আত্মপ্রেম, একদিক থেকে, অভ্যাসজাত পাপবোধের বিপরীত-আশ্রয়ী। আত্মপ্রেমের উপাদান হচ্ছে নিজেকে ভালবাসার অভ্যাস এবং অপরের ভালবাসা পাওয়ার কামনা। কিছুদূর পর্যন্ত এটা স্বাভাবিক এবং এর জন্যে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মাত্রাধিক্য ঘটলে এটা খুবই ক্ষতিকর। অনেক নারীর মধ্যে, বিশেষ করে ধনী-সমাজের মহিলাদের মধ্যে ভালবাসা অনুভবের ক্ষমতা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। তখন তাদের মনে জেগে ওঠে অন্য পুরুষদের ভালবাসা পাওয়ার এক তীব্র কামনা। এই ধরণের নারী যখন সন্দেহমুক্ত হন যে কোনও পুরুষ তাকে ভালবেসেছেন, তখনই সেই পুরুষের প্রয়োজন তার জীবনে শেষ হয়ে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়, কিন্তু এত বেশি নয়। এ প্রসঙ্গে ‘লিয়ে দাঁগেরোসে’ নামক কাহিনীর নায়ক, এ সুবিখ্যাত ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। মিথ্যা অহংকার এত উচ্চতায় ওঠে যে, তখন অন্য কোনও মানুষ সম্বন্ধে তার প্রকৃত কোনও কৌতূহল থাকে না। তাই এরা প্রেম থেকে প্রকৃত কোনও সুখ লাভ করতে পারেন। না। উদাহণস্বরূপ বলা যায়, একজন আত্মপ্রেমিক চিত্রশিল্পীদের প্রচুর শ্রদ্ধা পেতে দেখে নিজে চিত্রশিল্পের ছাত্র হতে পারেন, কিন্তু যেহেতু এই শিক্ষালাভ তার কাছে বিশেষ একটি উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষ্য, তাই শিল্পের আঙ্গিকে তার কোনও স্বাদ থাকবে না এবং নিজেকে বাদ দিয়ে তিনি অন্য কোনও কিছুর কথা ভাবতেই পারবেন না। এর ফল হবে ব্যর্থতা এবং নৈরাশ্য, অর্থাৎ ঈপ্সিত প্রশংসার পরিবর্তে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ লাভ। যে সব ঔপন্যাসিক তাদের উপন্যাসে আদর্শ নায়িকারূপে নিজেদের তুলে ধরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও একথা বলা যায়। যে বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক বাইরের তার প্রতি প্রকৃত আকর্ষণ কতটুকু তার ওপর যথার্থ সাফল্য নির্ভর করে। সফল রাজনীতিবিদদের বেলায় দেখা যায় সেই বিয়োগান্ত নাটক। কারণ তাদের নিজের সমাজের প্রতি যে আকর্ষণ এবং যে অব্যবস্থা দূর করবেন বলে তিনি দাঁড়ান, তার পরিবর্তে তার মধ্যে আত্মপ্রেম জেগে ওঠে এবং তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন শুধু নিজের জন্যে। তাই তিনি আর শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য থাকেন না, কেউ তাকে শ্রদ্ধাও করে না। যে ব্যক্তির একমাত্র ভাবনা যে পৃথিবীর সব লোক তার প্রশংসা করুক, তার পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভবও হয় তবুও তিনি পুরোপুরি সুখী হতে পারবেন না, কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কখনো সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক নয়। একজন আত্মপ্রেমিক নিজেকে কৃত্রিমভাবে একটি সীমার মধ্যে ততটুকু আবদ্ধ করেন যেটুকু করেন একজন পাপবোধে তাড়িত ব্যক্তি। আদিম মানুষ ভাল শিকারী বলে হয়তো গর্বিত ছিল, কিন্তু শিকারকে অনুসরণ করার মধ্যে যে উদ্দীপনা তা সে উপভোগ করত। আত্মতৃপ্তি বিশেষ একটা সীমা লঙ্ঘন করলে তার নিজের দোষে সব কাজেই আনন্দকে নষ্ট করে দেয়, যা তখন পৌঁছে যায় উদাসীনতা আর একঘেয়েমিতে। প্রায় ক্ষেত্রে এর মূলে রয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব যার প্রতিকার রয়েছে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির মধ্যে। কিন্তু এই আত্মমর্যাদা লাভ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সফল কাজের মধ্যে নিজেকে যুক্ত রাখা যার প্রেরণা পাওয়া যাবে বস্তুগত ব্যাপার থেকে।
আত্ম-অহংকারীর সঙ্গে আত্মপ্রেমিকের পার্থক্য হচ্ছে, তিনি আকর্ষণীয় হওয়ার চেয়ে বেশি চান ক্ষমতাবান হতে। তারা চান লোকে তাদের ভালবাসার চেয়ে ভয় করুক বেশি। বহু উন্মাদ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ অধিকাংশ মহৎ ব্যক্তি এই শ্রেণীতে পড়েন। মিথ্যা অহংকারের মতো ক্ষমতার প্রতি ভালবাসা সাধারণ মনুষ্য-চরিত্রের একটি প্রবল উপাদান এবং তাকে সেইভাবেই গ্রহণ করতে হবে। যখন এর মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পায় অথবা অসম্পূর্ণ বাস্তববোধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, তখন-ই তা মারাত্মক হয়ে ওঠে। আর তা ঘটলে মানুষ অসুখী বা নির্বোধ হয়। যদি দুটো–ও হয়, যে উন্মাদ নিজেকে মুকুটধারী রাজা মনে করছে, একদিক থেকে তিনি অবশ্য সুখী। কিন্তু তা এমন নয় যা কোনও প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি ঈর্ষা করবে। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’(২) উন্মাদের সমগোত্রীয়, যদিও তিনি উন্মাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু নিজের স্বপ্ন সফল করতে তিনি পারতেন না, কারণ তা তাঁর সাফল্যের সাথে সাথে অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। যখন এ বিষয়ে আর দ্বিধা ছিল না যে ইতিহাসের পরিচিত কালে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী, তখন তিনি ভাবলেন যে তিনিও একজন ঈশ্বর। তিনি কী একজন সুখী মানুষ ছিলেন? তাঁর মাদকাসক্তি, উগ্র ক্রোধ, নারীর প্রতি ঔদাসীন্য এবং তাঁর দেবত্বের দাবি, এসব থেকে বোঝা যায় তিনি তা হতে পারেননি। মানব প্রকৃতির অন্যসব উপাদান বাদ দিয়ে কোনও একটি বিশেষ উপাদানের অনুশীলন করলে শেষ পর্যন্ত সুখী হওয়া যায় না। সাধারণত আত্মগর্বী ব্যক্তি হলে, তা সে উন্মাদ হোক বা নামমাত্র প্রকৃতিস্থ হোক, অতিরিক্ত অবমাননা থেকে জাত হীনতাবোধের ফল। স্কুলে নেপোলিয়ন(৩) সহপাঠীদের তুলনায় হীনমন্যতাবোধে ভুগছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন দরিদ্র বৃত্তিধারী ছাত্র, আর সহপাঠীরা ছিলেন অভিজাত বংশের। তারপর তিনি যখন দেশত্যাগী রাজানুগতদের ফিরে আসার অনুমতি দিলেন তখন তাঁর প্রাক্তন স্কুল সহপাঠীদের তার সামনে মাথা নত করে অভিবাদন করতে দেখে তৃপ্তি লাভ করেছিলেন। কী স্বর্গীয় আনন্দ! তবুও তিনি জার (রাশিয়ার সম্রাট)-কে পরাজিত করে তা থেকেও একই ধরণের আনন্দ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই অভিযান শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনে নিয়ে যায়। কোনও মানুষই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় না। সেজন্যে যে জীবন ক্ষমাপ্রিয়তার প্রভাবে পড়ে কোনও না কোনও দিন তাকে দুরতিক্রম্য বাধার সামনে পড়তেই হয়। এমনটি যা ঘটতে পারে সে জ্ঞান পাছে চেতনাকে গ্রাস করে, তাই তাকে আটকাতে হয় এক ধরণের পাগলামির সাহায্যে। যদি কোনও ব্যক্তি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হন, তা হলে যদি কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেন তখন তিনি তাঁকে কারাগারে প্রেরণ অথবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। রাজনৈতিক দমন এবং মনোবিকলন অর্থে দমন হাত ধরে চলে। যখনই কোথাও মনোবিকলিক দমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখনও প্রকৃত সুখের অভাব দেখা যায়। ক্ষমতাকে নিজের সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখলে সুখ বৃদ্ধিতে অনেকভাবে সাহায্য করে। কিন্তু তাকে জীবনের চরম লক্ষ্য করলে তার ফল বিপদ ডেকে আনতে পারে, বাইরের দিক থেকে না হলেও অন্তরের দিক থেকে।