প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য এবং উদ্দীপনা যে মানুষের আছে, সে প্রতি আঘাতের পর নতুন আকর্ষণের দ্বারা সব দুর্ভাগ্যকে লঙ্ঘন করে যাবে। তার কাছে পৃথিবী এত ছোট হয়ে যাবে না যাতে একটি মাত্র ক্ষতি ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। এক বা একের অধিক ক্ষতির কাছে হার মানা এমন ঘটনা নয় যা কোমলতার প্রমাণরূপে প্রশংসিত হতে পারে। বরং একে প্রাণপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা বলেই ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। আমাদের স্নেহ-মমতা-প্রেম মৃত্যুর দয়ার ওপর নির্ভরশীল আমাদের প্রিয়জনদের ওপর যে কোনও সময় চরম আঘাত হানতে পারে। তাই আমাদের জীবনে সেই সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়, যা আমাদের জীবনের সকল অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে দুর্ঘটনার অধীন করে রাখতে পারে।
এইসব কারণে যে মানুষ বুদ্ধিমত্তার সাথে সুখের অন্বেষণ করছে তার পক্ষে যেসব মূল আকর্ষণের ওপর তার জীবন গড়ে উঠেছে, তার বাইরেও আরো কিছু অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকা প্রয়োজন।
—-
১. স্পিনোজা, Benedict de Spinoza (১৬৩২-১৬৭৭)। জাতিতে ইহুদী, তার বাবা-মা ইনকুইজিসনের ভয়ে পর্তুগাল থেকে অভিবাসন নিয়ে নেদারল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন। যুক্তিবাদী মুক্ত দার্শনিক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ। তিনি সর্বেশ্বরবাদী অদ্বৈতবাদে (pantheistic Monist) বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এবং পৃথিবীর মধ্যে কোনও দ্বৈতবাদ থাকতে পারে না। পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদের নতুন তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। ‘Ethie’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
১৬. প্রচেষ্টা ও সমর্পণ
সুবৰ্ণ মধ্যম মতবাদ হিসাবে চিত্তাকর্ষক নয়, আমি মনে করতে পারি, যখন আমি তরুণ ছিলাম ঘৃণা এবং অবজ্ঞার সাথে এই মত বর্জন করেছিলাম, কারণ সেসব দিনে বীরোচিত চরম কিছুই ছিল আমার কাছে বরণযোগ্য। যা হোক সত্য সবসময় উৎসাহব্যঞ্জক হয় না এবং যে সব জিনিসকে বিশ্বাস করা হয় উৎসাহব্যঞ্জক বলে, বাস্তবে তাদের অনুকূলে তেমন কিছু প্রমাণ মেলে না। সুবর্ণ মধ্যম যে অনুৎসাহব্যঞ্জক মতবাদ এটা হয়তো একটি উদাহরণ, কিন্তু অনেক বড় ব্যাপারে এটা সত্য নীতি।
একদিকে প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সমর্পণ– এই দুইয়ের ভারসাম্য রাখতে সুবর্ণ মধ্যমকে প্রয়োজনীয় বলে গ্রহণ করতে হবে। এই দুটি নীতিরই চরম সমর্থকরা রয়েছেন। সমর্পণ বা ভাগ্যকে বরণ করার নীতি প্রচার করেছেন সাধুপুরুষ ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা। আর প্রচেষ্টা বা উদ্যমশীলতার নীতি প্রচার করেছেন দক্ষ কুশলী এবং পৌরুষদীপ্ত খ্রিস্টানেরা। এই দুই বিপরীত মতের প্রবক্তাদের নীতিতে খণ্ডিত সত্য আছে, পুরো সত্য নেই। আমি এই অধ্যায়ে একটা ভারসাম্য আনয়নের চেষ্টা করব এবং প্রচেষ্টার পক্ষকে সমর্থন করে শুরুটা করব।
সুখ, কয়েকটি দুর্লভ ক্ষেত্র ছাড়া, এমন জিনিস নয় যা শুধুমাত্র শুভ ঘটনার যোগাযোগ ছাড়া পাকা ফলের মতো মুখে এসে পড়বে। আর এই কারণেই আমি এই বইয়ের নাম রেখেছি সুখের সন্ধানে’। কারণ পরিহারযোগ্য এবং অপরিহানীয় দুর্ভাগ্যে, রোগ এবং মানসিক জটিলতায়, সংগ্রাম এবং দারিদ্র্যে এবং বিদ্বেষে ভরা, এই পৃথিবীতে যে পুরুষ ও নারী সুখী হতে চায়, তাকে প্রত্যেক মানুষ যে অসংখ্য রকম পথে সুখ খুঁজে বেড়ায় তার জন্যে সংগ্রাম করে যেতে হবে। খুব কমক্ষেত্রেই এর জন্যে বড় রকমের উদ্যোগ প্রয়োজন হতে পারে। সহজ স্বভাবের লোক, যে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ অর্জন করেছে, যার স্বাস্থ্য ভাল, রুচি উন্নত, সে জীবনকে খুব আরামের সাথে উপভোগ করতে পারে এবং চারপাশের জীবনসংগ্রামের গোলমা দেখে অবাক হয়ে তার কারণ খুঁজে বেড়ায়। সুন্দরী আরামপ্রিয় রমণী যদি এমন কোন ধনবান পতিকে বরণ করে, যে তার কাছে কোনও আয়াসসাধ্য কাজ চাইবে না এবং বিয়ের পর যদি চর্বি বৃদ্ধিতে কোনও আপত্তি না করে, তাহলে সেও এক ধরনের অলস আরাম উপভোগ করবে, যদি অবশ্য তার সন্তানের বিষয়ে সৌভাগ্য থাকে। অধিকাংশ লোক ধনী নয়, অনেক ভাল স্বভাব নিয়ে জন্মায় না, অনেকের অস্বস্তিজনক সব প্রবৃত্তি থাকে, তার কাছে শান্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত জীবন অসহনীয় রকমের একঘেয়ে মনে হয়। স্বাস্থ্য হচ্ছে আশীর্বাদ কিন্তু তা রক্ষা করা যাবেই এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। বিয়ে অবধারিতভাবে পরম সুখের উৎস নয়। এইসব কারণে অধিকাংশ নারী-পুরুষের জন্যে সুখ অবশ্যই একটি সফল অর্জন। দেবতার দান নয় এবং এই অর্জনে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী উভয়েরই প্রচেষ্টা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্মুখী প্রচেষ্টার মধ্যে সমর্পণের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তাই আপাতত আমরা বহির্মুখী প্রচেষ্টার কথা বিবেচনা করেছি।
যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রে, পুরুষ অথবা নারী, যাদের জীবিকার জন্যে কাজ করতে হয় তাদের এ সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন এমনই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে তার ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা সত্য যে ভারতীয় ভিক্ষুকরা বিনা প্রচেষ্টায় ধর্মভীরু মানুষের সামনে শুধু ভিক্ষাপাত্রটি এগিয়ে দিয়েই জীবিকার সংস্থান করতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশসমূহে শাসক-কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উপার্জনকে ভাল দৃষ্টিতে দেখে না। তা ছাড়া এই কাজটিকে উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুর দেশে যেমন আরাম দেয়, সেসব দেশে তা নয়। শীতকালে, যে কোনওভাবে খুব কম লোক পাওয়া যাবে যারা গরম ঘরের কাজ ফেলে বাইরে অলসভাবে ঘুরে বেড়াবে। সুতরাং পশ্চিমী দেশে শুধু সমর্পণ সৌভাগ্যের অনেক পথের মধ্যে একটি নয়।