কিন্তু এই গ্রন্থে আলোচিত সমস্যাগুলির দিকে আবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। আধুনিক বিশ্বে মাতৃত্ব-পিতৃত্বের পূর্ণ আনন্দ একমাত্র তারাই পেতে পারেন যারা, আমি এতক্ষণ ধরে যা বলে আসছি, অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি সম্মানের মনোভাবকে গভীরভাবে অনুভব করেন। তাহলে তাদের আর ক্ষমতা প্রীতিকে ক্লান্তিকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না এবং সন্তানেরা স্বাধীনতা পেলে উৎপীড়ক মা-বাবা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তার তিক্ত মোহমুক্তির যে আতংক তার কোনও প্রয়োজন নেই। যে মা-বাবার এই মনোভাব তাঁরা বাৎসল্যে অনেক বেশি আনন্দ পান, যে আনন্দ মাতৃত্ব-পিতৃত্বের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশের দিনে উৎপীড়ক মা-বাবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। এই পিচ্ছিল ভুবনে যিনি এখনো নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে সগ্রাম করে চলেছেন, তার পক্ষে যে আবেগ সম্ভব তার চেয়ে তিনি ভালবাসাকে কোমলতার সাহায্যে উৎপীড়ন থেকে মুক্ত করেছেন তিনি অনেক বেশি আনন্দ পেতে পারেন যা আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি কোমল যা জীবনের সস্তা ধাতুকে অতীন্দ্রিয় আনন্দের বিশুদ্ধ সোনায় রূপান্তরিত করতে পারে।
মাতৃ-পিতৃসুলভ হৃদয়াবেগকে খুব উচ্চ মূল্য দিলেও আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই না, যা প্রায় সকলেই করে থাকেন, যে জননীরাই তাদের সন্তানের জন্যে নিজেরাই যথাসাধ্য করবেন। এই বিষয়ে কিছু প্রচলিত রীতিনীতি রয়েছে বহু প্রাচীনকাল থেকে। তখনকার যুগে প্রাচীনারা নবীনাদের যে কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক ভালমন্দ উপদেশ দিয়ে যেতেন, তার বাইরে সন্তান পালন সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানা ছিল না। বর্তমান কালে সন্তান পালনের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে এবং যিনি এই বিষয়ের কোনও বিশেষ বিভাগে যে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তার হাতেই এই ভার তুলে দিলে সবচেয়ে ভাল হয়। তাদের শিক্ষার যে বিভাগ সমাজে শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করা হয় সেখানে তা অনুমোদিত। মা ছেলেকে ক্যালকুলাস শেখাবে এটা আশা করা যায় না, তা সে ছেলে মায়ের যত প্রিয়ই হোক। বই-পড়া শিক্ষা বিষয়ে এটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত যে, যে মা এই বিষয়ে কিছু জানেন না, তার চেয়ে যারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের কাছেই তা বেশি শিখতে পারে। কিন্তু সন্তান বিষয়ে অন্যান্য অনেক বিভাগে এটি অনুমোদিত নয়, কেন না তার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায় নি। নিঃসন্দেহে কিছু জিনিস মা-ই ভাল করতে পারে, কিন্তু সন্তান যত বড় হতে থাকে। ততই তাকে আরো বেশি জিনিস শেখাতে হয় যা অন্যেরা ভাল শেখাতে পারেন। সাধারণভাবে যদি সকলে স্বীকার করত, তা হলে মায়েরা অনেক পরিশ্রম থেকে। বেঁচে যেত যা তাদের জন্যে ক্লান্তিকর, কারণ এটা এমন বিষয় নয় যাতে তাদের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে। যে নারী নিজের জন্যে অথবা তার সমাজের জন্যে কোনও বিশেষ রকম পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেছে তা মাতৃত্বলাভ করার পরও যাতে সেই দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে সেই স্বাধীনতা তার থাকা উচিত। গর্ভধারণের শেষ কটি মাস এবং শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় সেই কাজে অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু শিশুর বয়স যখন নয় মাস হয়ে যায় তখন সেই শিশু মায়ের পেশাগত কাজে অলঙ্নীয় বাধা হতে পারে না। সমাজ যখনই মায়ের ওপর তার সন্তানের জন্যে যুক্তির অতিরিক্ত ত্যাগ স্বীকারের দাবি তুলে ধরে তখন মা, যদি তিনি অস্বাভাবিক ধরনের সাধু স্বভাবের না হন, তাহলে সন্তানের কাছে তার যা প্রাপ্য তার অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশা করবেন। যে জননীকে চলিত রীতিতে আত্মত্যাগী বলা হয়, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতি অস্বাভাবিকরকম স্বার্থপর, কারণ মাতৃত্ব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়াতে তাকে জীবনের সবটুকু মনে করলে তৃপ্তি পাওয়া যাবে না এবং অতৃপ্ত জনক-জননীর আবেগের দিক থেকে সন্তানের ওপর অধিকারি-বিস্তারী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অতএব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সন্তান ও তার জননী- উভয়ের স্বার্থে মাতৃত্ব যেন জীবনের অন্যসব স্বার্থ এবং কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, তা দেখতে হবে যদি শিশুপালনের প্রকৃত প্রশিক্ষণ তিনি গ্রহণ করে থাকেন এবং যদি তাঁর নিজের সন্তানদের পালন করার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন হয়ে থাকে, তাহলে তার এই দক্ষতা আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত এবং শিশুপালনকে তার পেশা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। যে শিশুদের মধ্যে তাঁর নিজের সন্তানও অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। বাবা-মার কাছ থেকে রাষ্ট্র ন্যূনতম যেটুকু যদি তারা পূরণ করে তাহলে তাদের সন্তানদের কীভাবে বড় করে তুলবে এবং কে করবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তাদের থাকা উচিত। অবশ্য ধরে নিতে হবে যে, সন্তানেরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের তত্ত্বাবধানের বাইরে যাবে না। কিন্তু এমন রীতি চালু হওয়ার দাবি জানানো উচিত নয়। অন্য নারীরা যে কাজ খুব ভালভাবে করতে পারে প্রত্যেক জননী নিজেই তা করবে। যেসব মা সন্তানপালনে ব্যর্থতা ও অক্ষমতা অনুভব করে, যেমন অনেক মা করে থাকে তাদের উচিত যারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং যাদের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে কোনও দ্বিধা না করে তাদের হাতে সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। সন্তানদের মঙ্গলের জন্যে ঠিক কী করা উচিত, তা মেয়েদের শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে স্বর্গ-প্রেরিত কোনও প্রেরণা নেই। মানসিক উদ্বেগ যখন একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা অধিকার-প্রবণতার ছদ্মবেশ হয়ে যায়। জননীর ভাবাবেগপূর্ণ ব্যবহারে এবং অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশুরই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটে। বাবারা যে শিশুর জন্যে বেশি কিছু করতে পারে না এটা সবসময় স্বীকৃত হয়ে এসেছে, তবু সন্তানেরা মাকে যতটা ভালবাসতে পারে, বাবাকেও ততটাই পারে। যদি নারীদের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হয় এবং শিশুদের মন এবং দেহ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান যেভাবে বাড়ছে, তার সুবিধা যদি শিশুদের দিতে হয়, তা হলে সন্তানের সাথে জননীর সম্পর্ক আগামী দিনে ক্রমেই সন্তানের সাথে জনকের সম্পর্কের তুল্য করতে হবে।