কিন্তু ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি বলতে পারে, আমাকে এসব কথা বলে কী লাভ যে, সুখ হল ঈর্ষার প্রতিষেধক। আমি যতক্ষণ ঈর্ষা বোধ করি ততক্ষণ সুখের সন্ধান পাই না, আর তুমি বলছ সুখ না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঈর্ষা হতে বিরত হতে পারব না। কিন্তু বাস্তব জীবন এত যুক্তির ধার ধারে না। ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার কারণগুলি যদি জানতে পারা যেত, তাহলে এই রোগটি সারাবার পথে অনেক অগ্রগতি হত। কোনও তুলনার ভাষায় চিন্তা করার অভ্যাস ভয়ানক। যদি সুখদায়ক কিছু ঘটে তা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা উচিত, তখন ভাবা উচিতই নয় যে, অন্য কোনও লোক হয়তো এমন সুখ উপভোগ করে যা এর তুলনায় বেশি। ঈর্ষাকাতর লোকটি বলবে, “ঠিক কথা, রোদে ভরা উজ্জ্বল দিন, এখন বসন্তকাল, পাখিরা কুজন করছে, ফুলদল বিকশিত; কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সিসিলির বসন্ত এর চেয়ে সহস্র গুণ বেশি মনোরম। সেখানে হেলিকনের কুঞ্জবনে পাখিদের গান আরও মধুর এবং শারণের গোলাপ আমার বাগানের যে কোনও গোলাপের চেয়ে আরও বেশি মনজুড়ানো। এসব ভাবতে ভাবতে ঈর্ষাকাতর লোকটির মনের আকাশে সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়, পাখির গান অর্থহীন কোলাহলে পরিণত হয়, ফুলগুলির দিকে আর তাকাতে ইচ্ছা করে না। এইভাবে জীবনে সব আনন্দকে সে দূরে ঠেলে দেয়। সে ভাবে, আমার প্রেমিকা খুব সুন্দরী, আমরা পরস্পরকে কত ভালবাসি, কিন্তু শেবার রাণি কী অপরূপাই না ছিলেন! হায়রে সলোমন যেসব সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি যদি তা পেতাম!’ এই ধরনের সব তুলনা অর্থহীন এবং নির্বুদ্ধিতা। শেবার রাণি হোক অথবা পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হোক, যদি আমাদের অতৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে উভয়ক্ষেত্রেই সে কারণ সমান মূল্যহীন। বুদ্ধিমান অন্যের কী আছে আর কী নেই তা নিয়ে ভেবে নিজের আনন্দকে নষ্ট করে না। প্রকৃতপক্ষে ঈর্ষা এক ধরনের অন্যায়, যার কিছু অংশ নৈতিক, কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক। ঈর্ষার নিজের কোনও রূপ নেই, শুধু তুলনার সাহায্যে তাকে অনুভব করা যায়। মনে করুন আমি যে বেতন পাচ্ছি তা আমার প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর। যাতে আমার তৃপ্ত থাকা উচিত। কিন্তু আমি জানতে পারলাম, এমন একজন, যে আমার চেয়ে কোনও দিকেই বড় নয়, সে আমার দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ আমি যদি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ি তা হলে আমি যা পাচ্ছি যা আমার তৃপ্তিদায়ক হওয়া উচিত, তা ম্লান হয়ে গেল এবং আমার ওপর অবিচারের ধারণা আমাকে ক্ষয় করতে শুরু করল। এসবের যথাযথ প্রতিকার হচ্ছে মানসিক শৃঙ্খলা এবং অর্থহীন চিন্তা করার অভ্যাস ত্যাগ করা। মূল কথা হচ্ছে, সুখ অপেক্ষা ঈর্ষা করার মতো বড় কিছু নেই। যদি আমি ঈর্ষাকে দূর করতে পারি তাহলে আমি সুখকে পেয়ে যাব এবং তখন আমি হব ঈর্ষার পাত্র। যে ব্যক্তি আমার চেয়ে দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন। এই চিন্তার কোনও শেষ নেই। যদি আপনি গৌরব চান তা হলে হয়তো নেপোলিয়নকে(৬) ঈর্ষা করবেন। কিন্তু নেপোলিয়ন সীজারকে(৭) ঈর্ষা করতেন। সীজার করতেন আলেকজান্ডারকে(৮) এবং নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আলেকজান্ডার ঈর্ষা করতেন হারকিউলিসকে(৯)। যার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। অতএব একমাত্র সাফল্যের দিক থেকে আপনি ঈর্ষাকে এড়াতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসে অথবা পূরাণে সব সময় এমন লোক পাওয়া যাবে যিনি আপনার চেয়ে বেশি সফল। আপনি ঈর্ষা থেকে দূরে থাকতে পারেন। যদি যে আনন্দ আপনার কাছে আসবে, তা উপভোগ করেন, যে কাজ আপনার করা উচিত তা করেন অহেতুক যাদের আপনি বেশি সৌভাগ্যবান মনে করেন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা না করেন।
অপ্রয়োজনীয় বিনয়ের সঙ্গে ঈর্ষার সম্পর্ক গভীর। বিনয়কে একটি গুণ বলেই মনে করা হয়। কিন্তু আমার নিজের সন্দেহ খুব বেশি, বিনয়ের বাড়াবাড়ি হলে তাকে আর গুণ বলা যায় কিনা। বিনয়ী লোকের মনে বিশেষ প্রত্যয় জাগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। তারা সার্থকভাবে পারবেন এমন কাজ শুরু করতেও সাহস পান না। বিনয়ীদের বিশ্বাস, তারা যাদের সঙ্গে সাধারণভাবে মিশে থাকেন, তারা সব বিষয়েই বড়। তাই তারা বিশেষভাবে ঈর্ষার শিকার হন, যার জন্যে তাদের মনে ঈর্ষা থেকে অতৃপ্তির জন্ম হয়। আমি মনে করি, কোনও বালককে বড় করে তোলার সময় সে যে খুব ভাল, এই কথাটা বলার পক্ষে অনেক কিছু আছে। আমার মনে হয় না কোনও ময়ুর তার পুচ্ছের জন্যে অন্য ময়ুরকে ঈর্ষা করে, কারণ প্রত্যেকটি ময়ুর মনে করে তার পুচ্ছই পৃথিবীতে সুন্দরতম। এর ফলেই ময়ুরেরা শান্তিপ্রিয় বিহঙ্গ। কল্পনা করুন, কোনও ময়ুরকে শেখানো হল, নিজেকে নিয়ে সুন্দর ভাবনা অন্যায়, তা হলে সে অন্য ময়ুরকে পেখম মেলতে দেখামাত্র নিজেকে বলত, “আমি কিছুতেই কল্পনা করব না যে, আমার পেখম ওর চেয়ে সুন্দর, কারণ তা হবে আত্ম-অহংকার। কিন্তু হায়, তাহলে তো আমি ওর মতো সুখী হতাম। ঐ জঘন্য পাখিটা নিজের সৌন্দয্য সম্বন্ধে এতটা আত্মবিশ্বাসী! ওর কটা পালক যদি ছিঁড়ে দিই, তাহলে আর তুলনার কোনও ভয় থাকবে না। সম্ভবত সে তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে এবং প্রমাণ করবে যে এটি একটি খারাপ ময়ুর, যে অময়ুরোচিত আচরণের অপরাধে দোষী এবং সে তাকে ময়ুরদের নেতৃমণ্ডলীর অধিবেশনে অভিযুক্ত করবে। ক্রমে সে এই নীতি প্রতিষ্ঠা করবে যে, বিশেষভাবে সুন্দর পুচ্ছধারী ময়ুরেরা প্রায় সবসময় খারাপ হয় এবং ময়ুররাজ্যের জ্ঞানী শাসকদের উচিত ঝুলে পড়া বিশীর্ণ পালকধারী নিরহংকার ময়ুরকেই ভাল ময়ুর বলে নির্বাচন করা। এই নীতি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার পর সে সুন্দর শ্রেষ্ঠ সব ময়ুরদের একসাথে করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সুন্দর ময়ুরদের মনোহরণ পুচ্ছ অতীতের এক অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে যাবে। নীতিধর্মের ছদ্মবেশে এই হচ্ছে ঈর্ষার জয়লাভ। কিন্তু যেখানে প্রত্যেক ময়ুর নিজেকে অন্যের চেয়ে বেশি সুন্দর মনে করছে, সেখানে এইসব দমননীতির কোনও প্রয়োজন নেই। প্রতিযোগিতায় প্রত্যেকটি ময়ুর প্রথম পুরস্কার পেতে আশা করে এবং প্রত্যেকেই সেখানে তার নিজের ময়ুরীকে মূল্যবান মনে করে। তাই সে বিশ্বাস করে প্রথম পুরস্কার সেই পেয়েছে।