তুমি কেন গেলে না বেটা?
আব্বাজান, আমি আপনার হুকুমের ইন্তের করছিলাম।’ নয়ীম বললেন, ‘বেটা খোদা ও রসূলের হুকুমের পর আর কারুর হুকুমের প্রয়োজন নেই। যাও বেটা, যাও।’
‘আব্বাজান! আপনার তবিয়ৎ কেমন?
আমি ভালোই আছি, বেটা! নয়ীম মুখের উপর আনন্দের দীপ্তি টেনে আনবার চেষ্ট করে বললেন, তুমি যাও।’
আব্বাজান, আমরা তৈরী।
খালেদ ও আব্দুল্লাহ্ নিজ নিজ ঘোড়ায় যিন লাগাচ্ছেন। তাঁদের মায়েরা দু’জন কাছে দাঁড়ানো। নয়ীম তাঁদের চলে যাবার দৃশ্য চোখে দেখবার জন্য তার কামরার দরজা খুলে রাখবার হুকুম দিলেন। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঙিনার দিকে তাকিয়ে দেখছেন। আমিনা প্রথমে তলোয়ার বেঁধে দিলো তার ভাই খালেদের কোমরে, তারপর লাজকুণ্ঠিতভাবে আব্দুল্লাহর কোমরে। নয়ীম উঠে কামরার বাইরে যেতে চাইলেন, কিন্তু দুতিন কদম গিয়েই মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ ও খালেদ তাঁকে তুলবার জন্য ছুটে এলেন। কিন্তু তাদের আসার আগেই নয়ীম উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ‘আমি বিলকুল ঠিকই আছি। একটু পানি দাও।
আমিনা পানির পিয়ালা এনে দিলো। নয়ীম পানি পান করে আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন।
বেটা, তোমরা ঘোড়া ছুটিয়ে যাবে, তাই আমি দেখবো এখানে দাঁড়িয়ে। তোমরা জলদী সওয়ার হও।’
খালেদ ও আব্দুল্লাহ্ সওয়ার হয়ে বাড়ির বাইরে বেরুলেন। নয়ীমও ধীরে ধীরে পা ফেলে গেলেন বাড়ির বাইরে।
নার্গিস বললেন, ‘আপনি আরাম করুন। বিছানা ছেড়ে ওঠা আপনার ঠিক নয়।
নয়ীম তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, নার্গিস! আমি ভালো আছি। তুমি চিন্তা করো না।’
বাগিচার বাইরে গিয়ে খালেদ ও আব্দুল্লাহ খোদা হাফি’ বলে ঘোড়া ছুটালেন দ্রুতগতিতে। নয়ীম দূর পর্যন্ত তাদেরকে দেখবার জন্য চড়লেন বালুর ঢিবির উপর। নার্গিস ও উযরা তাঁকে মানা করলেন, কিন্তু নয়ীম পরোয়া করলেন না। তাই তাঁরাও ঢিবির উপর চড়লেন নয়ীমের সাথে। দুই তরুণ মুজাহিদ ঘোড়া ছুটিয়ে যথক্ষণ না মিলিয়ে গেলেন বহু দূর দিগন্তে, ততোক্ষণ নয়ীম সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁরা অদৃশ্য হয়ে গেলে তিনি যমিনের উপর বসে সিজদায় মাথা নত করলেন।
নয়ীমকে দীর্ঘ সময় সেজদায় পড়ে থাকতে দেখে উ ঘাবড়ে গিয়ে কাছে এসে ভাই বলে তাঁকে ডাকলেন ধরা গলায়, কিন্তু নয়ীম মাথা তুললেন না। নার্গিস ভয় পেয়ে নয়ীমের বায়ু ধরে নাড়া দিলেন। নয়ীমের দেহ নড়ছে না। নার্গিস তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে অলক্ষ্যে বলে উঠলেন, ‘আমার স্বামি! স্বামি আমার!
‘উযরা তার নাড়ির উপর হাত রেখে আমিনাকে বললেন, বেটি, উনি বেঁহুশ হয়ে পড়েছেন। যাও জলদী পানি নিয়ে এসো।’
আমিনা ছুটে গিয়ে ঘরে থেকে পিয়ালা ভরে পানি আনলো। উযরা নয়ীমের মুখে পানির ঝাঁপটা দিলেন। নয়ীমের হুঁশ হলে তিনি.চোখ খুলে পিয়ালা মুখে, নিলেন।
‘উযরা বললেন, ‘হোসেন, যাও, বস্তি থেকে কয়েকটি লোক ডেকে আন। তারা ওঁকে ধরে ঘরে নিয়ে যাবে।’
নয়ীম বললেন, ‘না, না, থাম। আমি নিজেই যেতে পারবো।’
নয়ীম উঠতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। বুকে হাত রেখে তিনি আবার শুয়ে পড়লেন।
‘আমার স্বামি! আমার মালিক!!’ নার্গিস চোখ মুছতে মুছতে বললেন। নয়ীম নার্গিসের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে, উযরা, আমিনা ও হোসেনের দিকে তাকালেন। সবারই চোখে পানি ছলছল করছে। ক্ষীণস্বরে তিনি বললেন, ‘হোসেন-বেটা, তোমার চোখে আঁসু দেখে বড়োই তীফ হচ্ছে আমার। মুজাহিদের বেটা যমিনের উপর চোখের আঁসু ফেলে না, ফেলে বুকের রক্ত। নার্গিস, তুমিও সংযত হও। উা, দোয়া করো আমার জন্য।’
যিন্দেগীর তরুণী মৃত্যুর তুফানের আঘাতে টম করছে। নয়ীম কলেমায়ে শাহযাদাত পড়বার পর অস্পষ্ট আওয়াযে কয়েকটি কথা বলে নীরব হয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য।