প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনা হল রুশ বিপ্লব। রাসেল এই ঘটনাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। কারণ রুশ বিপ্লবের বাণী ছিল ‘Power to the Soviets, land to the Peasants, breads to the Hungry and peace to the People.’ সোভিয়েট ইউনিয়ন রাসেলকে আমন্ত্রণ জানান একজন বেসরকারি প্রতিনিধিরূপে। সেখানে তিনি লেনিনের সাথে সমাজতন্ত্র নিয়ে মুখোমুখি আলোচনা করার সুযোগ পান। রাশিয়া পরিভ্রমণ শেষ করে তিনি গিয়েছিলেন। চীনে। সেখানে তিনি সান-ইয়াৎ-সেনের সাথে আলোচনা করার সুযোগ পান। সান-ইয়াৎ-সেন তাকে প্রভাবিত করেন। কিছুদিন সেখানে তিনি অধ্যাপনাও করেন আমন্ত্রিত হয়ে। এই দুই দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত দুটি বই ‘The Practice and Theory of Bolshevism” এবং “The Problem of China”।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধী ছিলেন রাসেল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে করেছিলেন সমর্থন। অনেকেই সেজন্যে রাসেলকে ভুল বুঝেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনও দ্বিচারিতা ছিল না। রাসেলের বিশ্বাস ছিল হিটলারের ফ্যাসিবাদ মানবতার শত্রু। সেই শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতে যুদ্ধকে সমর্থন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে স্বার্থের সংঘর্ষ, যা ছিল মানব সভ্যতার বিপক্ষে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল হিটলারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানব কল্যাণের স্বার্থে। সেখানে কোনও রকম নিরপেক্ষতারও সুযোগ নেই।
উদারপন্থী থেকে সমাজবাদীতে রূপান্তরিত হওয়ার পর লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব তার মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল।
রাসেলের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যা লিখতেন বা বলতেন তা একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করতেন। ১৯৩৯ সালে রাসেল ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। ১৯৪০’র প্রথমে নিউইয়র্কের সিটি কলেজে দর্শন-শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহনও করেন। কিন্তু নিউইয়র্কের ধর্মযাজকরা রাসেল ধর্ম এবং নৈতিকতা সম্বন্ধে ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন বলে তার প্রবল বিরোধীতা করেন। রাসেলকে শেষ পর্যন্ত সেই পদে যোগদান করতে দেওয়া হয় নি। ১৯৪০ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মতন্ত্রের এই ছিল রূপ।
রাসেলের জীবনের শেষ বিশ বছর ছিল সবচেয়ে কর্মময়। তাঁর বয়স যখন অষ্টাশি তখন তিনি গড়ে তোলেন ‘Campaign for Nuclear Disartaiment নামে একটি বড় আন্দোলন। তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীতে পারমানবিক মারণাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ হোক। পারমানবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার পক্ষে জনমত গঠনে তিনি লন্ডনে সত্যাগ্রহ শুরু করেন। তিনি নেতৃত্ব দেন সেই সত্যাগ্রহে । নব্বই ছুঁই ছুঁই সেই জ্ঞানতাপসকে কারাগারে প্রেরণ করেন ব্রিটিশ সরকার। বাসেল দম্পতির দু’মাস কারাবাস হয়েছিল। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যখন সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, রাসেল তার কারণ অনুসন্ধান করে অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে ধিক্কার দিয়েছেন অন্যায়কারী রাষ্ট্র এবং সরকারকে। সেই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী বা সাম্যবাদী যে মতবাদেরই হোক না কেন। তার শেষ জীবনের অধিকাংশ সময় অধিকার করে নিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠনে। তাঁর ‘War Crimes in Vietnam’ গ্রন্থটিতে রাসেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলিকে মানবতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সমগ্র বিশ্ব ছিল রাসেলের কর্মক্ষেত্রের পরিমণ্ডল। যেখানে অন্যায় দেখেছেন সেখানেই তার প্রতিবাদী কণ্ঠকে দেখা গেছে। পৃথিবীর সব নির্যাতিত মানুষের দুঃখে তিনি বিচলিত হয়েছেন। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। “India League’-র সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মানব কল্যাণে। সবরকম নিষ্ঠুরতা, হীনতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা থেকে মানবতার শত্রুদের তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর কাছে ভাল atalans to bet 1607: “The good life is one inspired by love and guided by knowledge.” দেশের এবং বিদেশের সরকারের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল তাকে অনেকবার। তবুও তিনি তাঁর পথ এবং মত নিয়ে কোনওদিন আপোষ করেন নি। প্রতিবাদই জীবন, মেনে নেওয়াই মৃত্যু’- এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন সারাজীবন। তাঁর মতো কর্মীপুরুষ এবং অনবদ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে হয়ত আর জন্ম নেবে না। আবার তার মতো অকৃত্রিম মানবদরদীও বোধহয় শেষ। তিনি যে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতেন, যে সমাজ-ভাবনা ছিল তাঁর, তা তিনি তুলে ধরেছেন “The Conquest of happiness” গ্রন্থে। বর্তমান সভ্য জগতের কাছে এটা তার উত্তরপুরুষরা যতদিন তা দীপ্যমান রাখতে পারবে, ততদিন তাদের কাছে সেই শিখা আলোকিত মশাল হয়েই থাকবে। রাসেলের জীবন এবং চিন্তাধারা কোনও দিন পৃথিবী থেকে মুছে যাবে না।
১৯৭০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মহাজীবনের অবসান। পৃথিবীর মানুষ চিরকাল তাঁকে অসীম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।