পরিবারের ভিত্তি হল বাবা-মার তাদের সন্তানদের জন্যে এক বিশেষ রকমের স্নেহের অনুভূতি। তারা পরস্পরকে যেভাবে ভালবাসে, বা অন্যের সন্তানদের, তার চেয়ে আলাদা। এটা সত্যি যে কোনও কোনও বাবা-মার সন্তানদের প্রতি স্নেহের অনুভূতি কম থাকে অথবা থাকেই না। কিন্তু একথাও সত্যি কোনও কোনও নারী নিজের সন্তানের প্রতি যে প্রবল বাৎসল্য অনুভব করে, ঠিক অনুরূপ বাৎসল্য অন্যের সন্তানের জন্যে অনুভব করে। এই ব্যাপারে সহজ করে বলা যায়, বাৎসল্য এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি, যা সাধারণ মানুষ নিজের সন্তানের প্রতি অনুভব করে, অন্য কোনও মানুষের প্রতি নয়। এই আবেগ আমরা পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। এই বিষয়ে ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গী আমার কাছে খুব বেশি জৈব-বিজ্ঞান সম্মত বলে মনে হয় না, কারণ যে কোনও লোক কোনও মা-প্রাণীকে দেখলেই বুঝতে পারবে তার শাবকদের জনকের প্রতি তার যে আচরণ তা তার শাবকদের সাথে তুলনায় একেবারেই আলাদা। মানুষের মধ্যে যা দেখতে পাওয়া যায় তা একই সহজাত প্রবৃত্তির পরির্তিত এবং কম নির্দিষ্ট রূপ। এই বিশেষ সহজাত আবেগের জন্যে তা না হলে প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবার সম্পর্কে আর কিছুই প্রায় বলার প্রয়োজন হত না। কারণ তা হলে সন্তানদের লালন-পালনের ভার পেশাদার পালকের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যে জিনিস রয়েছে অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি বাবা-মার বিশেষ স্নেহ, তাহলে বাবা-মার সহজাত আবেগ নষ্ট হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত, তাদের কাছে এবং সন্তানদের কাছে। সমান মূল্যবান। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহের মূল্য প্রধানত এটা যে, তা অন্য যে কোনও স্নেহের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। বন্ধু বন্ধুকে ভালবাসে তার গুণের জন্যে প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে ভালবাসে মোহনীয় শক্তির জন্যে। এই গুণ এবং শক্তি যদি কমে যায় তা হলে বন্ধু ও প্রেমিক পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একমাত্র বিপদের সময়েই জনক-জননীর পর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করা যায়, অসুস্থ হলে, এমন কি ম বিনষ্ট হলেও, যদি বাবা-মা আদর্শবান হন। আমরা যখন গুণের জন্যে প্রশংসিত হই, তখন আনন্দ নাই, যদি আমরা অনেকেই যথেষ্ট বিনয়ী বলে মনে মনে অনুভব করি যে এমন প্রশংসা বিপদজনক। বাবা-মা আমাদের ভালবাসেন কারণ আমরা তাঁদের সন্তান এবং এই ঘটনা অপরিবর্তনীয়। কাজেই তাদের কাছেই আমরা অন্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করি। সাফল্য পাওয়া গেলে এই জিনিস মূল্যবান মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যর্থ হলে তা এমন সান্ত্বনা এবং নিরাপত্তা যা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সব মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সাধারণভাবে এক পক্ষের সুখ পাওয়া সহজ। কিন্তু দুপক্ষের জন্যে তা অনেক কঠিন। কারারক্ষক কয়েদিকে পাহারা দিয়ে সুখ পেতে পারে, মনিব তার অধীনস্থ কর্মীকে ভয় দেখিয়ে সুখ পেতে পারে, শাসক প্রজাদের শক্ত হাতে শাসন করে সুখ পেতে পারে এবং রক্ষণশীল পিতাও যে তাঁর পুত্রকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যে বেতের ব্যবহার করে সুখ পান, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এইসব কিছু হল একপক্ষের সুখ, এর সাথে জড়িত অপরপক্ষের তাতে অসন্তোষ ছাড়া অন্য কিছু নেই। এই ধরনের পক্ষপাতমূলক সুখে যে ভুল আছে আমরা তা বুঝি। আমরা বিশ্বাস করি সুস্থ মানবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে উভয়পক্ষের যাতে তৃপ্তি তাই হওয়া উচিত। এই কথা বিশেষভাবে বাবা-মা এবং সন্তানদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু তার ফলে মা বাবারা আগে যেমন সন্তানদের কাছ থেকে আনন্দ পেতেন এখন তা পান না, অন্যদিকে সন্তানেরা আগে যেমন মা-বাবার কাছ থেকে দুঃখ-যন্ত্রণা পেত এখন তা পায় না। আমি মনে করি না, আগের দিনের তুলনায় মা-বাবা কেন এখন কম। আনন্দ পাচ্ছে তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, যদিও বর্তমানে একথা বাস্তব, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি এটাও মনে করি না, কেন মা-বাবা সন্তানদের আনন্দকে বাড়াতে পারবেন না তার কোনও কারণ আছে। আধুনিক পৃথিবীর সমসম্পৰ্কর্তার যেটা উদ্দেশ্য অর্থাৎ মননীয়তা এবং সুন্দর আচরণ, অন্যের ব্যক্তিত্বের প্রতি কিছু শ্রদ্ধা, তা এখানেও প্রয়োজন। আর এটাই বর্তমানে সাধারণ জীবনের কলহপ্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সুখ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমে জৈবিক উপাদান থেকে তারপর সমতায় বিশ্বাসী বিশ্বের পক্ষে অন্যের প্রতি যে মনোভাব থাকা প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে তা বাবা-মা কীভাবে গ্রহণ করে সেইদিক থেকে।
পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের যে আনন্দ তার মৌল উৎস দ্বিধাবিভক্ত। তার একটি হচ্ছে উত্তরপ্রজন্মের ভিতর নিজেরই দৈহিক বিস্তারের অনুভূতি, যা বেঁচে থাকবে নিজের দৈহিক মৃত্যু হলেও এবং তা সম্ভব তার যখন পালা আসবে সেও ঠিক একইভাবে নিজেকে বিস্তার করবে পরবর্তী প্রজন্মের ভিতর এবং এইভাবেই সে তার বংশধারার প্রাণ-বীজকে অমরত্ব দিয়ে যাবে। অপরটি হচ্ছে ক্ষমতা এবং কোমলতার ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ। নবাগত শিশুটি অসহায়, তার অভাব পূরণের জন্যে রয়েছে সহজাত আবেগ এবং তা শুধু সন্তান স্নেহকে তৃপ্ত করে না, মা-বাবার প্রভুত্ব করার ইচ্ছাকেও তৃপ্ত করে। যতদিন শিশুকে অসহায় মনে হবে ততদিন তার প্রতি যে স্নেহ বর্ষিত হয় তাকে স্বার্থহীন মনে করা যায় না, কেন না এর মধ্যে থাকে নিজেরই দুর্বল অংশকে রক্ষা করার আবেগ। কিন্তু সন্তানের শৈশব থেকেই মা বাবার মনে মাতৃ-পিতৃসুলভ স্নেহ এবং সন্তানের মঙ্গল। এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়, সন্তানের ওপর ক্ষমতা বিস্তার কিছুটা সহজাত প্রকৃতিপ্রদত্ত হলেও। সন্তান যত দিক থেকে সম্ভব স্বাধীন হতে শিখুক এটাই চাওয়া উচিত, কিন্তু তা মা-বাবার ক্ষমতা বিস্তারের প্রবৃত্তি থাকলে অপ্রীতিকর মনে হবে। কোনও কোনও মা-বাবা এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সচেতন নন এবং সন্তানেরা বিদ্রোহ না করা পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যান। কিন্তু অন্যেরা এই বিষয়ে সচেতন বলেই পরস্পর বিরোধী আবেগের শিকার হন। এই দ্বন্দ্বে তাদের পিতৃ-মাতৃত্বের সুখ হারিয়ে যায়। সন্তানের ওপর সব যত্ন মমতা ঢেলে দেওয়ার পর তারা দুঃখের সাথে বুঝতে পারেন তারা যা আশা করেছিলেন, সন্তান তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম হয়েছে। তারা চেয়েছিলেন ছেলে সৈনিক হোক, কিন্তু দেখেন সে যুদ্ধবিরোধী হয়ে উঠেছে। অথবা টলস্টয়ের মতো তাঁরা ছেলেকে যুদ্ধবিরোধী হবে বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু সে যোগ দিয়েছে ব্ল্যাক হানড্রেডস সেনাদলে। কিন্তু পরের পরিণতির জন্যে মোটেই নয়, যে শিশু নিজেই খেতে শিখেছে তাকে যদি আপনি খাইয়ে দেন তাহলে শিশুর কল্যাণের ওপর আপনি নিজের ভালবাসার ক্ষমতাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন যদিও আপনি ভাবছেন স্নেহবশত আপনি তার কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছেন। যদি আপনি বিপদ সম্পর্কে তাকে খুব বেশি সচেতন করে দেন তা হলে মনে হবে সম্ভবত আপনি তাকে আপনার ওপর নির্ভরশীল রাখার কামনা থেকে তা করছেন। আপনি যে প্রতিপাদক মেহ তাকে দিয়ে থাকেন, আপনি তাতে সাড়া চান, তাহলে মনে হবে আপনি সম্ভবত তার আবেগের সাহায্যে তাকে ধরে রাখতে চান। হাজার রকমভাবে ছোট অথবা বড়, মা-বাবার অধিকারবোধের চেতনা তাদের বিপথে চালিত করে, যদি না তারা খুব সতর্ক এবং মনের দিক থেকে নির্ভেজাল হয়। আধুনিক মা-বাবারা এ বিষয়ে সচেতন। তবুও মাঝে মাঝে সন্তানদের সাথে আচরণে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, তার ফলে তাদের খুব বেশি উপকারে আসতে পারতেন না। কিন্তু যদি তারা তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভুল করতে দিতেন তাহলে বেশি উপকারে আসতে পারেন। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যদি তারা নিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে তা হলে তাদের মনে যে দুশ্চিন্তা আসে, অন্য কিছুতে তা আসে না। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অন্তরে পবিত্র হওয়া অনেক ভাল। মা-বাবা যথার্থই সন্তানের ওপর তাদের প্রভাবের চেয়ে ওদের। কল্যাণ কামনাই বেশি করেন। তা হলে তাদের কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয় তার জন্যে মনোবিশ্লেষণের লেখা পাঠ্য বই পড়ার প্রয়োজন নেই। তাঁরা নিজের অন্তরের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে তার নির্দেশ খুঁজে পাবেন এবং এসব ক্ষেত্রে মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর থাকবে এবং তাতে সন্তানের মনে বিদ্রোহ তৈরী হবে না এবং বাবা-মার মনেও হতাশার বোধ তৈরী হবে না। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেখানোর জন্যে প্রথম থেকে মা-বাবার কাছে যে দাবি, যা শুধুমাত্র একটা নীতি নয় তা নৈতিক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক যাই হোক। এর গভীরে আছে একটা অনুভূতি যা অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের সমতুল্য, যা অধিকার-মনোভাব এবং নির্যাতনকে অসম্ভব করে তুলবে। এই মনোভাব শুধুমাত্র সন্তানদের ক্ষেত্রেই আচরণীয় তা নয়, এটা সমভাবেই প্রযোজ্য বিবাহের ক্ষেত্রে এবং বন্ধুত্বেও। যদিও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এটা তত কঠিন নয়। সুন্দর পৃথিবীতে রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই মনোভাব খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটা এমন একটা দুরাশা যে এই সম্বন্ধে আর কোনও আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে যখন এই বিশ্বজনীন মনোভাবের প্রয়োজন, তাই এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি শিশুদের ক্ষেত্রে কারণ তাদের অসহায়তার জন্যে, কারণ তাদের ছোট আকার এবং ক্ষীণ শক্তির জন্যে অমার্জিত লোকেরা তাদের অবজ্ঞা করে।