নয়ীমের বস্তি আট ক্রোশ দূরে। ঘোড়াটি কোথায় চলে গেছে। পায়ে নেই চলবার তাকৎ। পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে এসেছে। তার মনে খেয়াল এলো, ভোর হবার আগে এ বালুর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোন নিরাপদ জায়গায় না পৌঁছলে দিনের প্রখর রৌদ্রে তাঁকে মরতে হবে ধুকে ধুকে।
নক্ষত্রের স্তিমিত আলোয় পথ দেখে নিয়ে তিনি চলতে লাগলেন পায়ে হেঁটে। এক ক্রোশ গিয়ে তার পা আর চলে না। হতাশ হয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন বালুর উপর। মনযিলের এতো কাছে এসে হিম্মৎ হারানো মুজাহিদের সংকল্প ও সহিষ্ণুতার খেলাফ। তিনি আর একবার কাঁপতে কাঁপতে উঠে পা বাড়ালেন মনজিলে মকসুদরে দিকে। বালুর মধ্যে পা বসে যায়। চলতে চলতে তিনবার তিনি পড়ে গেলেন। আবার সংকল্প দৃঢ় করে উঠে তিনি এগিয়ে চলবার চেষ্ট করলেন। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে আর কমযোরী দরুন তাঁর চোখে ছেয়ে আসছে অন্ধকার। মাথা ঘুরছে ভীষণভাবে। বস্তি এখনো চারক্রোশ দূরে। তিনি জানেন, বস্তির দিকে প্রবহমান নদীটি এখান থেকে কাছে। তিনি কাঁপতে কাঁপতে একবার পড়ে আবার উঠে আরো এক ক্রোশ গেলে তার নযরে পড়লো তার বহু পরিচিত নদীটি।
নদীর পানি ঝড়ের ধুলোবালুতে ময়লা হয়ে গেছে। নদীর পানিতে ভাসছে বেশুমার ডালপালা। নয়ীম সাধ মিটিয়ে পান করলেন নদীর পানি। নদীর কিনারে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে তাঁর দীলে এসেছে কিছুটা শান্তি। তাই তিনি আবার শুরু করলেন পথ চলা।
নদী পার হলে তাঁর নযরে পড়লো বস্তির পাশের বাগ-বাগিচা। ক্লান্তি ও দৈহিক কমযোরীর অনুভূতি কমে এলো কনেক খানি। প্রতি পদক্ষেপে বেড়ে যাচ্ছে তাঁর চলার বেগ। খানিক্ষণ পরেই তিনি পার হতে লাগলেন বালুর টিবি-যেখানে ছেলেবেলায় তিনি খেলা করতেন উযরাকে নিয়ে, গড়ে তুলতেন ছোট ছোট বালুর ঘর। তারপর উঁচু খেজুর গাছগুলোর ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। কম্পিত বুক চেপে দরে কিছুক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন দরযায়। তারপর সাহস করে দরযায় করাঘাত করলেন। ঘরের বাসিন্দারা একে অন্যকে জাগাতে লাগলেন। এক যুবতী এসে দা খুললো। নয়ীম হয়রান হয়ে যুবতীর দিকে, তাকালেন। এযে হুবহু উযরারই চেহারা। নয়ীমকে দেখে মেয়েটি ফিরে গেলো ঘরের ভিতরে। একটু পরেই তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ ও নার্গিস এসে হাযির হলেন অভ্যর্থনা জানাতে। আব্দুল্লাহ ও নার্গিসের পিছনে কম্পিত পদে এসে দাঁড়ালেন উযরা।
চাঁদের রোশনীতে নয়ীম দেখলেন, সৃষ্টির সৌন্দর্য-রাণীর যৌবনের দীপ্তিতে ভাটা এলেও তার মুখের যে মোহময় আকর্ষণ, আজো তা অব্যাহত রয়েছে।
‘বোন!’ নয়ীম বেদনার্ত আওয়াজে ডাকলেন।
‘ভাই! উযরা অশ্রুসজল চোখে জওয়াব দিলেন।
নার্গিস এগিয়ে ভালো করে তাকালেন নয়ীমের দিকে। তার কামিযে রক্তের দাগ দেখে ঘাবড়ে বললেন “আপনি যখমী!
যখমী! উযরা সন্ত্রস্ত মুখে বললেন।
এতক্ষণ যে দৃঢ় সংকল্প তার দৈহিক শক্তিকে অটুট রেখেছিলো, তা মুহূর্তে ভেঙে পড়লো।
তিনি বললেন, আব্দুল্লাহ-বেটা, আমায় ধরো।’
আব্দুল্লাহ তাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
ভোর বেলায় নয়ীম বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। নার্গিস, উযরা, আব্দুল্লাহ, বিন নয়ীম, হোসেন বিন নয়ীম, উযরার ছোট ছেলে খালেদ ও মেয়ে আমিনা তাঁর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে। নয়ীম চোখ খুলে সবার দিকে তাকালেন। ইশারায় খালেদ ও আমিনাকে ডেকে তিনি কাছে বসালেন।
‘বেটা, তোমার নাম কি?
‘খালেদ।
“আর তোমার? মেয়েটিকে লক্ষ্য করে নয়ীম প্রশ্ন করলেন।
‘আমিনা। সে জওয়াব দিলো। খালেদের বয়স সতেরো বছরের কাছাকাছি। মনে হয়। আমিনার চেহারা দেখে বয়স চৌদ্দ পনেরো অনুমান করা যায়।
নয়ীম খালেদকে লক্ষ্য করে বললেন, বেটা, আমায় কোরআন পাক পড়ে শোনাও।’
খালেদ শিরীণ আওয়াযে সুরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত শুরু করলেন।
পরদিন ফেটে যাওয়া যখম আরো বেশী কষ্টদায়ক হয়ে উঠলো। নয়ীমের ভীষণ জ্বর দেখা দিলো। সিনার যখম থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরছে। রক্ত কমে যাওয়ায় তিনি মুছা যাচ্ছেন বারংবার। এমনি করে এক হর্তা কেটে গেলো। আব্দুল্লাহ, বসরা থেকে এক হাকীম নিয়ে এলেন। তিনি প্রলেপ পট্টি বেঁধে দিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু তাতে কোনো ফায়দা হলো না।
নয়ীম একদিন খালেদকে প্রশ্ন করলেন, “বেটা, তুমি এখনো জিহাদে যাওনি?’
চাচাজান, আমি ছুটি নিয়ে এসেছি।’ খালেদ জওয়াব দিলেন, ‘আমার চলে যাবার কথা ছিলো কিন্তু…….।
তুমি চলে যাবে তো গেলে না কেন?
‘চাচাজান, আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে…..।
‘বেটা, জিহাদের জন্য মুসলমানকে ছেড়ে যেতে হয় দুনিয়ার সব চাইতে প্রিয় বস্তুকে। আমার জন্য চিন্তা করো না তুমি। তোমার ফরয তুমি পূর্ণ করো। তোমার ওয়ালেদা কি তোমায় শেখাননি যে, মুসলমানের সব চাইতে বড়ো ফরয হচ্ছে জিহাদ।
‘চাচাজান, আম্মিজান আমাদেরকে ছেলেবেলা থেকেই শিখিয়েছেন এ সবক। আমি একটা দিন শুধু আপনার শুশ্রূষার জন্য থেকে গেছি। আমার ভয় ছিলো, যদি আমি আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে যাই, তাতে আপনি হয়তো রাগ করবেন।
‘আমার মাওলার খুশীতেই আমারও খুশী। যাও, আব্দুল্লাহকে ডেকে নিয়ে এসো।
খালেদ আর এক কামরা থেকে আব্দুল্লাহকে ডেকে আনলেন। নয়ীম প্রশ্ন করলেন, ‘বেটা তোমার ছুটি এখনো শেষ হয়নি?
আব্বাজান, পাঁচ দিন আগে আমার ছুটি শেষ হয়ে গেছে।’