যে বিষয়ে আধুনিক নৈতিকতা অত্যন্ত ক্রটিপুর্ণ তা হল ভয়ের প্রশ্ন। একথা সত্যি যে দৈহিক সাহসিকতা, বিশেষ করে যুদ্ধের সময় পুরুষদের কাছে প্রত্যাশিত। কিন্তু অন্যান্য কারণে সেই সাহসিকতা প্রত্যাশিত নয় এবং নারীদের কাছ থেকে কোনও ধরনের সাহসিকতাই আশা করা হয় না। পুরুষ তাকে পছন্দ করুক, তা যদি কোনও নারী কামনা করে তাহলে সাহসী নারীকে তার সাহসের কথা গোপন করতে হয়। দৈহিক বিপদভিন্ন অন্য বিষয়ে সাহসী লোক সম্পর্কে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। জনমত সম্পর্কে নিস্পৃহ ঔদ্ধত্য বলে ভাবা হয় এবং সে পুরুষ জনগণের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে সাহসী হয় তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সবই যা হওয়া উচিত তার বিপরীত। প্রত্যেক ধরনের সাহস, তা নারী বা পুরুষ যার ক্ষেত্রেই হোক, সৈনিকের দৈহিক সাহসের তুল্য প্রশংসা পাওয়া উচিত। যুবকদের ভিতরকার দৈহিক সাহসের সাধারণত্ব একথার প্রমাণ দেয় যে, জনমতের দাবি এই সাহসের জন্ম দিতে পারে। সাহস বেশি হলে দুশ্চিন্তা কমে যায়। সুতরাং ক্লান্তিও কমে যায়। আধুনিক নারী-পুরুষ যে ধরনের স্নায়ুবিক অবসাদে ভুগছে তার অধিকাংশই সচেতন অথবা অবচেতন ভয় থেকে জন্ম নিচ্ছে।
প্রায় সব ধরনের অবসাদের উৎস হচ্ছে উত্তেজনার প্রতি আকর্ষণ। যদি কোনও মানুষ অবসর সময় ঘুমিয়ে কাটাতে পারে, তা হলে তিনি সক্ষম থাকেন। কিন্তু কাজের সময়টা তার কাছে শুষ্ক লাগে এবং অবসর পেলেই তিনি আনন্দ উপভোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অসুবিধা হচ্ছে এই যে, যে সব উপভোগের জিনিস সহজে পাওয়া যায়, যার বাইরের চাকচিক্য বেশি, সেসবের বেশিরভাগ স্নায়ুকে ক্ষয় করে। উত্তেজক আমোদ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে হয় তা বিকৃত মনোভাবের, না হয় কোনও সহজাত অতৃপ্তির পরিচয় দেয়। সুখীবিবাহের প্রথম অবস্থায় প্রায় ব্যক্তিই উদ্দীপক উপভোগের প্রয়োজন বোধ করেন না। কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বিবাহ এত দীর্ঘদিন পর্যন্ত আটকে রাখতে হয় যে, শেষপর্যন্ত উপার্জনের দিক থেকে যখন আর কোনও অসুবিধা থাকে না, তখন দেখা যায় উদ্দীপক আমোদ উপভোগটা এর মধ্যেই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এবং তা মাত্র স্বল্প সময়ের জন্যে আটকে রাখা সম্ভব। বর্তমানে বিবাহের যে আর্থিক চাপ বহন করতে হয় তা এড়িয়ে যদি জনমত কোনও যুবককে একুশ বছর বয়সে বিবাহের অনুমতি দিত তা হলে অনেক মানুষই কাজের মতো অবসাদজনক আমোদ-প্রমোদের পথে পা বাড়াত না। এমনই হওয়া উচিত, এরকম সুপারিশ করা অবশ্য নীতিবিগর্হিত এবং বিচারক লিন্ডসের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা থেকেই অনুধাবন করা যাবে। দীর্ঘকালের সম্মানজনক কর্মজীবন সত্ত্বেও তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল, তিনি বড়দের রক্ষণশীলতার জন্যে তরুণরা যেসব দুর্ভোগ ভোগ করে সেসব থেকে তাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আমি আর এ বিষয়ে বেশিদূর যাব না। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আরো কিছু আলোচনা করব।
.
সাধারণ ব্যক্তি যেসব আইন এবং বিধিবিধান বদলাতে পারেন না, কিন্তু তার মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়, তার পক্ষে উৎপীড়ক নীতিবিদদের তৈরী এবং সুরক্ষিত পরিস্থিতির সাথে পেরে ওঠা কঠিন। কিন্তু এটা বুঝতে পারা উচিত যে, উদ্দীপক আমোদ-প্রমোেদ সুখের পথে এগিয়ে দেয় না। যতদিন আরো তৃপ্তিদায়ক উপভোগ তার আয়ত্তের বাইরে থাকবে, ততদিন উদ্দীপক জিনিস ছাড়া তার পক্ষে জীবনকে সহ্য করাই প্রায় অসম্ভব মনে হবে। এই অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি একটিমাত্র কাজ যা করতে পারেন তা হচ্ছে নিজের উপভোগের সীমা নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্বাস্থ্য ও কাজের পক্ষে ক্ষতিকারক অবসাদজনক প্রমোদে মত্ত না হওয়া। তরুণদের বাধাবিঘ্ন দূর করার প্রকৃত উপায় হচ্ছে সামাজিক নীতিমালার পরিবর্তন সাধন। এর মধ্যে তরুণদের ভেবে দেখা উচিত যে, পরে তাদেরও বিয়ে করার মতো অবস্থা আসবে। অতএব যা সুখী বিবাহকে অসম্ভব করে তুলতে পারে এমনভাবে জীবন কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ এ থেকে বিপদ সহজেই ঘটে যেতে পারে স্নায়ু অবসন্ন হলে। তখন বিয়ে করাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে।
স্নায়বিক অবসাদের সবচেয়ে খারাপ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা ব্যক্তি এবং বাইরের জগতের মধ্যে একটা আবরণ টেনে দেয়। বাইরের পৃথিবীর ধারণা তার কাছে পৌঁছায় অপূর্ণ, অস্বচ্ছ এবং পরিবর্তিতরূপে। তিনি তখন অন্য কোনও ব্যক্তিকে সহ্য করতে পারেন না, আহারে তৃপ্তি পান না, সূর্যালোকে আনন্দ পান না। সামান্য কয়েকটি জিনিসের প্রতি তার তীব্র মনোযোগ থাকে। অন্য সব কিছুর প্রতি তিনি উদাসীন। ফলে অবসাদ ধীরে ধীরে বেড়েই চলে এবং একসময় তা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, তখন তার চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয় এ সবই পূর্ব অধ্যায়ে আলোচিত, পৃথিবীর সাথে শূন্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কের শাস্তি। কিন্তু আমাদের বর্তমান নগরাঞ্চলে যেভাবে জন-বিস্ফোরণ ঘটছে তাতে মাটির সাথে কী করে সংযোগ রক্ষা করা যাবে তা ভেবে পাওয়া সহজ নয়। যাই হোক, এখানে আবার আমরা সেই বিশাল সামাজিক সমস্যার কাছাকাছি চলে এসেছি যা নিয়ে এই গ্রন্থে কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই।
০৬. ঈর্ষা
দুশ্চিন্তার পরেই অসুখী হওয়ার এক শক্তিশালী কারণ সম্ভবত ঈর্ষা। আমার বলা উচিত এই ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা মানুষের সর্বাপেক্ষা সনাতন এবং গভীরতম ক্রোধ-প্রবৃত্তির অন্যতম। বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে শিশুদের এটি খুব বেশি চোখে পড়ে এবং প্রত্যেক শিক্ষাদানকারীর উচিত এই প্রবৃত্তিকে খুব স্নেহময় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা। একটি শিশুকে বঞ্চিত করে অন্য এক শিশুর প্রতি সামান্য পক্ষপাতও সাথে সাথে তার চোখে পড়ে এবং তাতে সে রেগে যায়। যারা শিশুদের দেখাশোনা করেন, তাদের চরম, কঠোর, অপরিবর্তিত এবং সমভাগে বণ্টনযোগ্য ন্যায়বিচারের পথে চালিত হতে হবে। কিন্তু ঈর্ষা ও বিদ্বেষ (বিদ্বেষ ঈর্ষারই বিশেষ এক রূপ) বিষয়ে শিশুরা বড়দের তুলনায় একটু বেশি খোলামেলা। এই আবেগ শিশুদের মধ্যে যেমন বড়দের মধ্যেও একই রকম দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ পরিচারিকাদের কথা বলা যায়। আমার মনে পড়ে একজন বিবাহিতা পরিচারিকা গর্ভধারণ করার পর আমরা বলেছিলাম সে কোনও ভারী জিনিস তুলুক, আমরা তা চাই না। তার অব্যবহিত ফল দেখা গেল অন্যসব পরিচারিকারাও ভারী জিনিস তোলা বন্ধ করে দিল। তখন সেরকম কাজের দরকার হলে আমাদের নিজেদেরই তা করে নিতে হত। ঈর্ষা হল গণতন্ত্রের ভিত্তি। হেরাক্লিটাস(১) বলেন এফেসাসের নাগরিকদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। কারণ তারা বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে কেউ প্রথম স্থানীয় হবে না। গ্রীকরাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনই প্রায় এই ক্রোধ-প্রবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। আধুনিক গণতন্ত্র সম্বন্ধেও একথা সত্যি। তবে একটি আদর্শবাদী মতবাদ রয়েছে, যার মতে গণতন্ত্রই হল আদর্শ রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থা। আমি নিজে এই মতবাদকে সত্যি বলে মনে করি। কিন্তু ব্যবহারিক রাজনীতিতে এমন কোনও বিভাগ নেই, যেখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্যে আদর্শবাদী মতবাদ যথেষ্ট শক্তিশালী। যখন বড় কোনও পরিবর্তন ঘটে যায়, তখন তাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যে যেসব মতবাদ দেখা দেয় তা সবসময় ছদ্মবেশী মানসিক চাঞ্চল্য। মাদাম রোলার স্মৃতিকথা পড়ে দেখুন, যিনি বারংবার জনসেবায় উদ্বুদ্ধ মহিয়সী নারীরূপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেখা যাবে যা তাকে এমন উদ্দীপ্ত গণতন্ত্রীতে পরিণত করেছিল তা হল অভিজাত বাসগৃহ দেখার পর তার ভৃত্যদের বাসস্থান দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা।