে ব্যক্তি অসুখী তিনি সাধারণত এমন এক ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী হবেন যা দুঃখের, পক্ষান্তরে যিনি সুখী তিনি সুখের কোনও ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবেন। প্রত্যেকেই তাদের সুখের এবং দুঃখের জন্যে দায়ী করেন তাঁদের বিশ্বাসকে। কিন্তু আসলে কার্যকারণ ঠিক এর বিপরীত। কিছু জিনিস অধিকাংশ লোকের সুখের জন্যে অপরিহার্য। কিন্তু এসব খুব সহজ জিনিস : খাদ্য এবং বাসস্থান, স্বাস্থ্য, ভালবাসা, সফল কাজ এবং নিজেদের সমাজের শ্রদ্ধা, কারো কারো কাছে সন্তানলাভও প্রয়োজন। যেখানে এসবের অভাব সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রমী ব্যক্তি সুখ পেতে পারেন। কিন্তু যেখানে এসবের ভোগ করা যাবে অথবা সুপরিচালিত প্রচেষ্টায় পাওয়া সম্ভব, সেখানেও যদি মানুষ অসুখী থাকে তবে বুঝতে হবে তিনি কোনও মনস্তাত্ত্বিক সমন্বয়হীনতায় ভুগছেন এবং তা যদি খুব গভীর হয় তাহলে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তা যদি সাধারণ হয়, তবে সঠিক পথ অনুসরণ করলে রোগী নিজেই তা সারাতে পারবেন। যদি বাইরের ঘটনাবলী নিশ্চিতভাবে দুর্ভাগ্যজনক না হয়, সেখানে সুখকে লাভ করা সম্ভব, যদি না তার প্রবৃত্তি এবং আকর্ষণ অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী হয়। সুতরাং শিক্ষা এবং পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকা উচিত আমাদের যাতে আমরা আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাকে এড়িয়ে যেতে পারি এবং সেই ভালবাসা এবং সেই আকর্ষণকে অর্জন করতে পারি যা আমাদের অবিরাম নিজের বিষয়ে ভাবনাকে দূরে রাখতে পারে। কোনও মানুষই কারাগারে থাকার সময় সুখী হয় না এবং সেসব প্রবৃত্তি যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই বন্দী করে রাখে, তা যে কোনও খারাপ কারাগারের সমতুল্য। এইসব প্রবৃত্তির মধ্যে কিছু কিছু খুবই সাধারণ। যেমন ভয়, ঈর্ষা, পাপের চেতনা, আত্মকরুণা এবং আত্মপ্রশংসা। এর সবগুলিতেই আমাদের কামনা নিজেকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত হয়, যার অর্থ বাইরের পৃথিবী নিয়ে যথার্থ কোনও আকর্ষণ থাকে না, থাকে শুধু দুশ্চিন্তা। যদি এটি আমাদের কোনও ক্ষতি করে অথবা আমাদের অহংবোধ অতৃপ্ত রাখে। ভয় হচ্ছে প্রধান কারণ যার জন্যে মানুষ সত্যকে স্বীকার করতে চায় না এবং কল্পলোকের মিথ্যার আরামদায়ক আবরণে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু যে কাঁটা এসে সেই আবরণ ছিঁড়ে দেয় এবং সেই ছেঁড়া জায়গা দিয়ে ঠাণ্ডা ঝাঁপটা গায়ে লাগে এবং যে মানুষ এ ধরনের আরামে অভ্যস্ত সে অনেক বেশি কষ্ট পায় তার তুলনায় যে মানুষ প্রথম থেকে নিজেকে এসব বিষয়ে সইয়ে নিয়েছে। তার ওপর যারা নিজেদের প্রতারণা করে, তারা মনে মনে জানে তারা। কি করছে এবং তারা সবসময় একটা আতঙ্কে থাকে। যদি কোনও বিরূপ ঘটনায় তারা অনভিপ্রেত সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

আত্মকেন্দ্রিক প্রবৃত্তির একটা বড় ক্রটি হচ্ছে, তা জীবনে কোনও বৈচিত্র্য ঘটায় না। যে মানুষ শুধু নিজেকেই ভালবাসে, সে কারো প্রতি আসক্তির দিক থেকে উচ্ছল হয় না এ কথা সত্যি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার একাগ্রতা একই জিনিসের ওপর অপরিবর্তনীয় থাকার জন্যে তাকে বাধ্য হয়ে অসহনীয় একঘেয়েমিজনিত ক্লান্তিতে ভুগতে হয়। যে মানুষ পাপ-চেতনায় পীড়িত হয়, মনে করতে হবে সে একধরনের আত্মপ্রেমে ভুগছে। এই বিশাল পৃথিবীতে তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যবোধ হচ্ছে নিজেকে পাপহীন রাখা। প্রচলিত কয়েকটি ধর্মমতের একটি বড় ত্রুটি হচ্ছে তারা এই বিশেষ ধরনের আত্মমগ্নতায় উৎসাহিত করে।

সেই মানুষ সুখী, যে বস্তুগতভাবে বাঁচেন যার স্নেহ ভালবাসা অবারিত, আকর্ষণ ও উৎসাহ বিস্মৃত, যে এর ভিতর দিয়ে এবং বিপরীতভাবে নিজেও বহু লোকের স্নেহ-ভালবাসা এবং আকর্ষণ-উৎসাহের পাত্র হয়ে ওঠে, তার ভিতর দিয়েও সুখের সন্ধান করে। ভালবাসার পাত্র হওয়া সুখের একটি প্রবল কারণ। কিন্তু যে মানুষ ভালবাসা দাবি করে তার ওপর তা বর্ষিত হয় না। সহজভাবে বলতে গেলে যে মানুষ ভালবাসা দেয় সেই ভালবাসা পায়। কিন্তু সুদে অর্থ ধার দেওয়ার হিসাবের সাথে ভালবাসা দেওয়ার তুলনা অর্থহীন। যে পায় সেও তাকে নিখাদ ভালবাসা বলে মনে করে না।

যে মানুষ আপন খাঁচায় বন্দী থাকার জন্যে অসুখী, সে তাহলে কী করবে? যতদিন সে নিজের দুঃখের কারণ নিয়ে চিন্তা করবে, ততদিন সে আত্মকেন্দ্রিক হয়েই থাকবে, সুতরাং সে এই আবর্ত-চক্র থেকে বাইরে আসতে পারবে না। যদি তাকে এর বাইরে আসতে হয়, তাহলে বাইরের আকর্ষণ যথার্থ হওয়া চাই, কৃত্রিম উপায়ে ওষুধের মতো কোনও আকর্ষণকে প্ররোচকরূপে প্রয়োগ করা চলবে না। যদি এই অসুবিধা বাস্তব হয় এবং তার সঠিক কারণ নির্ণয় করা যায়, তাহলে তার বিশেষ কিছু করার নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি তার কষ্ট কোনও সচেতন অথবা অচেতন পাপবোধ থেকে আসে, সে প্রথমে নিজের সচেতন মনকে এই বলে প্রবোধিত করবে যে তার নিজেকে পাপকারী বলে ভাবার কোনও কারণ নেই। এরপর, আমরা আগের অধ্যায়সমূহে যেভাবে পথের নির্দেশ দিয়েছি, সেইভাবে তার যৌক্তিক বিশ্বাসকে অচেতন মনে রোপিত করার দিকে এগিয়ে যাবো। এইসময় সে কম হোক বা বেশি মনকে প্রভাবিত করে এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। যদি সে পাপবোধ মন থেকে দূর করতে পারে, তা হলে সম্ভবত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মনে বস্তুগত যথার্থ আকর্ষণ জাগরিত হবে। যদি আত্মকরুণাই তার কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তার প্রতিকারও সে একইভাবে করতে পারে, কিন্তু প্রথমে তাকে ভেবে নিতে হবে তার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে অসাধারণ দুর্ভাগ্যের কিছুই নেই। যদি কষ্টটা ভয় থেকে জন্ম নেয়, তাহলে তার এমন কিছু অনুশীলন করা উচিত যাতে সাহস বৃদ্ধি পায়। স্মরণাতীত কাল থেকে যুদ্ধে সাহস দেখানো একটা বড় গুণ বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং বালক ও যুবকদের প্রশিক্ষণের একটি বড় অংশ এমন চরিত্র গঠনের চেষ্টা করে আসছে যা যুদ্ধে নির্ভীকতা প্রদর্শন করতে পারে। কিন্তু নৈতিক সাহস এবং বুদ্ধিমত্তার সাহস এই দুটি অনেক কম চর্চিত হয়েছে, কিন্তু এদেরও নিজস্ব কৌশল রয়েছে। আপনি প্রতিদিন অন্তত নিজের কাছে একটি করে বেদনাদায়ক সত্যকে স্বীকার করুন যা বয়স্কাউটদের প্রতিদিনের একটি করে ভাল কাজ করার মতোই প্রয়োজনীয়। এই কথাটি নিজেকে অনুভব করতে শেখান যে, সৎগুণে এবং বুদ্ধিমত্তায় আপনি আপনার সব বন্ধুদের চেয়ে অপরিসীম না হলেও, যদিও আপনি সত্যি তাঁদের চেয়ে উন্নত, তারপরও জীবন সুন্দর। কয়েক বছর ধরে এইভাবে অনুশীলন করতে পারলে আপনি শেষ পর্যন্ত দেখবেন সত্য কথা স্বীকারে আপনার আর কোনও কুণ্ঠা নেই এবং এই অবস্থায় আপনি একটি বিস্তীর্ণ ভীতির সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।

আত্মমগ্নতা দূর হলে বস্তুগত আকর্ষণ কীসে কীসে হবে তার ভার ছেড়ে দিতে হবে আপনার মনের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত কাজ এবং বাইরের সামগ্রিক অবস্থার ওপর। আগে থেকেই মনে করবেন না, “ডাকটিকিট সংগ্রহে মনোনিবেশ করলে সুখী হতে পারতাম।” এবং তারপর ডাকটিকিট সংগ্রহ করতে শুরু করলেন, কিন্তু এমনও হতে পারে যে, এ কাজটা আপনার কাছে মোটেই আনন্দদায়ক হল না। যাতে যথার্থভাবেই আপনার আকর্ষণ, একমাত্র তাই আপনার কোনও কাজে লাগতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আত্মমগ্নতা ছাড়ার সাথে সাথে যথার্থ বস্তুগত আকর্ষণ জন্ম নেবে।

সুখী জীবন উন্নত জীবনের এক অসাধারণ বিস্তৃতি। বৃত্তিজীবী নীতিবাদীরা আত্মবঞ্চনা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করেছেন এবং তা করতে গিয়ে ভুল জায়গায় গুরুত্ব দিয়েছেন। সচেতন আত্মবঞ্চনা মানুষকে আত্মমগ্ন হতে শেখায় এবং সে কী ত্যাগ করেছে সে বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন করে তোলে। যার ফলে সে প্রায়ই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না এবং প্রায় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। যা প্রয়োজন তা আত্মবঞ্চনা নয়। কিন্তু কোনও মানুষকে নিজের সদগুণের সাধনায় রত থেকে বাইরের আকর্ষণের দিকে নিয়ে চলা, যাতে প্রয়োজন সচেতন আত্মবঞ্চনা। আমি এই বইটি রচনা করেছি সুখবাদীর ভূমিকা নিয়ে; অর্থাৎ যে মানুষ সুখকেই মঙ্গল মনে করে, তার ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু সুখবাদীর দৃষ্টিতে যেসব পথের কথা বলা হয়, তা সাধারণভাবে স্থির মস্তিষ্ক নীতিবাদীর পথের অনুরূপ। নীতিবাদীরা অধিকাংশ সময়, সবক্ষেত্রে সত্য না হলেও, মনের অবস্থার ওপর। গুরুত্ব আরোপ না করে কাজের ওপর গুরুত্ব দেন। যে কাজ করে তার ওপর কাজের যে প্রতিক্রিয়া হয় তা সেই সময়ের তার মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই ভিন্ন ভিন্ন মানসিক অবস্থায় কাজের প্রতিক্রিয়া এক নয়। যদি আপনি কোনও শিশুকে ডুবে যেতে দেখেন এবং সাহায্যের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে তাকে উদ্ধার করেন তাহলে নৈতিকভাবে আপনাকে খারাপ ভাবা চলবে না। পক্ষান্তরে যদি আপনি ভাবেন : ‘অসহায়কে উদ্ধার করবে”, তাহলে আপনি আগে যা ছিলেন তার চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যাবেন। এই চরম উদাহরণের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, সে কথা অনেক সহজ-সরল এবং সাধারণ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জীবনের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গী আমি অনুমোদন করছি এবং প্রচলিত নীতিবাদীরা যা অনুমোদন করেন তার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে এবং সে পার্থক্য আরো সূক্ষ্ম। উদাহরণস্বরূপ, প্রথাগত নীতিবাদী বলবেন, ভালবাসায় স্বার্থহীন হওয়া উচিত। একদিক থেকে দেখলে কথাটা যথার্থ। বলা যায় একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত তাতে কোনও স্বার্থ থাকবে না। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে এমন প্রকৃতির হবে যাতে এর সাফল্যের সাথেই জড়িয়ে থাকে নিজের সুখ। যদি কোনও পুরুষ আন্তরিকভাবে কোনও নারীকে বিয়ে করতে চান তাঁর সুখ কামনা করে এবং সেই সাথে এটাও ইচ্ছা করেন যে সেই নারী খুশী হবেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। নিঃসন্দেহে আমরা যাদের ভালবাসি তাদের সুখী দেখতে চাই। কিন্তু তা আমাদের সুখের বিকল্প হতে পারে না। বাস্তব সত্য হচ্ছে, যে বিরোধাভাস অহং এবং অবশিষ্ট পৃথিবীর মধ্যে বিরাজমান, যা রূপায়িত আত্মত্যাগ নীতির মধ্যে, তা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে যখন আমরা নিজেদের বাইরে অন্য মানুষ এবং জিনিসের মধ্যে যথার্থ আকর্ষণ খুঁজে পাব। এইসব আকর্ষণের মধ্যেই মানুষ বুঝতে পারে জীবন প্রবাহের একটা অংশ, যা বিলিয়ার্ড বলের মতো কঠিন কোনও আলাদা জিনিস নয়। যে বল অন্য বলের সাথে সংঘর্ষ ছাড়া অন্য কোনও সম্পর্ক রাখতে পারে না। সব দুঃখ কোনও না কোনও বিছিন্নতা অথবা অবিচ্ছিন্নতার অভাবের ওপর নির্ভরশীল। চেতন এবং অচেতন মনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হলে নিজের সাথে সমাজের যে সংহতি তা নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাইরের আকর্ষণ এবং ভালবাসা এই দুটিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখা যায় না। সেই মানুষই সুখী মানুষ যে এই দুইটির ঐক্য সাধনে ব্যর্থ হয় না, যার ব্যক্তিত্ব নিজের বিরুদ্ধেও খণ্ডিত হয়নি, পৃথিবীর বিরুদ্ধেও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে নি। এই মানুষই নিজেকে বিশ্বের নাগরিক বলে অনুভব করেন এবং এই বিশ্বের সব দৃশ্য এবং আনন্দ মুক্তভাবে ভোগ করেন, সে মানুষ মৃত্যুর ভয়ে ভীত নন, কারণ তিনি কখনো পরবর্তী প্রজন্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন না। জীবন ধারার সাথে এই ধরনের অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তিকে যুক্ত করার মধ্যেই পরম সুখ পাওয়া যায়।

 ১৮. বাট্রান্ড রাসেল (ভূমিকা)

বার্ট্রান্ড রাসেল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সব চিন্তাবিদদের মধ্যে একজন। তার মধ্যে পাওয়া যায় বহুমুখী প্রতিভার এক সমন্বিত রূপ। তিনি ছিলেন একাধারে বৈজ্ঞানিক, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, সমাজতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষাবিদ। তাঁর সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং অনুপম লিখনশৈলীর জন্য মননশীল মানুষরা তাকে চিরকাল স্মরণ করবেন। বর্তমান পৃথিবীর তিনি একজন শ্রেষ্ঠ দর্শনিক।

ইংল্যান্ডের এক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৭২ সালে ১৮ মে বার্ট্রান্ড রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডের রাসেল পরিবার ছিল উদারনৈতিক রাজনীতির সাথে যুক্ত। রাসেলের পিতামহ লর্ড জন রাসেল দু’বার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থী। বার্ট্রান্ড রাসেলের পিতা ছিলেন ভাইকাউন্ট অ্যামরারলে রাসেল। তিনিও ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। মুক্ত চিন্তাবিদ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। পিতামহ এবং পিতার জীবনের গভীর প্রভাব পড়েছিল রাসেলের জীবনে।

আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই গভর্নের্স এবং শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে রাসেলের পড়াশোনা চলেছিল। তখনকার অভিজাত পরিবারে সেটাই ছিল রীতি। কৈশোরে গণিতশাস্ত্রের ওপর রাসেলের তীব্র আগ্রহ দেখে তার গৃহশিক্ষকরা মুগ্ধ হন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও প্রবল অধ্যয়নস্পৃহা কৈশোর থেকেই দেখা গিয়েছিল। রাসেলের পিতামহের ছিল বিশাল ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার। বালক রাসেলের সেখানে ছিল অবাধ বিচরণ। আঠারো বছর বয়সে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি স্নাতক হন। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসী ও ইতালিয়ান ভাষায় তিনি তখনই বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি ফ্রান্সের ব্রিটিশ দূতাবাস, প্যারিসে কিছুদিন কাজ করেন, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই লন্ডনে ফিরে আসেন। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি এলিস স্মিথকে বিয়ে করেন।

বিয়ের পর রাসেল পত্নীকে নিয়ে সানেবক্সে বসবাস করতে থাকেন। তখন তিনি বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন দর্শনশাস্ত্রে ও গণিতশাস্ত্রে। উত্তরকালে পৃথিবীর বিদগ্ধ সমাজ তাঁকে এই দুই বিষয়ে অসামান্য অবদানকারীরূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এই সময়ে আরও দুটি বিষয়ের প্রতি তিনি বিষেভাবে আকৃষ্ট হন নারী ও পুরুষের সমানাধিকার এবং সমাজতন্ত্রবাদ বিষয়ক আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো তাকে মুগ্ধ করেছিল। কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দর্শন রাসেলকে অনুপ্রাণিত করে। মানুষের জীবনের উৎকর্ষতার কারণ হল ধর্ম নয়– জ্ঞান এবং বিজ্ঞান। তখন থেকেই এটাই হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্বাস।

মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে রাসেল তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বেচ্ছায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পরিত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন যে সম্পদ তিনি নিজে অর্জন করেননি তা ভোগ করার কোনও অধিকার তার নেই। তিনি সেইসব সম্পত্তি দিয়ে দেন কয়েকটি মানবকল্যাণব্রতী সংস্থায়। এরপরে তিনি জীবন কাটান তাঁর লেখা এবং অধ্যাপনা থেকে লব্ধ উপার্জন থেকে। সেই তরুণ বয়স থেকেই তিনি যুদ্ধবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেন। সেই যুদ্ধে যদি তাঁর স্বদেশও যুক্ত থাকে তবুও তিনি মত বদলাননি। স্বদেশের অন্যায় অত্যাচারকে দেশপ্রেমের নামে কখনও তিনি সমর্থন করেননি।

চব্বিশ বছর বয়সে রাসেলের রাজনীতি সংক্রান্ত বই ‘A Study মত German Social Democracy’ প্রকাশিত হয়। তারপর প্রকাশিত হয় জ্যামিতি সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। এই সময় তাঁর লেনিনের দর্শনবিদ্যা সম্পর্কিত একটি বইও প্রকাশিত হয়। এই সময় তিনি একটি গবেষণাপত্রও রচনা করেন। তাঁর সেই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল গণিত ও ন্যায়শাস্ত্রের মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধরা। রাসেল গণিত বলতে বুঝতেন তার কঠোর নৈর্ব্যক্তিকতা এবং বস্তুময়তাকে। রাসেলের বয়স যখন আটত্রিশ বছর তখন তিনি হোয়াইট হেডের সহযোগিতায় তাঁর ‘Principia Mathematica’ নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের রচনা শেষ করেন। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এই বিপুলায়তন গ্রন্থ বিশ্বের গণিতের ইতিহাসে ক্লাসিকরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। এই গ্রন্থ রচনায় সাত বছর বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছিল রাসেলকে। এই গ্রন্থের জন্যেই বার্ট্রান্ড রাসের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

জীবনের প্রথম দিকে তিনি উদারনৈতিক রাজনীতির সমর্থক থাকলেও পরে হয়ে উঠেছিলেন সমাজবাদী। তিনি অজ্ঞেয়বাদী বা নিরীশ্বরবাদী তা নিয়েও বিতর্ক ছিল একসময়। তবে তিনি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না, সে কথা স্পষ্টভাষায় বলে গেছেন তার অনেক গ্রন্থে-প্রবন্ধে-নিবন্ধে।

১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাসেল ছিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে। তাঁর স্বদেশ ইংল্যান্ড তখন যুদ্ধে অংশগ্রহকারী দেশ। রাসেলের যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তির জন্য প্রচারকার্য তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল নিজের শ্রেণী থেকে। তবে তার সাথে ছিলেন বিখ্যাত ওয়েবদ দম্পর্তি, বার্নার্ড শ, স্ট্রিভেলিয়ান এবং হারবার্ট স্যামুয়েল প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীরা। আরো যে কজন মনীষী এইসময় যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের জন্যে বিশ্বখ্যাত (সেইসময় নিন্দিত) হয়ে রয়েছেন তাঁরা হলেন রোমা রোলা (১৮৬৬-১৯৬৫), অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৯৭৯-১৯৫৫) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)।

যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এবং শান্তিবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যে স্বদেশবাসীর কাছে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন রাসেল। তাকে কারাবাস এবং জরিমানা দুই দণ্ডই ভোগ করতে হয়েছিল। এমন কী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ট্রিনিটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করতেন তারাও রাসেলকে কর্মচ্যুত করেন। পরে অবশ্য তিনি আবার সেখানে আমন্ত্রিত হন। ১৯১৭ সালের শেষভাগে ব্রিকসটনের কারাগারে ছয় মাস কাটিয়েছিলেন তিনি। কারাগারে বসেই তিনি তিনটে গ্রন্থ রচনা করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনা হল রুশ বিপ্লব। রাসেল এই ঘটনাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। কারণ রুশ বিপ্লবের বাণী ছিল ‘Power to the Soviets, land to the Peasants, breads to the Hungry and peace to the People.’ সোভিয়েট ইউনিয়ন রাসেলকে আমন্ত্রণ জানান একজন বেসরকারি প্রতিনিধিরূপে। সেখানে তিনি লেনিনের সাথে সমাজতন্ত্র নিয়ে মুখোমুখি আলোচনা করার সুযোগ পান। রাশিয়া পরিভ্রমণ শেষ করে তিনি গিয়েছিলেন। চীনে। সেখানে তিনি সান-ইয়াৎ-সেনের সাথে আলোচনা করার সুযোগ পান। সান-ইয়াৎ-সেন তাকে প্রভাবিত করেন। কিছুদিন সেখানে তিনি অধ্যাপনাও করেন আমন্ত্রিত হয়ে। এই দুই দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত দুটি বই ‘The Practice and Theory of Bolshevism” এবং “The Problem of China”।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধী ছিলেন রাসেল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে করেছিলেন সমর্থন। অনেকেই সেজন্যে রাসেলকে ভুল বুঝেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনও দ্বিচারিতা ছিল না। রাসেলের বিশ্বাস ছিল হিটলারের ফ্যাসিবাদ মানবতার শত্রু। সেই শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতে যুদ্ধকে সমর্থন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে স্বার্থের সংঘর্ষ, যা ছিল মানব সভ্যতার বিপক্ষে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল হিটলারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানব কল্যাণের স্বার্থে। সেখানে কোনও রকম নিরপেক্ষতারও সুযোগ নেই।

উদারপন্থী থেকে সমাজবাদীতে রূপান্তরিত হওয়ার পর লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব তার মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল।

রাসেলের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যা লিখতেন বা বলতেন তা একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করতেন। ১৯৩৯ সালে রাসেল ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। ১৯৪০’র প্রথমে নিউইয়র্কের সিটি কলেজে দর্শন-শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহনও করেন। কিন্তু নিউইয়র্কের ধর্মযাজকরা রাসেল ধর্ম এবং নৈতিকতা সম্বন্ধে ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন বলে তার প্রবল বিরোধীতা করেন। রাসেলকে শেষ পর্যন্ত সেই পদে যোগদান করতে দেওয়া হয় নি। ১৯৪০ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মতন্ত্রের এই ছিল রূপ।

রাসেলের জীবনের শেষ বিশ বছর ছিল সবচেয়ে কর্মময়। তাঁর বয়স যখন অষ্টাশি তখন তিনি গড়ে তোলেন ‘Campaign for Nuclear Disartaiment নামে একটি বড় আন্দোলন। তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীতে পারমানবিক মারণাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ হোক। পারমানবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার পক্ষে জনমত গঠনে তিনি লন্ডনে সত্যাগ্রহ শুরু করেন। তিনি নেতৃত্ব দেন সেই সত্যাগ্রহে । নব্বই ছুঁই ছুঁই সেই জ্ঞানতাপসকে কারাগারে প্রেরণ করেন ব্রিটিশ সরকার। বাসেল দম্পতির দু’মাস কারাবাস হয়েছিল। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যখন সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, রাসেল তার কারণ অনুসন্ধান করে অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে ধিক্কার দিয়েছেন অন্যায়কারী রাষ্ট্র এবং সরকারকে। সেই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী বা সাম্যবাদী যে মতবাদেরই হোক না কেন। তার শেষ জীবনের অধিকাংশ সময় অধিকার করে নিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠনে। তাঁর ‘War Crimes in Vietnam’ গ্রন্থটিতে রাসেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলিকে মানবতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সমগ্র বিশ্ব ছিল রাসেলের কর্মক্ষেত্রের পরিমণ্ডল। যেখানে অন্যায় দেখেছেন সেখানেই তার প্রতিবাদী কণ্ঠকে দেখা গেছে। পৃথিবীর সব নির্যাতিত মানুষের দুঃখে তিনি বিচলিত হয়েছেন। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। “India League’-র সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মানব কল্যাণে। সবরকম নিষ্ঠুরতা, হীনতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা থেকে মানবতার শত্রুদের তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর কাছে ভাল atalans to bet 1607: “The good life is one inspired by love and guided by knowledge.” দেশের এবং বিদেশের সরকারের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল তাকে অনেকবার। তবুও তিনি তাঁর পথ এবং মত নিয়ে কোনওদিন আপোষ করেন নি। প্রতিবাদই জীবন, মেনে নেওয়াই মৃত্যু’- এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন সারাজীবন। তাঁর মতো কর্মীপুরুষ এবং অনবদ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে হয়ত আর জন্ম নেবে না। আবার তার মতো অকৃত্রিম মানবদরদীও বোধহয় শেষ। তিনি যে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতেন, যে সমাজ-ভাবনা ছিল তাঁর, তা তিনি তুলে ধরেছেন “The Conquest of happiness” গ্রন্থে। বর্তমান সভ্য জগতের কাছে এটা তার উত্তরপুরুষরা যতদিন তা দীপ্যমান রাখতে পারবে, ততদিন তাদের কাছে সেই শিখা আলোকিত মশাল হয়েই থাকবে। রাসেলের জীবন এবং চিন্তাধারা কোনও দিন পৃথিবী থেকে মুছে যাবে না।

১৯৭০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মহাজীবনের অবসান। পৃথিবীর মানুষ চিরকাল তাঁকে অসীম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

Exit mobile version