‘তুমি বলেছিলে–যখন মেয়েটা ঘুম থেকে ওঠেনি, তখন যুবরাজ অবাক হয়েছিল।’ কনর বললো।
‘সে কৃষকের মেয়েকে খুন করে’ দানবটা বলতে থাকলো, ‘তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। যখন সে জেগে উঠলো, তখন ভান ধরে ছিল যেন সে কিছুই জানে না। শুনে অবাক লাগবে, কিন্তু সে বিশ্বাস করেছিল যে সে আসলেই কিছু জানে না। কখনো কখনো মানুষকে নিজের কাছেই মিথ্যে বলতে হয়।’
‘তুমি বলেছিলে–সে তোমার কাছে সাহায্য চাইছিল, আর তুমি সেটা করেছো।’
‘আমি কেবল বলেছি, সে আমাকে জাগানোর মতো যথেষ্ট কিছু বলেছিল।’ কনর বিস্ময়ের সাথে একবার দানবের দিকে তাকিয়ে আবার উঠোনের দিকে লক্ষ করলো, যেখানে কুয়াশা আবার ফিরে আসছে, ‘সে তোমাকে কী বলেছিল?’
‘বলেছে যে সে এটা রাজ্যের ভালোর জন্য করেছে। এই নতুন রানি আসলেই একটা ডাইনি, যুবরাজের দাদা সেটা আগেই সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু তার সৌন্দর্যের করণে সেটা উপেক্ষা করে যাযন। যুবরাজ একা এত শক্তিশালী একটা ডাইনির মোকাবেলা করতে পারবে না। এজন্য তার গ্রামবাসীদের ক্ষোভের সাহায্য নিতে হবে। কৃষকের মেয়ের খুনের মধ্য দিয়েই সেটা সম্ভব হয়েছিল। যুবরাজও অনুতপ্ত ছিল। কিন্তু রাজ্যের রক্ষার্থে তার বাবা মারা গিয়েছেন এবং তার প্রেমিকাও মারা গেল। এই মৃত্যুগুলো যেন বৃথা না যায়; এদের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। যখন সে বলেছিল যে রানি তার প্রেমিকাকে মেরে ফেলেছে, সে নিজের কাছেই মিথ্যা বলেছিল যেটা সে বিশ্বাস করেছে।’
‘যত্তসব!’ কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘মেয়েটাকে মারার কোনো দরকার ছিল না, গ্রামবাসী তাকে এমনিতেই সাহায্য করতো।’
‘যে মানুষ খুন করে, তার নিজেকে নির্দোষ দাবি করার ব্যাপারটিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। আমি অন্যায় দেখে জেগে উঠেছি। যুবরাজের অন্যায় না। রানির প্রতি হওয়া অন্যায় দেখে।’
‘যুবরাজকে কেউ ধরতে পেরেছিল? কেউ তাকে শাস্তি দিয়েছিল?’
‘সে প্রজাদের প্রিয় রাজা হয়ে উঠেছিল।’ দানবটা বললো, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে রাজ্য শাসন করেছে।’
ওপরে তাকিয়ে কনর নিজের শোবার ঘরের জানালার দিকে তাকালো, ‘তাহলে ভালো যুবরাজ আসলে খুনি ছিল এবং ডাইনি রানিটা আসলে খারাপ ছিল না। এখান থেকে তাহলে কী শিক্ষা পাওয়া যায়? এই শিক্ষা যে আমাকে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে?’
অদ্ভুত একটা গর্জন শোনা গেল, বুঝতে একটু সময় লাগলো যে দানবটা আসলে হাসছে।
‘তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গল্প শোনাচ্ছি?’ দানবটা বললো, ‘তোমাকে সামান্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি জেগে উঠেছি–এটা মনে করছো তুমি?’
দানবটা আরও জোরে হেসে উঠলো। তার হাসির শব্দে মনে হলো যেন আকাশ পাতাল কাঁপছে।
‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।’ কনর যেন একটু লজ্জা পেয়েছে।
‘না না।’ দানবটা বললো, ‘রানি আসলেই ডাইনি ছিল এবং সেও নিষ্পাপ ছিল না। কে বলতে পারে? সে তো যেভাবেই হোক ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল।’
‘তাহলে তুমি তাকে বাঁচিয়েছিলে কেন?’
‘কারণ সে কোন খুনি ছিল না।’
কনর উঠোনে একটু হেঁটে বেড়ালো, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এখানে ভালো কে?’
‘কেউ সব সময় ভালো থাকে না, আবার সব সময় খারাপও থাকে না। ভালো খারাপের মিশ্রণ নিয়েই মানুষ। ‘
কনর মাথা ঝাঁকালো, ‘এটা খুবই বাজে একটা গল্প। ধোঁকাবাজি।’
‘এটা একটা সত্যি গল্প। অনেককিছুই ধোঁকাবাজির মতো মনে হয়। রাজ্য তাদের যথার্থ যুবরাজ পায়, কৃষকের মেয়েরা কোনো কারণ ছাড়াই মারা পড়ে, আর কখনো কখনো ডাইনিদেরকে বাঁচাতে হয়। এসব যে কত প্রায়শই হয় তা জানলে তুমি অবাক হবে।’
ওপরে তাকিয়ে তার নানুর কথা ভাবলো কনর, ‘তো এসব কীভাবে আমাকে তার হাত থেকে বাঁচাবে?’
দানবটা পুরোপুরি উঁচু হয়ে দাঁড়ালো।
তোমাকে তার হাত থেকে বাঁচানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
কনর সোফায় উঠে বসলো, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
ঘড়িতে ১২টা বেজে ৭ মিনিট।
‘ধেত্তেরি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’
রেগেমেগে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তার পায়ে কিছু বাধলো।
‘এখন আবার কী?’
বাতি জ্বালতেই দেখলো মেঝেতে লম্বা একটা গাছের মূল গজিয়ে আছে, কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে সেটা ওঠানোর জন্য রান্নাঘর থেকে একটা চাকু আনতে গেল।
বোঝাপড়া
‘আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি।’ কনরের সাথে হাঁটতে হাঁটতে লিলি বললো।
‘কীসের জন্য?’ তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো কনর। দানবের গল্পটা নিয়ে সে এখনও বিরক্ত হয়ে আছে। মেঝে থেকে ওই মূলটা ওঠাতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে. এরপর যখনই তার ঘুম এসেছে, তখনই মনে হয়েছে যেন সকাল হয়ে গেছে। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার জন্য নানু তাকে বকাবকিও করছে। এমনকি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতেও দেয়নি। বলেছে–মায়ের না-কি সারারাত খুব কষ্ট হয়েছে, এখন তার বিশ্রাম প্রয়োজন। সেটা শুনে কনরের খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল নানু নয়, তারই উচিত ছিল রাতের বেলা মায়ের পাশে থাকা। তাড়াহুড়ো করে নানু তাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে।
‘আমাকে বিপদে ফেলার জন্য, বোকা কোথাকার।’ লিলির কণ্ঠে খুব একটা রাগ নেই।
‘তুমি নিজে নিজেই বিপদে পড়েছিলে।’ কনর বললো, ‘তুমি তো সালিকে ধাক্কা মেরে ফেলেছো।’
‘আমি তোমাকে তোমার বলা মিথ্যার জন্য মাফ করে দিলাম।’