কোন্ স্নেহ শ্রেষ্ঠ তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুব সহজ নয়। কারণ তার মধ্যে কিছু মাত্রায় রক্ষণাত্মক বস্তু থাকা উচিত, যাদের আমরা ভালবাসি তারা কোনও আঘাত পেলে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। কিন্তু আমি মনে করি, দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা যা দুর্ভাগ্যের প্রতি সহানুভূতির, যে দুর্ভাগ্য ঘটে গেছে তার বিপরীত, ভালবাসা যতটুকু সম্ভব, অল্প হলেও একটা ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের সম্পর্কে ভয় অন্যের সম্পর্কে ভয়ের চেয়ে আংশিক ভাল। তার ওপর প্রায় সময়েই এই বোধ অধিকার-বাসনার ছদ্মবেশ। আশা করা হয় ভয় জাগিয়ে অন্যের ওপর আরো বেশি প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা যাবে। পুরুষ ভীরু নারীকে যে পছন্দ করে এটাও তার একটা কারণ, তাহলে তাদের রক্ষা করে দখল করা যায়। নিজের ক্ষতি না করে কোনও মানুষ অন্যের জন্যে কতটা উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে, তা নির্ভর করে তার চরিত্রের ওপর। যে মানুষ শক্তিমান এবং দুঃঃসাহসী, নিজের ক্ষতি ছাড়াই অনেক কিছু সহ্য করতে পারে। কিন্তু ভীরু মানুষ এইভাবে যেন বেশি কিছু না করে সেই ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করা উচিত।
প্রাপ্ত স্নেহ-ভালবাসার কাজ দ্বিধাবিভক্ত। এর আগে নিরাপত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ বয়সে এর মধ্যে আরেকটু বেশি জৈবিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং তা হচ্ছে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্ব। যৌনতা-সম্পর্কিত ভালবাসার প্রেরণা জাগাতে না পারা যে কোনও নারী বা পুরুষের জন্যে চরম দুর্ভাগ্য। কেন না এতে তারা বঞ্চিত হয়, জীবন যে শ্রেষ্ঠ আনন্দ তাদের দান করে, তা থেকে। এই বঞ্চনা এখন হোক বা পরে হোক, উদ্দীপনাকে ধ্বংস করে এবং অন্তর্মুখীতা তৈরি করে। শৈশবের কোনও ভাগ্য বিপর্যয় চরিত্রে এমন ত্রুটির কারণ হতে পারে যার জন্যে উত্তর-জীবনে ভালবাসা পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না, যে ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে। এটা নারীদের তুলনায় সম্ভবত পুরুষের ক্ষেত্রে বেশি বাস্তব, কারণ নারীকে আকর্ষণ করে সম্ভবত পুরুষের চরিত্র, আর পুরুষের আকর্ষণ থাকে নারীর রূপে। একথা অবশ্যই বলা উচিত যে, এ বিষয়ে পুরুষরা নারীদের তুলনায় নিজেদের ছোট করে, কারণ নারীরা পুরুষদের যেসব গুণে খুশী হয়, তার থেকে পুরুষরা নারীদের যেসব গুণে খুশী হয় তা কম কাম্য। আমি নিশ্চিত নই, উন্নত চরিত্র গঠন করা সুন্দর রূপ তৈরী করার চেয়ে সহজতর কিনা। কিন্তু যে কোনও ভাবে পরের ধাপটি ভালভাবে বোঝা বেশি প্রয়োজনীয় এবং নারীরা সহজেই তা অবলম্বন করে, কিন্তু আগের ধাপটি অর্জন করার জন্যে পুরুষদের যা করা দরকার তারা তা করে না।
কোনও মানুষ যে স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে থাকে তা নিয়েই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। এখন আমি, যে স্নেহ ভালবাসা দেওয়া হয় তার কথা বলব। এটা আবার দুই প্রকার। এর একটি সম্ভবত জীবনের উদ্দীপনার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান প্রকাশ, অন্যটা হল ভয়ের প্রকাশ। আমার কাছে প্রথমটা পুরোপুরি প্রশংসাযোগ্য, আর পরেরটা খুব বেশি হলে একটি সান্ত্বনা। আপনি যদি খুব সুন্দর দিনে মনোরম বেলাভূমির পাশ দিয়ে জাহাজে চলেন, আপনি সাগর-বেলার প্রশংসা করবেন এবং এতে আপনি আনন্দ পাবেন। এই আনন্দ সম্পূর্ণরূপে বাইরের দৃষ্টি থেকে লাভ করা এবং মনের কোনও তীব্র প্রয়োজনের সাথে তা সম্পর্কহীন। অন্যদিকে যদি আপনার জাহাজটা ডুবে যায় এবং বিকল হয়ে পড়ে এবং আপনি সাঁতার কেটে তীরে এসে ওঠেন, তখন তার প্রতি আপনার নতুন ধরনের ভালোগা জন্মাবে। তখন এই তীর হয়ে উঠবে তরঙ্গের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা এবং এর সৌন্দৰ্য্য অথবা কুৎসিত রূপ অবান্তর ব্যাপারে পরিণত হবে। নিরাপদ জাহাজের যাত্রীর মনে যে অনুভূতি, সুন্দর ভালবাসার সমগোত্রীয় তা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে সাঁতার কেটে তীরে উঠে আসা যাত্রীর অনুভূতির সাথে যা মেলে তা সুন্দর ভালবাসা নয়। এদের মধ্যে প্রথম ধরনের ভালবাসা সম্ভব সে মানুষের পক্ষে যে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে। পক্ষান্তরে নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে দেখা দেয় ভালবাসার পরের রূপটি। নিরাপত্তাবোধের অভাবের কারণে যে অনুভূতি তুলনায় তা অনেক বেশি বস্তুগত এবং আত্মকেন্দ্রিক কারণ ভালবাসার মানুষ এখানে মূল্যবান কারণ তার কাছ থেকে পরিষেবা পাওয়া যায় বলে সহজাত কোনও গুণের জন্যে নয়। একথা আমার বলার উদ্দেশ্য নয় যে, জীবনে এ ধরনের ভালবাসার কোনও বৈধ ভূমিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে সকল নির্ভেজাল ভালবাসার মধ্যেই এই দুইয়ের কিছু কিছু অংশ যুক্তভাবে রয়েছে এবং ভালবাসা যতটুকু নিরাপত্তা বোধহীনতাকে দূর করতে সক্ষম ততটুকু তা একজন মানুষকে তার অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়। যে অনুভূতি থেকে সে আবার সেই মুহূর্তে বিপন্ন এবং ভয়ার্ত জগতের সব অন্ধকার যে দূর হয়ে গেছে তা অনুভব করতে পারে। এই ধরনের ভালবাসার যে ভূমিকা জীবনে, তাকে স্বীকৃতি জানিয়েও আমাদের বলতে হয় এটা অন্যটার তুলনায় কম সুন্দর, কারণ এটা ভয়ের ওপর নির্ভর করে এবং ভয় একটি ক্ষতিকর জিনিস এবং আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক। সবচেয়ে সুন্দর ভালবাসায় মানুষ আশা করে নতুন সুখের, পুরোনো অ-সুখ থেকে পালাতে নয়।
সুন্দরতম ভালবাসা যে দেয় এবং যে পায়, দুজনের জন্যেই জীবন-প্লাবী । প্রত্যেকেই পরমানন্দের সাথে ভালবাসা গ্রহণ এবং দান করে এবং পারস্পরিক সুখের কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে আরো বেশি চিত্তহারী মনে করে। এ ছাড়া আরো এক ধরনের ভালবাসা আছে যেটা খুব যে কম তা নয় তাতে একজন অন্যজনের প্রাণশক্তি শুষে নেয়। একজন যা দেয় অন্যজন তা গ্রহণ করে কিন্তু প্রতিদানে প্রায় কিছুই দেয় না। এই ধরনের রক্তশোষণকারীর দলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোক আছে, তারা একের পর এক হতভাগ্যকে ধরে এবং বলিপ্রদত্ত প্রাণীর মতো জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়। এবং নিজেদের উন্নতি করে নেয় এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের তা শুষে নিয়েছে তারা হয়ে পড়ে নিষ্প্রভ, ম্লান এবং শক্তিহীন। এই ধরনের লোক নিজেদের স্বার্থের জন্যেই শুধু অন্যদের ব্যবহার করে কিন্তু তাদের সত্তাকে কখনো স্বীকৃতি জানায় না। তারা কিছু সময়ের জন্যে যাদের ভালবাসে বলে মনে করে, মৌলভাবে তাদের প্রতি কোনও উৎসাহ থাকে না। তারা শুধু নিজেদের কাজের প্রেরণার বিষয়ে আগ্রহী এবং সম্ভবত তা নৈর্ব্যক্তিক ধরনের। বোঝা যায় এটা তাদের স্বভাবের ক্রটি। কিন্তু তা এমন একটা রোগ যাকে সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং নিরাময় করা খুব সহজ নয়। প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রায়ই যুক্ত থাকতে দেখা যায়, এবং আমার মনে হয় মানুষের সুখ উৎপাদন অর্থে যে ভালবাসা, যা দুজনের আলাদা মঙ্গলের জন্যে নয়, বরং যা দুজনের মিলিত মঙ্গলের জন্যে, তাই হল প্রকৃত সুখের সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ। যে মানুষের অহমিকা ইস্পাতের দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ সেখানে ভালবাসার এই বিস্তার সম্ভব নয় এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ দান থেকে বঞ্চিত, তা পেশায় সে যত সফলই হোক। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালবাসাকে তার সীমানা থেকে দূরে রাখে তা সাধারণত প্রথম জীবনের দুঃখ, পরবর্তীকালে অবিচার অথবা এমন কোনও কারণ যা নির্যাতন বাতিকে পরিণত হয়েছে, তা মানব সমাজের প্রতি রাগ বা ঘৃণা থেকে জন্ম নেয়। পৃথিবীকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে হলে অতি-অহমিকা, যা একটি কারাগার, থেকে যে কোনও মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে। কোনও মানুষ এই আত্ম-কাব্য থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কিনা তার লক্ষণ দেখা যাবে তার যথার্থ ভালবাসার ক্ষমতা আছে কিনা তার মধ্যে। ভালবাসা পাওয়া কোনও ভাবেই যথেষ্ট নয়, ভালবাসা যা পাওয়া গেল তাকে মুক্ত করে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং যেখানে দুই একমাত্রায় বিরাজ করে সেখানেই ভালবাসা শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনা খুঁজে পায়।