নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোই লিখতে হবে।
কনর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে করতে পারছে, কিন্তু সে-সব লিখার ইচ্ছা তার নেই। বাবার চলে যাওয়া, বিড়ালটা ঘুরতে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে না আসা–সে-সব কথা।
অথবা এক বিকেলে ‘জরুরি কিছু কথা আছে’ বলে মায়ের তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতি।
এই কথাটা ভাবতেই সে কেঁপে উঠে। তবু হাঁটা থামায় না।
সেদিনের আগে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মা তাকে তার পছন্দের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছেমতো ভিন্ডালু খেয়েছিল কনর সেদিন। তার দেখাদেখি মাও। বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে তাদের সে কী হাসাহাসি।
এসব ভাবতে ভাবতে কনরের ঠোঁটের কোনায় হাসি উঁকি দিলো। সেদিন স্কুল থেকে আসার সময় মা তাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। ওরা আসলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল না। বরং মা ওকে একটা সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। মা অসুস্থ হওয়ার পর কনর এই ছবি অনেকবার দেখেছে। তারপরেও ওরা ছবিটা দেখেছিল। পপকর্ন আর কোক খাওয়ার সময় দুজনের হাসি যেন বাঁধ মানছিল না।
কনার বোকা না। পরদিন যখন মা তাকে ওসব বলেছিল, তখনই সে বুঝে গিয়েছিল আগের দিন মা এত মজা কেন করেছে। কিন্তু এ কারণে সেদিনের আনন্দের রেশটুকু হারিয়ে যায়নি, সেদিনের হাসিগুলো হারিয়ে যায়নি।
তবে কনর এসবের কথাও লিখবে না।
‘এই!’ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ শুনতে পেল কনর, ‘এই কনর, দাঁড়াও।’
লিলি।
‘এই!’ লিলি দৌড়ে তার কাছে এলো। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে, ‘তুমি আজ এমনটা করলে কেন?’
‘আমাকে একা থাকতে দাও।’ কনর তাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে লাগলো।
‘তুমি মিস ওয়ানকে সত্যি কথা বলোনি কেন?’ লিলি তার পেছন পেছন আসতে লাগলো, ‘আমাকে এভাবে ভেজালে ফেললে কেন?’
‘তুমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছিলে কেন?’
‘আমি তোমাকেই সাহায্য করছিলাম।’
‘তোমার সাহায্যের আমার দরকার নেই। আমি একাই বেশ আছি।’
‘মোটেও না, তোমার মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল।’
‘তাতে তোমার কী?’ কনর একবারও থামলো না ।
‘আমাকে শাস্তি দিয়েছে, পুরো সপ্তাহ স্কুলের পর থাকতে হবে আমাকে। আর আমার বাবা-মায়ের কাছেও বিচার গেছে।’
‘এটা আমার সমস্যা না।’
‘কিন্তু এটা তোমার দোষ। ‘
কনর থেমে লিলির দিকে ঘুরলো। তাকে এতটাই রাগান্বিত দেখাচ্ছে যে লিলি কিছুটা পিছিয়ে গেল, যেন সে খানিক ভয় পেয়েছে।
‘এটা তোমার দোষ।’, কনর বললো, ‘সব তোমার দোষ।’
রেগেমেগে চলে যেতে যেতে লিলির কণ্ঠ শুনতে পেল সে। ‘আমি জানতাম আমরা ভালো বন্ধু।’
‘ছিলাম, এখন নেই।’ পেছনে না তাকিয়েই কনর উত্তর দিলো।
লিলিকে ছোটোবেলা থেকে চেনে সে। কনর আর লিলির মা বান্ধবী ছিল। লিলি তার কাছে অনেকটা আপন বোনের মতো। ওরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এছাড়া আর কিছু না। স্কুলের অনেক ছেলেমেয়ে ওদের খেপায়, কিন্তু কনর তো লিলিকে একটা মেয়ে হিসেবেই ভাবতে পারে না। ভাববেই-বা কীভাবে? ছোটোবেলা থেকেই তো তাকে দেখে এসেছে, একসাথে খেলা করেছে, সবকিছুই জানে। এটা কেবলই বন্ধুত্ব, আর কিছু না
কিন্তু তার মায়ের সাথে ওই কথোপকথনের পর হুট করেই ব্যাপারটা হয়ে গেল। লিলির মা জানলো, আর সেখান থেকে লিলি, আর তার থেকে বাকি সবাই। এক দিনের মধ্যেই কথাটা ছড়িয়ে গেল। এটার জন্য লিলিকে সে কখনও মাফ করবে না।
আরেকটা মোড় ঘোরার পর নিজের বাড়ি দেখতে পেল সে। ছোটো, কিন্তু নির্জন। ডিভোর্সের পর মা এখানে থাকারই দাবি করেছিল। বাবা তার নতুন বউ স্টেফানির সাথে আমেরিকায় চলে যায়। এসব ছয় বছর আগের ঘটনা, কনর এখন ভুলেও গেছে যে বাবা থাকলে কেমন লাগে।
তার মানে কিন্তু এই না যে সে কখনও বাবার কথা ভাবে না ।
বাসার পেছনের পাহাড়ের চূড়ায় থাকা চার্চের দিকে তাকালো সে। ইয়ো গাছটা গোরস্থানে ঘুমন্ত দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কনর নিজেকে একরকম জোর করে আশ্বস্ত করলো যে এটা কেবল একটা গাছ। অন্য দশটা গাছের মতোই সাধারণ একটা গাছ।
একটা গাছ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর মনে হলো, গাছটা সূর্যের আলোতেও ভয়ানক একটা মুখের আকৃতি নিয়ে গর্জে উঠলো, ‘কনর।’
তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে ঘরে ঢুকতেই সে আবার সেদিকে তাকালো। ওটা কেবল একটা গাছ।
তিনটি গল্প
ওইদিন রাতেও কনরের ঘুম আসছিল না। বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।
সন্ধেটা যেন পার হতেই চাচ্ছিল না। লাজানিয়া রান্না করতে গিয়ে মা এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে ‘ইস্টেন্ডার’ শো শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে সোফায় ঘুমিয়ে গেছে। এই শো-টা কনর একেবারেই পছন্দ করে না। তবু মায়ের জন্য রেকর্ডার অন করে দেয়। তারপর মায়ের শরীরে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে থালাবাসন ধুতে চলে যায়।
ফোন বাজার শব্দেও মায়ের ঘুম ভাঙেনি। কনর দেখেছিল লিলির মা ফোন করেছে, কিন্তু সে ধরেনি। তিনি একটা ভয়েস মেইল পাঠাবেন এমনিতেও। রান্নাঘরের টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক করে নিলো সে। মিসেস মার্লের জীবনগাথা হোমওয়ার্ক করেনি। সে কিছুক্ষণ ইন্টারনেটে সার্ফ করে। এরপর কিছুক্ষণ ইন্টারনেট চালিয়ে, দাঁত ব্রাশ করে নিজের ঘরে চলে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বাতি বন্ধ করার একটু আগেই তার ক্লান্ত মা এসে তাকে চুমু খেয়ে ‘শুভরাত্রি’ বলে গেছে।