কম-বেশি একঘেয়ে জীবনযাপনের ক্ষমতা শৈশবকাল থেকেই অর্জন করা উচিত। এ বিষয়ে আধুনিক পিতা-মাতাদের দোষ দেওয়া যেতে পারে। তারা সন্তানদের উপভোগের জন্যে অতিরিক্ত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করেন, যেমন চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং ভাল ভাল খাদ্যের আয়োজন। বিশেষ কোনও উপলক্ষ্য ছাড়া সন্তানদের কাছে তাদের একটা দিন যে অন্য দিনের চেয়ে আলাদা হওয়া কতটা প্রয়োজনীয় তা তারা বুঝতে পারেন না। শৈশবের সব আনন্দ এমন হওয়া উচিত যা শিশুরা চেষ্টা করে মাথা খাঁটিয়ে নিজেদের পরিবেশ থেকে নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিতে পারে। উত্তেজক আনন্দ, যাতে কোনও দৈহিক পরিশ্রম নেই, যেমন নাটক উপভোগ করা, এমন প্রমোদের ব্যবস্থা তাদের জন্যে খুব কম করা উচিত। এই ধরনের উত্তেজনা নেশার মতো, ধীরে ধীরে তার মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। উত্তেজনাময় উপভোগের সময় শারীরিক যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়, তা স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিপরীত। জমিতে একটি চারাগাছ বাধা না পেলে স্বাভাবিকভাবে সবচেয়ে বেশি বাড়ে। শিশুর ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়। ছোটদের পক্ষে অতিরিক্ত দেশভ্রমণ, বিচিত্র বিষয়ের ওপর তাদের মনে ছাপ ফেলা ভাল নয়। কারণ তা হলে তারা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় একঘেয়েমিও আর সহ্য করতে পারবে না। আমি বলি না যে একঘেয়েমির নিজস্ব একটা মূল্য আছে। আমি বলি যে কিছু মাত্রায় একঘেয়েমি না থাকলে কোনও কোনও ভাল কাজ সম্ভব হয় না। ওয়ার্ডওয়ার্থের(৭) ‘প্রেলিউড’-এর কথাই ধরা যাক, প্রত্যেক পাঠকই জানেন তার ভাবনা বা অনুভূতির মূল্য যাই হোক, তার পক্ষেই তা সম্ভব হয়েছে, কোনও কৃত্রিম শহরবাসী যুবকের পক্ষে তা সম্ভব হত না। কোনও বালক বা যুবকের যদি গঠনমূলক কিছু করার ইচ্ছা থাকে তবে তাদের কাজের জন্যে প্রয়োজন হলে তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই অনেক বিরক্তি সহ্য করবে। কিন্তু যে বালক বিক্ষেপ এবং অপচয়ের মধ্যে জীবন কাটিয়েছে তার মনে গঠনমূলক কিছু করবার কামনা জাগ্রত হবে না। এই কারণেই তার মন সব সময় ছুটতে পারে একের পর অন্য আনন্দের দিকে, কিছু সৃষ্টি করার দিকে নয়। এই অবস্থায় কোনও একটা যুগ যদি বিরক্তিকে সহ্য করতে না পারে, তা হলে সেই যুগ হবে ক্ষুদ্র মানুষের যুগ, যে মানুষ অন্যায়ভাবে প্রকৃতির শান্ত পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যে মানুষের ভিতরকার সব জীবনধর্ম ধীরে ধীরে শুষ্ক হয়ে যায়, সেই মানুষ যেন ফুলদানিতে সাজানো কর্তিত কুসুম।
আমি রহস্যমূলক ভাষা পছন্দ করি না। তবু আমি জানি না, যা বলতে চাই তা কবিতার বিশেষ কাব্যময় ভাষা ব্যবহার না করে বিজ্ঞানের ভাষায় কী করে বলব। আমরা যা কিছু নিয়ে ভাবতে চাই, আমরা যে এই বসুন্ধরার সন্তান সে কথা ভুললে চলবে না। আমাদের জীবন পৃথিবীর জীবনেরই অংশ এবং আমরা সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর মতো পৃথিবী থেকেই জীবনের পুষ্টি সংগ্রহ করে থাকি। বসুন্ধরার জীবনছন্দ ধীরগামী, হেমন্ত এবং শীত বসুন্ধরার পক্ষে ততটুকু প্রয়োজন ঠিক যতটুকু প্রয়োজন বসন্ত ও গ্রীষ্ম। স্থিতি তেমনি অপরিহার্য যেমনি গতি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়েও শিশুর পক্ষে পার্থিব জীবনের জোয়ার-ভাটার প্রবাহের সাথে সংযোগ রাখা বেশি প্রয়োজন। মানুষের দেহ যুগ যুগ ধরে এই ছন্দের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে এবং ধর্ম তার থেকে কিছু অংশ নিয়ে ইস্টার উৎসবের সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। যেমন ইস্টার উৎসবে আমি দু’বছর বয়সের একটি বালককে দেখেছি, যে সবসময় লন্ডনে বাস করেছে সে প্রথম সবুজ গ্রামাঞ্চলে এসে হেঁটে বেড়াবার সুযোগ পেয়েছে। তখন ছিল শীতকাল। প্রত্যেকটি জিনিস ভিজে এবং কর্দমাক্ত, প্রাপ্তবয়সী লোকের চোখে আনন্দজাগানিয়া কিছুই ছিল না। কিন্তু সেই বালকের মধ্যে বিচিত্র এক উল্লাস জেগে উঠল। সে ভিজে মাটির ওপর নতজানু হয়ে বসল আর মুখখানা ডুবিয়ে দিল সবুজ ঘাসের মধ্যে এবং অর্ধস্ফুট উল্লাসধ্বনি করতে লাগল। যে আনন্দ সেই বালক উপভোগ করছিল তা আদিম, সরল এবং অনন্য। এতে তার যে দৈহিক ও মানসিক চাহিদার তৃপ্তিসাধন হচ্ছিল, তা এমন গভীর যে, যাদের এই প্রয়োজন থেকে দূরে রাখা হয়, তারা কমই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। অনেক আনন্দের মধ্যে, যেমন জুয়াখেলা তার একটি ভাল উদাহরণ হতে পারে, মাটির সাথে তাদের কোনও সংযোগ নেই। এরকম আনন্দ যখন শেষ হয়, তা মানুষের মনে ঘৃণার বোধ জাগিয়ে তোলে, তাকে অতৃপ্ত রেখে যায়। কিন্তু তার কারণ কী, তা সে বুঝতে পারে না। এই আনন্দ এমন কিছুই দেয় না। যাকে আমোদ বলা যেতে পারে, বরং যেসব আমোদ-প্রমোদ আমাদের বসুন্ধরার প্রাণের সাথে সংযোগ ঘটায় তার মধ্যে এমন কিছু থাকে যা আমাদের গভীরভাবে তৃপ্তি দেয়। যখন তার অবসান হয়; তখন যে আনন্দ সে বহন করে আনে তার রেশ থেকে যায়, যদিও যখন তারা থাকে তাদের তীব্রতা অন্যান্য উদ্দীপক এবং চিত্তচাঞ্চল্যকর আমোদের চেয়ে কম হতে পারে। এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে আমার মনে যা আছে, তা স্বরলহরীর সব স্তরের কাজের মধ্যেই আছে, সরলতম কাজ থেকে সূক্ষ্মতম সব কাজের মধ্যে। যে দু বছরের বালকটির কথা কিছুক্ষণ আগে বলেছি, সে পৃথিবীর জীবনের সাথে মিলনের যতদূর সম্ভব আদিমতম রূপটি তুলে ধরেছে। কিন্তু উচ্চতর স্তরে এই জিনিসটি পাওয়া যাবে কবিতার মধ্যে। শেক্সপীয়ারের গীতিকবিতা এত সুন্দর হতে পেরেছে এই জন্যে যে, তা এই একই আনন্দে পূর্ণ, যে আনন্দ দুই বছরের বালককে ঘাসকে আলিঙ্গন করার প্রেরণা দিয়েছিল, ‘ঐ শোনো লার্ক পাখির গান এবং ঐ হলুদ বালু কণিকারা কাছে এসো’– এই দুটি কবিতার কথা মনে করুন, দেখবেন এই কবিতা দুটির মধ্যে সেই দুই বছরের বালকের আধো আধো উচ্চারণে প্রকাশিত সেই একই আবেগ যে সুসংস্কৃত ভাষায় ফুটে উঠেছে। অথবা প্রেম এবং শুধু যৌন আকর্ষণের তফাতের কথা ভাবুন, প্রেম এমন এক উপলব্ধি যার মধ্যে দীর্ঘ খরার পর সৃষ্টি স্পর্শ পেলে উদ্ভিদের যেমন হয়, তেমনি আমাদের সকল সত্তা নতুন জীবন পায় এবং সতেজ হয়। প্রেম-বিহীন যৌনমিলনে এই উপলব্ধির কোনও সন্ধান পাওয়া যাবে না, যখন ক্ষণিকের আনন্দ শেষ হয়ে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু ক্লান্তি, ঘৃণা এবং জীবনের শূন্যতাবোধ। প্রেম পার্থিব জীবনের অঙ্গ, প্রেমবিহীন যৌনমিলন তা নয়।