তিনি হফতা পর নয়ীমের অবস্থা কিছুটা ভালো হলে তিনি ঘরে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, কিন্তু হাকীম বললেন, যখম এখনো সারেনি। সফরে ওগুলো ফেটে যাবার আশংকা রয়েছে। তাই আপনাকে কম-সে-কম আরো এক মাস এলাজ করাতে হবে। আমার ভয় হচ্ছে, কোন বিষাক্ত হাতিয়ার থেকে এসব আঘাত লেগেছে, হয়তো রক্ত বিষাক্ত হয়ে আবার খারাপ কিছু হতে পার।’
*
নয়ীম আর এক হফতা দেরী করলেন, কিন্তু ঘরে ফিরে যাবার জন্য তাঁর বেকারারী বেড়ে চললো প্রতি মুহূর্তে। বিচানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করে তিনি কাটিয়ে দেন সারা রাত। মন চায়, আর একবার তিনি উড়ে যান তার দুনিয়ার বেহেশতে।
তাঁর বিশ্বাস, নার্গিস পৌঁছে গেছেন সেখানে। উযরার সাথে বালুর টিবির উপর দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন তাঁর পথ চেয়ে।
আরো বিশ দিন চলে গেলো। যে যখম কতকটা সেরে এসেছিলো, তা আবার খারাপ হতে লাগলো। আর হালকা হালকা জ্বর হতে লাগলো। হাকীম তাঁকে বললেন যে, এসব বিষাক্ত হাতিয়ারের যখমের ফল। তার শিরা-উপশিরায় বিষক্রিয়া হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন সেখানে থেকে এলাজ করাতে হবে।
একদিন মধ্যরাত্রের কাছাকাছি সময়ে বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছেন, ঘরে ফিরে তিনি উযরাকে কি অবস্থায় দেখবেন। সময় তাঁর নিষ্পাপ মুখে কতোটা পরিবর্তন এনেছে। তার বিষাদক্লিষ্ট রূপ দেখে কি ভাবের উদয় হবে তার মনে। তার মানে আরো খেয়াল জাগে, হয়তো এখনো তার ঘরে ফিরে যাওয়া কুদরতের মনযুর নয়। তিনি আগেও কত বার যখমী হয়েছেন। কিন্তু এবারকার যখমের অবস্থা অন্য রকম। তিনি মনে মনে বলেন, এই যখমের ফলেই হয়তো আমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বো, কিন্তু নার্গিস ও উযরার কাছে কত কথা আছে বলবার, নিজের ছেলে ও ভাতিজাদেরকে কত উপদেশ দেওয়া দরকার। মৃত্যুর ভয় নেই আমার। মৃত্যুকে নিয়ে তো হামেশা আমি খেলছি, কিন্তু এখানে শুয়ে শুয়ে মওতের ইনতেযার আমি করবো না। উষরা আমায় ঘরে ফিরে যাবার পয়গাম পঠিয়েছে।…..সেই ‘উযরা যাঁর মামুলী ইচ্ছার জন্য আমি জীবন বাজি রাখা সহজ মনে করেছি। তাছড়া নার্গিসের অবস্থাই বা কি হবে? আমি অবশ্যি চলে যাবো কেউ আমায় ফিরাতে পাবে না।’
.
বলতে বলতে নয়ীম বিছানা উঠে বসলেন। মুজাহিদের দৃঢ় সংকল্প শাররিক কমঘোরীর উপর হলো জয়ী। মানসিক প্রেরণার বলে তিনি উঠে টহল দিতে লাগলেন কামরার মধ্যে। তিনি যখমী, তা তার মনে নেই। তার শাররিক অবস্থা দীর্ঘ সফরের উপযোগী নয়, তা তিনি ভুলে গেছেন বিলকুল। তখন তার কল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু নার্গিস, উযরা, আব্দুল্লাহর ছোট বাচ্চা আর বস্তির সুদৃশ্য বাগ-বাগিচার রূপ। ‘আমি নিশ্চয়ই চলে যাবো এই হলো তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত।
তিনি কামরার ভিতর টহল দিতে দিতে আচানক থেমে গেলেন। মেযবানের নওকরকে তিনি আওয়ায দিলেন। নওকর ছুটে এসে কামরায় ঢুকে নয়ীমকে শুয়ে থেকে পায়চারী করতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো।
হাকীম সাহেবের হুকুম, আপনি চলা-ফেরা করবেন না।’ সে বললো “তুমি আমার ঘোড়া তৈরী করে দাও।’
‘আপনি কোথায় যাবেন?
‘তুমি ঘোড়া তৈরী করোগে।
‘কিন্তু এখন?
‘এখখুনি। নয়ীম কঠোর স্বরে বরলেন।
‘রাতের বেলা আপনি কোথায় যাবেন?
যা তোমায় বলেছি তাই করো। কোনো বাজে প্রশে জওয়াব নেই আমার কাছে।
নওকর ঘাবড়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো।
নয়ীম আবার বিছানার উপর বসে ভাবনার দুনিয়ায় হারিয়ে ফেললেন আপনাকে। খানিক্ষণ পর নওকর ফিরে এসে বললো ঘোড়া তৈরী, কিন্তু……।
নয়ীম তার কথার মাঝখানে জওয়াব দিলেন, তুমি কি করতে চাও, তা আমি জানি। আমার একটা করুরী কাজ রয়েছে। তোমার মালিককে বলবে, তাঁর এযাবত হাসিল করবার জন্য এত রাত্রে তাকে জাগানো আমি ঠিক মনে করিনি।’
ভোর হবার আগেই নয়ীম, কায়রোয়ান থেকে দুই মনযিল আগে চলে গেছেন। এতটা পথ তিনি বেশ হুঁশিয়ার হয়ে চলেছেন। ঘোড়া তিনি জোরে হাঁকান নি। এক এক মনযিলের পর খানিকটা বিশ্রাম করেছেন। ফুসতাতে গিয়ে তিনি দুদিন সেখানে থাকলেন। এখানকার শাসনকর্তা নয়ীমকে তার কাছে থাকতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু নয়ীম যখন কিছুতেই রাযী হলেন না, তখন তিনি পথের সব চৌকিকে জানিয়ে দিলেন তাঁর আগমন-সংবাদ। তাঁর সফরে যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি হুকুম জারি করলেন।
নয়ীম যতোই এগিয়ে যান মনযিলে মুকসুদের দিকে, ততোই ভালো বোধ করেন তাঁর শীরের অবস্থা। কয়েকদিন পর তিনি এক মরু-প্রান্তর অতিক্রম করে চলেছেন। কয়েক ক্রোশ পরেই তাঁর বস্তি। প্রতি পদক্ষেপে তার মনে জাগে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা। আনন্দ-সাগরে ভেসে চলে তার মন। আচানক ধুলি-রাশি দেখা গেলো। পূর্ব-দিগন্তে খানিক্ষণ পর অন্ধাকার দুলিঝড় ছেয়ে ফেললো চারদিকে। চারদিক ধূলোর অন্ধকার মরুভূমির তুফানের খবর নয়ীম জানেন ভালো করে। তিনি চাইলেন মরুঝড়ের সুসীবতে পড়বার আগেই ঘরে পৌঁছতে। ঘোড়ার গতি দ্রুতত হয়ে উঠলো। প্রথম ঝাঁপটা তিনি ঘোড়া ছুটিয়েছেন পূর্ণ গতিতে। হাওয়ার তে আর চারদিকের অন্ধকার বেড়ে চলেছে। ঘোড়া ছুটানোর ফলে নয়ীমের সিনার যখম ফেটে রক্তধারা গড়িগয়ে পড়ছে। সেই অবস্থায় তিনি অতিক্রম করেছেন দুই ক্রোশ। তুফানের হামলা চলছে পূর্ণবিক্রমে, ঝলসে-ওঠা বালু ছুটে আসছে তার দিকে। ঘোড়া চলবার পথ না পেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে নয়ীম ঘোড়া থেকে নেমে ঝড়ের দিকে পিছ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঘোড়াও মালিকরেই মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নয়ীম তাঁর মুখছুটে আসা বালু থেকে বাঁচাবার জন্য মুখ-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ছেন। বাবলা কাঁটা আর ডালপালা হাওয়ার বেগে ছুটে এসে তাঁর গায়ে লেগে চলে যাচ্ছে। নয়ীম এক হাতে ঘোড়রার বাগ ধরে অপর হাতে নিজের কাপড় চোপড় থেকে কাঁটা-ডাল ছাড়াচ্ছিলেন। ঘোড়ার বাগের উপর তার হাতের চাপ ঢিলা হয়ে এসেছে। হঠাৎ বাবলার একটা শুকনো ডাল উড়ে এসে ঘোড়ার পিঠে লাগলো বেশ জোরে। ঘোড়াটা এক লাফে নয়ীমের হাত ছাড়িয়ে গেয়ে দাঁড়ালো কিছুটা দুরে। আর একটা কাঁটার ডাল এসে ঘোড়ার কানে কাঁটা ফুটিয়ে চলে গেলে ঘোড়াটা একদিকে ছুটে পালালো। নয়ীম বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন অসহায় অবস্থায়। সিনার যখম ফেটে তার কামিয রক্তধারায় প্লাবিত হয়ে গেছে আর মুহূর্তে মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে আসছে তার দেহের শক্তি। ভয়ে তিনি উঠে কাপড় ঝাড়েন, আবার বসে পড়েন। কিছুক্ষণ পর রাত্রির নিকষ কালো আবরণ আরো বাড়িয়ে তুললো ঝড়ের অন্ধকার। রাত্রি এক প্রহর কেটে যাবার পর হাওয়ার বেগ হলো শেষ। ধীরে ধীরে আসমান সাফ হলে হেসে উঠলো দীপ্তিমান সিতারারাজি।