৩. দান্তে, Durante Alighieri (১২৬৫-১৩২১) ইতালীর কবি। বিশ্বনন্দিত মহাকবিদের একজন। তাঁকে বলা হয় ইউরোপীয় বেঁনেসার প্রথম সূর্যরশ্মি Divine Comedy তার কালজয়ী রচনা।
০৪. বিরক্তি এবং উত্তেজনা
বিরক্তি, মানবিক আচরণের একটি উপাদানরূপে তার প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি। এটা আমার বিশ্বাস। আমার আরো বিশ্বাস সমস্ত ঐতিহাসিক যুগকে ধরলে এই বিরক্তি এক বিরাট সহায়ক চালিকাশক্তিরূপে দেখা দিয়েছে। আজকের দিনে একথা আরো বেশি সত্যি। বিরক্তিকে বিশেষভাবে একটি মানবিক আবেগ বলে মনে হতে পারে। বন্দী প্রাণী, এটা সত্যি, মাঝে মাঝে উদাস হয়ে পড়ে। উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করে, হাই তোলে, কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব পরিবেশে ওরা বিরক্তির সমধর্মী কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করে বলে আমার মনে হয় না। অধিকাংশ সময় তারা শত্রুর সন্ধানে নিয়ত থাকে অথবা খাদ্যের অথবা দুয়েরই। কখনো তারা সঙ্গমে ব্যস্ত, কখনো দেহকে উষ্ণ রাখতে ব্যস্ত। কিন্তু কখনো যদি অসুখী থাকে তখনো বিরক্তি অনুভব করে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ের মতো, এ বিষয়েও বনমানুষদের সাথে আমাদের মিল রয়েছে, কিন্তু তাদের সাথে কোনও দিন বাস করা হয়নি বলে পরীক্ষার সুযোগ পাইনি। বিরক্তির একটি প্রধান উপাদান বর্তমান অবস্থার সাথে অধিকতর আরামপ্রদ কোনও কাল্পনিক অবস্থার সাথে তুলনা। বিরক্তির আরো একটি উপাদান কারো কর্মদক্ষতাকে সম্পূর্ণ কাজে না লাগানো। যে শত্রু কাউকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার মতে অপ্রীতিকর তবে কোনভাবেই বিরক্তিকর নয়। যে মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, সে বিরক্তি অনুভব করবে না, যদি না তার অতিমানবিক সাহসিকতা থাকে। হাউস অব লর্ডস-এ প্রথম বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেউ কখনো হাই তোলেননি। এ বিষয়ে প্রয়াত ডেভনশিয়ারের ডিউক একটি ব্যতিক্রম। তার জন্যে তিনি লর্ডদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। বিরক্তি হল ব্যর্থ কামনা প্রকাশের ঘটনা, যা প্রীতিকর নয় কোনওভাবেই। কিন্তু সে ঘটনা এমন যা অবসাদ-জর্জরিত মনে একদিনকে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা করে তুলবে। বিরক্তির বিপরীত হল, এক শব্দে বলতে গেলে, আনন্দ নয়, শুধু উত্তেজনা।
মানুষের অন্তরে, বিশেষ করে পুরুষদের উত্তেজনার স্পৃহা অত্যন্ত গভীর বাসা বেঁধেছে। আমার অনুমান, এই কামনা আগে যা ছিল তার চেয়ে সহজভাবে পূর্ণ হয়েছে শিকারের মাধ্যমে। শিকারকে অনুসরণ করার মধ্যে উত্তেজনা আছে, যুদ্ধে উত্তেজনা আছে আর প্রেম নিবেদনে। বর্বর মানুষ ঘুমন্ত স্বামীর পার্শ্ববর্তী নারীর সাথে অবৈধ প্রেমলীলায় রত হবে। এটা জেনেও স্বামী জেগে উঠলে তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু এরকম এক অবস্থা, আমার মনে হয় বিরক্তিকর নয়। কিন্তু কৃষিসভ্যতা আগমনের পর জীবন বিস্বাদ হয়ে পড়েছে। হয়নি শুধু অভিজাতদের জীবন, কারণ তারা এখন পর্যন্ত শিকারের যুগে রয়ে গেছেন। যন্ত্রযুগের মানুষদের ক্লান্তির কথা অনেক শোনা যায়। কিন্তু আমার মতে প্রাচীন পদ্ধতির কৃষিকাজ একই রকম ক্লান্তিকর। অধিকাংশ সমাজসেবক যা মনে করেন, আমি তার বিপরীত-টা মনে করি। আমার বলা উচিত যন্ত্রযুগ বিশ্বের মোট বিরক্তির অনেকটুকুই কমিয়ে দিয়েছে। চাকুরীজীবীদের কাজের সময়টার ওপর তাদের দখল নেই, কিন্তু সান্ধ্যকালীন অবসর তারা বিভিন্ন ধরনের আমোদ-প্রামাদে কাটাতে পারে। এই উপভোগ প্রাচীনপন্থী পল্লীগ্রামে অসম্ভব ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে সেটাও ভেবে দেখুন। আগের দিনে রাতের আহারের পর স্ত্রীকন্যারা বাসনপত্র ধুয়ে ঘর পরিষ্কার করার পর সকলে মিলে পারিবারিক গল্প-গুজব করত। সেটাই ছিল তাদের জন্যে আনন্দ উপভোগ। এর অর্থ হল বাড়ির বড়কর্তা ঘুমিয়ে পড়তেন, স্ত্রী উল বুনতেন, মেয়েরা ভাবত তাদের মরণের কথা অথবা মরুভূমির টিমবকটুতে গিয়ে বাস করার কথা। তাদের পড়াশুনা করতে দেওয়া হত না, বাড়ি থেকে বাইরে যেতে দেওয়া হত না। কারণ তত্ত্বটা ছিল এই যে সে সময় তাদের বাবা আলাপ করবেন তাদের সাথে যা সকলের জন্যেই আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে। ভাগ্য প্রসন্ন হলে অবশেষে তারা বিয়ে করত এবং তাদের সন্তান জন্মাবার পর আবার তারা নিজেদের প্রথম জীবনের মতো নিরানন্দ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যেত। আর যদি বিয়ের সৌভাগ্য না হত তাহলে সারাজীবন কুমারী থেকে শেষে মনে হয় দেহেমনে এক ক্ষয় হয়ে যাওয়া নারীতে পরিণত হত। এমন ভয়ংকর ভাগ্য যা বর্বররা প্রদান করত তাদের বলিপ্রদত্তাকে। শত বছর আগের পৃথিবীর বিষয় বিবেচনা করতে হলে সেসব বিরক্তির পরিমাণটা মনে রাখতে হবে। এবং আরও অতীতে ফিরে গেলে বিরক্তির অবস্থা আরো খারাপ মনে হবে। মধ্যযুগের একটি পল্লীর একঘেয়ে শীতকালের কথা ভেবে দেখুন। লোকে লিখতে পড়তে জানত না, অন্ধকারে তাদের আলো দিতে সম্বল ছিল শুধু মোমবাতি, তাদের একটিমাত্র ঘর, অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়ায় ভরে যেত, আর পুরো বাড়িতে সেই একটিমাত্র ঘরই শুধু হিমঠাণ্ডা নয়। পথ চলা তখন প্রায় অসম্ভব ছিল, তাই ভিন্ন পল্লীর মানুষের দর্শন খুব কম মিলত। শীতের সন্ধ্যায় একমাত্র আনন্দজনক খেলা ছিল ডাইনিবুড়িকে খুঁজে বেড়ান এবং এই খেলার উদ্ভব হয়েছে যেসব কারণে তাদের মধ্যে বিরক্তি অন্যতম।