ইংল্যান্ডের এক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৭২ সালে ১৮ মে বার্ট্রান্ড রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডের রাসেল পরিবার ছিল উদারনৈতিক রাজনীতির সাথে যুক্ত। রাসেলের পিতামহ লর্ড জন রাসেল দু’বার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থী। বার্ট্রান্ড রাসেলের পিতা ছিলেন ভাইকাউন্ট অ্যামরারলে রাসেল। তিনিও ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। মুক্ত চিন্তাবিদ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। পিতামহ এবং পিতার জীবনের গভীর প্রভাব পড়েছিল রাসেলের জীবনে।
আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই গভর্নের্স এবং শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে রাসেলের পড়াশোনা চলেছিল। তখনকার অভিজাত পরিবারে সেটাই ছিল রীতি। কৈশোরে গণিতশাস্ত্রের ওপর রাসেলের তীব্র আগ্রহ দেখে তার গৃহশিক্ষকরা মুগ্ধ হন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও প্রবল অধ্যয়নস্পৃহা কৈশোর থেকেই দেখা গিয়েছিল। রাসেলের পিতামহের ছিল বিশাল ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার। বালক রাসেলের সেখানে ছিল অবাধ বিচরণ। আঠারো বছর বয়সে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি স্নাতক হন। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসী ও ইতালিয়ান ভাষায় তিনি তখনই বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি ফ্রান্সের ব্রিটিশ দূতাবাস, প্যারিসে কিছুদিন কাজ করেন, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই লন্ডনে ফিরে আসেন। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি এলিস স্মিথকে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর রাসেল পত্নীকে নিয়ে সানেবক্সে বসবাস করতে থাকেন। তখন তিনি বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন দর্শনশাস্ত্রে ও গণিতশাস্ত্রে। উত্তরকালে পৃথিবীর বিদগ্ধ সমাজ তাঁকে এই দুই বিষয়ে অসামান্য অবদানকারীরূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এই সময়ে আরও দুটি বিষয়ের প্রতি তিনি বিষেভাবে আকৃষ্ট হন নারী ও পুরুষের সমানাধিকার এবং সমাজতন্ত্রবাদ বিষয়ক আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো তাকে মুগ্ধ করেছিল। কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দর্শন রাসেলকে অনুপ্রাণিত করে। মানুষের জীবনের উৎকর্ষতার কারণ হল ধর্ম নয়– জ্ঞান এবং বিজ্ঞান। তখন থেকেই এটাই হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্বাস।
মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে রাসেল তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বেচ্ছায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পরিত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন যে সম্পদ তিনি নিজে অর্জন করেননি তা ভোগ করার কোনও অধিকার তার নেই। তিনি সেইসব সম্পত্তি দিয়ে দেন কয়েকটি মানবকল্যাণব্রতী সংস্থায়। এরপরে তিনি জীবন কাটান তাঁর লেখা এবং অধ্যাপনা থেকে লব্ধ উপার্জন থেকে। সেই তরুণ বয়স থেকেই তিনি যুদ্ধবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেন। সেই যুদ্ধে যদি তাঁর স্বদেশও যুক্ত থাকে তবুও তিনি মত বদলাননি। স্বদেশের অন্যায় অত্যাচারকে দেশপ্রেমের নামে কখনও তিনি সমর্থন করেননি।
চব্বিশ বছর বয়সে রাসেলের রাজনীতি সংক্রান্ত বই ‘A Study মত German Social Democracy’ প্রকাশিত হয়। তারপর প্রকাশিত হয় জ্যামিতি সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। এই সময় তাঁর লেনিনের দর্শনবিদ্যা সম্পর্কিত একটি বইও প্রকাশিত হয়। এই সময় তিনি একটি গবেষণাপত্রও রচনা করেন। তাঁর সেই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল গণিত ও ন্যায়শাস্ত্রের মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধরা। রাসেল গণিত বলতে বুঝতেন তার কঠোর নৈর্ব্যক্তিকতা এবং বস্তুময়তাকে। রাসেলের বয়স যখন আটত্রিশ বছর তখন তিনি হোয়াইট হেডের সহযোগিতায় তাঁর ‘Principia Mathematica’ নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের রচনা শেষ করেন। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এই বিপুলায়তন গ্রন্থ বিশ্বের গণিতের ইতিহাসে ক্লাসিকরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। এই গ্রন্থ রচনায় সাত বছর বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছিল রাসেলকে। এই গ্রন্থের জন্যেই বার্ট্রান্ড রাসের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
জীবনের প্রথম দিকে তিনি উদারনৈতিক রাজনীতির সমর্থক থাকলেও পরে হয়ে উঠেছিলেন সমাজবাদী। তিনি অজ্ঞেয়বাদী বা নিরীশ্বরবাদী তা নিয়েও বিতর্ক ছিল একসময়। তবে তিনি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না, সে কথা স্পষ্টভাষায় বলে গেছেন তার অনেক গ্রন্থে-প্রবন্ধে-নিবন্ধে।
১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাসেল ছিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে। তাঁর স্বদেশ ইংল্যান্ড তখন যুদ্ধে অংশগ্রহকারী দেশ। রাসেলের যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তির জন্য প্রচারকার্য তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল নিজের শ্রেণী থেকে। তবে তার সাথে ছিলেন বিখ্যাত ওয়েবদ দম্পর্তি, বার্নার্ড শ, স্ট্রিভেলিয়ান এবং হারবার্ট স্যামুয়েল প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীরা। আরো যে কজন মনীষী এইসময় যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের জন্যে বিশ্বখ্যাত (সেইসময় নিন্দিত) হয়ে রয়েছেন তাঁরা হলেন রোমা রোলা (১৮৬৬-১৯৬৫), অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৯৭৯-১৯৫৫) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)।
যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এবং শান্তিবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যে স্বদেশবাসীর কাছে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন রাসেল। তাকে কারাবাস এবং জরিমানা দুই দণ্ডই ভোগ করতে হয়েছিল। এমন কী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ট্রিনিটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করতেন তারাও রাসেলকে কর্মচ্যুত করেন। পরে অবশ্য তিনি আবার সেখানে আমন্ত্রিত হন। ১৯১৭ সালের শেষভাগে ব্রিকসটনের কারাগারে ছয় মাস কাটিয়েছিলেন তিনি। কারাগারে বসেই তিনি তিনটে গ্রন্থ রচনা করেন।