সাঈদ–কথা বল! হানিফা আবার বললো।
উনি শহীদ হয়ে গেছেন!-আমার আফসোস, আমি যিন্দাহ ফিরে এসেছি।’
কথা বলতে বলতে সাঈদের চোখ থেকে উছলে পড়লো অশ্রুধারা।
সাঈদের মুখের কথা শেষ হতেই হানিফার পিছনে একটা চীৎকার ধ্বনি শোনা গেলো এবং ধপ করে যমিনের উপর কিছু পড়বার আওয়ায এলো। হানিফা ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে ফিরলো। সাঈদও হয়রান হয়ে আঙিনায় প্রবেশ করলেন। ইয়াসমিন ততক্ষণে নীচের দিকে মুখ দিয়ে পড়ে রয়েছে।
সাঈদ চলদী করে তাকে তুলে কামরায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন বিছানার উপর। তার হুঁশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চললো। অবশেষে হতাশ হয়ে তিনি ছুটলেন হাকীম ডাকতে। খানিকক্ষণ পর হাকীম নিয়ে ফিরে এসে সাঈদ দেখলেন, মহল্লার বহু নারী জমা হয়েছে ঘরের মধ্যে। হাকীমকে দেখে একজন বললো, এখন আর আপনার কোনো প্রয়োজন নেই। সে চলে গেছে।
সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে শহরের হাকিম ইয়াসমিনের জানাযা পড়ালেন। যহীরের শাহাদতের খবর রটে গেলো চারদিকে। তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা হলো। তারপর দোয়া করা হলো যহীর ও ইয়াসমিনের স্মরণচিহ্ন উযরার দীর্ঘজীবন কামনায়।
সাঈদ সেই দিনই উযরাকে এক ধাত্রীর হাতে সমর্পণ করলেন। হানিফাঁকে তিনি বললেন, তুমি যহীরের বাড়িতে থাকতে চাইলে আমি তোমার সব খরচ বহন করতে তৈরী। আর আমার বাড়িতে থাকা পছন্দ করলে আমি তোমার খেদমদ করবো।’
হানিফা বললো, আমি হলবে নিজের ঘরে চলে যেতে চাই। ওখানে আমার এক ভাই রয়েছে। ওখানে মন না বসলে আমি আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে। সাঈদ হানিফার সফরের ইনতেযাম করে পাঁচশ দিনার দিয়ে তাকে বিদায় করলেন।
দু’বছর পর সাঈদ উযরাকে ফিরেয়ে এনে নিজেই তাকে পালন করতে লাগলেন। ফারেসে খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাবার বেলায় তিনি উযরাকে রেখে গেলেন সাবেরার কাছে।
তিন
লোকালয়ের বাগ-বাগিচার ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী। পোষা জানোয়ারগুলোকে পানি খাওয়ানোর জন্য লোকালয়ের বাসিন্দারা নদীর কিনারে খুদে গেছে একটি ভালাব। নদীর পানিতে ভরে থাকে তালাবটি। তালাবের আশে পাশে দেখা যায় খেজুর গাছের মুগ্ধকর দৃশ্য। লোকালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রায় সব সময়েই এসে খেলা করে এখানে।
একদিন আব্দুল্লাহ, নয়ীম ও উযরা সেখানে খেলতে গেলো লোকালয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে। আব্দুল্লাহ তার সমবয়সী ছেলেদের সাথে গোসল করতে নামলো তালাকের মধ্যে। নয়ীম আর উযরা দাঁড়িয়ে তালাকের কিনারে। সেখান থেকে তারা বড় ছেলেদের সাঁতার কাটা, লাফ-ঝাঁফ ও দাপাদাপি দেখে খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কোনো ব্যাপারেই নয়ীম তার ভাইয়ের পেছনে পড়ে থাকতে চায় না। সাঁতার কাটতে সে শেখেনি, কিন্তু আব্দুল্লাহকে সাঁতার কাটতে দেখে সে নিজকে সামলে রাখতে পারলো না। উযরার দিকে তাকিয়ে সে বললো, এসো উযরা আমরাও গোসল করিগে।
আম্মিজান রেগে যাবেন। উযরা জওয়াব দিলো।
আব্দুল্লাহর উপর তো তিনি রাগ করেন না। আমাদের উপর কেন রাগ করবেন তাহলে?
উনি তো বড়ো। উনি সাঁতরাতে জানেন। তাই আম্মিজান রাগ করেন না।
‘আমরা গভীর পানির দিকে যাবো না। চলো যাই।’
উঁহু! উযরা মাথা নেড়ে বললো।
‘ডর লাগছে তোমার?
নাতো!
তবে চলো।’
নয়ীম যেমন সব কিছুতে আব্দুল্লাহর অনুসরণ করতে চায়-শুধু তাই নয়, তাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, তেমনি উযরাও নয়ীমের সামনে স্বীকার করতে চায় না তার কমজোরী। নয়ীম হাত বাড়িয়ে দিলে উযরা তার হাত ধরে পানিতে ঝাঁপ দিলো। কিনারের দিকে পানি খুব গভীর নয়, কিন্ত আস্তে আস্তে তারা এগিয়ে চললো গভীর পানির দিকে। আব্দুল্লাহ ছেলেদের সাথে অপর কিনারে খেজুর গাছের একটা গুঁড়ির উপর থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো। পালা করে আব্দুল্লাহর ন্যর যখন নয়ীম ও উমরার উপর পড়লো, তখন পানি তাদের গর্দান বরাবর উঠেছে। তখনো দু’জন পরস্পরের হাত ধরে রয়েছে। আব্দুল্লাহ ঘাবড়ে গিয়ে চীৎকার জুড়ে দিলো, কিন্তু তার আওয়ায পৌঁছবার আগেই উযরা ও নয়ীম গভীর পানিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। আব্দুল্লাহ দ্রুত সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তার আসার আগেই নয়ীমের পা যমিনের নাগাল পেয়েছে। নিন্তু উযরা তখন হাবুডুবু খাচ্ছে। আব্দুল্লাহ নয়ীমকে নিরাপদ দেখে এগিয়ে গেলো উযরার দিকে।
উযরা হাত-পা মারছে তখনো। আব্দুল্লাহ কাছে এলে সে তার গলায় বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তার বোঝা বয়ে নিয়ে সাঁতার কাটার সাধ্য আব্দুল্লাহর নেই। উযরা তাকে এমন ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, সে তার বায়ু নাড়তে পারছে না ঠিকমতো। দুতিন বার সে পানিতে ডুবে ডুবে ভেসে উঠলো আবার। এরই মধ্যে নয়ীম কিনারে চলে গেছে। সে আর সব ছেলেদের সাথে মিলে শুরু করলো ডাক চীৎকার। তখন এক রাখাল উটকে পানি খাওয়াতে এসেছিলো তালাবের দিকে। ছেলেদের ডাক-চীৎকারে সে ছুটে এলো এবং কিনারে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই পানিতে ঝাঁপ দিলো কাপড়-চোপড় সমেত। উযরা ততোক্ষণে বেহুশ হয়ে আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছে তার বাহুবন্ধন থেকে। সে তখন এক হাতে উযরার মাথার চুল ধরে অপর হাত দিয়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে।
রাখার দ্রুতগতিতে গিয়ে উযরাকে ধরে তুললো উপরে। আব্দুল্লাহ উযরার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সাঁতরে গেলো আস্তে আস্তে কিনারের দিকে। রাখাল উযরাকে পানি থেকে তুলে নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো সাবেরার ঘরের দিকে।