মিঃ ক্রাচের রচনার করুণতম অধ্যায় হচ্ছে প্রেম বিষয়ে আলোচনা। ভিকটোরিয়ান যুগের লোকদের প্রেম বিষয়ে ধারণা খুব উচ্চস্তরের ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের আধুনিক বাস্তববোধ দিয়েই প্রেমকে দেখি। “ভিকটোরিয়ানদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত সন্দেহবাদী, তাদের কাছে প্রেম ঈশ্বরের কিছু উদ্দেশ্যসাধন করত যা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের কাছে প্রেম ছিল ঈশ্বরের প্রতিরূপ। এই সঙ্কটের মুখে অনেক শক্তলোকও সাময়িকভাবে অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে পড়তো। তারা নিজেদের দেখেছেন এমন এক রহস্যময় শক্তির মুখোমুখি, যা তাদের মনে একপ্রকার ভক্তির ভাব জাগিয়ে তোলে, যা অন্য কিছুতে জাগায় না। তা এমন কিছু, যার প্রতি তাদের প্রশ্নহীন আনুগত্য সমর্পন করা উচিত। এ কথা তারা মর্মমূল থেকে অনুভব করেন। তাদের কাছে, প্রেম ঈশ্বরের মতোই সবরকম আনুগত্য দাবি করে। ঈশ্বরের মতোই জীবনের এক অর্থময় রূপবৈচিত্র্যে বিশ্বাসীদের ভূষিত করে। যাকে এখন পর্যন্ত যে কোনও ভাবে বিশ্লেষণ করে বাতিল করা যায়নি। তাদের চেয়ে আমরা ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে বেশি অভ্যস্ত, কিন্তু এখনও এমন পৃথিবীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, যেখানে প্রেম নেই। প্রেমহীন, ঈশ্বরহীন পৃথিবী যখন হবে, তখনি নিরীশ্বরতার সঠিক অর্থ কী তা বুঝতে পারব।” এটি খুবই কৌতুকের ব্যাপার যে আমাদের কালের তরুণদের চোখে ভিকটোরিয়ান যুগ যত প্রেমময় মনে হচ্ছে, সে যুগের লোকদের কাছে তা ততটা প্রেমময় ছিল না। আমার দুজন মহিলার কথা মনে পড়ে, দুজনেই সে যুগের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করতেন। আমার প্রথম জীবনে দুজনেই খুব পরিচিত ছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন নীতবাদী এবং অন্যজন ছিলেন ভলটেয়ারপন্থী, অর্থাৎ ধর্ম মানতেন না। প্রথম মহিলা এই বলে দুঃখ করতেন যে, সব কবিতা যেন শুধু প্রেম নিয়ে লেখা এবং তার মতে বিষয়টা স্বাদহীন। পরের মহিলা বলতেন–“আমার বিরুদ্ধে কারো কিছু বলবার নেই। কিন্তু আমার মতে বাইবেলের দশ-আদেশের ষষ্ঠটি অগ্রাহ্য করা যত খারাপ, সপ্তমটি তত নয়। কেন না আর যাই হোক এতে অন্যপক্ষের সম্মতি চাই।” এই দুটি মতের কোনওটাই, যাকে মিঃ ক্রাচ বিশেষভাবে ভিকটোরিয়ানরূপে চিহ্নিত করেছেন তা নয়। কারণ এই দু’জন মহিলা প্রেমে শ্রদ্ধাশীল নন তা খুব ভাল করে বোঝা যায়। মিঃ ক্রাচ লেখকজীবনে এমন কয়েকজন লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যারা আপন পরিবেশেই মানিয়ে নিতে পারেননি নিজেদের। এর একটা বড় উদাহরণ আমার মনে হয় রবার্ট ব্রাউনিং(৯)। কিন্তু প্রেম নিয়ে কবি রবার্ট ব্রাউনিং-এর ধারণা আমার কাছে কিছুটা শ্বাসরোধী মনে হয়। তার প্রেমের দর্শন হচ্ছে :
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তাঁর সৃষ্ট হীনতম জীবও
গর্বিত হয় দ্বৈত আত্মায়, তাঁদের একটি পৃথিবীর দিকে
তাকাবার জন্যে।
অন্যটি দয়িতার দিকে ফেরাবার জন্যে।”
এর থেকে বুঝতে পারা যায়, সার্বিকভাবে এই জগতে প্রতিযোগিতার ভাবই একমাত্র সম্ভাব্য পথ। কেন? কারণ ব্রাউনিং বলবেন পৃথিবী নিষ্ঠুর। তা হলে আমাদের বলতে হয়, পৃথিবী আপনাকে আপনার মূল্যে মেনে নেবে না। ব্রাউনিং দম্পতির অনুকরণে দুজনে পরস্পর প্রশংসাকারী সমিতি গঠন করতে পারেন। ভাল-মন্দ বিচার না করে কাজের সর্বদা প্রশংসা পাওয়া নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। ব্রাউনিং এমন অবিমিশ্র প্রশংসাই চেয়েছিলেন সাথীর কাছে, ব্রাউনিং অরোরা লি’ কে প্রশংসা না করার সাহসিকতার জন্য ফিটজেরাল্ড(১০)-কে মাত্রাহীন নিন্দা করেছিলেন। এভাবে তিনি নিজেকে উঁচু স্তরের বীরপুরুষ ভেবেছিলেন। সুতরাং এদের দুপক্ষেরই সমালোচনাশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়াকে আমি সত্যি প্রশংসামূলক। বলতে পারি না। এর মূলে রয়েছে ভীতি এবং নিরপেক্ষ সমালোচনার ঠাণ্ডা ঝাপ্টা থেকে নিরাপদে থাকার কামনা। অনেক বয়স্ক চিরকুমার নিজেদের ঘরে আরামের আগুনের পাশে বসে একই তৃপ্তি লাভ করেন। আমি নিজে ভিকটোরিয়ান যুগে অনেক দিন কাটিয়েছি। মিঃ ক্রাচের আদর্শে আমি আধুনিক নই। কোনও ভাবেই আমি প্রেমে বিশ্বাস হারাইনি। কিন্তু ভিকটোরিয়ানরা যে প্রেমের প্রশংসা করেন আমি তাতে বিশ্বাসী নই। এ প্রেমে দুঃসাহসিকতা আছে। জাগ্রত এর দৃষ্টি, এ যেমন শুভবোধের জন্ম দেয় তেমনি অশুভ দিককে ভুলিয়ে দেয় না। আমার প্রেম যে পাপমুক্ত অথবা পবিত্র এরকম ভনিতা করে না। প্রেমে এইসব গুণাবলী আরোপ করা, যে প্রশংসার যোগ্য, যৌন নিষেধাজ্ঞার পাপপূণ্য বোধ থেকে এসেছে। ভিকটোরিয়ানদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে অধিকাংশ যৌনতাই অশুভ এবং যে যৌনতার অনুমোদন দেওয়া হত তার সাথে জুড়ে দেওয়া হত নানাধরণের পবিত্রতার বিশেষ সব বিশেষণ। বর্তমান যুগের তুলনায় অতীত যুগে যৌন-ক্ষুধা অনেক বেশি ছিল। এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে ঠিক এই কারণে অতীতের লোকেরা যৌনতার গুরত্ব খুব বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন সাধুরা সবসময় করে থাকেন। বর্তমান কালে আমরা এক সংশয়-পূর্ণ যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি। এই সময় আমরা অনেকেই পুরানো আদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি কিন্তু নতুন কিছুই পাইনি। এতে তাদের অসুবিধা বেড়েছে যারা এখনও পুরানো আদর্শে বিশ্বাস করেন। এতে তাদের মনোজগতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা, নৈরাশ্য, অনুশোচনা এবং বিশ্বনিন্দুকতা। আমার বিশ্বাস এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু এ যুগে তাদেরই প্রাধান্য বেশি। আমার বিশ্বাস কেউ যদি এই যুগের সাধারণ অবস্থাপন্ন যুবকদের সাথে ভিকটোরিয়ান যুগের যুবকদের তুলনা করেন, তা হলে দেখবেন প্রেম সম্পর্কে বর্তমান সময়েই তৃপ্তিলাভ বেড়েছে এবং ষাট বছর আগের চেয়ে প্রেমের মূল্য নিয়ে আন্তরিকতা এখন অনেক বেড়ে গেছে। তবুও যে কিছু বিশ্বনিন্দুক সবকিছুই খারাপ দেখে, তার কারণ খুঁজতে হবে তাদের অবচেতন মনের ওপর অতীত আদর্শের অত্যাচারের মধ্যে, আর খুঁজতে হবে আধুনিক সময়ের লোকের আচরণ-নিয়ন্ত্রক যৌক্তিক নৈতিক আদর্শের মধ্যে। অনুতাপের মধ্যে এর প্রতিকার নেই। অতীতের প্রতি মমত্ববোধের মধ্যেও নেই, রয়েছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীকে সাহসের সাথে স্বীকার করার মধ্যে। আর রয়েছে কিছুমাত্রায় বাতিল কুসংস্কারকে তাদের সব রহস্যময় গুপ্তস্থান থেকে নির্মূল করার মধ্যে।