এমন অনেক আমোদ রয়েছে যা এইসব শর্ত পূরণ করতে পারে। খেলা দেখা, থিয়েটার দেখা, গলফ খেলা এই বিষয়ে অনিন্দনীয়। যার বই পড়ার নেশা আছে তার পক্ষে নিজের পেশা সম্পর্কিত বই বাদ দিয়ে অন্য বই পড়লে তৃপ্তিদায়ক হতে পারে। দুশ্চিন্তার কারণ যত জরুরী হোক সমস্ত দিন জেগে থাকার মুহূর্তে তা নিয়ে ভাবা উচিত নয়।
এই বিষয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সাধারণভাবে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় সহজে কাজ ভুলে থাকতে পারে। মেয়েদের কাজ যেহেতু গৃহের মধ্যে তাই তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক। কারণ তাদের কাজের স্থান পরিবর্তন হয় না, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তা নয়। অফিসের কাজের শেষে পুরুষেরা বাড়ি ফিরে মনকে নতুন করে তুলতে সাহায্য করে। যদি আমি ভুল না করে থাকি, তাহলে বলা যায়, যেসব মহিলার কাজ বাড়ির বাইরে তারা এ বিষয়ে পুরুষের চেয়ে প্রায় ততটুকু আলাদা, যতটুকু আলাদা যার বাড়িতে কাজ করে তারা। তাদের কাছে যেসব জিনিসের ব্যবহারিক মূল্য নেই, তাতে উৎসাহিত হওয়া বেশ শক্ত তাদের পক্ষে। তাদের উদ্দেশ্যেই তাদের ভাবনা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সম্পর্ক দায়িত্বহীন কোনও বিষয়ে তারা কখনো আগ্রহী হয় না। এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে সেকথা আমি অস্বীকার করি না, আমি শুধু সাধারণ নিয়মের কথা বলছি। মেয়েদের কলেজে যদি কোনও পুরুষ শিক্ষক না থাকে তাহলে মহিলা শিক্ষকরা সন্ধ্যায় বাজার করার গল্প করে। কিন্তু ছেলেদের কলেজে পুরুষ শিক্ষকরা তা করে না। এই বৈশিষ্ট্য মেয়েদের কাছে পুরুষদের তুলনায় অতিরিক্ত সচেতনতা বলে মনে হয়। কিন্তু আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এদের কাজের গুণগত মান কিছুমাত্রায় বাড়ে। বরং এতে দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং তা থেকে জন্ম নেয় রক্ষণশীলতার।
সবরকম নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণই মানসিক চাপ থেকে মুক্তির গুরুত্ব ছাড়াও অন্যভাবে কাজে লাগে। প্রথমেই বলতে হয়, তারা মানুষকে পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমরা পেশাগত কাজে, নিজেদের সমাজের পরিমণ্ডলে নিজেদের কাজের অনুরূপ কাজে ডুবে থাকি, যা এতই সহজ যে আমরা ভুলেই যাই যে সমগ্র মানবজাতির কাজের তুলনায় এই অংশটুকু কত ক্ষুদ্র। আমরা যা করি এই বিশ্বের কত শত জিনিস তার প্রভাবের বাইরে থাকে। কেন কোনও মানুষ তা মনে রাখবে? এর অনেকগুলি উত্তর আছে। প্রথমত প্রয়োজনীয় কাজের সাথে যতটুকু সংগতি রাখা যায় জগৎ সম্পর্কে ততটুকু আসল ধারণা অর্জন করা ভাল। ইহলোকে আমাদের অবস্থান বেশিদিনের জন্যে নয়। এই সময়ের মধ্যে এই অদ্ভুত গ্রহ এবং মহাবিশ্বে তার স্থান কোথায় তা নিয়ে যতটা সম্ভব জ্ঞানলাভ করতে হয়। আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ, তাই তা লাভ করার সুযোগকে অবহেলা করা আর থিয়েটারে গিয়ে নাটকের সংলাপ না শোনা একইরকম। এই বিশ্ব বহু বিয়োগান্ত অথবা মিলনান্তক, বীরোচিত অথবা উদ্ভট অথবা আশ্চর্যময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। যে মানুষের এইসব দৃশ্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই সে জীবনের একটি বড় সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।
তাছাড়া পরিমিতিবোধ থাকাটা খুব মূল্যবান এবং তা অনেক সময়েই অত্যন্ত সান্ত্বনা প্রদায়ক। আমরা পৃথিবীর যে ক্ষুদ্র কোণায় বাস করি এবং জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে যে ক্ষণ মুহূর্ত পাওয়া,তা নিয়ে অকারণ উত্তেজিত হওয়া, স্নায়ুকে পীড়িত করা এবং তাকে অযথা বাড়িয়ে দেখার দিকে আমাদের সকলেরই একটা প্রবণতা আছে। এই উত্তেজনা এবং নিজেদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণার মধ্যে এমন কিছু নেই যা বাঞ্ছনীয়। এটা সত্যি যে এই ভাবনা আমাদের আরো কঠিন পরিশ্রম করাতে পারে, কিন্তু তা আমাদের কাজের দক্ষতা বাড়াতে পারে না। খারাপ উদ্দেশ্যে অনেক বেশি কাজ, ভাল উদ্দেশ্যে অল্প কাজ অনেক ভাল। যদিও যারা জীবনে কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাসী তারা এর বিপরীতটাকেই সমর্থন করবেন। কাজ নিয়ে যারা অতিরিক্ত ব্যস্ত তাদের সবসময় অন্ধ গোঁড়ামিতে পড়ে যাওয়ার বিপদ থাকে, যার মূল কথা হচ্ছে সবকিছু ভুলে গিয়ে একটি বা দুটি মনের মতো বিষয় মনে রাখা আর এই একটি বা দুটি বিষয় অনুসরণ করতে পারলে আর যা থাকে তা থেকে যে ক্ষতি হতে পারে তাকে তুচ্ছ মনে করা। মানুষের বিরাট জীবন কল্পনা এবং এই পৃথিবীতে তার স্থান সম্পর্কে উদারতর ধারণা তৈরী করাই হচ্ছে এই ধরনের গোঁড়ামির বড় প্রতিষেধক। এই ব্যাপারে এমন বৃহৎ প্রসঙ্গ তুলে ধরা বড় কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু এই ছোট ব্যাপার না ধরলেও সেই বৃহৎ প্রসঙ্গটির নিজেরই একটি বড় মূল্য রয়েছে।
বর্তমান উচ্চশিক্ষার একটি গলদ এই যে, এতে কোনও একটি নির্ধারিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্যে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা আছে কিন্তু হৃদয় মন যাতে উদার হয়, তার জন্যে নিরপেক্ষ সমীক্ষায় পৃথিবীকে দেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ধরুন আপনি কোনও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত আছেন এবং নিজেদের দলের জয়লাভের জন্যে কঠিন পরিশ্রম করছেন, এই পর্যন্ত সবই ভাল, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলাকালীন এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যাতে সবার মনে ঘৃণা হিংসা এবং সন্দেহ বেড়ে যায়, এমন পথে গেলে জয়লাভের পথ কিছুটা সুগম হয়। যেমন, আপনি বুঝতে পারবেন জয়লাভের পথ অনেক সহজ হবে যদি কোনও বিদেশী জাতিকে অপমান করা যায়। আপনার মানসিক প্রসারতা যদি বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে অথবা যদি আপনি এই মতে দীক্ষা নিয়ে থাকেন যে যাকে কর্মদক্ষতা বলা হয় তা ছাড়া আর সব কিছু প্রয়োজনহীন, তা হলে আপনি এই ধরনের সন্দেহজনক পথ অবলম্বন করতে পারেন। এইভাবে আপনি আপনার তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে জয়লাভ করবেন, কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী ফল হবে মারাত্মক। যদি অন্যদিকে মানুষের অতীত যুগ, তার বর্বর অবস্থা থেকে ধীর এবং আংশিক উন্মেষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবে অকল্পনীয় কালের তুলনায় মানুষের সমগ্র অস্তিত্বের অতি-সংক্ষিপ্ততা– এইসব ধারণা আপনার মনের অভ্যস্ত অঙ্গ হয়, আমি বলি, যদি এই চিন্তাধারা আপনার সাধারণ অনুভূতিকে ছাঁচে তৈরী করে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, যে ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধে আপনি রত আছেন, তা এমন জরুরী নয়, যাতে আমরা যে অন্ধকার থেকে এত দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছি, তাহলে সেই ফেলে আসা পথে আবার এক ধাপ ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিকে স্বীকার করে নেওয়া। শুধু তাই নয়, যদি আপনি তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে পরাজিতও হন তাহলে তার ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে সেই একই বোধ আপনাকে হীন অস্ত্রধারণ করতে দেবে না। তাৎক্ষণিক সব কার্যকলাপকে অতিক্রম করে আপনার মনে উদিত হবে সেই লক্ষ্য যা অনেক দূরে এবং খুব ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, যেখানে পৌঁছানোর চেষ্টায় আপনি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ নন বরং মানজাতিকে যে বিশাল বাহিনী সভ্যতার অস্তিত্বময় জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, আপনি সেই বাহিনীরই একজন। আপনি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গী পেয়ে থাকেন, আপনার ব্যক্তিগত ভাগ্য যাই হোক এক গভীর সুখ কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবে না। সর্ব যুগের মহামানবদের সাথে আপনার আত্মিক বন্ধন তৈরী হবে এবং কোনও ব্যক্তির মৃত্যুকে মনে হবে একটি তুচ্ছ ঘটনা।