দুটি প্রধান উপকরণ কাজকে আকর্ষণীয় করে : প্রথম, দক্ষতার প্রয়োগ এবং দুই. নির্মাণ।
অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দক্ষতা প্রয়োগ করতে ভালবাসে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সহজ হয়ে আসে অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের দক্ষতার আরও উন্নতি করতে পারে। শৈশবের প্রথম থেকেই কাজের প্রেরণা শুরু হয়। যে বালক মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে পায়ের ওপর দাঁড়াতে অনিচ্ছুক হয়। একটা বড় কাজে যে আনন্দ পাওয়া যায়, দক্ষতার খেলা থেকেও তা লাভ করা যায়। একজন আইনজীবী বা একজন রাজনীতিকের কাজের মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা তাসের ব্রীজ খেলা থেকে পাওয়া আনন্দের সমতুল্য। অবশ্য এখানে শুধু দক্ষতার প্রয়োগ নয়, দক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দও আছে। কিন্তু যেখানে এই প্রতিযোগিতার উপাদানটি অনুপস্থিত সেখানেও কঠিন কৃতিত্ব প্রদর্শন করা সম্ভব। যে ব্যক্তি আকাশে বিমান নিয়ে নানারকম কৌশল দেখাতে পারে এবং তাতে যে গভীর আনন্দ পায় তার জন্যেই জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে। আমি কল্পনা করতে পারি একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসক যে অবস্থায় কাজ করেন তা বেদনাদায়ক হলেও তিনি তার নিখুঁত সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের পর তৃপ্তি লাভ করেন। একই রূপ আনন্দ তীক্ষ্ণতার কিছু কম হলেও সাধারণ মানের কাজ থেকেও পাওয়া যায়। আমি প্লাম্বার কারিগরের কথা শুনেছি যে তার কাজ থেকে আনন্দ পায়, যদিও এমন কারো সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। নৈপুণ্যের সব কাজই আনন্দজনক হতে পারে যদি অবশ্য সেই নৈপুণ্য প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল হয় অথবা তাতে সেই সুযোগ থাকে যার সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। এইসব শর্ত যদি অনুপস্থিত থাকে তা হলে যে ব্যক্তি নৈপুণ্যের উচ্চতম ধাপে পৌঁছেছে তার কাছে কাজ আর আকর্ষণীয় থাকবে না। যে ব্যক্তি তিন মাইলের দৌড়ে প্রতিযোগিতা করে, যখন এই পেশায় যোগ দেওয়ার বয়স পার হয়ে যাবে তখন আর এই প্রতিযোগিতায় আনন্দ পাবে না। সৌভাগ্যের কথা, অনেক কাজ আছে যার নতুন অবস্থায় নতুন রকম নৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় এবং যে ব্যক্তি কর্মরত তার পক্ষে মধ্য বয়সে ক্রমে ক্রমে উন্নতির ধাপে উঠে যাওয়া সম্ভব হয়। কিছু দক্ষতার কাজ আছে যেমন রাজনীতি, তাতে সফল হওয়ার উপযুক্ত বয়স হল ষাট থেকে সত্তর, তার কারণ হচ্ছে এ ধরনের কাজে অন্য লোক সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অতি প্রয়োজনীয়। এইজন্যে সত্তর বছর বয়সের সকল রাজনীতিক সম বয়সের অন্যান্য লোকের চেয়ে বেশি সুখী। এই বিষয়ে তাদের একমাত্র প্রতিযোগী হচ্ছে বড়বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা।
উৎকৃষ্ট কাজের আরো একটি উপকরণ আছে যা সুখের উৎসরূপে দক্ষতা প্রয়োগের চেয়েও বেশি মূল্যবান, তা হচ্ছে সৃষ্টি করার কাজ। কিছু কাজে অবশ্যই, তবে অধিকাংশ কাজেই নয়, কিছু নির্মাণ করা যায় এবং কাজের শেষে যা কৃতিত্বের স্তম্ভরূপে থেকে যায়। কাজের গুণগত মানে কোনটি সৃষ্টি আর কোনটি ধ্বংস তা আলাদা করা যায়। সৃষ্টির কাজে প্রথমদিকে অবস্থাটি কিছু বিশৃঙ্খল থাকলে, কাজ শেষ হওয়ার পর লক্ষ্যটা বাঝা যায়। ধ্বংসের কাজে এর বিপরীতটাই ঠিক। এর প্রথম দিকে থাকে লক্ষ্য এবং শেষের দিকে হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল। সুতরাং বলা যায় ধ্বংসকারীর লক্ষ্যই হচ্ছে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা, যার ভিতর কোন উদ্দেশ্য ফুটে উঠবে না। কোনও দালান নির্মাণ করা বা ভেঙ্গে ফেলার কাজে এটি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং এই গুণমান আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করা যায়। দালান নির্মাণে পূর্বে রচিত পরিকল্পনার বাস্তবায়িত করতে হয়। কিন্তু সেটি ভেঙ্গে ফেলতে হলে তার সব উপকরণ কীভাবে থাকবে তা নিয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, পরবর্তী নির্মাণের জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বিনষ্টি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ কাজের একটি অংশমাত্র, আলাদা নয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় পরবর্তী নির্মাণের কথা মনে না রেখেই লোকে প্রথমে ধ্বংসের কাজ শুরু করে। দেখা যায় এই কথাটা সে এই বিশ্বাসে নিজের কাছেও গোপন রাখে যে, নতুন নির্মাণের জন্যেই সে সব কিছু ভেঙে পরিষ্কার করছে। কিন্তু এটা যদি ছলনা হয়, তবে তার সেই ছলনার মুখোশ খুলে ফেলা সাধারণত অসম্ভব নয়, শুধু তাকে প্রশ্ন করতে হয়, এর পরবর্তী নির্মাণের কাজটা কী। এই বিষয়ে এটা পরিষ্কার হবে যে, উত্তরে সে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না এবং বলার মতো উৎসাহও নেই তার। অথচ প্রাথমিক ধ্বংসের কাজে সে খুব নির্দিষ্টভাবে এবং উদ্দীপনার সাথে সব বলেছিল। অনেক বিপ্লবী, যুদ্ধবাদী এবং হিংসার দূতদের সম্পর্কে একথা বলা যায়, তবে কর্মপ্রেরণার উৎস হল ঘৃণা করে তাদের ধ্বংস করা। কিন্তু তারপর কী হবে সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। আমি একথা অস্বীকার করতে পারি না যে সৃষ্টির মতো ধ্বংসের মধ্যেও আনন্দ আছে। এই আনন্দ ভয়ংকর এবং কোনও কোনও মুহূর্তে আরো তীব্র, কিন্তু তাতে কোনও গভীরতা নেই কারণ ধ্বংসের যা পরিণাম তার মধ্যে তৃপ্তির স্থান থাকে না। আপনি আপনার শত্রুকে হত্যা করলেন, তখন সে মারা গেল আপনার সব কাজ শেষ এবং বিজয় থেকে যে তৃপ্তি পেলেন তা অতি দ্রুত মিলিয়ে যাবে। অন্যপক্ষে নির্মাণের কাজ যখন সমাপ্ত হয়, তখন তা নিয়ে ভাবতেও আনন্দ। তা ছাড়া পরে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না এমন পূর্ণাঙ্গভাবে তা কখনও শেষ হয় না। সবচেয়ে তৃপ্তিজনক উদ্দেশ্য তাই, যা একের পর এক সাফল্যের পথ খুলে দেয় যা কখনও থামে না। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে ধ্বংসের তুলনায় নির্মাণই সুখের বড় উৎস। আরো বিশুদ্ধভাবে বলা যায়, যারা সৃষ্টির কাজে যে আনন্দ পায়, আর ধ্বংসের কাজে যারা আনন্দ পায়, তাদের কোনও তুলনা চলে না। কারণ মনে একবার ঘৃণা জাগলে নির্মাণকাজে অন্য লোক যে আনন্দ পায়, তেমন আনন্দ সহজলভ্য নয়।