প্রত্যেক পাশ্চাত্য দেশের পেশাদার নীতিবাগীশরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন ধর্মোপদেশ এবং ভাবপ্রবণতার সাহায্যে। একদিকে তারা বলেন প্রত্যেক বিবাহিত দম্পতির কর্তব্য হল ততগুলি সন্তানলাভ করা, ঈশ্বর যা ইচ্ছা। করেন। সন্তানদের স্বাস্থ্য ও সুখ নিয়ে তাদের কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে পুরুষ ধর্মতাত্ত্বিকেরা মাতৃত্বের পবিত্র আনন্দের কথা প্রচার করে থাকেন এবং ভনিতা করে বলেন, রুগ্ন দারিদ্রপীড়িত বড় পরিবার হল সুখের আকর। রাষ্ট্র তাদের সাথে যোগ দেয় এই যুক্তিতে যে কামানের জন্যে প্রচুর খাদ্য চাই, নইলে এমন চমৎকার নিখুঁত সব মারণাস্ত্র যদি হত্যার জন্যে প্রচুর লোক না পায় তা হলে তাদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বহাল থাকবে কীভাবে। আশ্চর্য হওয়ার কথা, ব্যক্তিগতভাবে কোনও বাবা-মা এই যুক্তি যদি অন্যের প্রযুক্ত বলে যদিওবা মেনে নেয় নিজেদের বেলায় পুরোপুরি বধির হয়ে থাকে। ধর্মতাত্ত্বিক ও দেশপ্রেমিকদের মনস্তত্ব ভ্রমে ভরা। ধর্মতাত্ত্বিকরা যতক্ষণ নরকানলের ভয় দেখাতে পারবেন ততক্ষণ সফল হবেন। কিন্তু বর্তমানে খুবই কম লোক এই ভয়কে গুরুত্ব দেয় এবং এই রকম কোনও ভয়ই যে আচরণ, একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার তা নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট নয়। আর রাষ্ট্রের সম্পর্কে বলা যায় তাদের যুক্তি অত্যন্ত হিংস্র। জনগণ একমত হতে পারে যে, অন্যেরা কামানের খাদ্য হোক, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের এভাবে ব্যবহার করা হোক তা তারা চায় না। সুতরাং রাষ্ট্র যা করতে পারে তা হচ্ছে দরিদ্র লোকদের অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই চেষ্টা একমাত্র অনুন্নত পাশ্চাত্য দেশ ছাড়া অন্য জায়গায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। খুব কম নর-নারীই জনগণের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে সন্তান লাভ করতে চাইবে। এই বিষয়ে তাদের ধারণা যত স্পষ্টই হোক যখন কোনও দম্পত্তি সন্তান লাভ করে তখন তারা হয় এই বিশ্বাস থেকে করে যে সন্তান তাদের সুখের সাথে যুক্ত হবে, না হয় কী করে জন্মনিরোধ করা যায় তা তারা জানে না। শেষের কারণটাই এখনো বেশি কার্যকর কিন্তু ক্রমশ তার শক্তি কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র অথবা গীর্জা যাই করুক এই কমানো আটকানো যাবে না। সুতরাং শ্বেত জাতিদের যদি অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পিতৃত্ব মাতৃত্ব যাতে পিতা-মাতাকে আবার সুখ দিতে পারে তা করা প্রয়োজন।
বর্তমানের পরিস্থিতির কথা না ভেবে যদি মানব-প্রকৃতির কথা ভাবা যায়, তাহলে আমার মনে হয়, একথাটা সকলে বুঝতে পারবেন যে পিতৃ-মাতৃত্ব মনস্তত্ত্বের দিক থেকে জীবনকে দান করতে পারে শ্রেষ্ঠ এবং সর্বাপেক্ষা স্থায়ী আনন্দ। এটা অবশ্য পুরুষ অপেক্ষা নারীর ক্ষেত্রে বেশি সত্যি। আধুনিক-পূর্ব যুগের প্রায় সব সাহিত্যেই এই ধারণাকে গ্রহণ করা হয়েছে। হেকুবা প্রিয়াম অপেক্ষা তার সন্তানদের বেশি যত্ন নেন। ম্যাকডাফ তার স্ত্রী অপেক্ষা সন্তানদের প্রতি বেশি যত্নশীল। ওল্ড টেস্টামেন্টে নারী-পুরুষ উভয়েই বংশধর রেখে যাওয়ার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব। চীনে এবং জাপানে এখনো পর্যন্ত এই মনোভাব টিকে রয়েছে। অনেকে বলতে পারেন এই কামনা এসেছে পূর্বপুরষ পূজা থেকে। আমি কিন্তু এর বিপরীতটাকেই সত্যি বলে মনে করি। বলা যায় মানুষের অন্তরে পরিবারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার যে কামনা থাকে, পূর্বপুরুষ তারই প্রতিফলন। পেশাজীবী মহিলাদের কথা কিছু আগেই বলা হয়েছে। আবার বলি, তাদের মধ্যেও সন্তান লাভের কামনা প্রবল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কেননা তা না হলে তারা সেই কামনা পূর্ণ করতে যে পরিমাণ আত্মত্যাগ করে তা কেউ করত না। আমার দিক থেকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে, যত অভিজ্ঞতাই আমি অর্জন করি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ পেয়েছি পিতৃত্ব-লাভে। আমার বিশ্বাস পরিস্থিতির কারণে কোনও নারী অথবা পুরুষকে সন্তানলাভ থেকে যদি বঞ্চিত থাকতে হয়, তখন তাদের একটি গভীর অভাব অপূর্ণ থাকে আর তা থেকে এমন এক অতৃপ্তি ও উদাসীনতা জন্ম নেয় যার কারণ সম্পূর্ণ অজানা থেকে যায়। এই পৃথিবীতে সুখী হতে হলে, বিশেষ করে যৌবন অতিক্রান্ত হলে নিজেকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, যার দিন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, এইভাবে না ভেবে ভাবা উচিত সৃষ্টির প্রথম বীজ থেকে যে জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে এক অজ্ঞাত এবং সুদূর ভাবীকালের দিকে এগিয়ে চলেছে সে তারই অংশ। নির্দিষ্ট ভাষায় প্রকাশিত এই সচেতন অনুভূতি জগতের প্রতি অতি সভ্যতাসূলভ এবং মননশীল দৃষ্টিভংগীর সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি অস্পষ্ট, সহজাত আবেগরূপে এটি আদিম এবং প্রকৃতিজাত এবং এর অভাবটাই উচ্চসভ্যতাসূলভ। যে মানুষ এমন কোনও মহৎ এবং উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করতে সমর্থ, যার অবদান প্রসারিত হবে আগামীকালে, তিনি তার কাজের ভিতর দিয়েই তৃপ্ত করতে পারেন তার অনুভূতিকে। কিন্তু যেসব পুরুষ ও নারীর এমন অসাধারণ প্রকৃতির দেওয়া উপহার নেই, তাদের তৃপ্তির একমাত্র পথ সন্তানলাভ। যারা তাদের সৃজনীশক্তিকে নষ্ট হতে দিয়েছে তারা জীবনপ্রবাহ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তা করতে গিয়ে তারা নিজেদের শুকিয়ে যাওয়ার এক প্রবল ঝুঁকির সম্ভাবনাকে বেছে নিয়েছে। তাদের জন্যে, যদি তারা বিশেষভাবে নৈর্ব্যক্তিক হতে না পারে, মৃত্যু অবধারিত। যে পৃথিবীটা তাদের পরে আসবে তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই আর এই কারণে তাদের নিজেদেরই কাছে নিজেদের যা কিছু কাজ সব তুচ্ছ এবং মূল্যহীন মনে হবে। যেসব নর-নারীর সন্তান এবং সন্তানের সন্তানরা রয়েছে এবং তাদের সহজাত স্নেহের উৎস থেকে ভালবাসেন, তাহলে আগামী দিনগুলি তাদের কাছে মূল্যবান মনে হবে, অন্তত তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এবং শুধু কোনও নৈতিকতা বা কল্পনার প্রয়াসে নয়, সহজাত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এবং যে ব্যক্তির সব প্রভাব তাঁর ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে যতদূর বিস্তৃত হয়েছে সেই প্রভাবের পরম্পরা আরো অনেক দূর প্রসারিত হতে পারে। আব্রাহামের মত, যিনি এই ভাবনা থেকে তৃপ্তিলাভ করবেন যে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরা প্রতিশ্রুত সেই ভূমির অধিকার লাভ করবে, যদি তা পরে বহু প্রজন্মে নাও ঘটে এই অনুভূতি থেকেই তিনি ব্যর্থতাবোধের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাবেন, না হলে তাঁর সব আবেগ নষ্ট হয়ে যাবে।