একথাও বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনও রকম নির্মাণ কাজের সুযোগ পেলে ঘৃণার অভ্যাস যত সহজে দূর করা যায়, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়।
বড় কোনও সৃষ্টিধর্মী কাজের সাফল্যে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা জীবনে প্রাপ্তব্য সেরা আনন্দসমুহের মধ্যে অন্যতম। যদিও দুর্ভাগ্যবশত এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ শুধু বিশেষভাবে দক্ষ লোকদের জন্যেই উন্মুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাফল্য থেকে যে আনন্দ তা থেকে কোনও মানুষকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না, যদি না দেখা যায় শেষ পর্যন্ত যে তার কাজই ছিল বিশেষভাবে খারাপ। এই তৃপ্তির অনেক প্রকারভেদ আছে। যে লোকটি একটি সেচ প্রকল্পের সাহায্যে তার পতিত জমিকে একটি গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত করে তুলেছে সে তাকে অত্যন্ত স্পষ্ট স্পর্শনযোগ্য রূপেই উপভোগ করবে। কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে। যে অল্প কজন রাষ্ট্রনায়ক বিশৃঙ্খল পরিবেশকে নতুন শৃঙ্খলায় রূপায়নে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কাজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে এ যুগে লেনিন একটি মহৎ উদাহরণ। শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ। শেক্সপীয়র তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন : যতদিন মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে, চোখে থাকবে দৃষ্টি, ততদিন এইগুলি বেঁচে থাকবে। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই ভাবনা তাঁকে দুর্ভাগ্যে সান্ত্বনা জুগিয়েছিল। তাঁর সনেটের ভিতর দিয়ে তিনি বলেছেন তার বন্ধুর সম্বন্ধে ভাবনা তাঁকে জীবনের সাথে আপোস করে চলতে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু যেসব সনেট তিনি বন্ধুর উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন সেসব যে তার বন্ধুর চেয়ে তাঁর এই উদ্দেশ্যপূরণে বেশি কার্যকর হয়েছিল, এমন একটি সন্দেহ আমার রয়ে গেছে। বড় শিল্পী এবং বড় বিজ্ঞানসেবকরা যে কাজ করেন তা নিজেই আনন্দপূর্ণ। যতক্ষণ তারা এই কাজ করবেন ততক্ষণ তারা যোগ্য লোকের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেয়ে যাবেন। এতে তারা সর্বাপেক্ষা মৌলিক ধরনের ক্ষমতার অধিকারী হন, যে ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং চেতনার ওপর প্রভাব। নিজেদের সম্পর্কে ভাল চিন্তা করার সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ তাদের রয়েছে। মনে হয় এইসব সুন্দর ঘটনার মিলন যে কোনও ব্যক্তিকে সুখী করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তবু এরকম ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ মাইকেল এঞ্জেলোর নাম করা যেতে পারে। তিনি খুব অসুখী মানুষ ছিলেন এবং বলতেন (না, আমি নিশ্চিত, তিনি সত্যি বলতেন না) যে, যদি তাকে তার দরিদ্র আত্মীয়দের ঋণ পরিশোধ করতে না হত, তাহলে তিনি ছবি আঁকার কষ্টটা আর সহ্য করতেন না। সবসময়ে না হলেও, অধিকাংশ সময়েই মহৎ শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতার সাথে মেজাজগত একটা অশান্তির যোগ থাকে এবং তা এতই প্রবল যে, শিল্পী তাঁর কাজ থেকে আনন্দ খুঁজে না পেলে বাধ্য হয়ে তাকে আত্মহত্যার পথে যেতে হয়। তাই আমরা মনে করতে পারি না যে মহৎ সৃষ্টি হলেই তা মানুষকে সুখী করবে, আমরা শুধু বলতে পারি এটি তাকে কম অসুখী করবে। বিজ্ঞানসেবীরা কিন্তু শিল্পীদের তুলনায় মেজাজগতভাবে অনেক কম সুখী এবং সাধারণভাবে যারা বিজ্ঞান নিয়ে মহৎ কাজ করেন তারা সুখী মানুষ। মূলত এই সুখ তারা লাভ করেন তাঁদের কাজ থেকে।
বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুখহীনতার একটা কারণ হল, বিশেষ করে যাদের সাহিত্যে দক্ষতা আছে, তাদের অনেকেই স্বাধীনভাবে নিজেদের মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। তারা শিক্ষাদীক্ষাহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত বৃহৎ সব সংস্থায় কর্মীরূপে কাজ করেন। সেসব পরিচালকদের নির্দেশে তাদের এমন সব জিনিস লিখতে হয়, যা তারা নিজেদের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন। যদি ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে অনুসন্ধান করা যায়, তাঁরা যে পত্রিকায় কাজ করেন তার নীতিমালায় তাদের বিশ্বাস রয়েছে কিনা, তাহলে জানা যাবে খুব কম সংখ্যক সাংবাদিকই মালিকদের নীতিতে বিশ্বাসী। বাকি অন্য সকলে শুধুমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে নিজেরা যে নীতিকে ক্ষতিকর মনে করে তার কাছেই তাদের দক্ষতা বিক্রি করে দেয়। এই ধরনের কাজে কখনও আসল তৃপ্তি থাকে না এবং কাজের সাথে আপোস করতে গিয়ে তাদের মন এমন বিষময় হয়ে ওঠে যে, সেই মন আর কোনও কিছু থেকেই আন্তরিকভাবে কোনও তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারে না। এরকম কাজ যাদের দায়ে পড়ে করতে হয় তাদের আমি নিন্দা করতে পারি না, কারণ এর যা বিকল্প তা হল অনাহার, যা আরো ভয়ানক। কিন্তু আমি মনে করি যেখানে কোনও ব্যক্তির সৃজনি প্রতিভার পক্ষে তৃপ্তিকর কাজ করা সম্ভব এবং সম্পূর্ণ অনাহারও এড়ানো যায়, সেখানে তাকে এই পরামর্শ দেওয়া চলে, সেখানে উচ্চ সাম্মানিক হলেও তা বর্জন করে নিজের সুখ এবং তৃপ্তিদায়ক কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে যথার্থ সুখ লাভ করা সম্ভবই নয় বলতে হবে। যে লোক নিজের কাজের জন্যে সংকুচিত সে খুব কমই আত্মসম্মান লাভ করে।
সৃষ্টিশীল কাজের তৃপ্তি, এখন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের বিশেষ সুবিধা হলেও অনেক লোকের পক্ষে এই বিশেষ সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। যে লোক নিজেই নিজের কাজের নিয়ন্তা সে এটা অনুভব করতে পারে। অথবা যে লোকের কাছে তার কাজ প্রয়োজনীয় মনে হবে এবং সেই কাজে যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন, সেও তা অনুভব করতে পারবে। মনের মতো সন্তানকে গড়ে তোলা একটি কঠিন সৃষ্টিমূলক কাজ। যা গভীর তৃপ্তি দিতে পারে। যে মা এটি সম্ভব করতে পেরেছে সে অবশ্যই অনুভব করতে পারবে যে তার পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী এমন কিছু মূল্যবান জিনিস পেয়েছে যা অন্যভাবে পাওয়া যেত না।