উদ্বেগের মনস্তত্ত্ব কোনও ভাবেই সরল নয়। মানসিক শৃঙ্খলার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ কোনও বিষয়ে ঠিক সময়ে চিন্তা করার অভ্যাসই হল সেই শৃঙ্খলা। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত চিন্তার অপব্যয় কম করে দিনের কাজ শেষ করা যায়। দ্বিতীয়ত এটি নিদ্রাহীনতার প্রতিষেধক এবং তৃতীয়ত এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপরতা এবং দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা অবচেতন বা অচেতন মনকে স্পর্শ করতে পারে না এবং যখন কোনও ঝামেলা দেখা দেয় এই ধরনের ব্যবস্থা যদি চেতনার গভীরে প্রবেশ করতে না পারে তাতে কোনও ফল পাওয়া যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা চেতনার ওপর অবচেতনার ক্রিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, কিন্তু অবচেতনার ওপর চেতনার ক্রিয়া নিয়ে তেমন কিছু করা হয়নি। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যবিদ্যায় শেষেরটির মূল্য অনেক বেশি এবং অবচেতনার সীমায় কখনো যদি যৌক্তিক বিশ্বাস গড়ে তুলতে হয় তাহলে এ বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে তা উদ্বেগ-সম্পর্কিত বিষয়ে প্রয়োগ করা যায়। একথা নিজেকে বলা খুব সহজ যে এই ধরনের দুর্ভাগ্য দেখা দিলে তা খুব ভয়ানক হবে না। কিন্তু এটি শুধুমাত্র সচেতন বিশ্বাসরূপে থাকলে ততক্ষণ এটি রাত্রির অনিদ্রাও বন্ধ করবে না, দুঃস্বপ্নও বন্ধ করতে পারবে না। আমার নিজের বিশ্বাস হল, যথেষ্ট বেগ এবং তীব্রতা যোগ করলে সচেতন চিন্তা অবচেতনার মধ্যে রোপিত করা সম্ভব। অবচেতনার অধিকাংশ পূর্বের তীব্র আবেগসচেতন চিন্তা দিয়ে গঠিত, বর্তমানে তারা সমাহিত অবস্থায় রয়েছে। এইভাবে সমাহিত করার কাজ স্বেচ্ছায় করা যায় এবং এইভাবে অবচেতনাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। আমি দেখেছি যে, আমাকে যদি কখনো কোনও কঠিন বিষয়ের ওপর কিছু লিখতে হয়, তাহলে আমি একটি উৎকৃষ্ট পথ খুঁজে নিই। আমি খুব গভীরভাবে চিন্তা করি এবং আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই করি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন ধরে। এই সময় শেষ হলে আমি আদেশ করি যে কাজটি আপাতত বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ুক। তারপর কয়েকমাস পার হয়ে যাওয়ার পর আমি সচেতনভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা শুরু করি এবং তাতে দেখতে পাই যে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এই কৌশল আবিষ্কারের আগে কাজ শেষ হওয়ার অন্তবর্তী মাসগুলিতে কাজের অগ্রগতি নেই বলে দুশ্চিন্তায় ভুগতাম। সেই দুশ্চিন্তার জন্যে কাজ যে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত তা নয়, বরঞ্চ অন্তবর্তী মাসগুলিও অকারণে নষ্ট হয়ে যেত। অথচ আমি এখন এই সময়ে অন্য কাজে মন দিতে পারি। দুশ্চিন্তা নিয়ে সমরূপ নানারকম পথ খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। যখন কোনও দুর্ভাগ্য ভয় দেখায় তখন খুব গভীর এবং শান্তভাবে ভেবে দেখুন তা সবচেয়ে বেশি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। সম্ভাব্য এই চরম দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়ে ভেবে দেখুন বাস্তবে এই দুর্ভাগ্য সত্যিই ততটা ভয়ানক নয়। এইরকম যুক্তি সবসময় পেয়ে যাবেন, কারণ দুর্ভাগ্য চরমরূপ গ্রহণ করলেও এমন কিছু ঘটে না যার কোনও সৃষ্টিমূলক গুরুত্ব আছে। দুর্ভাগ্যের সম্ভাবনার মুখে, তার দিকে শান্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে যদি নিজেকে বলা যায়, বেশ তো, যাই ঘটুক তাতে আমার কিছুই এসে যায় না, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা কমে গেছে আশাকেও ব্যাপকভাবে ছাড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকবার করার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু পরিশেষে যদি কঠিন দুর্ভাগ্যের মুখে দাঁড়াতে মানসিক প্রস্তুতিতে কোনও গলদ না থাকে, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা বাতাসে উড়ে গেছে এবং তাকে প্রতিস্থাপন করেছে একধরনের উল্লাস।
ভয়কে দূরে রাখার ব্যাপক সাধারণ কৌশলের এটি একটা অংশমাত্র। দুশ্চিন্তা একপ্রকার ভয় এবং সব ধরনের ভয় থেকেই জন্ম হয় অবসাদের। যে ব্যক্তি ভয় অনুভব করতে শেখেননি তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় অবসাদ অতিমাত্রায় কমে যায়। যে ভয় সবচেয়ে ভয়ংকর তা সেইখানেই দেখা যায় যেখানে আমরা তার মুখোমুখি হতে চাই না। অসময়ের মুহূর্তে ভয়ংকর সব চিন্তা মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয়। সেসব কোন ধরনের হবে তা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির মনের কোণে কোন না কোন ভয় লুকিয়ে আছে। কারো কাছে এই ভয় ক্যানসার, কারো কাছে তা আর্থিক বিপর্যয়, তৃতীয় জনের কাছে তা কলঙ্কজনক গোপন কথা ফাঁস হওয়া, চতুর্থ জনের কাছে তা সন্দেহের দাহ, পঞ্চম জন ভেবে রাতে অস্থির হয়ে উঠছেন যে প্রথম বয়সে শোেনা নরকানলের কথা। সম্ভবত সত্যি, মনে হয় এরা সকলেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে ভুল কৌশলের সাহায্য নিচ্ছেন। যখনই তাদের মনে ভয় দেখা দেয়, তারা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করেন, আমোদ প্রমোদ অথবা কাজ অথবা যা খুশি নিয়ে মেতে উঠে চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে দেন। কিন্তু প্রত্যেক ধরনের ভয় মনোযোগ না দেওয়ার জন্যে আরো খারাপ হয়ে যায়। মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অর্থই হচ্ছে, যে ভূতের বিভীষিকা থেকে দৃষ্টি ফেরানো হচ্ছে, তাকে মান্যতা দেওয়া। সব রকমের ভয় সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করা। গভীর মনঃসংযোগ করে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভয়ের সাথে পরিচিত হওয়া না যায়, ততক্ষণ। অবশেষে এই পরিচয় তার বিভীষিকার ধারাকে ভোঁতা করে দেবে। বিষয়টাই বিরক্তিকর মনে হবে এবং আমাদের চিন্তাও তা থেকে দূরে চলে যাবে। কিন্তু আগের মতো তার জন্যে কোনও চেষ্টার প্রয়োজন হবে না, তা সরে যাবে তার সম্বন্ধে কোনও উৎস নেই বলে। যখন আপনার কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করতে মন চাইবে, তা যাই হোক, সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা হল তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। স্বাভাবিকভাবে যা করা হত তার চেয়ে বেশি। যাতে শেষ পর্যন্ত সে বিষয়ে মোহটা দূর হয়ে যায়।