পারস্পরিক ভালবাসা বিকাশের মনস্তাত্ত্বিক অথবা সামাজিক বাধা সবক্ষেত্রেই অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর জন্যে পৃথিবী সর্বকালেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যদি ভুল লোকের কাছে পড়ে, সেই ভয় থেকেই মানুষ সহজে কারো প্রশংসা করতে চায় না, তারা সহজে ভালবাসাও দিতে চায় না। যদি তা অপাত্রে দান করা হয় এই ভয়ে যদি তার কাছ থেকে অথবা সমালোচনাময় পৃথিবী থেকে দুঃখ পায়। নৈতিকতা এবং বৈষয়িকতা এই দুয়ের নামেই সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার ফলে যেখানেই ভালবাসার সম্পর্ক, সেখানেই উদারতা এবং সাহসিকতাকে নিরুৎসাহ করা হয়। এইসব উপদেশ-নির্দেশ মানবসমাজের বিরুদ্ধে ভীরুতা এবং ক্রোধ তৈরী করে। কারণ অনেক মানুষ জীবনভর জানতেই পারে না কী তার মৌলিক চাহিদা এবং তা থেকে সে বঞ্চিতই থেকে যায় এবং প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে নয় জনেরই বিশ্বের প্রতি সুখী ও উদার মনোভাব গড়ে তোলার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, যাদের অনৈতিক বলা হয়, তারা যাদের বলা হয় না তাদের চেয়ে উন্নত। যৌনতা সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ে যাকে বিশুদ্ধ ভালবাসা বলা হয়, তা প্রায় থাকেই না। থাকলেও খুবই কম, বরং সেখানে দেখা যায় মৌলিক বিরূপতা, প্রত্যেকেই অন্যের কাছে ধরা না দেওয়ার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই নিজেদের একাকীত্বকে রক্ষা করে চলে। প্রত্যেকেই অস্পৃষ্ট থাকে এবং সে জন্যেই তারা ব্যর্থ হয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কোনও বাস্তব মূল্য নেই। আমি বলি না, তাদের সযত্নে এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ তা করতে গেলে যেখানে আরো মূল্যবান এবং গভীর ভালবাসা জন্মাবার সম্ভাবনা, তার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি বলতে চাই, যে যৌন সম্পর্কের বাস্তব মূল্য আছে তা এমন, যেখানে কোনও বাক-সংযম নেই, যার মধ্যে দুজনের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব একসাথে মিলিত হয়ে নতুন এক সংযুক্ত ব্যক্তিত্বে রপ লাভ করবে সব রকমের সতর্কতার মধ্যে। ভালবাসায় সতর্কতা সম্ভবত যথার্থ সুখের পক্ষে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক।
—–
১. ডীন, সুইফট, Dean Jonathan Swift (১৬৬৭-১৭৪৫) আয়াল্যান্ডে জন্ম ইংরেজী ভাষার বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক সাহিত্যের রচয়িতা (Satirist)।
১৩. পরিবার
অতীতের উত্তরাধিকাররূপে আমরা যতগুলি প্রতিষ্ঠান লাভ করেছি, তার মধ্যে, বর্তমানে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে বিশৃঙ্খল এবং লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে, এমন আর কোনওটি হয়নি। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহ এবং বাবা মার প্রতি সন্তানের ভালবাসা সুখের একটি শ্রেষ্ঠ উৎস। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বর্তমানে বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক দশের মধ্যে নয়টি ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের দুঃখের উৎস হয়ে পড়েছে এবং শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে অন্তত একপক্ষের দুঃখের কারণ হয়েছে। নীতিগতভাবে পরিবারের পক্ষে মৌলিক তৃপ্তি দিতে পারার ব্যর্থতা, আধুনিক যুগের অসন্তোষের একটি গভীর কারণ, যে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বা নারী নিজের সন্তানদের সাথে সুখের সম্পর্ক রাখতে চায় অথবা তাদের একটা সুখী জীবনে রাখতে চায়, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত এবং ভাবনার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করা উচিত। পারিবারিক বিষয় এত ব্যাপক বিশাল যে এই গ্রন্থে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর সাথে জড়িত বিশেষ সমস্যার সাথে সুখের সন্ধান-এর সম্পর্ক রয়েছে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। যে সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবছি তার মধ্যেও পরিবার সম্পর্কে শুধু সেটুকুই আলোচনা করতে পারি, যেখানে সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন না করেও পরিবারের উন্নতি বিধানের ক্ষমতা প্রত্যেকটি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এই সীমাবদ্ধতা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুতর, কারণ আমাদের কালে পারিবারিক অসন্তোষের কারণ বিচিত্র ধরনের মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাবিষয়ক এবং রাজনৈতিক। ধনী সমাজের নারীদের কাছে এখন মাতৃত্বকে পূর্বের তুলনায় দুটি কারণে অনেক বোঝা বলে মনে করা হয়। এই দুটি কারণ হচ্ছে– একদিকে অবিবাহিতা মেয়েদের নিজস্ব জীবিকার পথ খুলে যাওয়া, অন্যদিকে গৃহ-পরিষেবার জন্যে লোকের অভাব। আগের দিনের মেয়েরা চিরকুমারী জীবনের অসহনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে বাধ্য হত। অবিবাহিতা মেয়েদের বাড়িতে অর্থনৈতিক নির্ভরতার ওপর বাঁচতে হত প্রথম জীবনে বাবার ওপর, পরে অনিচ্ছুক ভাইদের ওপর। দিন যাপনের মতো কোনও কাজ ছিল না তাদের এবং বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে আনন্দ উপভোগের কোনও স্বাধীনতাও ছিল না। তাদের যৌনজীবনে উৎসাহিত হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, আসক্তিও ছিল না। তাছাড়া বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম ঘৃণ্য বলেই তারা বিশ্বাস করত। তবু এমন সব পারিবারিক রক্ষা-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও ফন্দিবাজ লুব্ধকের ছলাকলায় পড়ে তার চরিত্র নষ্ট হত, তাহলে তার দুর্দশার সীমা থাকত না। ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ বইয়ে এরকম অবস্থায় একটি নির্ভুল বর্ণনা আছে।
“তার অপরাধ লুকাবার
তার লজ্জা সবার দৃষ্টি থেকে ঢেকে রাখার
তার দয়িতের অন্তরে অনুতাপ জাগাবার,
এবং তার অন্তর ভাঙার একটাই পথ–
তার মৃত্যুকে আলিংগন।”