প্রেমের মূল্য দেওয়া কেন তা সংক্ষেপে বলা খুব কঠিন। তবু আমি চেষ্টা করব। প্রেমের মূল্য দেওয়া উচিত কারণ প্রেম নিজেই আনন্দের উৎস। এটি প্রেমের উচ্চতম মূল্য না হলেও, এর প্রত্যেকটি স্তরে এই আনন্দই অনিবার্যভাবে অবস্থান করছে।
“হে প্রেম! তারা তোমাকে খুব ভুল করে
বলে তোমার মধুরতা তিক্ত
কিন্তু তোমার রসাল ফল এমন যে
তার চেয়ে মধুরতর আর কিছু নেই।”
এই কয়েকটি পংক্তির অজ্ঞাতনামা লেখক নিরীশ্বরবাদের কোনও মীমাংসা খুঁজছেন না, বিশ্বরহস্যের চাবিও নয়। তিনি নিজের মধ্যেই আনন্দকে উপভোগ করছেন। প্রেম যে শুধু আনন্দের উৎস তাই নয়, এর অভাবও বেদনার উৎস। দ্বিতীয়ত প্রেমকে এজন্যে মূল্যবান মনে করতে হবে, কারণ তা জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। যেমন সঙ্গীত, পর্বতে সূর্যোদয় এবং পূর্ণিমার সুষমায় প্লাবিত সমুদ্র। যে মানুষ তার প্রেমিকার সাথে মিলে সুন্দর জিনিস উপভোগ করেনি সে প্রেমের যে যাদু-ক্ষমতা আছে তার সন্ধান পায়নি। প্রেম অহংবোধের আবরণটা ভেঙে ফেলতে পারে। কারণ এটি জৈব-সহযোগিতারই একটি রূপ, যাতে একের প্রকৃতিজাত উদ্দেশ্য মেটাতে অপরের আবেগের প্রয়োজন হয়। বিশ্বে নানা যুগে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের কোনওটা মহৎ কোনওটা নয়। স্টোইক এবং প্রথমযুগের খ্ৰীষ্টানরা বিশ্বাস করতেন মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ মঙ্গল পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা, অন্ততপক্ষে অন্য মানুষের সাহায্য ছাড়া। অন্যেরা ক্ষমতাকেই মনে করেছেন জীবনের চরম লক্ষ্য। কেউ কেউ মনে করেছেন ব্যক্তিগত আমোদ-প্রমোদকে। এসবই বিশেষ নির্জন দর্শনের পর্যায়ে পড়ে। কেন না এতে অনুমান করা হয়েছে। যে, মঙ্গল এমন একটা বস্তু যা শুধু ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সমাজে নয়, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে আলাদাভাবে রূপায়িত হওয়া সম্ভব। আমার বিবেচনায় এ সকল মতবাদ মিথ্যা এবং তা শুধু নৈতিক মতবাদ হিসাবে নয়, আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির উৎকৃষ্ট অংশের প্রকাশরূপেও। মানুষ সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এবং কিছু ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রকৃতি তার ভিতর এমন সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে যাতে সহযোগিতার জন্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ অন্তর প্রয়োজন তা সেই সহযোগিতা প্রেরণা যোগায়, যাদের কিছুমাত্র প্রেমের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা তাদের প্রিয়জনের চরম মঙ্গলের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোনও দর্শনে তৃপ্ত হবে না। সন্তানম্নেহের অনুভূতি আরও বেশি ক্ষমতাশালী। কিন্তু তার শ্রেণী প্রকাশ ঘটে পিতা-মাতার পরস্পরের প্রেমের ফলে। আমি এমন দাবি করি না যে মহৎ প্রেম খুব একটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এ কথা বলি যে মহৎ প্রেম এমন কিছু মূল্যবোধ তুলে ধরে, যা অন্যভাবে অজানা থেকে যেত। প্রেমের নিজেরই ভিতর এমন একটা ঐশ্বর্য আছে, যাকে অবিশ্বাস দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। মহৎ প্রেম সব সংশয়বাদীর নাগালের বাইরে। যারা তাদের অক্ষমতার জন্যে যদিও সংশয়বাদকেই দায়ী করে।
“সত্য প্রেম দীর্ঘজীবী অনল
যা মনে জ্বলছে অনন্তকাল
কখনো রুগ্ন হয় না, মরে না, শীতল হয় না,
কখনো স্থানচ্যুত হয় না।”
এর পর মিঃ ক্রাচ ট্র্যাজেডি নিয়ে কী বলেছেন তা দেখব। তিনি এ প্রসঙ্গে যা বলেন, আমি তার সাথে সহমত পোষণ করি। ইবসেনের(১১) ‘গোস্টস’, শেক্সপীয়ারের(১২) ‘কিং লিয়র’ থেকে নিম্নমানের। প্রকাশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত শব্দরাজি উপহার, কোনও কিছুই ইবসেনকে শেক্সপীয়ারে রূপান্তরিত করতে পারত না। যে উপাদান থেকে শেক্সপীয়ার তার নাটক সৃষ্টি করেছেন, মানবিক মর্যাদাবোধ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির ওপর গুরুত্ববোধ এবং জীবনের বিস্তার-সম্পর্কিত কল্পনার আশ্রয়, ইবসেনের কল্পনায় এসবের কোনও গুরুত্ব নেই, এবং তার সমসাময়িকদের কাছেও তার কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে না, ছিলও না। মধ্যবর্তী শতক সমূহের মধ্যে ঈশ্বর, মানুষ এবং প্রকৃতি সব কিছু কেন জানি মূল্য হারিয়ে ফেলেছে যার অর্থ এই নয় যে, আধুনিক শিল্পের বাস্তবতা আমাদের মানুষের হীনতার সন্ধানে লিপ্ত করেছে। এইভাবে মানুষের জীবনের হীনতা বাস্তববাদী চিত্রকলা পদ্ধতি যেন কোনওভাবে আমাদের ওপর চাপানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সেই ব্যাপার যে, প্রাচীন ধাচের ট্র্যাজেডি যেখানে রাজকুমারদের দুঃখের কথা থাকত তা বর্তমান কালের উপযোগী নয়। আমরা যখন অখ্যাত কোনও ব্যক্তির দুঃখের কথা একই রীতিতে আলোচনা করি, তখন তার প্রতিক্রিয়া এক হয় না। এর কারণ অবশ্য এটা নয় যে জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অবনতি হয়েছে। বরঞ্চ এর বিপরীতটাই সত্যি। কারণ, এখন আমরা বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তিকে আর বিশ্বের মহৎ মানুষ বলে মনে করতে পারি না। একমাত্র তাদেরই বিয়োগান্ত নাটকে আবেগের অধিকার থাকবে, আর অন্যেরা কিছু লোকের মহিমা বাড়াবার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে, এমন কথা আমরা মেনে নিতে পারি না। শেক্সপীয়ার বলেছেন :
“ভিক্ষুকরা মারা গেলে আকাশে ধূমকেতুর উদয় হয় না।
কিন্তু রাজকুমাররা মারা গেলে তাদের মৃত্যুতে
আকাশ ঝলসে ওঠে।”
শেক্সপীয়ারের কালে এই আবেগ সামগ্রিকভাবে কেউ বিশ্বাস না করলেও এতে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ রয়েছে যা বাস্তবতা বিশ্বজনীন এবং শেক্সপীয়ার নিজে তা মেনে নিয়েছিলেন। শেক্সপীয়ার তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারেন নি। এরই ফলে নাটকের চরিত্র কবি সিনার মৃত্যু কৌতুকময়। কিন্তু সিজার, ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের মৃত্যু শোকাবহ। কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে যে পার্থিব গুরুত্ব, পূর্ণতা পেয়েছে সেই মূল্যবোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি কেন না আমরা এখন গণতন্ত্রী, শুধু বাইরের রূপেই নয় অন্তরের উপলব্ধিতেও। তাই অতি বিয়োগান্ত নাটককে এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিকের চেয়ে সমাজকেন্দ্রিক হতে হয় বেশি। আমি যা বলতে চাই তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি; এর্নস্ট টোলার রচিত গ্রন্থ ‘মাসেমেনশ’(১৩)-এর সাহায্যে। আমার মনে হয় না, এই গ্রন্থ অতীতে শ্রেষ্ঠ সব যুগে যে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে তার কোনওটার সমতুল্য। কিন্তু সেসব গ্রন্থের সাথে এর যে যথার্থ তুলনা চলে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থ উন্নত করে অন্তরকে, এখানে গভীরতা এবং বাস্তবতাবোধ থেকে বীরোচিত কর্মকাণ্ড চিত্রিত হয়েছে। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন তেমনি এই গ্রন্থে ‘করুণা ও ভীতি জাগিয়ে পাঠকমনকে কলুষমুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই রকম আধুনিক বিয়োগান্ত নাটক কমই রচিত হয়েছে। কারণ এখন শিল্পিত সাধারণ বিষয় দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে না, অথচ প্রাচীন আঙ্গিক এবং ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে হবে। এই কাজ কঠিন। ট্র্যাজেডি রচনা করলে নাট্যকারকে ট্র্যাজেডি অনুভব করতে হবে। সেই অনুভবের জন্যে যে বিশ্বে তিনি বাস করেন তার জন্যে সচেতন থাকতে হবে। শুধু অন্তরে নয়, প্রতি রক্তকণায় এবং স্নায়ুতে। মিঃ ক্রাচ তার বইয়ে প্রথম থেকে শেষাবধি মাঝে মাঝে নৈরাশ্যের কথা বলে গেছেন। তিনি যে বীরোচিতভাবে আনন্দহীন বিশ্বকে স্বীকার করে গেছেন তা হৃদয়কে স্পর্শ করে। কিন্তু এই আনন্দহীনতার কারণ হচ্ছে তিনি এবং অধিকাংশ সাহিত্যসেবী এখন পর্যন্ত পুরানো আবেগসমূহকে নতুন যুগের প্রেরণায় সজীবিত করতে শেখেন নি। প্রেরণার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সাহিত্যিকদের নিজস্ব গোষ্ঠীতে তা নেই। যে সব সাহিত্যিক গোষ্ঠী রয়েছেন, সমাজের জীবনের সাথে তাদের প্রাণের কোনও সংযোগ নেই। এই সংযোগ খুব জরুরী, যদি মানুষের অনুভূতির আন্তরিকতা এবং গভীরতা দিয়ে আসল দুঃখ এবং বেদনাকে পরিমাপ করতে হয়। যেসব প্রতিভাদীপ্ত যুবক জগতে তাদের কিছুই করার নেই মনে করে, ঘুরে বেড়ায়, তাদের আমি বলি : লেখার চেষ্টা ত্যাগ কর, তার পরিবর্তে না লেখার চেষ্টা কর। বিশাল বিশ্বে বেরিয়ে পড়, জলদস্যু হও। বোর্নিওতে গিয়ে রাজা হও, সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে শ্রমিক হও, এমন জীবনকে গ্রহণ কর, যাতে তোমার প্রাথমিক জাগতিক চাহিদা মেটাতে তোমার প্রায় সকল ক্ষমতা দখল করে রাখবে। আমি প্রত্যেকের জন্যে এই পরামর্শ দান করছি না। শুধু তাদের জন্যে করছি যারা মিঃ ক্রাচ আবিস্কৃত ‘অসুখ’ নামের রোগে সংক্রামিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস এরকম জীবন-যাপন করার কয়েক বছর পরে সাবেক-বুদ্ধিজীবী দেখতে পাবেন, চেষ্টা করেও তিনি আর না লিখে পারছেন না, এবং এমন অবস্থা আসবে তখন নিজের কাছে আর তার লেখা তুচ্ছ মনে হচ্ছে না। লেখার আকৃতি থেকে লিখেই তিনি অপার আনন্দ লাভ করবেন।