- বইয়ের নামঃ সুখের সন্ধানে
- লেখকের নামঃ বার্ট্রান্ড রাসেল
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, দর্শন
সুখের সন্ধানে
০১. মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
প্রাণীরা যতক্ষণ সুস্থ থাকে, প্রচুর খেতে পায়, ততক্ষণই সুখে থাকে। মনে হয় মানুষেরও সেরকম থাকা উচিত, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে মানুষ সুখী নয়। অন্ততপক্ষে অধিকাংশ মানুষই সুখী নয়। আপনি নিজে যদি অসুখী হন, তাহলে মনে করতে পারেন আপনিও এ ব্যাপারে কোনও ব্যতিক্রম নন। আর আপনি যদি সুখী হয়ে থাকেন তাহলে নিজের কাছেই জানতে চান আপনার ক’জন বন্ধু আপনার মতো সুখী। তারপর আপনি বন্ধুদের জীবন পর্যালোচনা করে মুখ দেখে তাদের রূপ চেনার বিদ্যাটা আয়ত্ত করে নিন। আপনি যাদের প্রতিদিন দেখেন তাদের মনোভাবের সাথে যাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন তার জন্যে মনকে তৈরী করুন। কবি ব্লেক বলেছেন :
‘আমি যাকে দেখি তার মুখে দেখি একই চিহ্ন
দুর্বলতার চিহ্ন, বিষাদের চিহ্ন। (১)
এর নানা প্রকার হলেও আপনি সব জায়গায় সেই অসুখীভাবকে দেখতে পাবেন। মনে করুন আপনি নিউইয়র্কে আছেন, যা একটি আধুনিকতম নগর। কর্মব্যস্ত কোনও সময়ে এই নগরের এক জনাকীর্ণ রাজপথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, অথবা সপ্তাহশেষে কোনও বড় রাস্তায় অথবা কোনও সান্ধ্য নাচের আসরে। এবার মন থেকে অহংভাবটা দূর করে মনটাকে শূন্য করুন, তারপর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করুন একের পর এক অজানা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ঠিক তখন আপনি বুঝতে পারবেন ওদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধরনের আলাদা আলাদা সমস্যা রয়েছে। আপনি তাদের মধ্যে খুঁজে পাবেন উদ্বেগ, অতিরিক্ত মনঃসংযোগ, অজীর্ণতা, জীবন সংগ্রামে ব্যাকুলতা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে অনীহা, খেলাধুলায় অক্ষমতা, অন্যদের ব্যাপারে সহমর্মিতার অভাব। সপ্তাহ শেষে রাজপথে দেখবেন স্বচ্ছল নারী-পুরুষের ভিড়, যাদের অনেকেই খুব ধনী। যারা চলেছে আনন্দের সন্ধানে। সবারই গতি যেন সমতালে, যে গতি ধীরতম মোটরযানের সাথেই শুধু তুলনীয়। গাড়ির ভিড়ে পথ ঢেকে গেছে। কোনও কিছু দেখার উপায় নেই, চোখ অন্যদিকে ঘোরালেই দুর্ঘটনা।
সব গাড়ির সব যাত্রীরা কী করে অন্য গাড়িকে টপকে যাবে সেই চিন্তাতেই মেতে আছে। কিন্তু ভিড় সামলে তা করার উপায় নেই। এই চিন্তা থেকে যদি তারা মন অন্য দিকে সরিয়ে নেয় কখনও, বিশেষ করে যারা গাড়ির চালক নয় তারা, তা হলে তখন তারা এক অনুচ্চারিত বিরক্তিতে কাতর হয়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে ক্লান্তির ছাপ।
একবার হয়তো গাড়িভর্তি এক দল অশ্বেতাঙ্গ লোক প্রচুর হৈ চৈ করে মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আনন্দে। কিন্তু তাদের ব্যবহারে অন্যরা কষ্ট পাবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের হাতে পড়বে, কারণ ছুটির দিনে রাজপথে আমোদ-প্রমোদ বেআইনি।
অথবা, আপনি কোনও উৎসবমুখর সন্ধ্যার জনতাকে লক্ষ্য করুন, তারা আমোদ-প্রমোদে ভেসে সুখী হওয়ার জন্যে এসেছে- যেমন ভয়শূন্য মন নিয়ে লোকে দন্তচিকিৎসকের কাছে যায়। তারা মদ্যপান ও প্রমোদে ভেসে যাওয়াকে আনন্দের দরজা মনে করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাতাল হয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গীদের মনে কতটুকু বিতৃষ্ণা জেগে উঠছে সেদিকে আর তাকিয়ে দেখে না। তারপর আরো কিছু মদ্যপান করে তারা কাঁদতে আরম্ভ করে। তারা যে কত অপদার্থ এবং নৈতিকভাবে মায়ের স্নেহের অনুপযুক্ত তা নিয়ে অনুতাপ করতে আরম্ভ করে। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তাদের বিচারবুদ্ধি যে পাপবোধকে চেপে রাখে, মদ এসে তাকে তা থেকে মুক্ত করে দেয়।
সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের মধ্যে এই নানা প্রকার অতৃপ্তির কারণ খুঁজে দেখতে হবে। এই ব্যক্তি-মনস্তত্ত্ব আবার অনেকাংশে সমাজ ব্যবস্থার পরিপূরকের ওপর নির্ভরশীল। কোন কোন পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা সুখ ও তৃপ্তির পরিপোষক, তা নিয়ে আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। যেমন যুদ্ধ-বন্ধ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নিষ্ঠুরতা ও ভয়ের শিক্ষা- এইসব বিষয়ে এই লেখায় কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। যুদ্ধকে এড়ানো কী ভাবে সম্ভব, তা আবিষ্কার করা আমাদের সভ্যতার পক্ষে জরুরী। কিন্তু সেই পথ আবিষ্কৃত হলেও তা কোনও কাজে লাগবে না, কারণ মানুষ যতদিন অসুখী থাকবে, ততদিন সে অবিরাম দিনের আলো সহ্য করার চেয়ে পরস্পরকে উচ্ছেদ করা কম ভীতিকর মনে করবে। যন্ত্রনির্মিত দ্রব্য যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের তা মেটাবার যদি কিছুমাত্র সদিচ্ছা থাকে, তবে দারিদ্রকে ধরে রাখা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ধনবানরা নিজেরাই যদি এমন দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তাহলে সকলকে ধনবান তৈরী করে কী লাভ? নিষ্ঠুরতা এবং ভয়ের শিক্ষা খারাপ, কিন্তু যারা নিজেরাই এইসব কুপ্রবৃত্তির দাস তারা আর কী শিক্ষা দিতে পারে? এইসব বিবেচনা থেকে ব্যক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে। পুরুষ হোক অথবা নারী, আমাদের এই পিছন ফিরে তাকানো সমাজের মধ্যে বর্তমানে বাস করে, আত্মতৃপ্তির জন্যে এখন, এই মুহূর্তে সে কী করতে পারে? এই প্রশ্ন আলোচনা করতে আমি শুধু তাদের কথা উল্লেখ করব যাদের ব্যবহারিক অর্থে দুঃখ ভোগ করার কোনও চরম হেতু নেই। আমি ধরেই নেব তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্যে যথেষ্ট উপার্জন রয়েছে। সাধারণ কায়িক পরিশ্রমের জন্যে উপযুক্ত স্বাস্থ্য রয়েছে, আমি বড় ধরনের কোনও বিপদের প্রসঙ্গ তুলছি না, যেমন সকল সন্তানের মৃত্যু অথবা প্রকাশ্য কোনও গ্লানি। এসব হিসাবের মধ্যে নয়, কিন্তু আমি যা নিয়ে আলোচনা করব তা ভিন্ন ধরনের। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সভ্য বিশ্বের অনেক দেশের প্রচুর মানুষ দিনের পর দিন যেসব ছোট ছোট অতৃপ্তি ভোগ করে, তার কোনও বাইরের কারণ না থাকাতে, তা থেকে তারা মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না, আর সেজন্যে তা আরও বেশি অসহনীয় মনে হয়। আমার মনে হয়, এই অতৃপ্তির মোটামুটি কারণ হচ্ছে পৃথিবী সম্বন্ধে ভুল ধারণা, ভুল নৈতিকতাবোধ এবং জীবনের ভুল উদ্দেশ্য, যার ওপর শেষ পর্যন্ত তাদের তৃপ্তিলাভ নির্ভর করে, যা সেইসব আয়ত্তের পরিধির মধ্যেই থাকে। আমি এমন কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছি যা ঘটাতে পারলে কোনও ব্যক্তি যদি মোটামুটি অভাবী না হয়, তা হলে সে সুখী হতে পারবে।