এ ধরনের বড় বড় অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তার বাইরে। আমরা আলোচনা করছি। বর্তমানকালে সুখী হওয়ার জন্যে কী করতে হতে পারে তা নিয়ে। বর্তমান কালে বাবা-মা ও সন্তানদের সম্পর্কের ভিতর যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাধা রয়েছে সেইখানে যেতে পারলে আমরা এই সমস্যার কাছাকাছি চলে আসব। এই সমস্যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র থেকে জাত সমস্যাসমূহের একটি অংশ। প্রাচীনকালে ছিল মালিক এবং দাস। মালিক ঠিক করত কী করতে হবে এবং মোটামুটিভাবে তাদের দাসদের পছন্দ করত। কারণ তারাই ছিল তাদের সুখ-বৃদ্ধির যন্ত্র। দাস সম্ভবত তার মালিককে ঘৃণা করত। যদিও গণতান্ত্রিক মতবাদ এই ঘৃণা যতটা ব্যাপক ও সার্বজনীন বলে আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়, ততটা ছিল না। কিন্তু তবু তারা মালিকদের ঘৃণা করত এটা সঠিক হলেও, মালিকরা তা বুঝতে পারত না এবং যে কোনও ভাবেই হোক মালিকরা সুখী ছিল। গণতান্ত্রিক মতবাদ সাধারণভাবে গৃহীত হওয়ায় এর সব কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যেসব দাস আগে মালিকদের নীরবে মেনে চলত, তারাই এখন আর মালিকদের মানে না। যেসব মালিকদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ ছিল না, তারা এখন দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তার দোলায় দুলছে। ফলে সংঘর্ষ বেধেছে এবং উভয়পক্ষই অসুখী হয়েছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এসব আমি যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছি না, কারণ যেসব অসুবিধার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। সেই সময় পৃথিবী থেকে সুখ যে বিদায় নেয়, সে বিষয়ে চোখ বুজে থাকা অর্থহীন।
বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্কের যে পরিবর্তন সাধারণভাবে তা গণতন্ত্র প্রসারের একটি উদাহরণ। বাবা-মা সন্তানদের ওপর তাদের অধিকার বিষয়ে আগের মতো আর নিশ্চিত নয়। সন্তানেরা বাবা-মাকে যে শ্রদ্ধা করতেই হবে তেমন করে আর অনুভব করে না। বাধ্যতা নামে গুণটি আগের দিনে প্রশ্নহীনভাবে আদায় করে নেওয়া হত। এখন তা রীতি-বিরুদ্ধ হয়েছে এবং ঠিকই হয়েছে। শিক্ষিত বাবা-মাকে মনোবিশ্লেষণ ভীত করে তুলছে, যদি তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও ক্ষতি করে ফেলে সন্তানদের। তাদের চুম্বন করলে তাদের মনে ইডিপাস গূঢ়ৈষণা জাগতে পারে, আর না করলে তাদের মনে প্রবল ঈর্ষা সৃষ্টি হতে পারে। যদি তারা সন্তানদের আদেশ করে কাজ করতে বলে, তা হলে তাদের মনে এক ধরনের পাপবোধ জন্মাতে পারে, যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সন্তানেরা এমনসব অভ্যাসের অধীন হবে যা বাবা-মার কাছে বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুকে বুড়ো আঙুল চুষতে দেখলে তারা তার ভয়ংকর পরিণামের কথা ভাবে, কিন্তু তারা জানে না কী করে তা বন্ধ করতে হয়। যে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব একসময় ছিল শক্তির সুখময় প্রয়োগ, তা এখন হয়ে পড়েছে ভীরু, উদ্বিগ্ন এবং বিবেকতাড়িত সন্দেহ। পুরোনো দিনের নির্মল আনন্দ হারিয়ে গেছে, ঠিক এমন সময়ে যখন অবিবাহিতা মেয়েরা নতুন পাওয়া স্বাধীনতার জন্যে, মাতৃত্ব লাভের সিদ্ধান্ত নিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থত্যাগ করছে। এই পরিস্থিতিতে সচেতন জননীরা সন্তানের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করে না। কিন্তু অসচেতন জননীদের আশা অনেক বেশি। সচেতন জননীরা তাদের প্রকৃতিদত্ত স্নেহকে সংযত করে এবং সতর্ক হয়। অসচেতন জননীরা তাদের সন্তানের জন্যে যে আনন্দকে ত্যাগ করতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পেতে চায়। এক ক্ষেত্রে সন্তানদের স্নেহ উপবাসী থাকে অন্য ক্ষেত্রে তা আর্ত উদ্দীপক হয়। কোনও ক্ষেত্রেই এখানে পরিবার তার সবচেয়ে সেরাটা যা দিতে পারত, ছিল নির্মল এবং স্বাভাবিক আনন্দ তা পাওয়া যাবে না।
এইসব অসুবিধার জন্যে জন্মহার যদি নেমে যায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। মানুষের জন্মহার সাধারণভাবে কমতে কমতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যাতে মনে হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যেই জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করবে। সে সীমারেখা সচ্ছল লোকেরা অনেকদিন আগেই পার করে গেছে এবং তা শুধু কোনও একটা দেশে নয়, বিশেষভাবে সব উন্নতিপ্রাপ্ত সভ্য দেশসমূহে। সচ্ছল শ্রেণীতে জন্মহারের পরিসংখ্যান খুব বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত জীন আইলিনের গ্রন্থ থেকে দুটি বিষয় উদ্ধৃত করা যেতে পারে। দেখা যায় স্টকহোম নগরে ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালের ভিতর পেশাজীবী মহিলাদের উৎপাদিকা শক্তি সাধারণ জনসংখ্যার হিসাবে মাত্র একতৃতীয়াংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজের চার হাজার স্নাতকদের মধ্যে ১৮৯৬ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত নবজাত শিশুদের মোট সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অথচ প্রজন্মকে হ্রাস পাওয়ায় হাত থেকে বাঁচাতে আট হাজার শিশুর প্রয়োজন ছিল, যাদের মধ্যে এটাও কম সময়ে মারা যায়নি। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যে সভ্যতা শ্বেতকায়দের হাতে সৃষ্ট, তার একক একটি বৈশিষ্ট্য হল, তাদের নারী পুরুষরা যে অনুপাতে আত্মভূত করে সেভাবেই তারা বন্ধ্যাত্বপ্রাপ্ত হয়। সবচেয়ে যারা বেশি সভ্য, সবচেয়ে বন্ধ্যা তারা। সবচেয়ে কম সভ্য যারা সবচেয়ে বেশি ঊর্বর তারা। অবশ্য এদের মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তর রয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্য জাতিদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমত্তায় সবচেয়ে অগ্রবর্তী, তারা বিদায় নিচ্ছে। অল্প কয়েক বছরের ভিতর তারা সামগ্রিকভাবে সংখ্যায় কমে যাবে, যদি অবশ্য তুলনায় কম সভ্য অঞ্চল থেকে লোকজন অভিবাসন নিয়ে এসে সেই ঘাটতি পূরণ করে। আবার অভিবাসিতরা যখন পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে নেবে তাদেরও বন্ধ্যাত্ব লাভের পালা চলে আসবে। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে কোনও সভ্যতার যদি এটাই বিশেষত্ব হয়, তাহলে তা স্থায়ী হয় না। এদের মধ্যে জন্মহার বাড়াতে যদি প্রেরণা সৃষ্টি করা না যায়, তা হলে কিছু আগে না হয় পরে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং স্থান নেবে অন্য আরেক সভ্যতা, যেখানে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব প্রেরণার ভিতরেই এমন শক্তি থাকবে যা জনসংখ্যা কমতে দেবে না।