জীবনকে সামগ্রিকরূপে দেখার প্রবণতার মধ্যে মানুষে-মানুষে বিস্তর পার্থক্য। কিছু লোকের পক্ষে এরকম দেখা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং কিছু কাজ তৃপ্তির সাথে করতে পারলেও তা তাদের সুখের জন্যে প্রয়োজনীয়। আবার কিছু লোকের কাছে জীবন হল পরপর ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশ, তাদের নির্দিষ্ট কোনও গুগতি নেই, পরস্পরের মধ্যে কোনও ঐক্যসূত্রও নেই। আমার মনে হয়, প্রথমে যাদের কথা বললাম তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সুখলাভ করতে সক্ষম, কারণ তারাই ক্রমশ সেইরকম অবস্থা তৈরী করে নেবে যা থেকে তারা আনন্দ এবং আত্মসম্মান পেতে পারবে। অপরদিকে অন্যেরা, একবার এদিক, আরেকবার ওদিক করে বিশৃঙ্খল ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খাবে। কখনো কোনও বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে না। জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার অভ্যাস হল, জ্ঞান এবং বিশুদ্ধ নৈতিকতা– এই দুয়েরই অপরিহার্য অঙ্গ এবং আর যা প্রাধান্য পাওয়া উচিত, তা হল শিক্ষা। সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য জীবনকে সুখী করার জন্যে যথেষ্ট নয়। সুখী জীবনের জন্যে তাই হল অপরিহার্য অঙ্গ। আর সঙ্গতিপূর্ণ উদ্দেশ্য প্রধানত কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
১৫. নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ
যেসব বড় রকমের আকর্ষণকে ঘিরে মানুষের জীবন গড়ে উঠেছে এই অধ্যায়ে আমি তা নিয়ে আলোচনা না করে, ছোট রকমের আকর্ষণ যা তার অবসরকে ভরে রাখে এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে পূর্ব থেকেই নিয়োজিত তার চাপ থেকে মুক্ত করে, তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাধারণ লোকের জীবনে তার পত্নী, সন্তান, তার কাজ এবং আর্থিক অবস্থা এসব কিছু তার উদ্বেগ এবং গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার প্রধান অংশ দখল করে থাকে। এমনকী তার যদি বিবাহ-বহির্ভূত কোনও প্রেমের সম্পর্ক থাকে, তবু তার জন্যে মনে হয় ততটা গভীর দুশ্চিন্তা হয় না, যতটা হয় তার পারিবারিক জীবনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। যে আকর্ষণ তাকে কাজের সাথে জড়িত করেছে, তাকে আমি আপাতত নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ বলতে চাই না। যেমন একজন বিজ্ঞানসেবীকে তার বিষয় সংক্রান্ত সব ধরনের গবেষণার সাথে সমতা রেখে চলতেই হয়। এই ধরনের গবেষণায় তার মনোভাবে যে উদ্দীপনা এবং প্রাণশক্তি দেখা যায় তা তার বৃত্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত আন্তরিকতা। কিন্তু যদি তিনি তাঁর বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন বিজ্ঞানের অন্য কোনও শাখার গবেষণার কথা পড়েন, তাহলে তিনি তা পড়বেন ভিন্ন ধরনের আগ্রহ নিয়ে। বৃত্তিগত মন নিয়ে নয়, নিবিড়ভাবেও নয় এবং আরো আকর্ষণীয়ভাবে। সেখানে যা বলা হয়েছে তা যদি তিনি নির্দিষ্ট মনেও পড়েন তবু তা হত তার কাছে একটি আরামের ব্যাপার। কারণ সেই গবেষণাপত্র তার দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়। যদি সেই বই তাঁর কাছে আকর্ষণীয় বোধ হয়, তবে তা নৈর্ব্যক্তিক, যা তাঁর নিজের বিষয়ের ওপর বই হলে বলা যেত না। মানুষের জীবনের মূল কাজের বাইরে যেসব আকর্ষণ আছে, এই অধ্যায়ে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই।
অসন্তোষ, অবসাদ এবং স্নায়ুপীড়ার একটি কারণ হচ্ছে জীবনের পক্ষে বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন জিনিসে আকৃষ্ট হওয়ার অক্ষমতা। এর ফলে সচেতন মন কিছু ছোট ধরনের ব্যাপার থেকে বিশ্রাম পায় না এবং সে সবের প্রত্যেকটিতে সম্ভবত কিছু উদ্বেগ এবং কিছু দুশ্চিন্তার উপাদান যুক্ত আছে। একমাত্র ঘুমের সময় সচেতন মন নিষ্ক্রিয় কিন্তু অবচেতন মন পুরোপুরি সক্রিয় থাকে এবং জ্ঞানের পথে বিকশিত হয়। এর ফল হল উত্তেজনা বৃদ্ধি, বিচক্ষণতার অভাব, অসহিষ্ণুতা এবং মাত্ৰাজ্ঞানের অভাব দেখা দেয়। এই সবই হল অবসাদের কারণ এবং প্রক্রিয়া। মানুষ যখন অতিমাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার বাইরের আকর্ষণ কমে যায়, যতই তা কমতে থাকে ততই বাইরের আকর্ষণ তাকে যে মুক্তির স্বাদ দিচ্ছিল তা হারিয়ে যায় এবং সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই দুষ্টচক্রের শেষ পরিণাম হচ্ছে একেবারে ভেঙ্গে পড়া। বাইরের আকর্ষণ বিশ্রাম দেয় এই জন্যে যে, তাতে কোনও কাজের আহ্বান থাকে না। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ইচ্ছাকে পরিচালনার কাজ খুব ক্লান্তিকর, বিশেষ করে যখন তা খুব তাড়াতাড়ি করতে হয় এবং অবচেতন মনের সাহায্য ছাড়া করতে হয়। যারা মনে করে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মনকে বিশ্রাম দিতে হবে, তারা সঠিকভাবেই তা মনে করে। অবচেতন মনের ক্রিয়া শুধু ঘুমন্ত অবস্থাতেই চলে না, সচেতন মন অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকলে তার ক্রিয়া সচল থাকে। যে মানুষ কাজ শেষ হলে কাজের কথা ভুলে যেতে পারে এবং পরদিন কাজ শুরুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ভুলে থাকতে পারে এবং যে লোক মধ্যবর্তী সময়েও কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, তার চেয়ে পূর্বোক্ত লোক অনেক ভালভাবে কাজ করতে পারে। নিজের কাজ ছাড়া কোনও লোকের যদি অন্য বিষয়ে আগ্রহ থাকে তার পক্ষে যার কাজ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে আগ্রহ নেই, তার তুলনায় যখন কাজের কথা ভুলে থাকা প্রয়োজন হয়, ঠিক তখন ভুলে থাকা সহজতর হয়। তবে যে শক্তি সমস্ত দিনের কাজের শেষে ফুরিয়ে যায়, অন্য বিষয়ে আকর্ষণ থাকার জন্যে তা যেন আবার প্রয়োজন না হয়। ইচ্ছাশক্তি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও যেন তাতে না থাকে। জুয়া খেলার মতো অর্থ বিনিয়োগের কোনও ঝুঁকি যেন না থাকে। তা ছাড়া সে সব কাজে মন অবসাদগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনও উত্তেজনা যেন না থাকে, যা আগে থেকেই সচেতন বা অবচেতন মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে।