কিন্তু অন্য মেজাজে দেখলে সব কিছুর চেহারা বদলে যাবে। সূর্যের নিচে নতুন কিছুই আর নেই। কেন, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, আকাশ-যান, আর রাজনীতিবিদদের বেতার ভাষণের কথা ভাবুন? সলোমন(৪) এসবের কিছু জানতেন কি? যদি রাজ্যের অভ্যন্তর থেকে ফিরে এসে তিনি শেবার রাণির প্রজাদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত বেতার ভাষণ শুনতে পেতেন, তাহলে তাতে কী তিনি তাঁর তুচ্ছ গাছপালা আর জলাশয়ের মাঝখানে সান্ত্বনা পেতেন না? যদি তার অধীনে কোনও তথ্য দপ্তর থাকত এবং সংবাদপত্রে তার হারেমের আরাম সম্বন্ধে কী বলছে, এবং তার সাথে তর্করত বিরোধী জ্ঞানীদের কী দুর্দশা ঘটছে, তা যদি সেই দপ্তর সংবাদপত্রের কাটিং পাঠিয়ে তাঁকে জানাতে পারত, তাহলেও কী তিনি বলতেন সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই? হয়তো এসব তাঁর নৈরাশ্যকে সম্পূর্ণ দূর করতে পারত না। কিন্তু এসব কিছুকে তিনি নতুনভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন। বস্তুত আমাদের সময় সম্পর্কে মিস্টার ক্রাচের একটি অভিযোগ এই যে, সুর্যের নিচে নতুন জিনিস একটু বেশিই আছে। নতুনত্বের অভাব অথবা উপস্থিত–দুই-ই যদি সমান বিরক্তিকর হয় তাহলে তার কোনটি নৈরাশ্যের সত্যি কারণ হতে পারে তা মনে হয় না। তার ওপর এই কথাটি বিবেচনা করে দেখুন : “সব নদী সাগরে গিয়ে লীন হচ্ছে, তবু সাগর পূর্ণ হচ্ছে না। যেখান থেকে নদীসমূহ আসছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।” নৈরাশ্যের কারণরূপে বিবেচনা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভ্রমণ নিরানন্দময়। লোকে গ্রীষ্মকালে স্বাস্থ্যকর স্থানে যায়, আবার ফিরে আসে। এতে প্রমাণ হয় না যে গরমের দিনে স্বাস্থ্যনিবাসে যাওয়া অর্থহীন। জলের যদি অনুভূতি থাকত, তা হলে তা হয়তো শেলির(৫) ‘ক্লাউড’ (মেঘ)-এ বর্নিত রীতিতে নিজের সাহসে ভরা ভ্রমণচক্রটা উপভোগ করত। উত্তরাধিকারীর জন্যে সব রেখে যাওয়ার বেদনাবোধ থেকে বলা যায় যে বিষয়টি দুদিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। উত্তরাধিকারীর দিক থেকে দেখতে গেলে এটি স্পষ্টতই কম দুর্দশামূলক। সব কিছুই পরিণতিতে দূরে চলে যায়। শুধু সেই কারণে তার জন্যে হতাশ হওয়া উচিত নয়। যদি তাদের পরিবর্তে খারাপ জিনিস আসে তাহলে তাকে আশাব্যঞ্জক হওয়ার একটি কারণ মনে করা যেতে পারে। সলোমন যেমন মনে করেন, যদি তেমন কিছু ফিরে আসে? তা হলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই তো নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্যই যায় না, যদি না আবর্তনের প্রতিটি স্তর আলাদাভাবে বেদনাদায়ক না হয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তা কী বয়ে আনবে, তার মধ্যে বর্তমানের সমস্ত অর্থ নিহিত, এইভাবে দেখার ধারণাটাই অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমানের নিজেরই একটি মূল্য আছে। তার অংশবিশেষের কোনও মূল্য না থাকলে সমগ্রেরও কোনও মূল্য থাকে না। জীবন আর যাই হোক মিলনান্তক নাটক নয়। অবিশ্বাস্য রকমের বহু দুর্ভোগের ভিতর দিয়ে গিয়ে নায়ক-নায়িকার আনন্দঘন মিলন ঘটে যে নাটকে, বাস্তব জীবনকে তার অনুরূপ ভাবা উচিত নয়। আমি আমার সময়ে বেঁচে আছি এবং সেই সময়কে যথারীতি উপভোগ করছি, আমার পুত্র পরে আসবে এবং সেও তার সময়ের সম্পদ ভোগ করবে। তারপর তার পুত্র আসবে। এরইমধ্যে বিয়োগান্তক কী রয়েছে? বরং আমি যদি চিরজীবী হতাম, তা হলে শেষ জীবনে সব আনন্দ বিস্বাদে পরিণত হত। জীবন দুর্বিসহ বোঝা হয়ে উঠত। যেভাবে জীবন চলছে তাতে তা চিরসজীব রয়েছে,
“জীবনের আঁচে তপ্ত করেছি দুহাতে ভাই
আগুন নিভেছে, এবার আমিও বিদায় চাই।”(৬)
মৃত্যুতে যন্ত্রণা পাওয়া যতটা যুক্তিসঙ্গত, এই মনোভাবও ততটাই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং যুক্তি দিয়েই যদি মেজাজ গড়তে হয়, তা হলে হতাশ হওয়ার পক্ষে যতটুকু যুক্তি আছে, খুশী হওয়ার পক্ষেও ততটুকু যুক্তি রয়েছে।
‘একলিজিয়াস্টেস’ বিষাদময়। মিস্টার ক্রাচের মডার্ন টেম্পার’ হৃদয়বিদারক । মিস্টার ক্রাচ অন্তরের অন্তস্থলে বিষণ্ণ, কারণ মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ছে। পরবর্তী অসুখী যুগের অনেক মূল্যবোধ আর শাশ্বত মনে হয় না। তিনি বলেছেন, “আধুনিক নিরানন্দ কালটা হচ্ছে মৃত দুনিয়ার প্রেত-অধ্যুষিত কাল, এবং এখনও সেকাল স্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি। যে কিশোর পৌরণিক ধর্মীয় ভাবধারায় বড় হয়েছে, সে যেমন স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে দিগভ্রান্ত, এর সঙ্কট অনেকটা সেই রকম।” একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সম্পর্কে এটা সম্পূর্ণ সত্য। এঁরা সাহিত্যের শিক্ষালাভ করেছেন, তাই আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না। এঁরা প্রথম জীবনের বিশ্বাসকে আবেগের ভিত্তির ওপর স্থাপন করার শিক্ষা পেয়েছেন। তাই যা আধুনিক জগতের জ্ঞান দ্বারা পূরণ করা যায় তাতে তাদের আস্থা নেই। অন্যান্য আরো সাহিত্য-কর্মীর মতো। মিস্টার ক্রাচ এই ধারণায় নির্ভর করে বলছেন যে, বিজ্ঞান তার প্রতিজ্ঞা পালন করেনি। এই প্রতিজ্ঞা কিসের তা অবশ্য তিনি বলেননি। কিন্তু তিনি মনে হয় ভাবেন ষাট বছর আগে ডারউইন। ও হাক্সলি বিজ্ঞান থেকে এমন কিছু আশা করেছিলেন, যা বিজ্ঞান দিতে পারে নি। আমার মনে হয় এর সবটুকুই ভুল এবং এই ভুল পোষণ করে এসেছেন সেই সব।
লেখক এবং যাজক, যারা চান না তাদের বিশেষ জ্ঞানকে কেউ তুচ্ছ মনে। করুক। এ কথা সত্যি যে বর্তমানের জগতে অনেক নৈরাশ্যবাদী রয়েছে। যখনই অনেক লোকের আয় কমে যায় তখনি নৈরাশ্যবাদের প্রকোপ দেখা যায়। একথা ঠিক যে মিস্টার ক্রাচ একজন আমেরিকান এবং মোট কথা আমেরিকানদের আয় যুদ্ধের কারণেই অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে বুদ্ধিজীবীরা খুবই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধ প্রত্যেকের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তার ভাব জাগিয়ে তুলেছে। একটা যুগের মানসিক গঠনে বিশ্বের গতি প্রকৃতি বিষয়ক মতবাদের তুলনায় এইসব সামাজিক কারণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ত্রয়োদশ শতক সবচেয়ে নৈরাশ্রময় যুগ। যে বিশ্বাসের অভাব নিয়ে মিঃ ক্রাচ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তা এয়োদশ শতকের নৈরাশ্যভরা সময়ে তৎকালীন সম্রাট এবং কয়েকজন ইতালিয়ান অভিজাত ব্যক্তি ছাড়া অন্য সবার মনে গেঁথে ছিল। মিঃ ক্রাচ বলেছেন কিছু মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যেই আধুনিক কালের মানুষের এই দুর্দশা, তা কিন্তু সঠিক নয়। রজার বেকন(৭) বলেছেন, “যে কোনও অতীত যুগের তুলনায় বর্তমান পাপ বেশি মাত্রায় রাজত্ব করছে এবং পাপ ও জ্ঞান বিপরীতধর্মী। যদি বিশ্বের সমগ্র অবস্থা দেখি এবং সব জায়গায় তার রূপ কী দাঁড়িয়েছে তা বিবেচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব দুর্নীতি সর্বকালের সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং তা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে শীর্ষমহলে। … লাম্পট্য রাজ দরবারকে কলুষিত করেছে এবং ঔদারিকতা সবার মনিব সেজে বসেছে…। সমাজের শীর্ষস্তরে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে নিচের দিকের অবস্থা কী? গীর্জার প্রভুদের দেখুন, কীভাবে তারা আত্মাকে উদ্ধার করার চেয়ে অর্থের পিছনে ছুটছেন। …তারপর ধর্মীয় গোষ্ঠীদের দেখা যাক, যা বলতে যাচ্ছি তা থেকে কেউ বাদ যাবে না। দেখুন তাদের কী পরিমাণ অধঃপতন হয়েছে কেউ এ থেকে বাদ নেই, নতুন গোষ্ঠী (ফ্রায়ারগণ) নিজেদের উচ্চ মর্যাদাবোধ থেকে ভয়ানকভাবে নিচে নেমে গেছে। যাজকশ্রেণী এখন অহংকার, লাম্পট্য এবং লালসাগ্রস্ত। এবং যেখানেই যাজক-সহকারীরা একসাথে ছুটেছে, প্যারিসে হোক বা অক্সফোর্ডে, সেখানেই তারা কলহ, মারামারি এবং আরো সব কুকর্ম দ্বারা জনগণকে কলংকিত করেছে। …প্রত্যেকে যদি লালসা চরিতার্থ করতে পারে, তবে কী হচ্ছে, কেমন করে হচ্ছে, কোন্ কৌশলে হচ্ছে, কিছুই আসে যায় না। প্রাচীন যুগের পৌত্তলিক পণ্ডিতদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, তাঁদের জীবন আমাদের চেয়ে এত বেশি ভাল ছিল যে, দুয়ের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না। যেমন ভাল ছিল শালীনতায় এবং বিশ্বকে নিন্দা করার ব্যাপারে, তার সব আনন্দ, ঐশ্বৰ্য্য এবং মর্যাদা নিয়ে। এসব জানা যাবে অ্যারিস্টটল,সেনেকা, টুলি, অভিসেনা, আলফারারিয়াস, প্লেটো, সক্রেটিস এবং অন্যান্যদের লেখা থেকে। এইভাবে তারা জ্ঞানের রহস্যে পৌঁছেছিলেন এবং তার রহস্য ভেদ করেছিলেন।”(৮) রাজার বেকনের অভিমত হচ্ছে, তাঁর সমকালীন সাহিত্যসেবীদের কেউ তাঁর মতো নিজের যুগকে পছন্দ করেননি। এসবের মুলে কোনও দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে আমি তা মূহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করি না। বাস্তব অর্থে এর মূলে আছে যুদ্ধ, দারিদ্র এবং সন্ত্রাস।