যে বিশেষ ধরনের বিরক্তিতে আধুনিক নাগরিকরা ভুগছে তা পার্থিব জীবনের সাথে তাদের যে বিচ্ছেদ ঘটেছে তার সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মরুভূমিতে তীর্থযাত্রার মতোই এ জিনিস জীবনকে তাপিত, ধূলিময় এবং তৃষিত করে তোলে। যাদের নিজেদের পছন্দানুযায়ী জীবনধারা বেছে নেওয়ার মতো সঙ্গতি রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা বিশেষ ধরনের অসহনীয় বিরক্তিতে ভোগে, তাদের সেই বিরক্তির কারণ শুনতে আত্মবিরোধী মনে হলেও তা হচ্ছে বিরক্তির ভীতি। কল্যাণকর বিরক্তি থেকে পালিয়ে গিয়ে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর কবলে গিয়ে পড়েন এবং তা অনেক বেশি খারাপ। সুখী জীবন অনেক পরিমাণে শান্ত জীবন হওয়া উচিত। কেননা এইটাই একমাত্র পথ। শান্তিময় পরিবেশেই আনন্দ বেঁচে থাকে।
——-
১. জেন অস্টেন, Jane Austen (১৭৭৫-১৮১৭)। ব্রিটিশ মহিলা ঔপন্যাসিক। সৌজন্য, শিষ্টাচার, সামাজিক নীতিবোধের আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর রচনা নিখুঁত শিল্পলাবণ্যে উজ্জ্বল।
২. কনফিউসিয়াস, Confucias (খ্রীঃ পূঃ ৫৫০-৪৭৯)। চৈনিক দার্শনিক। একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক রূপে পৃথিবীতে আজও স্বীকৃত এবং সম্পূজিত।
৩. সক্রেটিস, Socrates (খ্রীঃ পূঃ ৪৬৯-৩৯৯)। প্রাচীন গ্রীসের বিশ্বনন্দিত দার্শনিক। তিনি ছিলেন পৃথিবীতে নীতি-নৈতিকতার প্রবর্তক। প্লেটো (Plato) তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য।
৪. কান্ট, Imannel Kant (১৮০৯-১৮৮২)। জার্মান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী।
৫. ডারউইন, Charles Rovert Darwin (১৮০৯-১৮৮২)। অবিস্মরণীয় জীব-বিজ্ঞানী, ‘Origin of Species’ তার প্রাণীজগতের ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বেও বিরোধী বিপ্লবাত্মক গ্রন্থ।
৬. মার্কস, Karl Marx (১৮১৮-১৮৮৩)। রাইনল্যান্ডে জন্ম, ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সাম্যবাদী মতবাদের প্রবক্তা। ‘Das Capital’ তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ। যাকে বলা হয় ‘Bible of the Proleteriat’। ৭. ওয়ার্ডওয়ার্থ, William Wordsworth (১৭৭০-১৮৫০) ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি।
০৫. অবসাদ
অবসাদ নানা রকমের। তাদের মধ্যে কয়েকটি আবার সুখের পথে অন্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি অন্তরায় সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র শারীরিক অবসাদ, যদি মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, তা হলে তা সুখের একটা কারণ হতে পারে। এতে ভাল ঘুম হয়, ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং ছুটির সম্ভাবিত আমোদসমূহকে মাধুর্যে ভরে তোলে। কিন্তু তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কৃষক রমণীরা উন্নত দেশসমূহের বাইরের সব দেশে ত্রিশেই বুড়ি হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে পড়ে। শিল্পায়ন প্রথার প্রথম যুগে অতি পরিশ্রমে ছোট ছোট ছেলেদের দৈহিক বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যেত এবং প্রায় তারা মারা যেত। চীন এবং জাপানে এখনো তা হচ্ছে, যেখানে শিল্পায়ন নতুন। আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলিতে এই প্রথা এখনো দেখা যায়। শারীরিক শ্রম একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে চালাতে গেলে তা বর্বরোচিত অত্যাচারে পরিণত হয়। প্রায়ই এধরনের অত্যাচার করে শ্রমিকদের জীবনকে দুঃসহনীয় করে তোলা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অংশে, যা হোক, দৈহিক অবসাদ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে শিল্পব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে। বর্তমানকালে উন্নত সমাজে যে রকমের অবসাদ সবচেয়ে ভয়ানক তা হল স্নায়ুবিক অবসাদ। বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে, এই অবসাদ ধনবানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল এবং ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমজীবীদের মধ্যে অনেক কম দেখা যায়।
আধুনিক জীবনে স্নায়বিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। প্রথমত পুরো কাজের সময়ে, কাজ করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে শহরের কর্মীরা সব সময় নানারকম শব্দ দূষণের মুখোমুখি হয়। এটা সত্যি অধিকাংশ শব্দে সে মনোযোগ না দেওয়ার বিদ্যাটা শিখে নেয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই শব্দ তার শক্তিকে ক্ষয় করে দেয়। তা তার জন্যে আরও ক্ষতির কারণ হয় এই জন্যে যে, ঐ শব্দ না শোনার জন্যে অবচেতন মনে একটা চেষ্টা চলতে থাকে, যা স্নায়ুকে পীড়িত করে। তাছাড়া আমাদের অজান্তে আরো একটি জিনিস আমাদের মনে অবসাদ তৈরী করে এবং তা হচ্ছে অবিরাম অজ্ঞাত পরিচয় লোকদের সাথে দেখা হওয়া। অন্যান্য সব প্রাণীর মতো মানুষেরও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে স্বশ্রেণীর প্রত্যেক অপরিচিতকে মনে মনে পরীক্ষা করে নেওয়া, সেই আগন্তুকের সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করবে না শত্রুর মতো তা ঠিক করা। ভিড়ের সময় মাটির নিচে পাতাল রেলে যারা যাতায়াত করেন তাদের এই প্রবৃত্তিকে চেপে রাখতে হয় এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও যারা গায়ে গায়ে চাপাচাপি করে বসেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে এক অবরুদ্ধ ক্রোধ অনুভব করেন। সকলের তাড়া থেকে সকালের গাড়ি ধরার এবং তার ফলে অজীর্ণতা। ফলশ্রুতিতে যতক্ষণে অফিসে পৌঁছে দিনে কাজ শুরু করা না যায়, ততক্ষণে কালো কোট পরিহিত কর্মীটির স্নায়ু ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। তখন সমগ্র মনুষ্যসমাজকেই তার আবর্জনা বলে মনে হয় তার মনিবও ঠিক একই অবস্থায় অফিসে আসেন। এবং কর্মীর মানসিক ক্ষতিপূরণ করার কোনও ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন না। ছাঁটাই হওয়ার ভয় থেকেই সমপূর্ণ ব্যবহার দেখাতে বাধ্য হয় কর্মীটি, কিন্তু এই অস্বাভাবিক আচরণ তার স্নায়বিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়। যদি কর্মীরা সপ্তাহে একবার মনিবের নাক টেনে লম্বা করার সুযোগ পেতেন তাহলে তার সম্বন্ধে কর্মীরা কী ভাবেন তা প্রকাশ পেত এবং তাতে তাদের স্নায়বিক চাপ অনেক কমে যেতে পারত। কিন্তু মনিবের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। তাই এটা থেকে কোনও ফল লাভ করা যেত বলে মনে হয় না। কর্মচারীর কাছে ছাটাই হওয়ার ভয় যেমন, নিয়োগকর্তা মনিবের কাছে দেউলিয়া হওয়ার ভয়ও তেমন। অবশ্য একথা ঠিক, অনেকে এত বড় আসনে আছেন যে তাদের এই ভয় নেই। কিন্তু এই ধরনের উচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে তাদের বছরের পর বছর কঠিন সগ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের বিশ্বের সকল দেশের ঘটনাবলীর ওপর সক্রিয় দৃষ্টি রাখতে হয়েছে এবং তার সাথে তাদের প্রতিযোগীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। এইসব কিছুর মিলিত ফল হল, যখন সত্যিই সাফল্য এল, তখন দেখা গেল সাফল্যলাভকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। যখন আর দরকার নেই তখনো তিনি তাকে ছাড়তে পারছেন না। একথা সত্যি যে, ধনীদের পুত্ররা রয়েছে, কিন্তু তারা ধনী হয়ে না জন্মালে যেসব উদ্বেগে ভুগত, ঠিক তার অনুরূপ উদ্বেগ নিজেদের জন্যে তৈরী করে নিতে তারা সফলকাম হয়। বাজি ধরে, জুয়া খেলে তারা তাদের পিতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে। প্রমোদে গা ভাসিয়ে ঘুমের সময় কমিয়ে দিয়ে শরীরকে দুর্বল করে এবং যখন তারা কিছুটা শান্ত হয়, তখন পিতারা তাদের জন্যে যে সুখের ব্যবস্থা করেছেন তা ভোগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, পছন্দের অথবা প্রয়োজনের তাগিদ থেকে, অধিকাংশ আধুনিক মানুষ স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতিকর জীবন কাটায় এবং সবসময় তারা এত পরিশ্রান্ত থাকে যে, সুরার সাহায্য ছাড়া কোনও আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।