আধুনিক কুমারী মেয়েরা এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না, যদি তার ভাল শিক্ষা থাকে তাহলে সাধারণভাবে সুখে থাকার মতো একটা জীবিকার ব্যবস্থা করা কঠিন নয় এবং সে বাবা-মার অধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে। বাবা-মা কন্যাদের ওপর অর্থনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বলে তারা এখন কন্যাদের নৈতিকতা অনুমোদন না করার ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হয়েছে। যে মেয়ে গঞ্জনা সহ্য করার জন্যে অপেক্ষা করবে না, তাকে গঞ্জনা দিয়ে লাভ নেই। উচ্চপেশাজীবী অবিবাহিতা তরুণী তাই বর্তমানকালে বুদ্ধিমত্তা এবং আকর্ষণীয়তায় যদি সাধারণ মানের নিচে না হয়, যতদিন সে সন্তানলাভের কামনা থেকে মুক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সে সম্পূর্ণভাবে নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু সন্তানকামনা প্রবল হলে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং তার কাজটিও হারাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এতদিন যে আরামের জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে তার থেকে অনেক নিচের স্তরে নেমে যায়, কারণ তার স্বামীর উপার্জন, সে আগে যা উপার্জন করত কোনওভাবে তার চেয়ে বেশি নয়। যে আয় থেকে এখন সংস্থান করতে হয় একটি পরিবারের, শুধুমাত্র একজন রমণীর নয়। স্বাধীনভাবে চলার পর এখন প্রয়োজনীয় খরচের জন্যে প্রতিটি পয়সা অন্যের কাছে চেয়ে নেওয়া তার জন্যে পীড়াদায়ক। এইসব কারণে এইরকম নারী মাতৃত্বলাভে দ্বিধাগ্রস্ত।
কোনও নারী তবুও যদি সব দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে উঠে মা হতে চায়, সে আগের প্রজন্মের নারীদের তুলনায় একটি নতুন এবং আতঙ্কজনক সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং তা হল গৃহ পরিষেবার অভাব অথবা নিম্নমানের পরিষেবা। এর ফলে সে বাড়ির সাথে বাঁধা পড়ে যায়, হাজাররকম সব তুচ্ছ কাজ করতে সে বাধ্য হয়, যা তার দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের পক্ষে অনুপযুক্ত। অথবা এসব যদি সে নিজে নাও করে তবু কাজে অবহেলাকারী পরিচারিকাদের তিরস্কার করতে করতে নিজের মেজাজ নষ্ট করে। সন্তানদের লালন-পালনের ভার কার ওপর দেওয়া হবে সে বিষয়ে যদি তার ভাল জ্ঞান থাকে, তবে নার্সদের হাতে তাদের সপে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়, তার ওপর পরিচ্ছন্নতা এবং শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ সতর্কতার ব্যাপার তো রয়েছেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে উচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নার্স রাখতে সমর্থ হয়। এইসব ছোট-বড় তুচ্ছ নানা বিষয়ের চাপে যদি সে তার সমস্ত লাবণ্য এবং কমনীয়তা এবং বুদ্ধিমত্তার তিন-চতুর্থাংশ হারিয়ে না ফেলে, তবে তাকে ভাগ্যবর্তী বলতে হবে। এইসব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় যে, এরকম নারী তাদের স্বামীদের কাছে ক্লান্তিকর এবং সন্তানদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে স্বামী যখন বাড়ি ফিরে আসে, স্ত্রী তখন সারাদিনের কষ্টের কাহিনী বলতে শুরু করে, তখন তা বিরক্তিকর। কিন্তু যে স্ত্রী এসব বলে না সে অন্যমনস্ক থাকে। সন্তানদের সম্পর্কে, সে তাদের পাওয়ার জন্যে যেসব স্বার্থত্যাগ তাকে করতে হয়েছে সে বিষয়ে সবসময় সে এমনই সচেতন, যার ফলে সে এর জন্যে আশার-অতীত যে পুরস্কার তা দাবি করবেই। সব সময়ে নানা তুচ্ছ বিষয়ে মনোসংযোগ করতে হয়েছে বলে সে ব্যস্তবাগীশ এবং সংকীর্ণমনা হয়ে গেছে। সে যতরকম অবিচার ভোগ করেছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর কারণ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে তাদের ভালবাসা হারিয়েছে। কিন্তু যদি সে তাদের অবহেলা করত এবং মনের আনন্দ ও দেহের লাবণ্য ধরে রাখত তাহলে তারা সম্ভবত তাকে ভালবাসত।
এইসব দুর্ভোগ প্রধানত অর্থনৈতিক, তাছাড়া আরও একটা সমস্যা রয়েছে যা সমান গুরুতর। সেটা হচ্ছে গৃহসমস্যা। বড় বড় নগরে অনেক লোক কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগে শহর এখনকার গ্রামাঞ্চলের মতোই ছিল। শিশুরা এখনো যে শিশু-ভোলানো ছড়াটি গায়,
“পলের গির্জার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ
গাছটি একেবারে আপেলে ভরা
লন্ডন শহরের ছোট ছেলেরা
তারা লাঠি নিয়ে ছুটছে সেগুলি পাড়তে
ছুটে চলেছে বেড়ার পর বেড়া পার হয়ে
যতক্ষণ না তারা পৌঁছে লন্ডন ব্রিজের কাছে।”
পলের গীর্জা আর নেই। আমি জানি না সেন্ট পল গীর্জা ও লন্ডন ব্রিজের মধ্যে যত বেড়া ছিল কখন তা অদৃশ্য হয়েছে। বহু শতাব্দী আগে লন্ডন শহরের ছোট ছোট ছেলেরা এরকম আনন্দ উপভোগ করতে পারত। এই শিশুতোষ ছড়া তাই নির্দেশ করে। কিন্তু খুব বেশি দিনের কথা নয় যখন অধিকাংশ মানুষ পল্লীঅঞ্চলে বাস করত, শহরগুলি এত বড় ছিল না। শহর ছেড়ে আসা যেত খুব সহজে এবং শহরের অনেক বাড়ির সাথে বাগান দেখা খুব সাধারণ দৃশ্য ছিল, কিন্তু এখন ইংল্যান্ডে শহরের লোকসংখ্যা গ্রামের তুলনায় অনেকগুণ বেশি বেড়েছে। আমেরিকাতে এই বৃদ্ধি এখনো কম, কিন্তু খুব দ্রুত তা বেড়ে চলেছে। লন্ডন এবং নিউইয়র্কের মতো নগর এতই বড় যে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে প্রচুর সময় লাগে। নগরে যারা বাস করে তারা সাধারণভাবে একটি ফ্ল্যাট নিয়েই তৃপ্ত থাকে, তার সাথে অবশ্য এক বর্গ ইঞ্চি মাটিও সংলগ্ন থাকে না। মধ্যবিত্তদের খুশী থাকতে হয় ন্যূনতম জায়গা নিয়ে। ছোট ছোট শিশুরা থাকলে ফ্ল্যাটে জীবন কাটানো কঠিন। সেখানে তাদের খেলার জায়গা নেই। তাদের কোলাহল থেকে দুরে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই তাদের বাবা-মার। এজন্যে উচ্চপেশাজীবীরা ক্রমেই শহরতলিতে থাকার দিকে ঝুঁকছে। শিশুদের কথা বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে এটা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু এতে মানুষের ক্লান্তি আরো বেড়ে যায় এবং পরিবারের জন্যে যতটুকু ভূমিকা সে পালন করতে পারত ততটুকু করার ক্ষমতা তার থাকে না।