যেসব বিষয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছি তাতে সমর্পণ অত্যন্ত কঠিন। অন্য অনেক বিষয় আছে যাতে তা সহজ। এই বিষয়গুলি হচ্ছে যেখানে শুধু গৌণ উদ্দেশ্যগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু জীবনের প্রধান লক্ষ্যসমূহের সাফল্যের সম্ভাবনা বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনও লোক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও দাম্পত্য জীবনে অসুখী হওয়ার জন্যে মন বিক্ষিপ্ত থাকে, তা হলে তার পক্ষে বাঞ্ছিত সমর্পণ মেনে নিতে ব্যর্থতা দেখা দেবে। যদি তার কাজ সত্যি মন ভরে রাখার মতো হয়, তাহলে তার উচিত এই ধরনের সব আপতিক বাধাকে বৃষ্টির দিনের মতোই বিরক্তিকর মনে করা, কারণ এইরকম বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া বোকামি।
কোনও কোনও লোক ধৈর্যের সাথে সেইসব অসুবিধা সহ্য করতে পারে না, যা বাধা না পেলে আমাদের জীবনের একটা বড় অংশকে দখল করে রাখে। এরকম লোক গাড়ি ধরতে না পারলে ক্ষেপে যায় নৈশাহারের রান্না খারাপ হলে প্রচণ্ড রেগে যায়, চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হলে হতাশায় ডুবে যায়, পোশাক পরিচ্ছদ সময়মত স্টীমলড্রি থেকে ফিরে না আসলে সমস্ত শিল্প জগতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করে বসে। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে যে শক্তি নষ্ট হয়, তা যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগাতে পারলে একটা সাম্রাজ্য গড়া এবং ভাঙ্গার জন্যে যথেষ্ট। গৃহ পরিচারিকা যে ধুলা পরিষ্কার করেনি, রন্ধনকারী যে আলু সিদ্ধ করেনি, ঝাড়ুদার যে ঠিকমত ঝুল ঝাড়েনি বুদ্ধিমান লোক তা দেখেও দেখেন না। আমি বলতে চাই না যে তিনি এর প্রতিবিধান করেন না, সময় পেলে অবশ্যই করেন। আমি বলতে চাই যে, তিনি এসব আবেগ বর্জন করে করেন। উদ্বেগ, বিরক্তি ও উত্তেজনা এসব হল আবেগ যা কোনও উদ্দেশ্যই সিদ্ধ করে না। এসব যিনি প্রবলভাবে অনুভব করেন, তিনি হয়তো বলবেন, এসব আবেগ দমন করতে তিনি অপারগ এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, পূর্বে উল্লেখিত মৌলিক সমর্পণের চেয়ে অন্যকোনও কম প্রয়োজনীয় কিছুতে তাকে দমন করা যেতে না পারে। বড় নৈর্ব্যক্তিক আশা যা মানুষকে তার কাজে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা অথবা দাম্পত্য জীবনের দুঃখকে সহ্য করতে সক্ষম করে, তার সম্বন্ধে সেই একই প্রকার মনোযোগ তাকে গাড়ি ধরতে না পারার বা কাদায় ছাতা পড়ে যাওয়ার দুঃখেও ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেবে। তিনি যদি বদমেজাজি হন, তা হলে এর চেয়ে কম কিছুতে তার রোগ সারবে কিনা বলা কঠিন।
যে মানুষ সারাক্ষণ উত্তেজিত থাকেন, তাকে যদি উদ্বেগের সাম্রাজ্য থেকে উদ্ধার করা যায়, তাহলে তিনি জীবনকে অনেক বেশি আনন্দময় বলে নতুন করে খুঁজে পাবেন। পরিচিত বক্তিদের নিজস্ব যেসব আচরণ-বৈশিষ্ট্য এতকাল তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলত, এখন তার কাছে তা কৌতুকপ্রদ মনে হয়। যখন মিস্টার এ, তার টিয়েরা ডেল ফিউয়েগোর বিশপের পুরানো সত্য কাহিনীটি তিনশ সাতান্ন বার বিবৃত করা শেষ করবেন, তখন আর রেগে না গিয়ে শুধু কবার বলা হল তার সংখ্যা গুনে মজা পাবেন এবং পূর্বের মতো নিজের জানা কোনও কাহিনী বলার চেষ্টা করে বিষয় পরিবর্তনের বৃথা চেষ্টা করবেন না। যখন ভোরের গাড়ি ধরার তাড়ার সময় তার জুতোর ফিতে ছিঁড়ে যায়, তখন তা ঠিক করে নিয়ে তিনি ভাববেন এই বিপুলা পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনার বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই। যখন তিনি বিয়ের প্রস্তাবকালীন বিরক্তিকর কোন প্রতিবেশির আগমনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি ভাবেন মানুষমাত্রই এই ধরনের বিপত্তির সীমা নেই, যা আসে অদ্ভুত এবং বিচিত্র সাদৃশ্য এবং সমান্তরাল ঘটনা থেকে। আমার ধারণা প্রত্যেক নরনারীর মনে নিজের সম্পর্কে একটা ছবি তৈরী হয়ে আছে এবং যদি কোনও ঘটনা সেইসব নষ্ট করে তারা বিরক্ত হয়। এই বিরক্তি থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে শুধু একটি ছবি নয়, একটি পুরো চিত্রশালা তৈরী করে রাখা যাতে প্রয়োজনে যে ঘটনা উল্লেখ করা হল, তার উপযুক্ত একটিকে নির্বাচন করা যায়। যদি কোনও ছবি হাস্যকর মনে হয়, তবে আরো ভাল। নিজেকে সবসময় বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো দেখা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়, নিজেকে সর্বক্ষণ কৌতুক নাটকের বিদূষক রূপে দেখার কথাও আমি বলছি না, কারণ যারা এমন করে তারা আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। অবস্থানুযায়ী উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে সামান্য কৌশল প্রয়োজন। অবশ্য যদি নিজেকে বিস্মৃত হয়ে আদৌ কোনও ভূমিকা গ্রহণ না করা হয় সেটা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু কোনও ভূমিকায় অভিনয় করা যদি দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে মনে করতে হবে স্থায়ী অভিনয়কারী কোনও নাট্যদলের অভিনেতারূপে এবং তাতেই একঘেয়েমিকে এড়ানো যাবে।
অনেক সক্রিয় লোকের মত হল, তাঁরা যে কর্মশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্পের সাহায্যে সফল হন বলে মনে করেন, সেখানে তা বিন্দুমাত্র সমর্পণ এবং হাস্যরসের সামান্য ঝলকও তা নষ্ট করে দিতে পারে, এটা তাদের বিশ্বাস। এসব লোকেরা আমার মতে ভ্রান্ত। কাজের মূল্য আছে এমন কাজ তাঁরাও করতে পারেন, যারা কাজের গুরুত্ব অথবা সহজ-সাধ্যতার ধারণা নিয়ে আত্মপ্রতারণা করেন না। যারা শুধু আত্মপ্রতারণার সমর্থন পেলেই কাজ করতে পারেন, তাদের উচিত পেশাগত কাজ শুরু করার আগে সত্যকে সহ্য করার শিক্ষা আয়ত্ত করা। কারণ এখন না হয় পরে কোনও সময়, এই যে অবাস্তব ধারণার কারণে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা, তা তাদের কাজকে হিতকর না করে ক্ষতিকর করবে। ক্ষতি করার তুলনায় কিছু না করা ভাল। পৃথিবীর অর্ধেক প্রয়োজনীয় কাজ শুধু ক্ষতিকর কাজের সাথে যুদ্ধ করতেই নষ্ট হয়। বাস্তবের মূল্য বুঝতে কিছু সময় নষ্ট হলে প্রকৃতপক্ষে তা নষ্ট হয় এবং এরপর যে কাজ করা হবে তা যাদের কাজে বিরামহীন অহমিকার প্রেরণার প্রয়োজন হয় তার চেয়ে কম ক্ষতিকর। নিজের সম্পর্কে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছার সাথে এক ধরণের সমর্পণ বা ভাগ্যবরণ জড়িয়ে আছে। এই ধরনের যদিও প্রথমদিকে কিছু বেদনা থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং সম্ভাব্য একমাত্র রক্ষাকবচ। যা আত্মপ্রতারকদের নৈরাশ্য এবং মোহমুক্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। যা প্রতিদিন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তাকে বিশ্বাস করার মতো ক্লান্তিকর এবং শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তার মতো চরম বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না। এইরকম প্রচেষ্টা থেকে মুক্ত হওয়াই হল নিরাপদ এবং স্থায়ী সুখের অপরিহার্য শর্ত।
১৭. সুখী মানুষ
একথায় কোনও দ্বিধা নেই যে, সুখের কিছু অংশ বাইরের ঘটনাবলী এবং কিছু অংশ নিজের ওপর নির্ভরশীল। এই বইতে আমি যে অংশ আমাদের নিজের ওপর নির্ভরশীল তা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং তার ফলে, এই মতে উপনীত হয়েছি যে, এই অংশ সম্পর্কিত যে সমস্যা তার সমাধানের ব্যবস্থাপত্র অত্যন্ত সহজ। অনেকে মনে করেন, যার মধ্যে আমরা অবশ্যই মিস্টার ক্রাচকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, যার কথা আমরা পূর্বের কোনও অধ্যায়ে তুলে ধরেছি, কোনও না কোনও ধর্মবিশ্বাস ছাড়া সুখ অসম্ভব। অনেকে মনে করেন, যারা নিজেরা অসুখী, তাদের দুঃখের কারণ খুব জটিল এবং উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিসূত্রজাত। আমি বিশ্বাস করি না এসব জিনিস সুখের অথবা দুঃখের কারণ হতে পারে। আমার মনে হয় সেসব শুধুই লক্ষ্মণ। যে ব্যক্তি অসুখী তিনি সাধারণত এমন এক ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী হবেন যা দুঃখের, পক্ষান্তরে যিনি সুখী তিনি সুখের কোনও ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবেন। প্রত্যেকেই তাদের সুখের এবং দুঃখের জন্যে দায়ী করেন তাঁদের বিশ্বাসকে। কিন্তু আসলে কার্যকারণ ঠিক এর বিপরীত। কিছু জিনিস অধিকাংশ লোকের সুখের জন্যে অপরিহার্য। কিন্তু এসব খুব সহজ জিনিস : খাদ্য এবং বাসস্থান, স্বাস্থ্য, ভালবাসা, সফল কাজ এবং নিজেদের সমাজের শ্রদ্ধা, কারো কারো কাছে সন্তানলাভও প্রয়োজন। যেখানে এসবের অভাব সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রমী ব্যক্তি সুখ পেতে পারেন। কিন্তু যেখানে এসবের ভোগ করা যাবে অথবা সুপরিচালিত প্রচেষ্টায় পাওয়া সম্ভব, সেখানেও যদি মানুষ অসুখী থাকে তবে বুঝতে হবে তিনি কোনও মনস্তাত্ত্বিক সমন্বয়হীনতায় ভুগছেন এবং তা যদি খুব গভীর হয় তাহলে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তা যদি সাধারণ হয়, তবে সঠিক পথ অনুসরণ করলে রোগী নিজেই তা সারাতে পারবেন। যদি বাইরের ঘটনাবলী নিশ্চিতভাবে দুর্ভাগ্যজনক না হয়, সেখানে সুখকে লাভ করা সম্ভব, যদি না তার প্রবৃত্তি এবং আকর্ষণ অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী হয়। সুতরাং শিক্ষা এবং পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকা উচিত আমাদের যাতে আমরা আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাকে এড়িয়ে যেতে পারি এবং সেই ভালবাসা এবং সেই আকর্ষণকে অর্জন করতে পারি যা আমাদের অবিরাম নিজের বিষয়ে ভাবনাকে দূরে রাখতে পারে। কোনও মানুষই কারাগারে থাকার সময় সুখী হয় না এবং সেসব প্রবৃত্তি যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই বন্দী করে রাখে, তা যে কোনও খারাপ কারাগারের সমতুল্য। এইসব প্রবৃত্তির মধ্যে কিছু কিছু খুবই সাধারণ। যেমন ভয়, ঈর্ষা, পাপের চেতনা, আত্মকরুণা এবং আত্মপ্রশংসা। এর সবগুলিতেই আমাদের কামনা নিজেকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত হয়, যার অর্থ বাইরের পৃথিবী নিয়ে যথার্থ কোনও আকর্ষণ থাকে না, থাকে শুধু দুশ্চিন্তা। যদি এটি আমাদের কোনও ক্ষতি করে অথবা আমাদের অহংবোধ অতৃপ্ত রাখে। ভয় হচ্ছে প্রধান কারণ যার জন্যে মানুষ সত্যকে স্বীকার করতে চায় না এবং কল্পলোকের মিথ্যার আরামদায়ক আবরণে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু যে কাঁটা এসে সেই আবরণ ছিঁড়ে দেয় এবং সেই ছেঁড়া জায়গা দিয়ে ঠাণ্ডা ঝাঁপটা গায়ে লাগে এবং যে মানুষ এ ধরনের আরামে অভ্যস্ত সে অনেক বেশি কষ্ট পায় তার তুলনায় যে মানুষ প্রথম থেকে নিজেকে এসব বিষয়ে সইয়ে নিয়েছে। তার ওপর যারা নিজেদের প্রতারণা করে, তারা মনে মনে জানে তারা। কি করছে এবং তারা সবসময় একটা আতঙ্কে থাকে। যদি কোনও বিরূপ ঘটনায় তারা অনভিপ্রেত সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।