ইয়াসমিন!
‘স্বামী!
যে অশ্রুধারা ইয়াসমিন তার দীলের গভীর তলায় গোপন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো, অলক্ষ্যে তা এবার বাঁধমুক্ত হলো। দুজনেরই দীল তখন কাঁপছে, কিন্তু দীলের সে কাঁপন অতি মৃদু এবং ধীরে ধীরে তা যেনো মৃদুতর হয়ে আসছে। সারা সৃষ্টি যেনো এক অপূর্ব সুর-ঝংকারে মুখর। কিন্তু সে সুরের তান যেনো আগের চাইতে আরো গম্ভীর হয়ে আসছে। মুজাহিদের পরীক্ষার মুহূর্ত সমাগত। প্রেমের অনুভূতি আর কর্তব্যের অনুভূতির সংঘাত। সৃষ্টির সুর-মুৰ্ছনা মৃদুতর হয়ে এসেছে আর সেই মুহূর্তে যহীরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমিন শুধু ইয়াসমিন। সৌন্দর্য ও মনোহারিত্বের প্রতিমূর্তি। বর্ণগন্ধময় দুনিয়া! আর অপর দিকে? দীল ও আত্মার হুকুম। সেই গভীর সুরের জগতে আবার লাগে কাঁপন। মুদৃ সুরঝংকার আবার তীব্রতর হয়ে ওঠে। যহীর তাঁর কম্পিত পা দু’খানি আবার সামলে নেন। হাতের চাপ ঢিলা হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত দুজন আলাদা হয়ে দাঁড়ান সামনাসামনি।
ইয়াসমিন, এ যে কর্তব্যের ডাক। যহীর বললেন।
স্বামী, আমি তা জানি,। ইয়াসমিন জওয়াব দেয়।
‘আমার ফিরে আসা পর্যন্ত হানিফা তোমার খেয়াল রাখবে। তুমি ঘাবড়াবে না তো?
না, আপনি আশ্বস্ত হোন।
ইয়াসমিন, একবার হেসে দেখাও তো আমায়। এমনি মুহূর্তে বাহাদুর নারী কখনো চোখের পানি ফেলে না। তুমি এক মুজাহিদের বিবি’।
স্বামীর হুকুম তামিল করতে গিয়ে ইয়াসমিন হাসলো, কিন্তু সে হাসির সাথে সাথেই দু’টি বড় বড় অশ্রুবিন্দু তার চোখে থেকে গড়িয়ে পড়লো।
স্বামী, আমায় মাফ করুন।’ অশ্রু মুছে ফেলতে ফেলতে সে বললো, আহা! আমিও যদি এক আরব মায়ের কোলে পালিত হতাম!’ কথাটি শেষ করতে করতে সে এক গভীর বেদনদার আবেশে চোখ মুদলো আর একবার সে তার বাহু প্রসারিত করলো যহীরের দিকে। কিন্ত চোখ খুলে সে দেখলো, তার প্রিয়তম স্বামী আর নেই সেখানে।
ইয়াসমিন পালিত হয়েছিলো এক ইরানী মায়ের কোলে। তাই আরব-নারীর তুলনায় নারীসুলভ কোমলতা ও সূক্ষ অনুভূতি ছিলো তার ভিতরে বেশি। যহীর বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর তার বে-কারারী সীমা ছাড়িয়ে গেলো। তার চোখে বদলে গেলো দুনিয়ার রূপ। পুরানো পরিচারিকা হানিফা সব রকম চেষ্টা করে তার দীলকে আশ্বস্ত করতে চাইতো। কয়েকমাস পরে ইয়াসমিন বুঝলো, তার দেহের মধ্যে প্রতিপালিত হচ্ছে আর একটি নতুন মানবদেহ। এরই মধ্যে স্বামীর কাছ থেকে কয়েকখানি চিঠিও এসেছে তার কাছে।
হানিফা যহীরকে লিখে জানিয়েছেঃ “তোমার ঘরে এক ছোট্টে মেহমান আসবে শিগগীরই। ফিরে এসে দেখবে, ঘরের রওনক বেড়ে গেছে আনেকখানি। হাঁ, তোমার বিবি দিন কাটাচ্ছে কঠিন মর্মপীড়ার মধ্যে দিয়ে। ছুটি পেলে কয়েকদিনের জন্যে এসে তাকে সান্তনা দিয়ে যেয়ো।
আটমাস পর যহীর লিখলেন, দু’মাসের মধ্যে তিনি ফিরে আসবেন ঘরে। এই চিঠি পেয়ে প্রতীক্ষার জালা ইয়াসমিনের কাছে আগের চাইতেও বেশী অসহনীয় হয়ে উঠলো। দিনের প্রশান্তি আর রাতের নিদ্রা তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে শরীরও পড়লো ভেঙ্গে।
যহীরের ইনতেযারের সাথে সাথে ছোট্ট মেহমানের ইনত্যেরও বেড়ে চললো। শেষ পর্যন্ত ইনতেযারের মেয়াদ শেষ হলো এবং যহীরের ঘরের নির্বাক আবহওয়া একটি শিশুর কলশব্দে কিছুটা প্রাণময় হয়ে উঠলো। এই শিশুই উযরা।
উযরার পয়দায়েশের পর ইয়াসমিনের হুঁশ হলে চোখ খুলেই সে প্রথম প্রশ্ন করলো, উনি এলেন না?
উনিও এসে যাবেন।’ হানিফা সান্তনার ভংগীতে বললো।
‘এতো দেরী হলো? খোদা জানেন, কবে আসবেন তিনি।
*
উযরা পয়দা হবার পর তিন হফতা কেটে গেছে। ইয়াসমিনের স্বাস্থ্য দিনের পর দিন ভেঙ্গে পড়ছে। রাত্রে ঘুমের মধ্যে বারংবার সে যহীরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উঠে বসে। কখনো আবার ঘুমের মধ্যে চলতে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।
হানিফা ঘুমে, জাগরণে, উঠতে, বসতে তাকে সান্তনা দেয়। এছাড়া আর সে কি-ই-বা করতে পারে?
একদিন দুপুর বেলা ইয়াসমিন শুয়ে রয়েছে তার বিছানার উপর। হানিফা তার কাছে এক কুরসীতে বসে উযরাকে আদর করছে। এমন সময় কে যেনো ঘা দিলো দরজার উপর।
‘কে যেনো ডাকছে। ইয়াসমিন নেহায়েত কমোর আওয়াযে বললো।
হানিফা উযরাকে ইয়াসমিনের পাশে শুইয়ে রেখে উঠলো এবং বাইরে গিয়ে দরযা খুলে দিলো। সামনে সাঈদ দাঁড়ানো।
হানিফা অধীর ও পেরেশান হয়ে বললো, সাঈদ, তুমি এসেছো? যহীর কোথায়? সে এলোনা?’
ইয়াসমিনের কামরা যদিও বাইরের দূর থেকে বেশ দূরে, তথাপি হানিফার কথাগুলো তার কানে পৌঁছে গেছে। সাঈদের নাম শুনেই তার কলিজা ধড়ফড় করে উঠলো এবং এক লহমার মধ্যে হাজারো দুর্ভাবনা জাগলো তার মনে। কম্পিত বুকখানি হাতে চেপে ধরে সে উঠলো বিছানা থেকে। কাঁপতে কাঁপতে কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো হানিফার কাছ থেকে দু’তিন কদম পিছনে। হানিফা দরযায় দাঁড়িয়ে তখনো চেয়ে আছে সাঈদের মুখের পানে, তাই ইয়াসমিনের আগমন সে লক্ষ্য করতে পারেনি। সাঈদ দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরার বাইরে। তাই দেখতে পাননি ইয়াসমিনকে।
হানিফা আর একবার প্রশ্ন করলো, কিন্তু সাঈদ নীরব।
সাঈদ! হানিফা বললো, জওয়াব দিচ্ছো না কেন? তবে কি সে–?
সাঈদ গর্দান তুলে হানিফার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু কথা ফুটছে না তার মুখে। তার বড় বড় খুবসুরত চোখ দুটি অশ্রুভারাক্রান্ত। তার মুখের উপর ফুটে উঠেছে অসাধরণ দুঃখ ও বিষাদের ছাপ।