পূর্বপুরুষদের তুলনায় আমাদের বিরক্তি অনেক কম, কিন্তু আমরা বিরক্তিকে বেশি ভয় পাই। আমরা জানি, বা বিশ্বাস করতে শিখেছি যে বিরক্তি মানুষের জীবনের স্বাভাবিক অংশ নয়, এবং বিরক্তিকে এড়ানো যারা চরম উত্তেজনাময় কাজের সাহায্যে। আজকাল মেয়েরা নিজেরা উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। এই স্বনির্ভরতা তাদের সন্ধ্যাবেলা নিজেদের মতো করে আনন্দে কাটাতে সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তারা এখন তাদের ঠাকুমাদের সময়ের দুর্ভোগ এবং ‘সুখী পারিবারিক সময়’ কাটাবার অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। আমেরিকায়, যারা শহরে বাস করছে, কিংবা করতে পারছে না, প্রত্যেকের একটি মোটরগাড়ি আছে, অন্ততপক্ষে একটি মোটর সাইকেল। এই যন্ত্রযানের সাহায্যে তারা সিনেমায় যেতে পারে। প্রত্যেক বাড়িতে অবশ্য একটি রেডিও আছে। আগের চেয়ে অনেক সহজে এখন তরুণ-তরুণীরা মিলতে পারে। প্রত্যেক পরিচারিকা অন্তত সপ্তাহে একদিন এমন প্রমোদ আশা করে যা স্থায়ী হয়েছিল জেন অস্টেনের(১) নায়িকার ক্ষেত্রে সারা উপন্যাস জুড়ে। সামাজিক স্তরে যতই আমরা ওপরের দিকে উঠেছি ততই আমাদের উত্তেজনা উপভোগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্যে কুলাচ্ছে তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সাথে নিয়ে চলেছে আমোদ, নৃত্য আর মদ্যপান। আর যে কারণেই হোক তারা নতুন স্থানে এসব উত্তেজনা বেশি করে উপভোগের আশা করছে। যাদের কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়, কাজের সময় তাদের জন্যে কিছু বিরক্তি যেন অপেক্ষা করে থাকেই। কিন্তু যাদের প্রচুর অর্থ থাকার ফলে কাজ করে জীবন চালাতে হয় না তাদের চোখের সামনে যে আদর্শ, তা হচ্ছে বিরক্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত জীবন। এই আদর্শ মহৎ, আমি তার অমর্যাদা করা থেকে দূরে থাকতে চাই। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, আদর্শবাদীরা এটা লাভ করা যত সহজ বলে ভাবেন তা তত সহজ নয়, বেশ কঠিন-ই বলা যায়। যাই হোক সকালগুলি বিরক্তিকর, গতদিনের সন্ধ্যাগুলির আনন্দময়তার অনুপাতে। মধ্য বয়স আসবে, সম্ভবত বার্ধক্যও আসবে। বিশ বছর বয়সে লোকে ভাবে ত্রিশ বছরেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমি, আটান্ন বছর বয়সেও এই মত পোষণ করি না। আমার বিশ্বাস আর্থিক মূলধন ব্যয় করা যতটা অবিজ্ঞজনিত কাজ, জীবনের মূলধন নষ্ট করাও তাই। সম্ভবত কিছু বিরক্তি জীবনের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। বিরক্তি থেকে পলায়নের ইচ্ছা খুব স্বাভাবিক। সুযোগ পেলে মানুষের সকল জাতি তা প্রকাশ করেছে। শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে যখন অসভ্যেরা প্রথম সুরার স্বাদ পেল, তারা এর সাহায্যে এতদিনের বার্ধক্যজনিত অবসাদ থেকে পালাবার একটা পথ পেয়ে গেল, এবং যে যে সময়ে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে সেই সেই সময় ছাড়া তারা অবিরাম মদ্যপান এবং হুল্লোড় করতে করতে মৃত্যুকে বরণ করেছে। যুদ্ধ, গণহত্যা এবং উৎপীড়ন– এসবই বিরক্তি থেকে পালাবার এক একটি পথ। এমন কী চুপচাপ থাকার চেয়ে প্রতিবেশিদের সাথে কলহ-বিবাদ করাও অনেক ভাল বলে মনে হয়। নীতিবাগীশদের কাছে বিরক্তি তাই একটি প্রধান সমস্যা এবং মানবসমাজে অন্তত অর্ধেক পাপ বিরক্তির ভয়েই ঘটে থাকে।
বিরক্তি সম্পূর্ণ অশুভ, এটা মনে করা অনুচিত। বিরক্তি দু’রকমের হতে পারে। এক ধরনের বিরক্তি ফলপ্রসু, অন্যটা একেবারে ফলহীন। প্রথমটা জন্মে মাদক আর নেশার অভাবে, দ্বিতীয়টার উদ্ভব হয় প্রয়োজনীয় কাজের অভাবে। সব ধরনের উত্তেজনা সীমিতভাবে হলেও মাদকবস্তুর একটা ভূমিকা থাকে। যে জীবন অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ তা পরিশ্রান্ত এক জীবন যেখানে শিহরণ পাওয়ার জন্যে, যা আনন্দের একটা প্রয়োজনীয় অংশ বলে মনে করা হয়, দরকার হয় অবিরাম অতি উদ্দীপক কিছুর যোগান। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত উত্তেজনায় অভ্যস্ত সে একজন অসুস্থ ব্যক্তি যার লোভ রয়েছে গোলমরিচের প্রতি, সে পরে মরিচের পরিমাণমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও আর স্বাদ পাবে না, অথচ সেই পরিমাণ গোলমরিচে অন্য যে কেউ দম আটকে মারা যাবে। অতিরিক্ত উত্তেজনা এড়ানোর মধ্যে কিছু বিরক্তি থাকেই, আর অতিরিক্ত উত্তেজনা শুধু যে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর তা নয়, তা সবরকম উপভোগের স্বাদ নষ্ট করে দেয় আর গভীর ইন্দ্রিয়তৃপ্তির পরিবর্তে বিকৃতিতে আসক্তি জন্মায়। জ্ঞানের বদলে চাতুর্য্য এবং রূপের বদলে অমসৃণতা জাগিয়ে তোলে। উত্তেজনার বিরুদ্ধে আমি চরম কিছু বলছি না। কিছু পরিমাণে উত্তেজনা স্বাস্থ্যপ্রদ কিন্তু অন্য সব জিনিসের মতো এর মাত্রাও পরিমাণের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। উত্তেজনা খুব কম হলে রুগ্ন আসক্তি জাগিয়ে তুলবে আর খুব বেশি হয়ে গেলে তা ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে। সুতরাং সুখী জীবনে কিছু পরিমাণে বিরক্তি সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকা জরুরী এবং এটা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় যা তরুণদের অবশ্যই শেখানো উচিত।
সমস্ত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের কিছু বিরক্তিকর অংশ থাকে এবং সমস্ত মহৎ জীবনেই কিছু কিছু অনাকর্ষণীয় বিস্তার থাকে। ধরা যাক কোনও আমেরিকান প্রকাশকের বিবেচনার জন্যে সেই প্রথম ওল্ড টেস্টামেন্টের পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়েছে। তার মন্তব্য কী হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়। বিশেষ করে এই গ্রন্থের বংশলতিকা অধ্যায় নিয়ে তিনি বলতে পারেন না যে আপনার পাঠকরা কতগুলি মানুষের নাম জানতে আগ্রহী হবে, যাদের সম্বন্ধে আপনি তেমন কিছুই বলেননি। আমি স্বীকার করছি, আপনি শুরুটা খুব সুন্দরভাবে করেছেন। আমি প্রথমে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, কিন্তু সবকিছু এত বিস্তারিতভাবে বলা অতিশয়োক্তি হয়ে গেছে। এর ভিতরকার উজ্জ্বল অংশগুলি রেখে অবান্তর অংশ সব বাদ দিয়ে যুক্তিসঙ্গত আকারে কলেবর কমিয়ে পাণ্ডুলিপিটি আবার আমার কাছে নিয়ে আসুন। আধুনিক প্রকাশকের বক্তব্য অনেকটা এই ধরনের। কারণ তিনি আধুনিক পাঠকের বিরক্তির ভয় সম্পর্কে জানেন। তিনি কনফুসিয়াসের(২) শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, কোরান, মার্ক্সের ক্যাপিটাল এবং অন্যান্য সব পবিত্র গ্রন্থ যেগুলি ‘বেস্ট সেলার’ রূপে প্রমাণিত হয়েছে, সম্পর্কেও একই কথা বলবেন। শুধু পবিত্র গ্রন্থ সম্বন্ধে নয়, বিরক্তিকর অংশ সম্বলিত সব শ্রেষ্ঠ উপন্যাস নিয়ে তাঁর এই মত। যে উপন্যাসের প্রথম পাতা থেকে শেষ অবধি নানা চিত্তহারী বিষয়ে ঝলমল করে তা অবশ্যই মহৎ কোনও গ্রন্থ নয়। মহৎ লোকের জীবনও, কয়েকটি মহৎ মুহূর্ত ছাড়া সবসময়। চিত্তহরণকারী হয় না। সক্রেটিস(৩) নিশ্চয় মাঝে মাঝে ভোজসভায় যোগ দিয়েছেন এবং নিশ্চয় হেমলক পানের পর যখন বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে তখনও তিনি আলাপচারিতায় প্রচুর তৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু জীবনের অধিকাংশ কাল তিনি পত্নী জানৰ্থিপের সাথে শান্তিতে কাটিয়েছেন। বিকেলে ভ্রমণের সাহায্যে স্বাস্থ্যচর্চা করেছেন এবং কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলিতও হয়েছেন। শোনা যায় কান্ট(৪) সারা জীবনে কোয়েনিসবার্গ থেকে দশ মাইলের বেশি দূরত্বে যাননি। ডারউইন(৫) বিশ্ব পরিভ্রমণ শেষ করে অবশিষ্ট জীবন নিজের ঘরেই কাটিয়েছেন। মার্ক্স(৬) কয়েকটি বিদ্রোহের সৃষ্টি করে অবশিষ্ট জীবন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মোট কথা, দেখা যাচ্ছে শান্তিপুর্ণভাবে জীবন কাটানোই মহৎ ব্যক্তিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের আনন্দ উপভোগ এমন নয়; যা বাইরের দৃষ্টিতে উত্তেজনাপূর্ণ মনে হতে পারে। বিরামহীন কাজ ছাড়া কোনও বড় সাফল্য সম্ভব নয়। সুতরাং এই কাজে এমনভাবে আবিষ্ট হতে হবে যে এবং তা এত কঠিন যে, তা শেষ হলে তীব্র কোনও আমোদ উপভোগ করার শক্তি থাকে না। অবশ্য ছুটির দিনে শারীরিক শক্তি বাড়ানোর জন্যে কঠিন কিছু করা চলে, যার মধ্যে আল্পস পর্বতে আরোহণ করা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে।