যে দর্শনবিদ্যার কথা বলতে যাচ্ছি, সম্ভবত আমার নিজের জীবনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে তার সাথে প্রকৃত পরিচয় ঘটবে। আমি সুখী হয়ে জন্মাইনি, শৈশবে আমার প্রিয় স্তবগান ছিল ‘পার্থিব বিষয়ে শ্রান্ত এবং আপন পাপে ভারাক্রান্ত। পাঁচ বছর বয়সে আমার অন্তরে প্রতিফলিত হয়েছিল, যদি আমি সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচি, যা আমার বর্তমান বয়সের মাত্র চৌদ্দ ভাগের এক ভাগ, তা হলে আমার সামনে যে সুবিস্তৃত একঘেয়ে জীবন রয়েছে তা সহ্য করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কৈশোরে আমি জীবনকে ঘৃণা করেছি এবং ক্রমাগত আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। কিন্তু গণিতশাস্ত্রকে বেশি করে জানতে আগ্রহী হওয়ায় আমি সেই ইচ্ছা থেকে দূরে থেকেছি। তার জন্যেই আমি এখন জীবনকে উপভোগ করছি। এখন আমি বরং বলতে পারি, একটি বছর শেষ হচ্ছে আর আমিও জীবনকে আরো বেশি উপভোগ করছি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কী আমার চাওয়া, তা জানতে পারার জন্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে অনেকগুলি উপভোগ্য বস্তুর দখল প্রতিষ্ঠা করেছি। আর এর জন্যে অংশত দায়ী হচ্ছে কিছু কামনার বস্তুকে সফলভাবে ত্যাগ করতে পারা, যেমন কিছু বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যে, সব কিছু অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মুলত যা অসম্ভব বলে মনে করেছি তা-ই ত্যাগ করেছি। আমার এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ এই যে, আমি নিজের সম্বন্ধে ভাবনা কমিয়ে দিতে পেরেছিলাম। যেমন যারা পিউরিটানদের শিক্ষা পেয়েছে আমিও তাদের মতো আমার পাপ, বোকামি এবং নানা ভুল-ত্রুটি বিষয়ে ধ্যান করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। নিজেকে মনে হত, এবং যথার্থই মনে হত, আমি একটা হতভাগ্য উদাহরণ। ধীরে ধীরে আমার নিজের বিষয়ে, আমার ভুল-ত্রুটির বিষয়ে উদাসীন থাকতে শিখলাম। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাইরের বস্তুতে ঘনীভূত করতে আরম্ভ করলাম। যা হচ্ছে চলমান দুনিয়ার অবস্থা, জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা আর স্নেহভাজন সহমর্মী ব্যক্তিরা। বাইরের জিনিসে মন দিলে অবশ্য সেসব আবার তাদের নিজস্ব ধরনের সম্ভাব্য মনোবেদনা বয়ে আনে। যেমন বিশ্ব যুদ্ধে মত্ত হয়ে উঠতে পারে, কোনও বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানার্জন সাধ্যের বাইরে হতে পারে, প্রিয় বন্ধুরা মারা যেতে পারে। কিন্তু এই রকম মনোযন্ত্রণা জীবনের উৎকর্ষকে নষ্ট করতে পারে না, যেমন পারে নিজের প্রতি ঘৃণাজাত বেদনা। বাইরের প্রত্যেকটি কাজে অনুসন্ধিৎসা যে কোনও কাজে উৎসাহ দেয় এবং সেই অনুসন্ধিৎসা যতদিন সজীব থাকে ততদিন তা সম্পূর্ণভাবে অবসাদকে প্রতিরোধ করার কাজে লাগে। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কৌতূহল অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও প্রেরণার সঞ্চার করে না। নিজের ব্যাপারে উৎসাহ, দিনলিপি লেখার প্রেরণা দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানে আগ্রহ জাগতে পারে অথবা সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হতে সাহায্য করতে পারে। তাও আবার আশ্রমের দৈনন্দিন কাজে ডুবে গিয়ে নিজের অহং ভুলে যেতে না পারলে সুখী হওয়া যাবে না। যে তৃপ্তি তিনি ধর্মের করুণায় পেয়েছেন বলে ভাবছেন, তা তিনি একজন ঝাড়ুদার হয়েও পেতে পারতেন, যদি তিনি সেই পদে থাকতে বাধ্য হতেন। যেসব হতভাগ্যের আত্মনিমগ্নতা এমন-ই গভীর যে, অন্য কোনও উপায়ে তা থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে না। তাদের তৃপ্তিলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে বাইরের শৃঙ্খলার ওপর ভরসা।
আত্ম-নিমগ্নতা নানা ধরণের। সাধারণভাবে তিনটি ধরণের ওপর আলোচনা করা যেতে পারে : পাপী, আত্মপ্রেমিক এবং আত্মঅহংকারী।
আমি পাপী, অর্থে যে পাপকাজ করে তাকে বোঝাচ্ছি না। কেন না পাপকাজ সকলেই করে না হলে কেউ করে না। সবকিছু নির্ভর করে পাপ বলতে কী বোঝায় তার ওপর। পাপী বলতে যে ব্যক্তি পাপের চিন্তায় নিমগ্ন তাকে বোঝাতে চাই। এই ব্যক্তি সবসময় নিজের কাজের বিরোধী। যদি তিনি ধার্মিক হন, তবে এই আত্মবিরোধিতাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে ব্যাখ্যা করেন। তার নিজের বিষয়ে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা আছে। তার নিজের সম্বন্ধে যে জ্ঞান, তার সাথে সেই ধারণার অবিরাম বিরোধ চলছে। শৈশবে তার জননীর হাঁটুর পাশে বসে যেসব নীতিবাক্য তিনি শুনেছেন যদি তা দীর্ঘদিন যাবৎ তার চেতনা থেকে হারিয়ে যায়, তবে তার জন্যে পাপবোধ হয়তো তার চেতনার গভীরে ডুবে আছে এবং শুধুমাত্র মত্ত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে, তবুও সবকিছুর স্বাদ নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মনের গভীরে কিন্তু তিনি এখনও শৈশবে শেখা নিষিদ্ধ জিনিসকে সেভাবেই মেনে নেন। শপথ করা অন্যায়, মদ্যপান অন্যায়, সাধারণ ব্যবসায়িক চতুরতা অন্যায় এবং সবার ওপরে যৌনতা অন্যায়। তিনি অবশ্য এইসব উপভোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন না। কিন্তু এর জন্যে তার অধঃপতন হচ্ছে এই ধারণা থেকে সবকিছু তার বিষময় হয়ে ওঠে। একটিমাত্র সুখ যা তিনি অন্তর দিয়ে পেতে চান তা হচ্ছে তার জননীর স্নেহাদর। যা তিনি পেয়েছেন শৈশবে, যা তাকে এখনও উদ্বেলিত করে। কিন্তু সেই আনন্দ তার জন্যে আর উন্মুক্ত নয়। তাই আর কিছুকে তিনি পরোয়া করেন না। যেহেতু পাপ তাকে করতেই হবে, তাই গভীরভাবেই তিনি তাতে ডুবে যেতে চান। যখন তিনি প্রেমে পড়েন তখন তিনি দয়িতার কাছে মাতৃসুলভ কোমল স্পর্শ খোঁজেন, কিন্তু তা পেলেও গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ মাতৃমূর্তির আভাসের জন্যে কোনও নারীকে তিনি সম্মান করতে পারেন না, তারা তার যৌনসঙ্গী হয়েছেন বলে। তারপর ব্যর্থতার জন্যে তার মধ্যে জেগে ওঠে এক নিষ্ঠুরতা। তা থেকে জেগে ওঠে অনুশোচনা, আর সেই সাথে নতুনভাবে তিনি আবার কল্পিত পাপবোধ আর প্রকৃত অনুশোচনার স্বাদহীন পথে যাত্রা করেন। এটাই অধিকাংশ দুশ্চরিত্র লম্পটদের মনস্তত্ত্ব। তারা যে পথভ্রষ্ট হন তার কারণ হল তারা একটি অপ্রাপ্যনীয় জিনিসের ওপর নিষ্ঠা রেখে চলেন (তা হচ্ছে মা কিংবা মায়ের প্রতিকল্প)। এ সাথে যুক্ত হয়েছে সেই হাস্যকর নৈতিকতা, যা তার মনে শৈশবে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম জীবনের বিশ্বাস ও ভালবাসার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়াই এইসব মাতৃসুলভ গুণাবলীর শিকারদের সুখ পাওয়ার প্রথম স্তর।