আমার ইচ্ছানুযায়ী যদি উচ্চশিক্ষা সংগঠনের ক্ষমতা থাকত আমি তাহলে প্রাচীন রক্ষণশীল ধর্মসমূহের, তরুণদের মনে যার আবেদন খুব কম এবং যেসব নীতি অনুযায়ী সবচেয়ে কম বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুর্বোধ্য ও সংস্কার বিরোধী, বদলে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতাম যাকে ঠিক ধর্ম বলা যায় না কারণ তা হত শুধু কিছু নির্ধারিত সত্যের প্রতি মনোসংযোগ করা। আমি চেষ্টা করতাম তরুণরা যাতে অতীতকে প্রাণবন্তরূপে জানতে পারে এবং স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে মানুষের ভবিষ্যৎ তার অতীত থেকে অনেক অনেক দীর্ঘ, যা পরিমাপের যোগ্য নয়। যাতে তারা গভীরভাবে বুঝতে পারে, যে গ্রহে আমরা জীবন কাটাচ্ছি তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং এই গ্রহে যে জীবনের আবির্ভাব হয়েছে তা একটি সাময়িক ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই সাথে আমি ঐ ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতাবোধের পাশাপাশি আরেক গুচ্ছ তথ্য তুলে ধরতাম, তরুণদের মনকে প্রভাবিত করতে যে মানুষ কত মহৎ হতে পারে, তার জ্ঞান কত অসীম হতে পারে। সমগ্র মহাবিশ্বে এমন কিছু নেই যা তার সমান মূল্য বহন করে। স্পিনোজা বহুকাল আগে মানুষের বন্ধন এবং মানুষের মুক্তির কথা বলে গেছেন। তার লেখার ধরণ এবং ভাষা এত কঠিন দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র ছাড়া অন্যদের পক্ষে সহজবোধ্য নয়। কিন্তু আমি যা বলতে চাই তার সারমর্ম, তিনি যা বলে গেছেন তার সাথে প্রায় অভিন্ন।
মানুষ একবার যদি বুঝতে পারে যত অস্থায়ী বা সংক্ষিপ্ত ভাবেই হোক, কিসে আত্মা মহান হয়, তা হলে সে আর নিজেকে ক্ষুদ্র এবং স্বার্থপর হতে দেবে না। তুচ্ছ দুর্ভাগ্যে বিচলিত বা ভবিষ্যতের ভাবনায় ভীত হতে দেবে না, যদি দেয় তাহলে কখনো সে আর সুখী হতে পারবে না। যে মানুষ আত্মার মহত্বে সক্ষম সে মনের বাতায়ন সম্পূর্ণ খুলে দেবে, যাতে সেই পথ বেয়ে বিশ্বের সর্ব অংশ হতে মুক্ত সমীর প্রবাহিত হতে পারে। সে তখন নিজেকে এবং জীবনকে এবং জগৎকে মানুষের সীমার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সত্যরূপে দেখতে পাবে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং অণু প্রমাণ, এ কথা বুঝতে পেরে সে অনুভব করতে পারবে, পরিচিত এই বিশ্ব, মূল্যবান যা কিছুই ধারণ করুক তা প্রতিটি মানুষের মনে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এবং সে দেখবে যে মানুষের মনের দর্পণে বিশ্ব প্রতিবিম্বিত, সে এক অর্থে বিশ্বের মতোই বৃহৎ। যে মানুষ অবস্থার দাস তার মনকে যেসব ভয় তাড়িত করে তা থেকে বেরিয়ে এসে সে এক গভীর আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করবে এবং তার বাইরের জীবনের সকল ভাগ্য পরিবর্তনের মধ্যেও সুখী মানুষ বলে আনন্দের গভীরে ডুবে থাকবে।
এইসব বড় বড় দূর কল্পনা ছেড়ে আমরা যে অব্যবহিত প্রসঙ্গে কথা উত্থাপন করেছিলাম, সেখানে ফিরে যেতে পারি যেমন নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণের কথায়। অন্য একটা দিক থেকে এইসব আকর্ষণ সুখের পথে সাহায্য করতে পারে। খুব সৌভাগ্যের জীবনেও অনেক সময় দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। খুব কম মানুষ আছে, অবিবাহিতরা ছাড়া যে নিজের স্ত্রীর সাথে কখনো ঝগড়া করেনি, খুব কম বাবা-মা আছে যারা নিজেদের সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়নি, খুব কম ব্যবসায়ী আছে যারা আর্থিক সংকট এড়াবার চেষ্টা করেনি, খুব কম পেশাদার ব্যক্তি আছে যারা কখনো ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়নি। এইরকম সময়ে উদ্বেগের বাইরে অন্য কিছুতে উৎসাহী হওয়া বিরাট মঙ্গল। এই সময়ে উদ্বেগ সত্ত্বেও যখন করার মতো কিছু থাকে না, তখন কেউ দাবা খেলে, কেউ গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে, কেউ জনপ্রিয় জ্যোতির্বিদ্যায় ডুবে থাকে। অন্য একজন হয়তো ক্যালডি’র উর নামক স্থানের পুরাতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে বই পড়ে সান্ত্বনা পায়। এই চারজনের প্রত্যেকেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। বরং যে লোকটি মনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কিছুই করেনি এবং তার কষ্টকে তার ওপর প্রভুত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেনি। এবং প্রয়োজনে নিজেকে যখন সময় আসবে, বিপদের মুখোমুখি হওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত করে তুলেছে। অত্যন্ত প্রিয়জনের মৃত্যুতে সান্ত্বনার বাইরে যে বেদনা তার সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে যে নিজেকে দুঃখের হাতে তুলে দেয় তার ভাল কিছু হয় না। দুঃখ অনিবার্য এবং তা আসবেই, তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা উচিত, তা কমানোর যত রকম পথ আছে অবলম্বন করা উচিত, কোনও কোনও লোক যেমন করে, বলা যায়, দুর্ভাগ্য থেকে দুর্দশার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে বের করে নিতে চায় তাকে শুধুমাত্র ভাবপ্রবলতা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আমি একথা অস্বীকার করি না যে কোনও মানুষ দুঃখে ভেঙ্গে পড়তে পারে, কিন্তু তবুও আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে এই ভাগ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে প্রত্যেকটি মানুষের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত এবং যে কোনও উপায়ে হোক, সে উপায় যত তুচ্ছ হোক, যদি তা নিজেই ক্ষতিকর অথবা মর্যাদাহানিকর না হয়। যে সব উপায় আমি ক্ষতিকর এবং মর্যাদাহানিকর মনে করি, তার মধ্যে আমি মাতলামি এবং মাদকাসক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করি। এদের উদ্দেশ্যই হল চিন্তার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া এর প্রতিকার নয়, প্রতিকার হচ্ছে নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত করা অন্তত যে কোনও মূল্যে বর্তমান দুর্ভাগ্যের কাছ থেকে দূরের কোনও খাতে প্রবাহিত করা। কিন্তু জীবন যদি সামান্য কটা জিনিসে সব আকর্ষণকে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং সেই সামান্য কটাও যদি দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব শক্ত। দুর্ভাগ্য এলে যদি তাকে বহন করতেই হয় তাহলে সুখের সময়ে আগেই আকর্ষণের বিষয়বৈচিত্র এবং সংখ্যার প্রসারণ করে নেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তাহলে যে মনের ভাব বর্তমানকে বহন করতে পারছে না, তার চেয়ে ভিন্ন মনোভাব এবং আলাদা আকর্ষণ যেখানে আছে সেই শান্তিপূর্ণ স্থানে যাওয়ার জন্যে মন প্রস্তুত থাকবে।