সাধারণ সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জীবনে ঈর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
যখন ভূগর্ভস্থ রেলে বসে থাকেন তখন পাশ দিয়ে যদি কোনও সুসজ্জিতা মহিলা চলে যান, তখন অন্য মহিলাদের চোখের দিকে তাকাবেন, দেখবেন তাদের নিজেকে সম্ভবত আরো ভালরূপে সজ্জিতা দুচারজন ছাড়া সেই পাশ কাটানো মহিলার প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে এবং নানাভাবে তার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। এই সাধারণ ঈর্ষার একটি রূপ হচ্ছে কুৎসার প্রতি আসক্তি। অন্য নারী সম্পর্কে যে কোনও কুৎসা, তুচ্ছ প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও সাথে সাথে বিশ্বাস করা হয়। উন্নত নীতিজ্ঞানও একই উদ্দেশ্যসাধন করে। যারা ঘটনাক্রমে এর বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলে, তাদের ঈর্ষা করা হয় এবং তাদের অন্যায়ের জন্যে শাস্তি প্রদানকে পূণ্য কাজ বলে মনে করা হয়। এই বিশেষ ধরনের পূণ্য নিশ্চয় নিজেরই পুরস্কার।
ঠিক একই জিনিস আবার দেখা যাবে পুরুষদের মধ্যেও। পার্থক্যটা শুধু এই যে নারীরা অন্য সব নারীকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবে, কিন্তু পুরুষরা একই পেশাজীবী হলে তবেই পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। এইটাই সাধারণ নিয়ম। পাঠক, আপনি কখনো অবিবেচকের মতো এক চিত্রশিল্পীর কাছে অন্য শিল্পীর প্রশংসা করেছেন? আপনি কী কখনো একই দলের একজন রাজনীতিবিদের প্রশংসা অন্য রাজনীতিবিদের কাছে করেছেন? যদি করে থাকেন, তা হলে শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রে আপনি বিদ্বেষের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। লেবনিজ(২) এবং হাইজেনসের(৩) মধ্যে যেসব পত্র বিনিময় হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি চিঠিতে দেখা যায় নিউটনের(৪) মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। এই অনুমান থেকে অনেক দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা পরস্পরকে লিখেছে ‘মিঃ নিউটনের মতো অতুলনীয় প্রতিভার বিচার ক্ষমতা আচ্ছন্ন হয়ে পড়া কি পরিতাপের বিষয় নয়? এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তি একের পর এক চিঠিতে স্পষ্টতই বিষয়টি মনে মনে উপভোগ করেছেন এবং কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন। বাস্তবক্ষেত্রে যে ঘটনা নিয়ে তারা শোকের ভণিতা করেছেন, তা ঘটেইনি, যদিও নিউটনের কিছু খামখেয়ালি আচরণ এই ধরনের গুজবের জন্ম দিয়েছিল।
সাধারণ মানুষের সবরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঈর্ষা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। ঈর্ষান্বিত লোক শুধু যে অন্যের ওপর দুর্ভাগ্য চাপাতে চায় তা নয়, সুযোগ পেলে চাপিয়ে দেয় এবং সে নিজেও ঈর্ষায় অসুখী হয়। নিজের যা আছে তা থেকে আনন্দলাভ না করে অন্যের যা আছে তা নিয়ে দুঃখ পায়। সে অন্যের যেসব সুবিধা ভোগ করছে, সম্ভব হলে তা থেকে বঞ্চিত করে। অথচ যেসব সে নিজে পেলে তা তাদের মতোই তার কাছে কামনীয় হত। যদি এই মনোবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তা সকল সৌন্দর্যের পক্ষে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এমনকী বিশেষ দক্ষতার সফল প্রয়োগেও। শ্রমিক যখন পায়ে হেঁটে তার কাজে যায় তখন চিকিৎসক রোগী দেখতে গাড়িতে যাবেন কেন? যেখানে সকলে প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাস করছে তখন বিজ্ঞান গবেষককে কেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বাস করতে দেওয়া হবে? কেন বিশ্বের পক্ষে মূল্যবান এবং দুর্লভ জ্ঞানের অধিকারী কোনও ব্যক্তিকে গৃহকর্মের ভাবনা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে? ঈর্ষা এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে মানুষের স্বভাবে একদিকে কিছুর অভাব থাকলে অন্যদিকে তার পরিপূরক কিছু থাকে, যেমন প্রশংসার মনোবৃত্তি। যিনি মানবজাতির সুখবৃদ্ধি কামনা করেন, তার উচিত প্রশংসা বাড়ানো এবং ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা কমানো।
কিন্তু ঈর্ষার প্রতিষেধক কি? সন্তদের কাছে স্বার্থত্যাগরূপ প্রতিষেধক আছে। যদিও তাদের ভিতর এক সন্ত অন্য সন্তকে ঈর্ষা করছেন এমনটা অসম্ভব নয়। বহু বছর ধরে উচ্চ স্তম্ভে বাস করে সেন্ট সিমিয়ান স্টাইলাইটস যদি শুনতেন অন্য কোনও সন্ত আরো দীর্ঘদিন এবং আরো সরু কোনও স্তম্ভে বাস করছেন তা হলে সম্পূর্ণ খুশী হতেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। সন্তদের কথা থাকুক, সাধারণ নর-নারীর পক্ষে ঈর্ষার একমাত্র ওষুধ হচ্ছে সুখ লাভ করা। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এই যে ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা নিজেই সুখের পথে একটি মারাত্মক বাধা। শৈশবের দুরবস্থা ঈর্ষাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। যে শিশু দেখে তাকে ছেড়ে তার কোনও ভাই বা বোন বেশি আদর পাচ্ছে তখন থেকে সে ঈর্ষা করতে শেখে। সে যখন বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে আসে, তখন সেইসব অবিচার খুঁজে বেড়ায়, যা তার প্রতি হওয়া সম্ভব। যদি অবিচার হয়, সাথে সাথে তা তার চোখে পড়ে। যদি তা না হয়, তাহলে সেই অবিচার নিয়েই সে কল্পনা করে, এমন লোক তো অসুখী হবেই।
সে বন্ধুদের কাছেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কারণ কোন সময় কল্পনাজাত অবহেলা এড়িয়ে চলার কথা সে মনে রাখতে পারে না। কেউ তাকে পছন্দ করছে না, সেকথা সে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে প্রথমে। পরে সে বিশ্বাসকে নিজের ব্যবহারের সাহায্যে সত্যি করে তোলে। শৈশবের আরেকটি দুর্ভাগ্য হচ্ছে যেসব পিতামাতার বাৎসল্যবোধ কম তাদের সন্তান হওয়া। এই অবস্থায় নিজের বাড়িতে আদরের কোনও ভাইবোন না থাকলেও অন্য পরিবারের বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের তার চেয়েও বেশি আদর করছে দেখতে পারে। এতে শিশুদের প্রতি তার ঘৃণা জন্মাবে, নিজের বাবা-মার ওপরও এবং বড় হলে তার অবস্থা বাইবেলে বর্ণিত ইসমাইলের মতো হয়েছে মনে হবে। কোনও কোনও রকম সুখ প্রত্যেকের স্বাভাবিক জন্মগত অধিকার। তা থেকে বঞ্চিত হওয়া তাকে মানসিকভাবে বিকৃত আর বিষাক্ত করে তোলে।