যে সব ধনী বোধহীন তাদের কথা ছেড়ে দিয়ে সাধারণভাবে যাদের অবসাদ কঠিন জীবনসংগ্রামের সাথে যুক্ত, তাদের কথায় আসা যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এদের অবসাদ আসে দুশ্চিন্তা থেকে। দুশ্চিন্তা এড়ানো যায় উন্নততর জীবনদর্শন গ্রহণ করে এবং আর একটু মানসিক-শৃঙ্খলার সাহায্যে। অধিকাংশ নারী ও পুরুষ তাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিমাত্রায় অপারগ। এ কথায় আমি বলতে চাই যে, যেখানে প্রতিকারের কোনও উপায় নেই সেখানেও তারা উদ্বেগজনক বিষয়ের চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারে না। মানুষ ব্যবসাবিষয়ক চিন্তাকে বিছানায় সঙ্গী করে নিয়ে যায়। যে সময়ে তাদের পরের দিনের ঝামেলা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নতুন শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন, তখন তারা তখনকার প্রতিকারহীন দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে। তারা পরবর্তী দিনে সঠিক চলার পথ কী হবে তা নিয়ে ভাবতে চায় না। তাদের ভাবনা হচ্ছে অর্ধ-উন্মাদের লক্ষণযুক্ত নিদ্রাহীনতার রোমন্থন। পরদিন সকাল পর্যন্ত এই মধ্যরাতের উন্মাদ-ভাব তাদের মনে জড়িয়ে থাকে। ফলে তাদের বিবেচনা-বোধ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মেজাজ খারাপ হয় এবং যে-কোনও বাধায় তা সহজে রেগে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। জ্ঞানী ব্যক্তি যন্ত্রণার কথা ভাবেন একা উদ্দেশ্য নিয়ে। অন্য সময়ে তারা আলাদা কিছু নিয়ে ভাবেন এবং রাত্রিতে কিছুই ভাবেন না। আমি এমন কথা বলতে চাই না যে, গভীর সংকটে যেমন, যখন ধ্বংস আসন্ন অথবা একজন মানুষের সন্দেহ করার কারণ থাকে তার স্ত্রী তাকে প্রতারনা করছে, তখন তার পক্ষে কিছু চিন্তা না করা সম্ভব। অবশ্য কেউ যদি তার মনকে বিশেষভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থাকে তা আলাদা কথা। তবে তারা সংখ্যায় বড় কম। তারাই শুধু তাৎক্ষণিকভাবে যার প্রতিকার হবে না, তেমন বিষয়ে উদ্বেগহীন থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ দিনের সাধারণ সব অসুবিধা যদি তার সম্পর্কে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব। সাধারণ মনকে আবাদ করতে পারলে সুখ এবং কর্মদক্ষতা কী পরিমাণ বেড়ে যায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই মন সঠিক সময়ে একটি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে, সবসময় অল্প চিন্তায় মগ্ন থাকবে না। যখন কোনও কঠিন বা উদ্বেগাকুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়। যত তাড়াতাড়ি সব উপায় পাওয়া যাবে তাতেই সবচেয়ে গভীর চিন্তা প্রয়োগ করা উচিত এবং একবার সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তা সংশোধন করা ঠিক নয়, যদি না একবারে নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায়। অব্যবস্থিত চিত্ততার মতো ক্লান্তিকর আর কিছু নেই, এমন অর্থহীনও কিছু নেই।
যেসব বিষয় দুশ্চিন্তার কারণ তার অপ্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলে অনেক দুশ্চিন্তা কমে যায়। আমি অনেক সভায় ভাষণ দিয়েছি, প্রথমদিকে শ্রোতাদের দেখে আমি ভয় পেতাম এবং ঘাবড়ে গিয়ে ভালভাবে বলতে পারতাম না। এই কঠিন পরীক্ষাকে আমি এমনই ভয় পেতাম যে, সব সময় মনে ইচ্ছা হত বক্তৃতার আগেই যেন আমার পা ভেঙে যায়। বক্তৃতা যখন শেষ হত আমি স্নায়ুর যন্ত্রণায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়তাম। তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে ভাবতে শেখালাম, আমি ভাল বলি বা খারাপ বলি, কোন ক্ষেত্রেই পৃথিবীর ক্ষতি বা লাভ কিছুই নেই। দেখা গেল ভাল বা খারাপ বলা নিয়ে দুশ্চিন্তা যত কমিয়ে আনলাম, ততই আমার ভাষণ তত কম খারাপ হতে লাগল। এমনিভাবে স্নায়ুযন্ত্রণা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেল। এইভাবে অনেক স্নায়বিক অবসাদ সম্পর্কেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমাদের কাজসমূহ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যা আমরা স্বাভাবিকভাবে ভাবি। আমাদের সাফল্য বা ব্যর্থতায়, মোট কথা, বিশেষ কিছুই আসে যায় না। এমন কী গভীর দুঃখও বাঁচতে পারে। যেসব বিপদকে একসময় মনে হয়েছে যে, তারা জীবনের সুখ চিরদিনের জন্যে নষ্ট করে দেবে, সময়ের সাথে সাথে তাদের তীব্রতা এতই কমে যায় যে মনে করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু সব আত্মকেন্দ্রিক বিষয়ের ওপরের বাস্তব হচ্ছে কোনও মানুষের অহংবোধ জগতের খুব একটি বড় অংশ নয়। কোনও ব্যক্তি যদি ভাবনা এবং কামনাকে অহংবোধের অতীত বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন, তাহলে তিনি সব বিপদের মধ্যে অবস্থান করেও একটু শান্তি পেতে পারেন যা কোনও অহংসর্বস্ব ব্যক্তির পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
যাকে বলা হয় স্নায়ুর স্বাস্থ্যবিদ্যা, তা নিয়ে খুব কমই অনুশীলন করা হয়েছে। শিল্পকারখানা বিষয়ক মনস্তত্ত্ব অবশ্য অবসাদ নিয়ে বিষম অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং একথা খুব সযত্নপ্রসূত পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি যদি দীর্ঘসময় ধরে কোনও কাজ করতে থাকে তা হলে শেষ পর্যন্ত তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু এই ফলাফলের জন্যে এত বৈজ্ঞানিক আড়ম্বরের প্রয়োজন ছিল না। মনস্ততত্ত্ববিদরা অবসাদ দিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। যার পরিধি বেশ ব্যাপক। যার মধ্যে স্কুলগামী শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনও পরীক্ষাই মূল সমস্যাকে স্পর্শ করেনি। অবসাদের গুরুত্বপুর্ণ কারণ হচ্ছে অবশ্যই আধুনিক জীবনের আবেগ। বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অবসাদ বিশুদ্ধ পেশীজাত অবসাদের মতো ন্দ্রিার মধ্যেই তার ক্ষতিপূরণ করে নেয়। কোনও ব্যক্তির যদি আবেগহীন বুদ্ধিজাত কাজ বেশি করতে হয়, যেমন দীর্ঘ গণনাসংক্রান্ত কাজ, তবে তিনি তার প্রতিদিনের অবসাদ দিনের শেষে নিয়মিত ঘুমিয়ে দূর করেন। অতিরিক্ত কাজের চাপে যে ক্ষতি হয়, তা শুধু সেই কাজের জন্যে নয়, সেই ক্ষতি হয় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের জন্যে। আবেগজাত অবসাদের অসুবিধা এই যে তা বিশ্রামের অন্তরায়। লোকে যতই ক্লান্ত হয় ততই তার পক্ষে তা দূর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্নায়ুবৈকল্যের একটা লক্ষণ হচ্ছে নিজের কাজকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং কাজ থেকে ছুটি নিলে সব কিছু বরবাদ হয়ে যাবে এই ধারণা। আমি যদি চিকিৎসক হতাম, এরকম যার বিশ্বাস তাদের প্রত্যেককে ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র দিতাম। স্নায়ুবৈকল্যে যা মনে হয় কাজের চাপে ঘটেছে, আসলে তার প্রত্যেকটি আমি যতটা জানি তা ঘটেছে কিছু আবেগ থেকে উৎপন্ন উদ্বেগ থেকে, যা থেকে রোগী পালাবার জন্যে পথ খুঁজে নেন কাজের মধ্যে। কারণ তার যে দুর্ভাগ্য ঘটুক তার চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়ার মতো অন্য কোনও পথ খোলা থাকে না বলেই তিনি কাজ ছাড়তে চান না। অবশ্য এই দুশ্চিন্তা দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকেও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তার কাজ আর দুশ্চিন্তা একসূত্রে বাঁধা। কিন্তু সেই অবস্থাতে তার বিচারশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং উদ্বেগের তাড়নায় তার দুশ্চিন্তা হয়তো তাকে কাজের দিকে ঠেলে দেয় এবং এইজন্যেই দেউলিয়া হওয়ার সর্বনাশ আগেই ঘটে যায়। যদি তিনি কাজ কম করতেন তাহলে তা দেরিতে ঘটত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আবেগ উদ্ভুত উদ্বেগ স্নায়ুবৈকল্যের কারণ, কাজ নয়।