এটা স্পষ্ট যে, অতৃপ্তির মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনেক এবং নানা ধরণের । কিন্তু তাদের মধ্যেও একটা মিল আছে। জন্ম-অসুখী তাকেই বলা হয় যে প্রথম জীবনে কোনও স্বাভাবিক কামনার সহজ পরিতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরে সেই একটিমাত্র কামনার পরিতৃপ্তিকেই অন্য আর সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সে তার জীবনকে একটিমাত্র দিকেই চালিত করেছে। কামনার সাথে প্রস্তুতির ওপরেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে, তার সাথে যুক্ত আনুষাঙ্গিক উপকরণসমূহকে অগ্রাহ্য করে। বর্তমানে আর এক নতুন ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, কোনও ব্যক্তি নিজেকে কোনও বিষয়ে অতি পরাজিত মনে করার ফলে কোনও পথেই তৃপ্তিকে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেছে চিত্তবিক্ষেপ আর বিস্মৃতিকে। এরপর সে সহজ আনন্দের অনুসারী হয়ে উঠবেই। এর অর্থ হল সে নিজেকে অর্ধমৃত করে জীবনকে সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ মাতলামির কথা বলা যায়, যা হল সামাজিক আত্মহত্যা। মাতলামি থেকে যে সুখ পাওয়া যায় তা শুধুই নেতিবাচক, অতৃপ্তিকে সাময়িকভাবে ভুলে থাকা। আত্মপ্রেমী এবং আত্মগর্বী লোক অন্তত বিশ্বাস করে সুখ লাভ করা সম্ভব, যদিও তা পাওয়ার জন্যে তারা ভুল পথ অবলম্বন করে। কিন্তু যে লোক নেশার পথে এগিয়ে যায়, যে নেশাই তা হোক সে সবছির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র বিস্মৃতি ছাড়া। তার ক্ষেত্রে প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, সুখ অবশ্যই প্রত্যেকের কাম্য। নিদ্রাহীন ব্যক্তি যেমন নিদ্রাহীনতার জন্যে গর্বিত, অসুখী ব্যক্তি তেমনি অসুখী হওয়ার জন্যে সবসময় গর্বিত থাকে। দারিদ্রের অহংকার, অতৃপ্তির অহংকার এসব কিছুই মনে হয় সেই লেজকাটা খেকশিয়ালের মতোই অহংকারের। যদি তা সত্যি হয় তাহলে তার প্রতিবিধান হল নতুন লেজ গজানোর শিক্ষা দান করা। যদি তারা সুখের পথ দেখতে পায়, তাহলে আমার বিশ্বাস, খুব কম মানুষই স্বেচ্ছায় অসুখী হওয়ার পথ বেছে নেবে। এমন লোক যে রয়েছে তা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি তাই ধরে নেব যে, পাঠকেরা অসুখী হওয়ার চেয়ে সুখী হতেই চাইবেন। আমি জানি না এ বিষয়ে বুঝতে তাদের কোনও সাহায্য করতে পারব কিনা, কিন্তু এই ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টা তাদের কোনও ক্ষতি করবে না।
——–
১. কবি ব্লেক- William Blake (১৭৫৭-১৮২৭) অষ্টাদশ শতকের কবি। যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে অতীন্দ্রিয়বাদকে অবলম্বন করে কাব্যসাধনা করেছেন। রাসেলের উদ্ধৃতি “Auguries of Innocence” কবিতা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
২. আলেকজান্ডার : Alexander the Great (খ্রিঃ পূঃ ৩৫৬-৩২৩)। সম্রাট ফিলিপের পুত্র, বিশ্ববিখ্যাত দিগ্বিজয়ী, দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন।
৩.নেপোলিয়ন, Napolean Bonaparte (১৭৬৯-১৮২১)। ফরাসী জেনারেল, পরে কনসাল এবং সম্রাট। ইউরোপের ইতিহাসে সুবিখ্যাত এক নাম। শেষ জীবন কাটে বন্দীদশায়-সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেখানেই মৃত্যু।
০২. বায়রনীয় অ-সুখ
বিশ্বের ইতিহাসে পূর্বেও যেমন ছিল, বর্তমানেও সবার ধারণা এই যে, আমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তারা প্রাচীন যুগের সব উৎসাহ-উদ্যমের পরিচয় পেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে বেঁচে থাকার জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যারা এই মতো ধারণ করেন, তারা যথার্থই অসুখী, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা গর্বিত। কারণ তারা বিশ্বের এই প্রকৃতিকে অতৃপ্তির হেতুরূপে প্রচার করেন এবং মনে। করেন যে, আলোকিত মানুষের পক্ষে অতৃপ্তিই হচ্ছে একমাত্র যৌক্তিক মনোভাব। তারা তাদের অতৃপ্তির জন্যে অহংকার বোধ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দুর্দশাকে উপভোগ করেন, তিনি নিজে দুর্দশাগ্রস্ত নন। এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সরল। এ বিষয়ে দ্বিধা নেই যে উচ্চমন্যতাবোধ এবং অন্তদৃষ্টি দুঃখভোগ জনিত কিছু ক্ষতি পূরণ করে। কিন্তু সহজ আনন্দ উপভোগের অভাব তা পূরণ করতে পারে না। আমি মনে করি না যে অসুখী হওয়ার মধ্যে কোনও উচ্চমার্গের বিচারবোধ আছে। জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অবস্থায় যতটা সম্ভব ততটাই সুখী হবেন এবং যদি তিনি অনুভব করেন যে পৃথিবীর ব্যাপারে ভাবনা একটা বিশেষ সীমার পর বেদনাদায়ক, তখন তিনি তার পরিবর্তে অন্য কিছু ভাববেন। এই অধ্যায়ে এই কথাটাই আমি প্রমান করতে চাই। পাঠককে বোঝাতে চাই যে নানারকম বিতর্ক থাকলেও যুক্তি কখনো সুখের ওপরে নিষেধবিধি আরোপ করেনি। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি যারা তাদের দুঃখের কারণকে আন্তরিকভাবে তাদের পৃথিবী সম্পর্কিত ভাবনার জন্য দায়ী করেন, তারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেন। মূল কথা হচ্ছে, তারা কেন অসুখী তা-ই তারা জানেন না। আর এই অতৃপ্তি তাদের অভ্যস্ত পারিপার্শ্বিক বিশ্বের কম পছন্দের বৈশিষ্ট্যসমূহের দিকেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখে।
আধুনিক আমেরিকানদের জন্যে আমি যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীটি তুলে ধরতে চাই তা মিস্টার জোসেফ উড ক্রাচ’ তার ‘দ্য মডার্ন টেম্পার’ নামে যে পুস্তক তাতে তুলে ধরেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্যে এটি করেছেন কবি বায়রন।(১) সর্বকালের জন্যে করেছেন ‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক। মিস্টার ক্রাচ বলেছেন: আমরা পরাহত এবং জগতে আমাদের স্থান নেই, কিন্তু তাই আমরা আমাদের মানবজন্মের জন্যে দুঃখিত নই।