ঈর্ষা অবশ্যই প্রতিযোগিতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যে সৌভাগ্য আমাদের নাগালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে কখনো আসবে না তাকে আমরা ঈর্ষা করি না। যে যুগে সামাজিক স্তরভেদ ঈশ্বরের বিধান বলে নির্ণীত হয়ে গেছে, সেই যুগে ধনী দরিদ্রের ভেদকেও ঈশ্বরের বিধান বলে মান্য করার বাধ্যতা চলে এসেছে। সেখানে দরিদ্ররা ধনীদের ঈর্ষা করে না, ভিক্ষুকরা কোটিপতিদের ঈর্ষা করে না। কিন্তু অন্য ভিক্ষুকরা যদি সাফল্য লাভ করে, তাহলে অবশ্যই তাদের ঈর্ষা করবে। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক অবস্থানের অস্থায়িত্ব এবং গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের
সাম্যনীতিতে ঈর্ষার পরিসর অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান মুহূর্তে এটি ক্ষতিকর। কিন্তু আরো ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থায় পৌঁছাবার জন্যেই এই অন্যায়কে সহ্য করে যেতে হবে। অসম ব্যবস্থাকে যুক্তি দিয়ে দেখলে তাকে অন্যায় বলেই মনে হবে যদি অবশ্য সেই অসমতা গুণের উৎকর্ষের ওপর না দাঁড়ায়। যখনি তাকে অন্যায় বলে দেখা হবে তখন সে ঈর্ষার জন্ম হবে তার প্রতিকার সেই অন্যায় দূর না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। সুতরাং আমাদের যুগে ঈর্ষা এক অদ্ভুত রকম ভূমিকা পালন করছে। দরিদ্র ধনীকে ঈর্ষা করে, দরিদ্রতর জাতিরা ধনী জাতিদের ঈর্ষা করে, নারী ঈর্ষা করে পুরুষদের, সতী নারীরা ঈর্ষা করে অসতীদের, তারা শাস্তি পাচ্ছে না বলে। যদিও এই কথাটাই সত্যি যে ঈর্ষা বিভিন্ন শ্ৰেণী, বিভিন্ন জাতি ও নারী পুরুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক শক্তি। একই সাথে একথাও সত্যি যে ঈর্ষার ফলে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা হয়, তা কিন্তু ভাগ্যহীনদের সুখ বাড়ায় না। যেসব আবেগ ব্যক্তিজীবন নষ্ট করে দেয়, তা সমাজজীবনও নষ্ট করে দেয়। একথা মনে করা অনুচিত যে ঈর্ষার মতো ক্ষতিকর কিছু থেকে ভাল ফল পাওয়া যাবে। সুতরাং যারা আদর্শবাদী নীতির কারণে সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বৃদ্ধি কামনা করেন তাদের অবশ্যই আশা করা উচিত যে, ঈর্ষা ছাড়া অন্য কোনও শক্তিই হবে সেই পরিবর্তনের যন্ত্র।
সব খারাপ জিনিসের মধ্যেই পরস্পর একটা যোগসূত্র থাকে এবং একটি খারাপ থেকে অন্য একটি খারাপের জন্ম হতে পারে। সাধারণভাবে দেখা যায় অবসাদ ঈর্ষার একটি কারণ। যখন নিজের কাজ শেষ করার পক্ষে নিজের শক্তিকে অপ্রতুল মনে হয় তখন সাধারণভাবে তার মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, তাদের প্রতি ঈর্ষা জেগে উঠবেই। ঈর্ষা কমানোর একটা সহজ উপায় হচ্ছে তাই অবসাদ কমানো। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে এমন একটা জীবন বেছে নেওয়া যা প্রবৃত্তিকে সুখজনক করে তোলে। যে ঈর্ষা স্বাভাবিক পেশাজাত বলে মনে হয় এমন অনেক ঈর্ষার বাস্তব উৎস হল যৌনতা। বিবাহিত জীবন সুখের হলে এবং মনের মতো সন্তান পেলে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সন্তানকে উপযুক্তভাবে মানুষ করার মতো প্রচুর সংস্থান থাকবে, ততক্ষণ সে অন্য লোকদের তার অতিরিক্ত বৈভব বা সাফল্যের জন্যে ঈর্ষা করবে না। মানুষের সুখের উপকরণগুলি এতই সাধারণ যে, ভদ্রলোকরা তা স্বীকার করতে চান না যে তাদের অভাব কীসের। যে কোনও সুসজ্জিতা রমণীকে দেখলেই যেসব রমণী ঈর্ষিত দৃষ্টিতে তাকান তাদের কথা আগেই বলেছি। তারা যে তাদের সহজ প্রবৃত্তিজাত জীবনধারায় সুখী নন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রবৃত্তিজাত সুখ ইংরেজিভাষী মানুষের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে খুব দুর্লভ। এই ব্যাপারে সভ্যতা মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে। ঈর্ষা কমাতে হলে তার কারণ খুঁজে বের করতেই হবে এবং যদি কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে আমাদের সভ্যতার জন্যে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে, যা থেকে উৎপন্ন ঘৃণিত উন্মত্ততায় ধ্বংস হয়ে যাবে সেই সভ্যতা। প্রাচীনকালে লোকে শুধু তাদের প্রতিবেশীদের ঈর্ষা করত, কারণ তাদের পরিচিতের সেই ছিল সীমা। এখন শিক্ষা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিকে না চিনেও বৃহত্তর মানবসমাজ তাদের কাছে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠে। ছায়াছবির মাধ্যমে ধনীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তারা জানতে পারে বলে মনে করে। সংবাদপত্র তাদের বিদেশী জাতির অসভ্যতা সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়। প্রচারের মাধ্যমে যাদের চামড়ার রং তাদের চেয়ে আলাদা তাদের নোংরা কার্যকলাপের কথাও তারা জানতে পারে। হলুদ জাতি ঘৃণা করে সাদাদের, সাদা কালোদের এবং এইভাবেই চলতে থাকে। বলা যেতে পারে এসব প্রচারের কুফলজাত। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় কোনও গভীরতা নেই। প্রচার কেন বন্ধুত্বের মনোভাব তৈরী না করে, ঘৃণা সৃষ্টিতে অধিকতর সাফল্য লাভ করে? এর স্পষ্ট কারণ হচ্ছে মানুষের মনকে বর্তমান সভ্যতা যেভাবে তৈরী করেছে তাতে সে বন্ধুত্বের চেয়ে ঘৃণার দিকেই বেশি করে ঝুঁকে পড়েছে। সে ঘৃণাপ্রবণ কারণ সে অতৃপ্ত, কারণ সে গভীরভাবে অনুভব করে সম্ভবত নিজের অজান্তে সে কোনও কারণে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত অন্যেরা আমাদের ঠকিয়ে প্রকৃতির দান, মানুষের সব আনন্দ উপভোগের ভাল ভাল জিনিসগুলি নিয়ে নিয়েছে। আধুনিক মানুষ যেসব সুখ ভোগ করে সেসবের আসল সমষ্টি আদিম যুগের সমাজে যেসব সুখ দেখা যেত তার চেয়ে সন্দেহাতীতভাবে অনেক বেশি। কিন্তু তা আরও কত বাড়ানো যেতে পারে সেই চেতনাই যেন বেশি তাদের মধ্যে। সন্তানদের নিয়ে যখনই পশুশালায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে, তখনই আপনি যেসব বানর ব্যায়ামের কসরত দেখাচ্ছে না বা বাদাম ভেঙে মুখে দিচ্ছে না তাদের চোখে এক অদ্ভুত অব্যক্ত বেদনা দেখতে পাবেন। আপনি কল্পনা করতে পারেন তারা ভাবছে তাদের মানুষ হয়ে জন্ম। নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তার রহস্য উদ্ধার করতে পারছে না। বিবর্তনের পথে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জ্ঞাতিরা এগিয়ে গেছে তারা পড়ে রয়েছে পিছনে। সভ্য মানুষের সত্ত্বাও একইরকম, পশুশালায় বানরের মতোই পীড়িত ও বেদনাহত। সে বুঝতে পারে প্রায় তার নাগালের মধ্যেই তার চেয়ে ভাল কিছু রয়েছে, কিন্তু সে জানে না কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াবে, কীভাবেই বা তাকে লাভ করবে। নৈরাশ্যে আক্রান্ত হয়ে সে তারই মতো পথহারা এবং অসুখী মানুষদের ওপর রেগে যায়। বিবর্তনের পথে চলতে চলতে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি যেটি অন্তিম পর্যায় নয়। এই পর্যায়কে আমাদের অতিক্রম করে যেতে হবে অতি দ্রুত, কারণ যদি আমরা তা না পারি তাহলে আমাদের অধিকাংশ মধ্যপথে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অবশিষ্টেরা সন্দেহ আর ভয়ের অরণ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং ঈর্ষা অশুভ হলেও-এর ফল ভয়ানক হলেও সম্পূর্ণরূপে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে নয়। এটি আংশিকভাবে একটি বীরসুলভ বেদনার প্রকাশ, এই বেদনা তাদের অন্ধরাত্রে পথ চলা আরো ভাল বিশ্রামের স্থান পেতে অথবা মৃত্যু আর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। এই নৈরাশ্যের মধ্যে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে হলে সভ্য মানুষ তার হৃদয়কে উদার করবে। যেমন সে করেছে তার মনকে। নিজেকে অতিক্রম করার শিক্ষা তাকে শিখে নিতে হবে এবং তা করতে গিয়ে তাকে জেনে নিতে হবে সমগ্র বিশ্বের মুক্তির পথ।