পাশ্চাত্যের দেশসমূহে অনেক মানুষের সুখের জন্যে যা প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু অতিরিক্ত অর্থের চাহিদা থাকে। কারণ তা তাদের কাছে সাফল্যের অনুভূতি তৈরী করে। কোনও কোনও পেশায় যেমন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই অনুভূতি বেশি উপার্জনশীল নয় এমন লোকের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ পেশায় উপার্জনের পরিমাণকে সাফল্যের মানদণ্ডরূপে ধরা হয়। এইখানে আমরা এমন একটি প্রসঙ্গকে স্পর্শ করেছি যার সম্পর্কে প্রায় ক্ষেত্রেই কিছু সমর্পণের উপাদান বাঞ্ছনীয়। কারণ এই প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে বড় ধরনের সাফল্য শুধু অল্পসংখ্যক লোকের পক্ষেই মাত্র সম্ভব।
বিবাহ এমন একটা বিষয় যার সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতেও পারে অথবা নাও হতে পারে। যেখানে একটি লিঙ্গ যদি সংখ্যালঘু হয়, যেমন ইংল্যান্ডে পুরুষ এবং অষ্ট্রেলিয়ায় নারী, তা হলে সেই সংখ্যালঘুদের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই কম প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। আর যে লিঙ্গের সদস্যরা সংখ্যাগুরু তাদের বেলায় বিপরীতটাই সত্যি। মেয়েরা সংখ্যাগুরু হলে তারা যে পরিমাণ প্রচেষ্টা ও চিন্তা এই বিষয়ে ব্যয় করে, তা নারী বিষয়ক সাময়িকীতে যেসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় তা চর্চা করলেই সহজে বোঝা যাবে। যেখানে পুরুষরা সংখ্যাগুরু সেখানে তারা প্রায়ই খুব তাড়াতাড়ি কাজ হয় এমন পথ খুঁজে নেয় যেমন রিভলবার চালনায় দক্ষতা। এটা খুব স্বাভাবিক, কারণ সংখ্যাগুরু পুরুষরা এখন সভ্যতার প্রান্তসীমায় রয়ে গেছে। যদি কোনও মহামারী পক্ষপাতিত্ব করে ইংল্যান্ডের পুরুষদের সংখ্যাগুরুতে পরিণত করে, তাহলে তারা কী করবে জানি না, হয়তো তারা প্রাচীন প্রেমিক বীরদের পথ অবলম্বন করবে।
সন্তানদের যথার্থভাবে মানুষ করে তুলতে যে পরিমাণ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় তা এমনই সুস্পষ্ট যে কেউ তা অস্বীকার করবে না। যেসব দেশ সমর্পণে বিশ্বাসী এবং যাকে ভুল করে জীবনের প্রতি আধ্যাত্মিক দর্শন বলা হয়ে থাকে, যেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার খুব বেশি, ওষুধ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, নির্বীজকরণ, উপযুক্ত পথ্য এইসব জিনিস পার্থিব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পাওয়া যায় না। এসব লাভ করতে হলে প্রয়োজন বস্তুগত পরিবেশের দিকে শক্তি ও বুদ্ধিচালনা। যারা মনে করে বস্তুমাত্রই মায়া, তারা আবর্জনাকেও তাই মনে করে এবং এভাবে চিন্তা করতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর কারণ ঘটায়।
আরো সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যাদের স্বাভাবিক বাসনা পুষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায়নি, তাদের প্রত্যেকের স্বাভাবিক এবং ন্যায্য উদ্দেশ্যের মূলে রয়েছে কোনও শক্তি। মানুষ কোন শক্তিটি কামনা করবে তা নির্ভর করে তার সবচেয়ে প্রাধান্যকারী আসক্তির ওপর। কোনও মানুষ শক্তি কামনা করে অন্য মানুষের কাজের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে। আরেকজন কামনা করে অন্যের চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে, তৃতীয়জনের কামনা অন্যের আবেগের ওপর। একজন চাইছে বস্তুগত পরিবেশকে পরিবর্তন করতে, অন্যজনের কামনা বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ। জনকল্যাণকর প্রতিটি কাজের সাথে কোনও একটি মুক্তির কামনা বিজড়িত, যদি না এই উদ্দেশ্য সামলে রেখে দুর্নীতির সাহায্যে অর্থলাভ করা একমাত্র লক্ষ্য না হয়, তা হলে এই কথা সত্যি যে লোকটি মানুষের দুর্দশার অকৃত্রিম মানবতাবোধ জাত বেদনা থেকে কর্ম প্রেরণা লাভ করছে, তার দুঃখবোধ যদি বিশুদ্ধ হয়, তা হলে সে মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্যে ক্ষমতা কামনা করবে। একমাত্র যে মানুষ ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন সে তার সহমানুষ সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ উদাসীন। সুতরাং যেসব মানুষের সহযোগিতায় উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে, তাদের কর্মপদ্ধতির ভিতর কোনও কোনও ধরনের ক্ষমতার জন্যে কামনা থাকবেই এবং এটাকে স্বীকার করে নিতে হবে। ক্ষমতা কামনার প্রত্যেকটি ধরণ যেখানে জড়িত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ব্যর্থ হয়, তা হবে পারস্পরিক সমন্বয়ের একটি প্রচেষ্টা। পাশ্চাত্য দেশের মানসিকতায় এই উপসংহার খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্যে এমন লোকেরও অভাব নেই যারা ভান করছে, যাকে বলা হয় প্রাচ্যবিজ্ঞতা’ তা পাওয়ার জন্যে যে মুহূর্তে প্রাচ্যই তা পরিত্যাগ করেছে। সম্ভবত তাদের কাছে আমরা যা বলছি তা সন্দেহমুক্ত নয় এবং তাই যদি হয় তা হলে আমাদের বলাটা যথার্থ।
সুখের অধিকার অর্জনে সমর্পণেরও একটা ভূমিকা আছে। প্রচেষ্টার ভূমিকার চেয়ে তার গুরুত্ব কম নয়। বুদ্ধিমান লোক পরিহারক দুর্ভাগ্যের সামনে বসে না থাকলেও অবধারিত দুর্ভাগ্য এড়াতে সময় এবং আবেগ নষ্ট করবে না এবং যেসব দুর্ভাগ্য নিজে থেকেই পরিহারযোগ্য, তা পরিহার করতে যদি আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে নির্ধারিত সময় নষ্ট হয়, তা হলে তা পরিহার না করে বরং তা সহ্য করে যাবে। এমন অনেক লোক আছে যারা পছন্দ না হলে প্রত্যেকটি তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঝামেলা করে এবং যে শক্তি প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো যেত তা এইভাবে নষ্ট করে। এমনকী কাজ অত্যন্ত ব্যর্থতার চিন্তা সবসময় মনের শান্তিকে বিনষ্ট করতে থাকে। খ্রিস্টান ধর্ম ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে অর্পণ করার কথা বলেছে। এমনকী যারা এই বাগ-বৈশিষ্ট্য মেনে নিতে পারে না তাদের জন্যেও তাদের সবরকম কাজকে ব্যাপ্ত করে ঐরকম কিছু থাকা উচিত। কোনও ব্যবহারিক কাজে যে কর্মদক্ষতা প্রয়োজন তার অনুপাত, যে পরিমাণ আবেগ তাতে দেওয়া হয় তার সমান নয়। প্রকৃতপক্ষে আবেগ অনেক সময় কর্ম দক্ষতার প্রতিবন্ধক। যে মনোভাব দরকার তা হল নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করব কিন্তু ফল ছেড়ে দেব ভাগ্যের হাতে। সমর্পণ বা ভাগ্য বরণ দুরকমের একটির মূলে হতাশা, অন্যটির মূলে অদম্য আশা। প্রথমটি খারাপ, দ্বিতীয়টি ভাল। চরমভাবে পরাজিত হয়ে যে লোক বড় কিছু লাভ করার আশা পরিত্যাগ করেছে সে হতাশাজনিত সমর্পণ শিখতে পারে এবং যদি সে তা করে তাহলে সে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে দেবে। যে তার হতাশাকে ধর্মীয় নীতিকথায় ঢেকে রাখতে পারে অথবা তার হতাশাকে, তত্ত্বভাবনাই মানুষের যথার্থ লক্ষ্য–এই নীতির ছদ্মবেশে আড়াল করতে পারে। কিন্তু সে তার অন্তর্হিত পরাজয়কে যেভাবেই আড়াল করুক সে সাধারণভাবে অনুপযুক্ত এবং নীতিগতভাবে অসুখী হয়ে থাকবে। যে মানুষের সমর্পণ অদম্য আশার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার কর্মধারা আলাদা। যে আশা অপরাজেয় তাকে বৃহৎ এবং নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। আমার ব্যক্তিগত কার্যসূচি যাই হোক, আমি মৃত্যুর হাতে পরাজিত হতে পারি অথবা কোনও রোগের কাছে। আমার শত্রুরা আমাকে পরাস্ত করতে পারে। কাজ করতে গিয়ে হয়তো দেখা গেল এমন একটা অজ্ঞানতার পথে আমি এগিয়েছি যাতে সফল হতে পারব না। এইভাবে হাজার রকম উপায়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত আশার ব্যর্থতা অবধারিত হতে পারে কিন্তু যদি ব্যক্তিগত আশা, মানবজাতির কোনও বড় আশার অংশ হয়, তা হলে ব্যর্থ হলেও তাতে সম্পূর্ণ পরাজয়ের ভাব থাকবে না। যে বৈজ্ঞানিক নিজে কোনও বড় আবিষ্কারের কামনা করেন এবং বিষয়টির ওপর তার ব্যক্তিগত অবদান বড় না হয়, তা হলে নির্ভেজাল অহংভাবপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে যিনি গবেষণা করেন, তার নৈরাশ্যের তুলনায়, সম্পূর্ণ অন্যরকম হবে। বহু প্রয়োজনীয় কোনও সংস্কার সাধনের কাজ শেষ হল না এবং তিনি হয়তো এই কথাটি মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে, তার জীবদ্দশায় আর একাজ তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু যদি তার নিজের অংশগ্রহণ ছাড়াও মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আগ্রহ থাকে তাহলে তাঁর অসম্পূর্ণতার জন্যে পুরোপুরি নৈরাশ্যে ডুবে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।