আধুনিক জীবনে প্রতিযোগিতার ওপর যে প্রাধান্য আরোপ করা হয়েছে তার সাথে সভ্য সমাজের আদর্শাবলীর ক্ষয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান। অগাস্টার যুগ শেষে রোমে যা যা ঘটেছিল তা অবশ্যই এই ধরনের। নারী ও পুরুষ, বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাধারণ আলাপচারিতায় শৈল্পিক দক্ষতা, অষ্টাদশ শতকের ফরাসী সালোঁ-তে যার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল, চল্লিশ বছর পূর্বেও তার ঐতিহ্য সজীব ছিল। এটা এক উচ্চস্তরের শিল্প, যা প্রদর্শন করতে হত এমন কিছুর জন্যে যা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এ যুগে তার কোনও মূল্য নেই যেন। চীনে দশ বছর পূর্বেও এর চর্চা ছিল। কিন্তু আমার ধারণা জাতীয়তাবাদীদের দেশসেবার নতুন উদ্যম এর চর্চাকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছে। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের জ্ঞান যা পঞ্চাশ বা একশত বছর আগেও শিক্ষিতসমাজে বিশ্বজনীন নির্মল আনন্দ পরিত্যক্ত হয়েছে। বসন্তকালে কয়েকজন আমেরিকান ছাত্র তাদের ক্যাম্পাস-সীমান্তের বনানীর ভিতর দিয়ে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। চমৎকার সব বনফুলে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে। কিন্তু পথপ্রদর্শকদের একজনও ঐ কাননের একটি ফুলের নামও জানে না। এই জ্ঞান তো তাদের কোনও কাজে লাগবে না। এই জ্ঞান তাদের উপার্জনও বাড়াবে না।
এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। কোনও ব্যক্তি বিশেষ তার সমস্যা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধও করতে পারবে না। এই সমস্যার প্রকাশ ঘটেছে সাধারণভাবে যে জীবনদর্শন গৃহীত হয়েছে তা থেকে। যে দর্শন অনুযায়ী জীবনটাই একটা সগ্রাম, একটা প্রতিযোগিতা, যাতে শুধু সম্মান অর্জন করবে বিজয়ী। এর জন্যেই বুদ্ধি এবং মেধাকে কাজে না লাগিয়ে প্রবৃত্তির অতিরিক্ত চর্চা করা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত একথা বলবার সময় আমরা ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দিচ্ছি। পিউরিটান (রক্ষণশীল) নীতিবাগিশরা আধুনিক সময়ে সর্বদা ইচ্ছাশক্তির ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও মূলে তারা বিশ্বাসকেই প্রধান্য দিতেন। হতে পারে ইউরিটানবাদ তার দীর্ঘজীবনে এমন একটা প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে ইচ্ছাশক্তির অতিবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সেই সাথে ইন্দ্রিয়বোধ এবং মেধাকে অনাহারে শুকিয়ে মারা হয়েছে, এবং এরকম একটি প্রতিযোগিতার দর্শনকে তাদের প্রকৃতির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে গ্রহণ করেছে। সে যাই হোক, প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় ডাইনোসরদের বুদ্ধির চেয়ে দৈহিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আধুনিক ডাইনোসরদের দৈহিক ক্ষমতার বিশাল সাফল্য সর্বাঙ্গীনভাবে তাদের অনুকরণ করতে প্ররোচিত করেছে। প্রত্যেক দেশের শ্বেতাঙ্গদের জন্যে এরাই হচ্ছে আদর্শ এবং আগামী একশত বছর পর্যন্ত এটা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে হয়। যারা এই ফ্যাশনের অনুসরণ করেনি, তারা অবশ্য একথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারে যে, ডাইনোসররা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেনি। তারা পরস্পরকে হত্যা করেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বুদ্ধিমান যারা দূরে দাঁড়িয়ে তাদের হত্যালীলা দেখেছিল, তারাই পেয়ে গেছে তাদের রাজত্বের উত্তরাধিকার। আমাদের আধুনিক ডাইনোসররাও এমনিভাবে নিজেদের হত্যা করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, গড়ে প্রত্যেক বিবাহ থেকে দম্পতিরা দুটি সন্তানও পেতে চান না। সন্তান আসুক এমন কামনা থেকে তারা জীবনকে উপভোগ করেন না। এখানে এই অহেতুক উদ্দীপনাহীনতার দর্শন যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে তাদের পিউরিটান পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, তা বর্তমান পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য বলে দেখা গেছে। তারা তাদের জীবনদর্শনে এমনি অসুখী যে, সন্তানলাভের কামনা তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাই জৈবিক বিচারে তাদের বিলুপ্তি অনিবার্য। সেদিন খুব দূরে নয়, যখন তাদের স্থান দখল করবে এমন কিছু মানুষ যারা আরো আমোদপ্রিয় এবং প্রাণচঞ্চল।
যে প্রতিযোগিতা জীবনের মূল লক্ষ্যরূপে বিবেচিত, তা অত্যন্ত ভয়ানক, তেমনি একাগ্র, তেমনি দৃঢ়পেশিবদ্ধ এবং অনড় বাসনার ব্যাপার যে তা খুব বেশি হলে এক বা দুই প্রজন্ম পর্যন্ত জীবনের সমরূপ ভিত্তি বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই কালসীমা শেষ হলে তা থেকে অবশ্যই স্নায়বিক ক্লান্তি জন্ম নেবে, নানারকম পলায়নী মনোবৃত্তির উদয় হবে এবং কাজের মতো-ই কঠিন এবং কঠোরভাবে আমোদপ্রমোদের পিছনে ছুটবে (কাজে অবসর উপভোগ সম্ভব নয় বলে)। এবং সবার শেষে বন্ধ্যাত্বের কারণে বংশলুপ্তি ঘটবে। প্রতিযোগিতার দর্শনে শুধু যে কাজের স্পৃহা বিষময় হয়ে ওঠে তা নয়, অবকাশও একই পরিমাণ বিষময় হয়ে ওঠে। যে অবকাশ শান্তিদান করে এবং ক্লান্ত স্নায়ুকে সজীব করে তোলে তাকেই বিরক্তিকর মনে হয়। প্রতিযোগিতর বেগ অবধারিতভাবে বেড়ে যাবেই এবং তার স্বাভাবিক পরিণতি হবে মাদকদ্রব্য সেবনে আশ্রয় লাভ এবং ভেঙে পড়া। এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে জীবনের সুষম আদর্শে সুস্থ এবং প্রশান্তির জায়গাটা নির্বাচন করে তাকে স্বীকৃতিদান।
——–
১. কনরাড, Joseph Conrad (১৮৫৭-১৯২৫)। বৃটিশ ঔপন্যাসিক, তিনি জাতিতে পোলিশ। Lord Jim তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
২. আরনল্ড বেনেট, Amold Bennet (১৮৬৭-১৯৩১) ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, The Old Wives Tale তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।