নয়মের বেটা আব্দুল্লাহ দুশমনদের সারি ভেদ করে এগিয়ে গেলেন বহুত দুরে এবং যখমী হয়ে যখন তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক আরবী সালার তার কোমরে হাত দিয়ে তাঁকে তুলে বসালেন ঘোড়ার উপর এবং তাকে নিয়ে পৌঁছে দিলেন ময়দানের বাইরে এক নিরাপদ জায়গায়।
হিস্পানিয়া ও শামের সেনাবাহিনী প্রায় তিন-চতুর্থাংশ নিহত হলো। বাকী সিপাহীরা সরে যেতে লাগলো এক দিকে। বার্বাররা তাদেরকে পিছপা হাতে দেখে অনুসরণ করলে কয়েক মাইল। পরাজিত ফউজ আলজাযায়ের গিয়ে দম ফেললো।
স্পেনের ওয়ালীর কাছে এ পরাজয়ের খবর পৌঁছলে তিনি হিস্পানিয়া সব প্রদেশ থেকে নয়া ফউজ সংগ্রহের চেষ্টা করলেন এবং এই নয়া লশকরের নেতৃত্ব নেবার জন্য নির্বাচন করলেন নয়ীমকে। নয়ীম তাঁর বেটার চিঠিতে তার যখমী হবার ও এক আরব সালারের ত্যাগ স্বীকারের ফলে জানে বেঁচে যাবার খবর পেয়েছেন আগেই। ১২৫ হিজরীতে যখন বাবার বাহিনী তামাম উত্তর আফ্রিকায় যুলুমের তান্ডব-নত্য চালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন নয়ীম আচানক দশ হাজার সিপাহী নিয়ে অবতরণ করলেন আফ্রিকার উপকুলে। বার্বাররা তাদের আগমন সম্পর্ক ছিলো। বেখবর! নয়ীম তাদেকে বারংবার পরাজিত করে এগিয়ে চললেন পূর্ব দিকে!
ওদিকে আজাযায়ের থেকে পরাজিত সৈনিকরাও শুরু করলো অগ্রগতি। বার্বারদের দমন করা হতে লাগলো দুদিক থেকে। এক মাসের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেলো মারাকাশের বিদ্রোহের আগুন, কিন্তু আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব এলাকার কোথাও কোথাও তখনো পাওয়া যাচ্ছে এ বিপদের আভাস। খারেজী ও বার্বাররা মারাকেশ থেকে সরে গিয়ে তিউনিসকে করলো তাদের কর্মকেন্দ্র। নয়ীম তখন মারাকেশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত। তাই তিনি তিউনিসের দিকে যেতে পারলেন না। তিনি ফউজের বাছাই করা অফিসারদের নিজের খিমায় একত্র করে এক তেজোব্যঞ্জক বক্তৃতা করে বললেন,
তিউনিসের উপর হামলা করবার জন্য একজন জীবন পণকারী সালারের প্রয়োজন। আপনাদের মধ্যে কে আছেন এ খেদমতের যিম্মা নিতে তৈরী?’
নয়মের কথা শেষ না হতেই তিনজন মুজাহিদ উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর পুরানো দোস্ত ইউসুফ, দ্বিতীয় তাঁর নওজোয়ান বেটা আব্দুল্লাহ, আর তৃতীয় নওজোয়ানের চেহারা-আকৃতি আব্দুল্লাহর সাথে অনেকটা মেলে, কিন্তু নয়ীম তাকে চেনন না।
তোমার নাম কি?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন।
আমার নাম নয়ীম। নওজোয়ান জওয়াব দিলেন।
নয়ীম বিন?
নয়ীম বিন আব্দুল্লাহ। নওজোয়ান জওয়াব দিলেন।
‘আব্দুল্লাহ? আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রহমান?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন।
‘জি হ্যাঁ।
নয়ীম এগিয়ে এসে নওজোয়ানকে বুকে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘আমায় চেনো তুমি?
“জি হ্যাঁ, আপনি আমদের সিপাহসালার।
তাছাড়া আমি আরো কিছু।’ নওজোয়ানের দিকে সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নয়ীম বললেন, “আমি তোমার চাচা। আব্দুল্লাহ, এ তোমার ভাই।
আব্বাজান! ইনিই আমর জান বাঁচিয়েছিলেন মারাকেশের লড়াইয়ের সময় ‘ভাইজান কেমন আছেন? নয়ীম প্রশ্ন করলেন।
‘দু বছর হলো, তিনি শহীদ হয়েছেন। এক খারেজী তাঁকে কতল করেছিলো।
নয়ীমের দীল ধড় ফড় করে উঠলো। খানিকক্ষণ তিনি নীরব রইলেন। হাত তুলে তিনি মাগফেরাতের জন্য দোআ করে প্রশ্ন করলেন, তোমার ওয়ালিদা?’
তিনি ভালো আছেন।’
‘তোমার ভাই কটি?
‘এক ভাই আর একটি ছোট বোন?
নয়ীম বাকি অফিসারদের বিদায় করে তাদের যাবার পর নিজের কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নয়ীম বিন আব্দুল্লাহকে দিতে দিতে বললেন, তুমি এ আমানতের হকদার, আর তুমি এখানেই থাক। আমি নিজেই যাব তিউনিসের দিকে।
‘চাচাজান, আমায় কেন পাঠাচ্ছেন না?’
‘বেটা, তুমি জোয়ান। তোমরা দুনিয়ার প্রয়োজনে আসবে। আজ থেকে তুমি এখানকার সেনাবাহিনীর সিপাহসালার।……..আব্দুল্লাহ ইনি তোমার বড় ভাই। এঁর হুকুম দীল-জান দিয়ে মেনে নেবে।’
নয়ীম বিন আব্দুল্লাহ বললেন, ‘চাচাজান, আপনার কাছে কিছু বলবার আছে আমার।’
বলো বেটা।
‘আপনি ঘরে যাবেন না?
‘বেটা, তিউনিস অভিযানের পর আমি শিগগীরই যাবো।
চাচাজান, আপনি অবশ্যি যাবেন। আম্মিজান প্রায়ই আপনাকে মনে করেন। আমার ছোট বোন আর ভাইও আপনার কথা বলে বারবার।
তিনি কি জানেন যে আমি যিন্দাহ রয়েছি।
আম্মিজান বিশ্বাস ছিলো যে, আপনি যিন্দহ রয়েছেন। তিনি আমায় মারাকেশ অভিযানের পর স্পেনে গিয়ে আপনাকে তালাশ করবার তাকিদ করেছেন এবং চাচীজানকে নিয়ে আপনাকে ঘরে তশরীফ নিতে বলেছেন।’
আমি খুব শিগগীরই ওখানে পৌঁছে যাবো। আব্দুল্লাহ তুমি আলুস চলে যাও। ওখান থেকে তোমার মাকে নিয়ে খুব শিগগীরই ঘরে পৌঁছে যাবে। তিউনিস থেকে কর্তব্য শেষ করে আমি আসবো। আমি আন্দালুসের ওয়ালীকে চিঠি লিখছি। তিনি তোমাদের সাগর-পথে সফরের ইনতেযাম করে দেবেন।
*
তিউনিসে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে নয়ীমকে বহুবিধ অপ্রত্যাশিত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলো। বারবার বিদ্রোহীরা এক জায়গায় পরাজয় স্বীকার করে অপর জায়গায় গিয়ে লুটপাট করতে লাগলো। কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের পর তিনি তিউনিসের বিদ্রোহ দমন করলেন। তিউনিস থেকে বিদ্রোহী দল পিছপা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো পূর্ব দিকে। নয়ীম বিদ্রোহীদের দমন করবার সিন্ধান্ত স্থির করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। তিউনিস ও কায়রোয়ানদের মাঝখানে বিদ্রোহীরা কয়েকবার মোকাবিলা করলো নয়ীমের ফউজের সাথে কিন্তু তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হলো। কায়রোয়ানের কাছে যে শেষ লড়াই হলো, তাতে নয়ীম যখমী হলেন গুরুতররূপে। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নেয়া হলো কায়রোয়ানে। সেখানকার শাসনকর্তা তাকে নিজের কাছে রেখে তার এলাজ করার জন্য ডাকলেন এক অভিজ্ঞ চিকিৎসককে। বহুক্ষণ পর নয়ীমের হুঁশ ফিরে এলো, কিন্তু বহু পরিমাণ রক্ত ক্ষয় হবার ফলে তিনি এতটা কমজোর হয়ে পড়লেন যে, তিনি দিনের মধ্যে কয়েকবার মছা যেতে লাগলেন। এক হফতা কাল নয়ীম জীবন-মৃত্যুর সংঘাতের ভিতরে বিছানায় পড়ে রইলেন। তাঁর অবস্থা দেখে কায়রোয়ানদের ওয়ালী ফুসতাত থেকে এক মশহুর হাকীমকে ডেকে পাঠালেন। হাকীম নয়ীমের যখম পরীক্ষা করে তাঁকে আশ্বাস দিলেন, কিন্তু এও বললেন যে, তাঁকে দীর্ঘকাল শুয়ে শুয়ে কাটাতে হবে।