এই ব্যক্তির কর্মজীবনে রয়েছে একশত গজ দৌড়ের মনস্তত্ত্ব। কিন্তু যেহেতু এই দৌড়ের শেষ লক্ষ্য হচ্ছে কবরস্থান, সেহেতু একশত গজের পক্ষে যে নিবিষ্টতা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তিনি তার সন্তানদের সম্পর্কে কী জানেন? সপ্তাহের কাজের দিনগুলিতে তাকে থাকতে হয় অফিসে। আর রবিবারে তিনি থাকেন গলফ লিংকে। তিনি তার স্ত্রীর সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখেন? সকালে যখন স্ত্রীকে ফেলে বেরিয়ে যান, তখনো স্ত্রীর ঘুম ভাঙে না। সারা সন্ধ্যা স্বামী-স্ত্রী দুজনে সামাজিকতা রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, যা দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার সম্ভবত কোনও পুরুষবন্ধু নেই যিনি তার কাছে মূল্যবান। কিন্তু তার এমন অনেক বন্ধু আছে যাদের সাথে আনন্দলাভের অভিনয় করতে হয়। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় এই আনন্দ যদি তিনি সত্যিই অনুভব করতে পারতেন। তিনি বসন্তকালকে বা ফসল তোলার কালকে ততটুকুই জানেন, যতটা বাজারে লাভক্ষতির সাথে যুক্ত। মনে হয় তিনি অনেক বিদেশও ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু চরম ক্লান্তির চোখে। বই তার কাছে তুচ্ছ, সঙ্গীত মূল্যহীন। এভাবে বছরের পর বছর কাটিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তার মনোযোগ আরো একাগ্র হয়, ব্যবসার বাইরে জীবন হয় শুষ্ক এবং নিরানন্দময়। আমি এই জাতীয় প্রৌঢ় আমেরিকানদের স্ত্রীকন্যাদের সাথে ইউরোপে দেখেছি। স্পষ্টই বোঝা গেল এরা বেচারাকে বুঝিয়েছেন কিছু ছুটি উপভোগ করা উচিত এবং মেয়েদের পুরানো মহাদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মাতা-কন্যা আনন্দে তাকে ঘিরে দাঁড়ায় এবং যা কিছু তাদের কাছে দেখার মতো মনে হয় তাদের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গৃহস্বামী চরম ক্লান্ত, বিরক্ত। শুধু ভাবতে থাকেন অফিসের লোকেরা এখন কী করছে অথবা বেসবল ক্রীড়াজগতে কী হচ্ছে। তার নারী-সঙ্গীরা অবশেষে তার সম্পর্কে হতাশ হন এবং মনে করে পুরুষরা এক একজন বস্তুবাদী বর্বর। একথা তাদের কখনো কী মনে হয় না যে লোভের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এ কথা অবশ্য সম্পূর্ণ সত্যি নয়, যেমন সতীদাহ প্রথা একজন ইউরোপীয়ানের দৃষ্টিতে যেমন, আসলে ঠিক তা নয়। হতে পারে দশটির ক্ষেত্রে নটি বিধবা স্বেচ্ছায় আত্মদান করেছে। কারণ তাকে তৈরী করা হয়েছে পুড়ে মরার গৌরব লাভের জন্যে। কারণ তাই ছিল ধর্মের বিধান। ব্যবসায়ীর গৌরব এবং ধর্ম দাবি করে আরো অধিক অর্থ উপার্জন। সুতরাং তিনি হিন্দু বিধবার মতো এই অত্যাচার আনন্দের সঙ্গে মেনে নেন। অমেরিকান ব্যবসায়ীকে আরো সুখী করতে হলে তার ধর্মকে পরিবর্তন করে নিতে হবে। যতদিন তিনি শুধু সফলতা নয়, অন্তর থেকে বিশ্বাস করবেন সাফল্যের পিছনে ধাবমান হওয়াই মানুষের কর্তব্য। যিনি তা করেন না তিনি হতভাগ্য। ততদিন তার জীবন এমন কেন্দ্রীভূত এবং চিন্তাময় থাকবে যাতে তিনি কোনওভাবেই সুখী হতে পারবেন না। অর্থ বিনিয়োগের একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রায় প্রত্যেক আমেরিকান তার অর্থের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে শতকরা ৮ ভাগ লভ্যাংশ চাইবেন, তবুও নিরাপদ বিনিয়োগ ৪ শতাংশ চাইবেন না। এর ফলে তাদের প্রায়ই অর্থনাশ হচ্ছে, সাথে সাথে অবিরাম মানসিক উদ্বেগ আর অশান্তি বেড়ে চলেছে। আমার নিজের কথা হচ্ছে আমি অর্থ থেকে যা চাই তা হচ্ছে নিরাপত্তার সাথে অবসর। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ যা চান তা হচ্ছে আরো বেশি অর্থ যা দিয়ে চমকপ্রদ সমারোহ প্রকাশ করা যায়। যাতে তিনি দীপ্তির আভায় সমশ্রেণীর ব্যক্তিকে অতিক্রম করতে পারেন। আমেরিকার সামাজিক মান অনির্দিষ্ট এবং সবসময় ওটা ওঠা-নামা করে। তার ফলে সব ধরনের উন্নাসিক প্রবৃত্তি সেখানে সামাজিক অবস্থান ভেদে একরকম স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ফলে তা বড় অস্থির। যদিও একমাত্র অর্থ দিয়েই শুধু মানুষ বড় হয়ে ওঠে না, তবু অর্থকে বাদ দিয়েও বড় হওয়া কঠিন। তার ওপর অর্থ সৃষ্টি করাই হল মস্তিষ্কের স্বীকৃত মাপ। যে ব্যক্তি অনেক অর্থ উপার্জন করেন তিনি চালাক, যিনি করতে পারেননি তিনি চালাক নন। কে আর নির্বোধ বলে পরিচিত হতে চান! সুতরাং বাজারের অবস্থা অনিশ্চিত হলে তার অবস্থা পরীক্ষার সময় তরুণদের অবস্থার মতো অস্থির হয়ে পড়ে।
ব্যবসায় বিনষ্ট হলে পরিণতি কী হতে পারে, ব্যবসায়ীর এই দুশ্চিন্তার ভিতর যথার্থ অথচ অযৌক্তিক ভয়ের একটা অংশ প্রায়ই অনুপ্রবেশ করে। একথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত, আরনল্ড বেনেটের(১) ‘ক্লে-হ্যাংগার’ যতই ধনবান হন, তার মন সবসময় শংঙ্কিত ছিল যে, তিনি কারখানার ভিতর মারা যাবেন। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যারা শৈশবে দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়েছেন, তারা সবসময় ভয়ে। কাতর থাকেন যে, তাদের সন্তানরাও সেই দারিদ্র ভোগ করবেন। তারা ভাবতে থাকেন সেই দারিদ্র্য রুখে দিতে যত অর্থের সঞ্চয় গড়ে তোলা প্রয়োজন তা প্রায় অসম্ভব এই ভয় প্রথম প্রজন্মে অনিবার্য, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম, যারা কঠিন দারিদ্র্যের মুখোমুখি হননি তাদের কাছে এই ভয় সামান্য, বাস্তব সমস্যার শুধু একটা অংশবিশেষ।
সন্তোষের মূল উৎস প্রতিযোগিতামূলক সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। এর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়াই হল বাস্তব সংকট। একথা আমি অস্বীকার করি না যে, সাফল্যের অনুভূতি জীবন উপভোগ সহজ করে দেয়। একজন চিত্রশিল্পীর কথা ধরা যাক, তিনি যদি প্রথম যৌবনে অখ্যাত থাকেন এবং পরে তার প্রতিভা যথার্থ স্বীকৃতি পায়, তিনি আরো সুখী হবেন। একথাও আমি অস্বীকার করি না যে অর্থ। কিছুদূর পর্যন্ত সুখকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব অতিক্রম করলে, সুখ আরো বেড়ে যাবে আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি সাফল্য সুখের একটা উপাদান মাত্র। অন্যান্য আর সব উপাদানকে ত্যাগ করে যদি সাফল্য পেতে হয়, তা হলে তাকে অনেক বেশি মূল্যে কেনা হয়।