আমরা বরং মানবরূপে ধ্বংস হব। তবুও পশুরূপে বেঁচে থাকতে চাইব না । কবি বায়রন বলেন :
‘যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে।
যৌবনের ভারের গরিমা ডুবে যায় কাল সিন্ধু নীরে।‘(২)
‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক বলেন :
‘এই কারণে, যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের চেয়ে মৃত, অর্থাৎ যারা আগেই মরে গেছেন, তাদের আমি বেশি সাধুবাদ দিয়েছি।
সত্যিই এই দুই প্রকারের মানুষের চেয়ে সেই বেশি ভাল যিনি এখনও জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি এখনো সূর্যের নিচে ঘটে যাওয়া পাপাচার দেখেননি।
এই তিনজন নৈরাশ্যবাদী জীবনের সকল উপভোগের বিষয়কে দেখেই এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন যার মধ্যে কোনও আনন্দের কণা নেই। মিস্টার ক্রাচ নিউইয়র্কের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের সমাজে বাস করেছেন। বায়রন পৌরাণিক যুগের নায়কদের মতো হেলেসপন্টে সাঁতার কেটেছেন এবং চুটিয়ে প্রেম করেছেন। একলিজিয়াস্টেসের লেখক প্রমোদের বৈচিত্রে বায়রনকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি মদে ডুবেছেন, সঙ্গীতে আত্মহারা হয়েছেন এবং আনুষঙ্গিক সব কিছুতেই নিজেকে জড়িত করেছেন। তিনি জলাশয় তৈরী করেছিলেন। তাঁর অনেক সেবাদাস ও সেবাদাসী, অনেকে তাঁর বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিল। এমন অবস্থাতেও তিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি। কিন্তু তবুও তিনি দেখেছেন সব কিছু অর্থহীন। এমনকি জ্ঞানও তার কাছে অর্থহীন।
“আমি অন্তর দিয়ে জানতে চেয়েছি জ্ঞানকে, জানতে চেয়েছি উন্মাদনা ও মুখতাকে। আমি দেখেছি আত্মা এতেও পীড়িত হয়, কারণ যত জ্ঞান তত অনুতাপ। যে মানুষ জ্ঞানকে বাড়াবেন তিনি দুঃখকেই বাড়াবেন।”
তাঁর জ্ঞান তাঁকে বেদনাহত করেছিল, মনে হয়। তিনি এ থেকে মুক্তির ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
“অন্তর থেকে আমি বলেছিলাম এবার এসো, আনন্দ দিয়ে যাচাই করি তোমাকে।
অতএব প্রমোদে ভেসে যাও। কিন্তু দেখলাম তাও অর্থহীন।”
কিন্তু তার জ্ঞান তার সঙ্গ ছাড়েনি,
“আমি তখন নীরবে বললাম, যেমন বুদ্ধিহীনের বেলায় ঘটে, তেমনি আমার বেলাতেও ঘটে। তা হলে আমি বেশি জ্ঞানী হলাম কেন? তখন আবার আমি মনে মনে বললাম, এও অর্থহীন।
সুতরাং আমি জীবনকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। কারণ যা কিছু এই বিশ্বে হয়ে যাচ্ছে তা আমার কাছে বেদনাদায়ক। কারণ সবকিছুই অর্থহীন এবং মানস সত্তার পক্ষে বিরক্তিকর।”
এটা লেখকদের পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে, লোকে অনেক আগেকার দিনের লেখা আর পড়েন না। কিন্তু যদি পড়তেন; তাহলে তারা এই সিদ্ধান্তে আসতেন যে জলাধার সম্পর্কে যাই বলা হোক, নতুন বই লেখা নিশ্চিতভাবেই অর্থহীন। আমরা যদি দেখাতে পারি জ্ঞানী লোকের পক্ষে একমাত্র একলিজিয়াস্টেসের মতবাদই উন্মুক্ত, সেকথা ঠিক নয়। তা হলে ঐ একই মেজাজের পরবর্তী অন্যসব লেখা নিয়ে আমাদের আর ভাববার কিছু নেই। এই ধরণের আলোচনায় আমাদের উচিত, লেখার মনন এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ– এই দুইয়ের পার্থক্যটা মনে রাখা। লেখার মননের সাথে কোনও তর্ক নেই, কোনও অনুকূল ঘটনায় তার পরিবর্তন হতে পারে অথবা আমাদের শারীরিক কোনও পরিবর্তনে তার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তর্ক দ্বারা কখনো নয়। আমি নিজে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যখন মনে হয়েছে সব কিছু অর্থহীন, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি কোনও দার্শনিক চিন্তা দিয়ে নয়। পেয়েছি কোনও অবশ্য করণীয় কাজের চাপে পড়ে। আপনার শিশুসন্তান অসুস্থ হলে আপনি অসুখী হতে পারেন। কিন্তু কখনো আপনার মনে হবে না যে এসব অর্থহীন। আপনার মনে হবে যে সন্তানকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। এ প্রশ্ন আপনার মনে উঠবেই না যে জীবনের কোনও চরম মূল্য রয়েছে কিনা। ধনী লোক মনে করতে পারেন এবং সচরাচর মনে করেও থাকেন সবকিছু অর্থহীন। কিন্তু যদি কোনও কারণে তার অর্থনাশ হয়, তবু তার মনে হবে না যে পরবর্তী আহারের ব্যাপারটাও অর্থহীন। প্রকৃতিলব্ধ অভাবের সহজ পূরণ থেকেই এই অনুভূতি জাগ্রত হয়। মানবজাতি অন্যসব প্রাণীর মতো এক বিশেষ ধরণের জীবনযুদ্ধের উপযোগী হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর অর্থের সাহায্যে মানুষ বিনা শ্রমে তার সব খেয়াল চরিতার্থ করতে পারে। অবস্থা যদি এমনি হয় পরিশ্রমের অভাবই সুখের একটি প্রধান উপকরণ তার জীবন থেকে চলে যাবে। যেসব জিনিসের প্রতি মানুষের কামনা প্রবল নয়, সেসব যদি সে সহজে লাভ করে, তা হলে সে মনে করবে কামনা পূরণে সুখলাভ হয় না। তার অন্তর যদি কিছু দার্শনিক ভাবনায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তা হলে তার মনে হবে মূলত মানবজীবন দুঃখময়। তা হলে যে মানুষ যা চায়, তাই যদি পেয়ে যায়, সে আরও অসুখী। সে ভুলে যায় যে কিছু অভাব থাকা সুখের একটি অপরিহার্য উপাদান।
এই হল মেজাজ বা মননের কথা, যা এখানে শেষ করতে হয়। অবশ্য একলিজিয়াস্টেসে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনাও রয়েছে।
“নদী সাগরে গিয়ে পড়ছে, তবু সাগর অপূর্ণ।
সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই।
পূর্ব-স্মৃতি বলে কিছুই নেই।
এই পৃথিবীতে সুর্যের নিচে যে শ্রম আমি করেছি,
আমি ঘৃণা করেছি তাকে, কারণ আমার পরে যে জন্মাবে
তাকে দিয়ে যেতে হবে অর্জিত সম্পদ।”
এই আলোচনা আধুনিক দার্শনিকের ভাষায় সাজিয়ে নিলে তা অনেকটা এইরকম দাঁড়াবে : মানুষ নিরন্তর পরিশ্রম করছে, বস্তু অবিরাম গতিশীল, তবু কিছুই অবিনশ্বর নয়। যদিও পরিবর্তনের নিয়মে যা করে আসছে তার সাথে পূর্বের কোন পার্থক্য নেই। কোনও মানুষ মারা গেলে তার উত্তরপুরুষ তার শ্রমের ফল ভোগ করে। নদী পড়ছে সাগরে গিয়ে। কিন্তু তার জলরাশি সেখানে থাকছে না। বারবার সীমাহীন, উদ্দেশ্যহীন চক্রে মানুষ এবং সব জাগতিক বস্তুর উদ্ভব এবং বিনাশ হচ্ছে। কোনও উন্নতি নেই, স্থায়ী কোনও ফল নেই। এমনি চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নদীদের যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে তারা চলত না, স্তব্ধ হয়ে থাকত। সলোমন(৩) যদি বুদ্ধিমান হতেন, তাহলে তিনি উত্তরপুরুষের ভোগের জন্যে ফলের গাছ পুঁততেন না।