ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জীবনে যে দর্শন প্রচলিত, তাই হল তাদের সকল দুঃখের আকর। ইউরোপে এখনো অন্যান্য কিছু গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মর্যাদা নষ্ট হয়নি। কিছু কিছু দেশে একটি অভিজাত গোষ্ঠী আছে। বুদ্ধিবৃত্তি সব দেশেই রয়েছে। দু একটি ছোট দেশ বাদ দিলে অন্যসব দেশে সেনা এবং নৌবহর খুব সম্মান পায়। এখন একথা সত্যি যে একজন ব্যক্তির বৃত্তি যাই হোক, তার সাফল্যের মধ্যেই প্রতিযোগিতার একটি উপাদান আছে। তথাপি একথাটা সত্যি যে, যে ধরনের বস্তু মর্যাদা পায়, তা শুধু সাফল্য নয়, তা হল তার উৎকর্ষতা। যাই হোক তা, তার ওপরই নির্ভর করে সাফল্য। একজন বিজ্ঞানীর অর্থ থাকতে পারে, নাও পারে, অর্থ রয়েছে বলে তিনি বেশি শ্রদ্ধেয়, না হলে ততটা শ্রদ্ধেয় নন। একথা কখনো সত্যি নয়। একজন নৌবহরের খ্যাত এডমিরাল বা জেনারেলকে দরিদ্র দেখলে কেউ অবাক হন না। প্রকৃতপক্ষে এসব ক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিজেই এক প্রকার সম্মান বহন করে যেন। এইসব কারণে ইউরোপে শুধুমাত্র অর্থ-প্রতিযোগিতা কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমিত এবং মনে হয়, সে কারণে তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারকারী বা সম্মানিত নন। কিন্তু আমেরিকায় বিষয়টি অন্যরকম, সেখানে পরিসেবাসমূহ জাতীয় জীবনে খুব ছোট ভূমিকা পালন করে বলে তাদের কোনও প্রভাব দেখা যায় না। জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃত্তি সম্পর্কে বলা যায় যে, বাইরের কোনও ব্যক্তি বলতে পারেন না, একজন ডাক্তার কিংবা একজন আইনজীবী তাদের নিজ নিজ পেশায় কতটা যোগ্য। তাদের যোগ্যতা বিচার হবে শুধু তাদের উপার্জন থেকে, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান থেকে। অধ্যাপকেরা তো ব্যবসায়ীদের ভাড়া করা ভৃত্য। সেজন্যে তারা প্রাচীন দেশগুলিতে যে শ্রদ্ধা পান, আমেরিকাতে পান তার চেয়ে অনেক কম। এই কারণেই সেখানকার পেশাজীবীরা ব্যবসায়ীদের অনুকরণ করেন এবং ইউরোপের মতো তাদের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই। সুতরাং ধনিক গোষ্ঠীদের মধ্যে আর্থিক সাফল্যের জন্যে যে অশালীন এবং নির্ভেজাল সংগ্রাম চলছে তা বন্ধ করতে পারার মতো কিছুই নেই।
প্রথম বয়স থেকেই আমেরিকান বালকেরা উপলব্ধি করে যে অর্থ-ই হল একমাত্র বস্তু যাকে গণ্য করা যায়। শিক্ষালাভে যথেষ্ট অর্থ উপার্জনের সুযোগ নেই তাই শিক্ষা নিয়ে তারা ভাবে না। শিক্ষার যে উদ্দেশ্য পরিকল্পিত হয়েছিল, তা হচ্ছে উপভোগের ক্ষমতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে দেওয়া। উপভোগ বলতে আমি বোঝাতে চাই সেইসব সূক্ষ্ম বিষয়ের উপভোগ, যা অপরিশীলিত মানুষের অধিকারের সীমার বাইরে। অষ্টাদশ শতকে একজন ভদ্রলোকের একটি বিশেষ পরিচয় ছিল, তিনি সাহিত্য, চিত্রকলা এবং সঙ্গীতে বিশেষ আনন্দ পেয়ে থাকেন। আজকের দিনে আমরা তার রসবোধের সাথে একমত নাও হতে পারি। কিন্তু এর মধ্যে অন্ততপক্ষে কোনও অসাধুতা ছিল না। আজকের দিনে ধনীলোকের রসবোধ সম্পূর্ণ আলাদা হতে চলেছে। তিনি কখনো বই পড়েন না। যদি তিনি নিজের সুনাম বৃদ্ধির জন্যে চিত্রশালা স্থাপনের ব্যবস্থা করতে থাকেন, তবে তার জন্যে ছবি পছন্দ করার ভার ছেড়ে দেবেন চিত্রবিশেষজ্ঞদের ওপর। এ থেকে যে আনন্দ তিনি পাবেন, তা ছবির সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে নয়, অন্য ধনী ব্যক্তিদের এইসব ছবি সগ্রহ করতে দেননি সেই আনন্দে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও, যদি ইহুদী হন, তবে মমগ্রাহী হতে পারেন। ইহুদী না হলে তিনি যেমন অন্যান্য শিল্পে, তেমনি এখানেও বেরসিক হতে পারেন। এসবের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, অবসর নিয়ে কী করবেন, তিনি তা জানেন না। তিনি যতই ধনবান হতে থাকেন ততই তার পক্ষে আরো বেশি অর্থ উপার্জন করা সহজতর হয়। এবং অবশেষে দিনে পাঁচ মিনিটের অবসর পেলেও তা কীভাবে কাটাবেন তা তিনি জানেন না। বেচারা শেষ পর্যন্ত সাফল্যের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন। সাফল্যই যতদিন জীবনের লক্ষ্য বলে স্বীকৃতি পাবে, ততদিন এরকমই হবে। সাফল্য অর্জনের পর তা নিয়ে কী করা যায় তা যতদিন লোকে না শিখবে, ততদিন তার জন্যে তাকে বিরক্তি আর ক্লান্তির বোঝা বহন করে যেতেই হবে।
মনের প্রতিযোগিতামূলক অভ্যাস ধীরে ধীরে নিজের সীমা ছাড়িয়ে অন্যদিকে প্রসারিত হয়। একটা বই পড়ার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। এক বইটার পাঠ উপভোগ, আর সেই পড়ার কথা অন্যদের বলা। আমেরিকায় মেয়েদের অভ্যাস হচ্ছে প্রত্যেক মাসে কোনও কোনও বই পড়া অথবা পড়ার ছলনা করা। কেউ কেউ সম্পূর্ণ বইটা শেষ করে, কেউ মাত্র প্রথম অধ্যায়টি পড়ে, কেউ শুধু বইটির সমালোচনা পড়ে। কিন্তু সবার টেবিলেই এসব দেখা যায়। তারা কিন্তু প্রথম শ্ৰেণীর সাহিত্যপুস্তক পড়ে না। পাঠাগারগুলি কখনো পড়বার জন্যে ‘হ্যামলেট’ অথবা ‘কিং লিয়র’ বেছে নিয়েছে এমন একটি মাসের নাম পাওয়া যাবে না। এমন কোনও মাসের কথা বলা যাবে না, যে মাসে দান্তে(৩) সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন মনে হয়েছে। ফলে যা পড়া হয় তা সবই সাধারণ মানের আধুনিক বই, কোনও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গ্রন্থ নয়, এটাও প্রতিযোগিতার ফলাফল। সম্ভবত এর সব কিছুই খারাপ। নয়। কেননা যেসব মেয়ের কথা বলা হচ্ছে তারা নিজেরা পছন্দ করে বই পড়লে, তাদের সাহিত্য-পুরোহিত এবং সাহিত্য-প্রভুরা তাদের জন্যে যা পছন্দ করতেন, তার চেয়েও খারাপ হত।